প্রকৃতপক্ষে বান্দা যে সব কাজ করে, যেমন ঈমান আনা, কুফরী করা, আনুগত্য করা, অবাধ্য হওয়া, বসে থাকা, ঘুমিয়ে পড়া, উঠে দাঁড়ান, কথা বলা, ইত্যাদি সবই তার নিজস্ব উপার্জন, আর এ সবের স্রষ্টা মহান আল্লাহ্ তা'আলা । বান্দা তার নিজের ইচ্ছায় বাইরের কোন প্রভাব ছাড়াই যা চায় তাই করে। এ তার ‘কসব’ বা উপার্জন । আর এ ক্ষেত্রে আল্লাহ্ খালিক বা স্রষ্টা। ‘কসব' এমন ব্যাপার, যার কর্তা আলাদাভাবে কোন উপকরণ ছাড়া তা সংঘটিত করতে পারে না। খাল্ল্ক বা সৃষ্টি এমন ব্যাপার, যার কর্তা নিজেই কোন উপকরণ ছাড়া তা সংঘটিত করেন। যা বান্দার ইচ্ছা ছাড়া সংঘটিত হয় তা তার কসব নয়, কিন্তু তা আল্লাহর সৃষ্ট। যেমন ভীত-সন্ত্রস্ত ব্যক্তির কাঁপুনি। ক্রিয়া থেকে উৎপন্ন আনুষঙ্গিক, যেমন প্রহারের বেদনা, বান্দার কসব নয়, আল্লাহর খাল্ক বা সৃষ্টি। সূরা সাফ্ফাত ৩৭, আয়াত ৯৫-৯৬-এ বলা হয়েছে : তোমরা কি ইবাদত কর তাদের, যাদের তোমরা খোদাই করে নির্মাণ করো ? অথচ আল্লাহ্ই সৃষ্টি করেছেন তোমাদের এবং যা কিছু তোমরা তৈরি কর তাও । এখানে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ মানুষের স্রষ্টা এবং তার কাজেরও স্রষ্টা, তাই ইবাদত তো তাঁরই করতে হয়। যে সৃষ্ট, যে সৃষ্টি করতে পারে না; তার ইবাদত করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আল কুরআনে বারবার বর্ণিত হয়েছেঃ আল্লাহ্ সবকিছুর স্রষ্টা । আল্লাহ অমুখাপেক্ষী আর তোমরা সবাই মুখাপেক্ষী। আর প্রশ্ন রাখা হয়েছে : যিনি সৃষ্টি করেন, তিনি কি তার সমান, যে সৃষ্টি করতে পারে না ?
ইমাম আ'যম তাঁর 'আল অসিয়াত' গ্রন্থে বলেছেনঃ আমরা স্বীকার করি যে, বান্দা তার যাবতীয় ক্রিয়াকর্ম বিশ্বাস, স্বীকৃতি ও পরিচিতি সহ সৃষ্ট। যখন কর্তা সৃষ্ট তখন তার ক্রিয়াকর্ম অবশ্যই সৃষ্ট ।
বান্দার সব কাজ, তা ভাল হোক অথবা মন্দ হোক, আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর জ্ঞানে, তাঁর ফায়সালায় ও তাঁর নির্ধারণ অনুযায়ী সংঘটিত হয়। এবং যাবতীয় ইবাদত, তা ওয়াজিব হোক কিংবা নফল, কম হোক অথবা বেশি, আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী কায়িম হয়। যেমন আল্লাহ বলেছেন : আনুগত্য কর আল্লাহর এবং আনুগত্য কর রাসূলের। ইবাদত তাঁর মহব্বত ও ভালবাসার জন্য সংঘটিত হওয়ার অর্থ আল্লাহ্ চান তাই বান্দা করে । যেমন তিনি বলেছেন : আল্লাহ্ মুত্তাকীদের ভাল বাসেন ; আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণ লোকদের ভালবাসেন; আল্লাহ্ পবিত্রতা অবলম্বনকারীদের ভালবাসেন; ইত্যাদি। মু'মিনদের সম্বন্ধে আল্লাহ্ বলেছেনঃ
আল্লাহ্ তাঁদের প্রতি প্রসন্ন এবং তাঁরাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট ; তাঁরা আল্লাহর দল। জেনে রেখো, আল্লাহর দলই কামিয়াব হবে ।
বান্দার যাবতীয় পাপ কাজ, তা ছোট হোক কিংবা বড় হোক, সংঘটিত হয় . আল্লাহর জ্ঞান, ফয়সালা, নির্ধারণ ও ইচ্ছা অনুযায়ী, তবে তাঁর ভালবাসায় ও সন্তুষ্টিতে নয়। এসব কাজ তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী হয় না। আল্লাহ্ ইরাদা না করলে এর কোনটিই হতে পারে না। কেননা তিনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। বান্দা চায় তাই আল্লাহ্ ঘটান। এখানেই বান্দার ইখতিয়ার। যার জন্য তাকে পুরস্কৃত করা হয় ও শাস্তি দেওয়া হয় ৷ তবে আল্লাহ্ এসব পাপ কাজ পছন্দ করেন না । যেমন আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছেঃ
আল্লাহ কাফিরদের ভালবাসেন না ; আল্লাহ্ যালিমদের ভালবাসেন না। আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের জন্য কুফরী পছন্দ করেন না। (৩৯ : ৭)
শয়তান অশ্লীলতা, অন্যায় কাজ ও সীমালঙ্ঘনের প্ররোচনা দেয় আর আল্লাহ্ এসব থেকে নিষেধ করেন। তিনি নির্দেশ দেন ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়-স্বজনকে দান করার । নিষেধ হলো নির্দেশের বিপরীত। তাই কুফরী থেকে যখন আল্লাহ্ নিষেধ করেছেন, তখন তা তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী সংঘটিত হয়, একথা অকল্পনীয়। যা কিছু বিদ্যমান তা সবই আল্লাহর সৃষ্টি। এর মধ্যে বান্দা যে আমল করে তাও আল্লাহর সৃষ্টি। তবে এসবের কতকের সঙ্গে তাঁর সন্তুষ্টি ও ভালবাসার সম্পর্ক রয়েছে। আর কতকের সঙ্গে তাঁর ক্রোধ ও বিরাগ রয়েছে। আল্লাহ্ সবকিছুরই স্রষ্টা। তবে ভব্যতা ও শিষ্টতার দরুণ এরূপ বলা ঠিক নয় যে, আল্লাহ্ কুফর ও নিফাক, যুলম ও ফিসকের স্রষ্টা এবং ইচ্ছা করে এসব সৃষ্টি করেছেন। বরং বান্দা যখন তার নিজ ইচ্ছায় করতে চেয়েছে তখন তিনি তার মধ্যে করার ক্ষমতা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। 'আল অসিয়াত' গ্রন্থে ইমাম আ'যম বলেছেন যে, বান্দার কাজ তিন প্রকারঃ ফরিযা, ফযিলা ও মা'সিয়া। ফরিযার মধ্যে ফরয ও ওয়াজিব শামিল। ফরয এমন কাজ, যার জন্য ই'তিকাদ ও আ'মল প্রয়োজন। ওয়াজিব এমন কাজ, যার জন্য আ'মল প্রয়োজন। ফযিলার মধ্যে সুন্নাত, মুস্তাহাব ও নফল শামিল। মা সিয়াতের মধ্যে হারাম ও মাকরূহ শামিল । ফরিযা আল্লাহর নির্দেশে, তাঁর ইচ্ছায়, তাঁর মহব্বতে, তাঁর সন্তুষ্টিতে, তাঁর ফয়সালায়, তাঁর নির্ধারণে, তাঁর ইরাদায়, তাঁর তওফীকে সৃষ্ট। ফযিলা আমল আল্লাহর নির্দেশ নয়। তবে তাঁর ইচ্ছায়, তাঁর সন্তুষ্টিতে, তাঁর ফয়সালায়, তাঁর নির্ধারণে ও তাঁর তওফীকে সৃষ্ট। আর মা সিয়াত তাঁর নির্দেশ নয়। তবে তাঁর ইচ্ছায় কিন্তু তাঁর মহব্বতে নয় ; তাঁর ফয়সালায় কিন্তু তাঁর সন্তুষ্টিতে নয় ; তাঁর নির্ধারণে কিন্তু তাঁর তওফীকে নয় বরং তাঁর অসন্তুষ্টি ও বিরাগে ।