ইমাম আ'যমের মতে মুখের স্বীকৃতি ও অন্তরের বিশ্বাস-এ উভয় মিলে ঈমান । শুধু মুখের স্বীকৃতিই যদি ঈমান হতো, তাহলে সব মুনাফিক মু'মিন হতো । কেননা তারা তো মুখে স্বীকার করে। আর শুধু অন্তরের প্রত্যয়ই যদি ঈমান হতো তাহলে সব আহলে কিতাব মু'মিন হতো । কেননা তারা রাসূলুল্লাহকে তাদের কিতাবে বর্ণিত কথায় প্রকৃত রাসূল বলে জানতো। মুনাফিকদের সম্পর্কে আল-কুরআনের ঘোষণা : যখন মুনাফিকরা আপনার কাছে আসে তখন তারা বলে, “আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল। আল্লাহ্ জানেন যে, নিশ্চয়ই আপনি তাঁর রাসূল। আর আল্লাহ্ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, নিশ্চয়ই মুনাফিকরা তো মিথ্যাবাদী।” (৬৩ : ১)
আহলি কিতাব সম্পর্কে আল-কুরআনের ঘোষণা : যাদের আমি কিতাব দিয়েছি তারা মুহাম্মদকে সেরূপ জানে, যেরূপ তারা জানে নিজেদের সন্তানদের। আর তাদের একদল তো জেনেশুনে সত্য গোপন করে থাকে। (২ঃ ১৪৬)
আল্লাহ্ তা'আলা মুনাফিকদের মৌখিক সাক্ষ্যকে তাদের অন্তরের বিশ্বাসের বিপরীত হওয়ায় মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাই তারা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে এসে ইসলামে বিশ্বাসের কথা বললেও তাদের কথা অনুযায়ী তাদের মু'মিন হিসাবে স্বীকার করা হয়নি। বরং তাদের নাম দেয়া হয়েছে ‘মুনাফিক'। অতএব শুধু মৌখিক স্বীকৃতি ‘ঈমান’ নয়। মুনাফিকদের মৌখিক স্বীকৃতি ছিল কিন্তু ছিল না অন্তরের বিশ্বাস । অপরপক্ষে আহলি কিতাব তো ভাল করেই জানতো যে, মুহাম্মদ (সা) আল্লাহর রাসূল। তাদের এ জানা ঈমানের জন্য যথেষ্ট ছিল না। তাদের মধ্যে কতক তাঁকে আরবদের নবী মনে করতো। এতেও তারা মু'মিন হয়নি। কারণ তারা যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁকে সারা জাহানের জন্য প্রেরিত আল্লাহর রাসূল বলে বিশ্বাস না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের মু'মিন বলা যাবে না। ঈমানের জন্য তাই ইকরার ও তাসদীক উভয়ই জরুরী। এ দু'য়ের সমন্বয় হলেই ঈমান পাওয়া যাবে, অন্যথায় নয় ৷
তাসদীক বা অন্তরের প্রত্যয় ঈমানের রুকন বা মূল ভিত। আর ইকরার বা মৌখিক স্বীকৃতি ঈমানের শর্ত। কেননা অন্তরের ব্যাখ্যাদাতা হলো মুখ। মুখের দ্বারাই প্রকাশ করা হয় অন্তরের ভাব ও বিশ্বাস। তাই তাসদীক (অন্তরের প্রত্যয়) ঈমানের জন্য থাকতে হবে। এর অবিদ্যমানতা ঈমানের অবিদ্যমানতার নামান্তর। কিন্তু কোন বিশেষ অবস্থায় ইকরার বা মৌখিক স্বীকৃতি না পাওয়া গেলে ঈমান নেই বলা যাবে না । যেমন সূরা নাহলের ১০৬ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে : “কেউ কুফরী করলে আল্লাহ্ সঙ্গে তার ঈমানে পর এবং কুফরীর জন্য হৃদয় উন্মুক্ত রাখলে তার ওপর আপতিত হবে আল্লাহর ক্রোধ এবং তার জন্য রয়েছে মহাশাস্তি ; তবে তার জন্য নয়, যাকে কুফরীর জন্য বাধ্য করা হয় কিন্তু তার চিত্ত ঈমানে দৃঢ়, অবিচলিত।” যখন প্রকাশ করা সম্ভব তখন লুক্কায়িত-লালিত বিশ্বাস প্রকাশ না করলে কুফরী হবে। কিন্তু যখন প্রকাশ করলে জীবনের ভয় রয়েছে তখন তা গোপন করা বৈধ, এমনকি কুফরীর জন্য বাধ্য করলে সে কাফির হবে না। তাই ইমাম আ'যমের মতে ইজমালী ঈমান হলো, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ওপর ও তিনি যা আল্লাহর তরফ থেকে নিয়ে এসেছেন তাতে বিশ্বাস করা। এটুকু করলেই একজন মোটামুটি ভাবে ঈমানের অন্তর্ভুক্ত হবে। তবে বিস্তারিত ভাবে প্রশ্ন করলে কেউ যদি ঈমানের জন্য প্রয়োজন এমন কোন বিষয় প্রত্যাখ্যান করে বা না মানে, তা হলে তার ঈমান নেই, সে কাফির। যেমন মদ ও সুদ হারাম হওয়া, নামায ফরয হওয়া ইত্যাদি। তবে ইজতিহাদী ব্যাপারের কোন কিছু কেউ অস্বীকার করলে কুফরী হবে না। ইমাম আবূ মানসূর মাতুরীদীর মতে, ঈমান হলো অন্তরের বিশ্বাস, আর দুনিয়ায় আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপনের জন্য ইকরার হলো ঈমানের শর্ত। কেননা তাসদীক গোপন ও অদৃশ্য ব্যাপার। বিধান মোতাবেক সমাজ পরিচালনার জন্য চাই প্রকাশ্য স্বীকৃতি। মুখের স্বীকৃতির মাধ্যমে অন্তরের গোপন বিশ্বাসের প্রকাশ ঘটে। অতএব যে ব্যক্তি অন্তরে বিশ্বাস রাখলো কিন্তু মুখে প্রকাশ করলো না, সে আল্লাহর কাছে মু'মিন, কিন্তু দুনিয়ার বিধান মোতাবেক মু'মিন নয়। অপরপক্ষে, যে ব্যক্তি মুখে ইকরার করলো, কিন্তু অন্তরে বিশ্বাস করলো না, যেমন মুনাফিক, সে আল্লাহর কাছে মু'মিন নয়, কিন্তু দুনিয়ার বিধানে মু'মিন। আল কুরআনের অনেক আয়াতে এ সম্পর্কে সমর্থন রয়েছে, যেমন সূরা মুজদালা ৫৮, আয়াত ২২ ; সূরা ৪৯, আয়াত ১৪ ; সূরা ১৬, আয়াত ১০৬ ইত্যাদি এবং বুখারী, মুসলিম, আবূ দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবন মাজা প্রভৃতি হাদীস গ্রন্থে উদ্ধৃত উসামা (রা)-কে বলা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর হাদীস, যখন সে এক ব্যক্তিকে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু বলার পরও হত্যা করেছিল : তুমি কি তার হৃদয় চিরে দেখেছো যে, সে সত্যবাদী না মিথ্যাবাদী ?
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(৩০) ২৪. আখিরাতে আল্লাহ্ তা'আলা পরিদৃষ্ট হবেন | (৩২) ২৬. ঈমানে হ্রাস-বৃদ্ধি নেই |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |