আল্লাহ্ তা'আলা মাখলূককে কুফরীর প্রভাব ও ঈমানের আলো থেকে মুক্ত অবস্থায় পয়দা করেছেন। তাদের মাঝে যোগ্যতা দিয়েছেন ভাল, মন্দ, আলো, আঁধার, পাপ, পুণ্য পার্থক্য করার ও গ্রহণ-বর্জন করার। সূরা তাগাবুন ৬৪, আয়াত ২ এ বর্ণিত হয়েছেঃ
আল্লাহ্ই তো তোমাদের সৃষ্টি করেছেন। তারপর তোমাদের মধ্যে কেউ হয় কাফির আবার কেউ হয় মু'মিন। তোমরা যা কর আল্লাহ্ তার সম্যক দ্রষ্টা। মাখলূককে সৃষ্টি করার পর, আল্লাহ্ তা'আলা তাঁর রাসূলদের মাধ্যমে ও তাঁদের পরে তাঁদের স্থলাভিষিক্তদের মাধ্যমে, তাঁর ইবাদতের জন্য সম্বোধন করেন। তাদের নির্দেশ দেয়া হয় ঈমান ও আনুগত্যের ; বারণ করা হয় কুফর ও অবাধ্যতা থেকে ।
মানুষ নিজের ইচ্ছায় আল্লাহর নির্দেশ না মেনে, তাঁকে ছেড়ে, তাঁর সন্তুষ্টির তোয়াক্কা না করে, অহঙ্কার বশে, অবাধ্য হয়ে কুফরী করে । আবার কতক মানুষ তাঁর সন্তুষ্টির আশায়, নিজের কাজের মাধ্যমে, মুখের স্বীকৃতির মাধ্যমে ও অন্তরের প্রত্যয়ের মাধ্যমে ঈমান আনে। সূরা ইউনুস ১০, আয়াত ৪৪-এ আল্লাহ্ তা'আলা বলেছেনঃ
নিশ্চয় আল্লাহ্ যুলুম করেন না মানুষের প্রতি বিন্দুমাত্র, বস্তুত: মানুষ নিজেরাই যুলুম করে নিজেদের প্রতি।
কুফরী করা নিজের প্রতি নিজে যুলুম করার শামিল। যে কুফরী করল সে তা নিজের ইচ্ছায় করল। আর যে ঈমান আনল সে তা নিজের ইচ্ছায় আনল। তাই কারো কাফির হওয়া ও কারো মু'মিন হওয়া আল্লাহর শাশ্বত ‘ইলমের পরিপন্থী নয় । আল্লাহ্ তাদের কুফ্রী ও ঈমান সম্পর্কে পূর্ব থেকেই অবহিত । বস্তু জগতে তারা যথাসময় যা করেছে আল্লাহ তা তাঁর শাশ্বত জ্ঞানে জানতেন।
এখানে হযরত ইউসুফ (আ)-এর বক্তব্য যা সূরা ইউসুফ ১২, আয়াত ৩৮-এ বর্ণিত হয়েছে প্রণিধানযোগ্যঃ
আমি আমার পিতৃপুরুষ ইব্রাহীম, ইস্হাক ও ইয়াকূবের মতবাদ অনুসরণ করি । আল্লাহর সঙ্গে কোন কিছু শরীক করা আমাদের কাজ নয়। এ হলো আল্লাহর অনুগ্রহ আমাদের প্রতি এবং সমস্ত মানুষের প্রতি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না ।
প্রথমে আল্লাহ তা'আলা আদম (আ)-এর পৃষ্ঠ থেকে তাঁর সন্তানদের পিঁপড়ার ন্যায় বের করেন এবং তাঁর ডানে ও বামে ছড়িয়ে দেন। তাদের জ্ঞান দান করেন যাতে তারা তাঁর কথা বুঝতে পারে ও উত্তর দিতে পারে। তারপর তিনি তাদের ‘আমি কি তোমাদের রব নই' বলে সম্বোধন করেন। তিনি তাদের নির্দেশ দেন ঈমান ও ইসানের এবং নিষেধ করেন কুফ্রী ও নাফরমানী থেকে। তারা সেদিন আল্লাহ্ কথার জবাব দিয়েছিল তাঁর রাবুবিয়্যাতের স্বীকৃতির দ্বারা। বলেছিল “হাঁ” তুমি আমাদের রব। তাদের এ স্বীকৃতিই প্রকৃত ঈমান। তারা যখন জন্মগ্রহণ করে তখন এ স্বীকৃতি নিয়েই জন্মগ্রহণ করে । এ কথাই কুরআনে বলা হয়েছে :
তুমি একনিষ্ঠ হয়ে নিজেকে দীনে প্রতিষ্ঠিত কর। আল্লাহর সে প্রকৃতির অনুসরণ কর, যে প্রকৃতিতে তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টিতে কোন পরিবর্তন নেই।
(সূরা রূম ৩০, আয়াত ৩০)
হাদীসে বর্ণিত হয়েছেঃ
প্রত্যেক মানব শিশু সহজাত প্রকৃতি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। আর তা হলো ইসলাম। তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদী বানায়, অথবা নাসারা বানায়, অথবা অগ্নি উপাসক বানায় ।
যে জন্মের পর কুফরী করল, সে আল্লাহর কাছে দেয়া ঈমানের প্রতিশ্রুতির খেলাফ করল। আল্লাহর রাবুবিয়্যাতের স্বীকৃতির বিরোধিতা করল। আর যে ঈমান আনল, সে তো তার কর্মের মাধ্যমে, স্বীকৃতির মাধ্যমে ও প্রত্যয়ের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি পালন করল। ইসলাম গ্রহণ করা এবং মৃত্যু পর্যন্ত দৃঢ়ভাবে ইসলামে কায়িম থাকা, আল্লাহর কাছে দেওয়া ওয়াদায় ‘উবুদিয়্যাতের বাস্তব প্ৰমাণ ।
আল্লাহ্ তা'আলা বান্দাকে সৃষ্টি করে তাকে শক্তি দিয়েছেন স্বেচ্ছায় আনুগত্য করার অথবা অবাধ্য হওয়ার। সে বাধ্য নয় তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ক্রিয়া সম্পাদন করতে। সূরা আ'রাফ ৭, আয়াত ১৭২-১৭৩-এ বর্ণিত হয়েছেঃ
“স্মরণ কর, তোমার রব বনী আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের বংশধরকে বের করেন এবং তাদের নিজেদের সম্বন্ধে স্বীকারোক্তি গ্রহণ করেন আর বলেন, আমি কি তোমাদের রব নই ? তারা বলেঃ নিশ্চয়ই ; আমরা সাক্ষী রইলাম। এ স্বীকৃতি গ্রহণ এ জন্য যে, কিয়ামতের দিন তোমরা যেন না বল, 'আমরা তো ছিলাম এ বিষয়ে অনবহিত।' কিংবা তোমরা যেন না বল, “শিরক তো করেছে আমাদের পূর্ব পুরুষরা এর আগে, আর আমরা তো তাদের পরবর্তী বংশধর ; তবে কি তুমি আমাদের হালাক করবে বিপথগামীদের কৃত কর্মের জন্য?” এ সম্পর্কে ইবন আব্বাস (রা) রাসূলুল্লাহ্ (সা) থেকে বর্ণনা করেন : আল্লাহ্ তা'আলা আদম (আ)-এর পৃষ্ঠদেশ থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেন । তাঁর সমস্ত সন্তানদের তাঁর পৃষ্ঠদেশ থেকে বের করেন এবং তাঁর সামনে ছড়িয়ে দেন। তাদের প্রত্যেককে অবয়ব দান করেন এবং তাদের কার্যকরী জ্ঞান ও বক্তব্য প্রকাশের রসনা দেন। তারপর তাদের সঙ্গে এমনিভাবে কথা বলেন যে, আদম (আ) তা প্রত্যক্ষ করেন। আল্লাহ্ বলেন : “আমি কি তোমাদের রব নই ?” তারা বলেন : “নিশ্চয়ই, আমরা সাক্ষী রইলাম ।”