কোন কোন রেওয়ায়াতে দেখা যায়- মিলাদ ও কিয়াম প্রথা হিসাবে প্রথম তিন যুগে ছিলনা। সপ্তম শতাব্দী হিজরীতে তা প্রথা হিসাবে চালু হয়েছে। এ কারণে এটাকে বিদআতে হাসানা বলা হয়। অথচ ইবনে হাজর হায়তামীর রেওয়ায়াতে দেখা যায়- চার খলিফার যুগেও মিলাদ ছিল। ইবনে কাসিরের বর্ণনায় দেখা যায় - হযরত ইবরাহীম (আঃ) মিলাদ ও কিয়াম করেছিলেন। এই দুই বর্ণনার মধ্যে কোনটি সঠিক? এমন সংশয় দেখা দেয়া স্বাভাবিক। এর সমাধান হচ্ছে এইঃ প্রথম যুগে মিলাদ ও কেয়াম রেওয়াজ হিসাবে এবং প্রথা হিসাবে চালু ছিলনা। কখনও হতো, আবার কখনও হতোনা। ৭ম শতাব্দী হিজরীতে এসে তা নিয়মিত প্রথায় পরিণত হয়েছে। যেমন : তারাবিহর নামাজ প্রথমে জামাতবদ্ধভাবে হতোনা। কিন্তু হযরত ওমর (রাঃ)-এর যুগে এসে নিয়মিতভাবে জামাতের সাথে বিশ রাকআত চালু হয়ে যায়। এই প্রথাকেই হযরত ওমর (রাঃ) শাব্দিক অর্থে উত্তম বেদআত বলেছেন। মূল তারাবিহর নামাজকে তিনি বেদআত বলেননি। তদ্রূপ-মিলাদুন্নবীর মূল কাজটি বেদআত নহে । পরবর্তী যুগে নির্দিষ্ট আকারে ও প্রকারে নিয়মিত প্রথা হিসাবে চালু হওয়াকেই কোন কোন কিতাবে শাব্দিক অর্থে উত্তম বেদআত বলা হয়েছে। সুতরাং উভয় বর্ণনার মধ্যে মৌলিক কোন সংঘাত ও পার্থক্য নেই। দেওবন্দী আলেম রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী বলেছেন- বিদআতে হাছানা মূলতঃ সুন্নাত। কেননা হাদীসে অনুরূপ বলা হয়েছে। বর্তমান কালেও দেশে দেশে বিভিন্ন পদ্ধতিতে মিলাদ শরীফ পাঠ করা হয়ে থাকে। বাগদাদ শরীফে গাউসুল আজম মসজিদে মিলাদ শরীফ পাঠ করা হয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ২/৩ ঘন্টাব্যাপী। ঐ সময়ে দিওয়ানে হাসসান থেকে নবীজীর শানে কাসিদা পাঠ করা হয়। অধীন লেখক ১৯৮২ সালে শুক্রবারে এমন এক মিলাদ মাহফিলে শরীক ছিলাম। শর্ষিনার মরহুম পীর আবু জাফর সাহেবও সাথে ছিলেন।
পবিত্র মিলাদুন্নবীর প্রচলন সর্বযুগেই ছিল। তবে স্থান কাল পাত্র ভেদে আকার ও প্রকারের বিভিন্নতা ছিল এবং এখনও আছে। মিলাদ বিরোধিরাও বসে বসে কোন কোন সময় মিলাদের নামে শুধু দরূদ পড়ে। এটা তাদের ধোকাবাজী। তারা ইয়া নাবী, ইয়া রাসুল- বলে সম্বোধন করাকে শিরিক বলে এবং কেয়ামকে হারাম বলে। সমস্বরে ইয়া নাবী সালাম আলাইকা - পাঠ করাকে ফতোয়ায়ে রশিদিয়াতে কৃষ্ণলীলার গান বলে উপহাস করা হয়েছে এবং “ইয়া রাসুলাল্লাহ” বাক্যটিকে কুফর সদৃশ বাক্য বলা হয়েছে- (ফতোয়া রাশিদিয়া পৃষ্ঠা ৬২)। দেওবন্দ আলেমদের অধিকাংশই মিলাদ ও কেয়াম বিরোধী। যেখানে সুন্নী আলেম আছে, সেখানে তারা বলে- কেয়াম করা মোস্তাহাব- করলেও চলে, না করলেও ক্ষতি নেই । আবার যেখানে সুন্নী আলেম কম বা দুর্বল থাকে, সেখানে বলে-কেয়াম করা হারাম ও শিরক- ইত্যাদি। হানাফী মাজহাবের ইমাম ইব্রাহীম হলবী রুহুস সিয়ার (সীরতে হলবী নামে খ্যাত) গ্রন্থের এক জায়গায় লিখেনঃ
[আরবী]
অর্থাৎঃ “কিয়াম করা মুস্তাহসান। যে ব্যক্তি কেয়াম করবে- সে মোস্তাহ্সান কাজের সওয়াব পাবে। আর যে করবেনা - সে সওয়াব থেকে বঞ্চিত থাকবে। কিন্তু যে ব্যক্তি নীতিগতভাবে কেয়াম মানবেনা বরং অস্বীকার করবে- সে কাফের হবে” ।
(সীরতে হলবী- রূহুস সিয়ার)
ইহাই চূড়ান্ত ফতোয়া ।
মিলাদুন্নবীর মাহফিল ও কেয়াম সম্পর্কে যে সব দলীল পেশ করা হলো- তার চেয়ে অনেক বেশী দলীল আল্লামা ইবনে হাজর হায়তামী (রাহঃ) আন-নে'মাতুল কোবরা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন- যা এখানে উল্লেখ করা হয়নি। যারা মানতে ইচ্ছুক, তাদের জন্য এটাই যথেষ্ঠ । আল্লামা ইবনে হাজর হায়তামী (রহঃ) তাঁর গ্রন্থে (আন-নে'মাতুল কোবরা) আরো কয়েকজন বিশ্ববিখ্যাত ইমাম ও শাইখের (রহঃ) নাম এবং তাদের ফতোয়া উল্লেখ করেছেন। তারা হচ্ছেনঃ (১) হযরত হাসান বসরী (রঃ) (২) হযরত মারুফ কারাখী (রহঃ) (৩) হযরত সিররি সাকাতী (রহঃ) (৪) হযরত জুনায়দ বাগদাদী (রহঃ) প্রমুখ মনিষীবৃন্দ। এতে দেখা যাচ্ছে যে, সাহাবা যুগ থেকে শুরু করে প্রত্যোক যুগেই মিলাদুন্নবীর প্রচলন ছিল। এসব মহা মনিষীগণের ফতোয়ার মোকাবিলায় ফাকেহানী, ইবনে ওহাব নজদী, রশিদ আহমদ, খলীল আহমদ, আশ্রাফ আলী থানবী গংদের মতামতের কি মূল্য আছে? ওহাবীদের পীর বলে খ্যাত হাজী এমদাদুল্লাহ মোহাজিরে মক্কী বলেন
“আমি মিলাদ মাহফিলে শরীক হই, নিজেও মিলাদ কেয়াম করে থাকি এবং খুবই আনন্দ পাই”।
(ফয়সালা হাফত মাসায়েল)
আমাদের দেশের ওহাবী সম্প্রদায়ের আলেমরাই মানুষকে গোমরাহ করছে। সরলপ্রাণ মুসলমানের কোন দোষ নেই। রাসুলের পক্ষে থাকার মধ্যেই নাজাত নিহিত। বিপক্ষে যাওয়ার পরিণতি খুবই ভয়াবহ। আল্লাহ আমাদেরকে রাসুলের প্রতি মহব্বত মূলক কাজের তৌফিক দিন। আমিন - (লেখকের পৃথক গ্রন্থ “ঈদে মিলাদুন্নবী (দঃ)" তে মিলাদ ও কিয়াম-এর তরতীব, নিয়ম কানুন, বিভিন্ন আশেকানা না'ত শরীফ ও সমর্থনকারী পীর মাশায়েখ এবং জগত বরেণ্য উলামায়ে কেরামের তালিকা দেখুন) । নিম্নে তাদের নাম পেশ করা হলোঃ
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(২১) মিলাদ কিয়াম সমর্থক ইমামগণের অভিমত | (২৩) মিলাদ ও কিয়াম সম্পর্কে মক্কা-মদিনার প্রাচীন ৪টি ফতোয়া |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |