ওহাবী সম্প্রদায় কিয়াম বিরোধী। তারা কিয়ামকে হারাম বলে, বিদআত বলে এবং তাদের দাবীর পক্ষে কিছু হাদীসও পেশ করে- কিন্তু তার সঠিক ব্যাখ্যা করেনা । যদিও ব্যাখ্যা করে- তাহলে অপব্যাখ্যা করে। যেমন :
[আরবী]
অর্থ : হযরত আনাছ (রাঃ) হতে বর্ণিত- তিনি বলেন, সাহাবায়ে কেরামের নিকট নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অধিক প্রিয় আর কেউ ছিলেননা । যখন তাঁরা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আগমন করতে দেখতেন - তখন দাঁড়াতেন না। কেননা, তাঁরা অবগত ছিলেন যে, তিনি এরূপ করা অপছন্দ করতেন।
(তিরমিজি শরীফ)
[আরবী]
অর্থ : হযরত মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন “যে ব্যক্তি এরূপ পছন্দ করে যে, লোকেরা তাঁর সামনে পুতুলের মত দাঁড়িয়ে থাকুক, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে তৈরী করে নেয়” ।
(তিরমিজী ও আবু দাউদ)
[আরবী]
অর্থ : হযরত আবু উমামা বাহেলী (রাঃ) হতে বর্ণিত- তিনি বলেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লাঠিতে ভর দিয়ে ঘর থেকে বের হলেন। আমরা তাঁর সম্মানে দাঁড়িয়ে গেলাম। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন- “তোমরা পারস্য দেশীয় লোকদের মত কিয়াম করোনা। তারা একজন অপরজনকে যেভাবে তাজীম করে- সে ভাবে নয়”।
(আবু দাউদ)
উপরোক্ত তিনটি হাদীস মেশকাত শরীফে সঙ্কলিত হয়েছে। তিরমিজি ও আবু দাউদ উক্ত হাদীসগুলো নিজ নিজ গ্রন্থে সংকলন করেছেন। এগুলোতে বিশেষ ধরনের কিয়ামকে নিষেধ করা হয়েছে। মূল কিয়ামকে নিষেধ করা হয়নি। মূল কিয়াম যে সুন্নাত- তার প্রমান বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে। একই মিশকাত শরীফে কিয়ামের পক্ষে হযরত আবু হোরায়রার হাদীস এবং হযরত সাআদ (রাঃ) সংক্রান্ত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ)-এর হাদীসও বর্ণিত হয়েছে- যা ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেছেন- যা একটু আগে উদ্ধৃত করা হয়েছে। তাহলে কিয়ামের পক্ষে ও বিপক্ষে বর্ণিত হাদীসগুলো একসাথ করে বিশ্লেষণ না করে ঢালাওভাবে “কিয়াম নিষিদ্ধ” বলার মধ্যে তো সততার প্রমান পাওয়া যায় না এবং এটা কোন ঈমানদার আলেমের কাজ হওয়াও উচিৎ নয় ।
এখন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, উল্লেখিত প্রথম হাদীসে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নেতার সম্মানে দাঁড়ানোর নির্দেশ করেছেন এবং দ্বিতীয় হাদীসে হুজুরের সম্মানে সাহাবীগণের দীর্ঘ কিয়ামের বিষয়ে হুজুরের কোন প্রকার নিষেধাজ্ঞা ছিলনা। তাহলে বাকী তিন হাদিসে তিনি কি কারণে কিয়াম নিষেধ করলেন? কোন্ পরিবেশে তিনি সাহাবীদের দাঁড়ানো অপছন্দ করেছেন এবং কোন্ ধরনের কিয়ামকে তিনি নিষিদ্ধ করেছেন- তা খতিয়ে দেখলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, কি কারণে তিনি ঐ বিশেষ ধরনের কিয়াম অপছন্দ করেছেন।
কিয়াম বিরোধীদের পেশকৃত প্রথম হাদীসে বুঝা যায় যে, সাহাবীগণ হুযুরের আগমনে কিয়াম করতেন না। কেননা তিনি “এরূপ কিয়াম” করা পছন্দ করতেন না। “এরূপ কিয়াম”-এর ধরন সম্বন্ধে মোল্লা আলী ক্বারী (রহঃ) মিরকাত গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন
[আরবী]
অর্থ : “নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাগণের ঐ ধরনের কিয়ামকেই অপছন্দ করতেন- যে ধরনের চরম বিনয়মূলক কিয়াম আল্লাহর জন্য করা হয় । অহংকারী ব্যক্তিদের জন্য যে ধরনের বিনয়মূলক কিয়াম করা হয়- ঐ ধরনের কিয়ামও তিনি নিজের জন্য অপছন্দ করতেন এবং ঐ ধরনের কিয়ামের বিরোধিতা করতেন”।
(মিরকাত)
[ অন্য একটি জবাব হলো- হাদীস খানা সাহাবীর ব্যক্তিগত অভিমত ইহা হুযুর (দঃ)-এর ভাষ্য নয়। হুযুর (দঃ)-এর অনুমোদিত কিয়াম হলো- যা আবু সায়ীদ খুদরী (রাঃ) ও আবু হোরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন। তৃতীয় জবাব হলো- এই অপছন্দ ছিল বিনয় মূলক - নিষেধ মূলক নয়- লেখক]।
মোল্লা আলী ক্বারীর ব্যাখ্যার দ্বারা পরিস্কার হয়ে গেলো যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মূল কিয়ামকে অপছন্দ করতেন না বরং আল্লাহর সামনে অথবা অহংকারীদের সামনে যে ধরনের কিয়াম করা হয়- সে ধরনের কিয়ামকেই তিনি অপছন্দ করতেন এবং সাহাবীগণ সেই ধরনের কিয়াম থেকে বিরত থাকতেন। হযরত আনাছের বর্ণনার উদ্দেশ্যও তাই। হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ)-এর সাথে তিনিও মসজিদে হুযুরের সম্মানে কিয়াম করতেন। সুতরাং হুযুর (দঃ) অহঙ্কার মূলক কিয়ামকেই অপছন্দ করতেন। তাজিমী ও বিনয় মূলক কিয়াম সাহাবীগণের আমল। এটিই সঠিক ব্যাখ্যা ।
কিয়াম বিরোধীদের পেশকৃত দ্বিতীয় হাদীসের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, কারো সম্মানে মূর্তিবৎ দাঁড়িয়ে থাকাকেই হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষিদ্ধ করেছেন - মূল কিয়ামকে নয়। হাদীস খানা স্বব্যাখ্যাত। তদুপরি - হাদীস খানা হুযুরের বেলায় প্রযোজ্য নয়। অহংকারী ও দাম্ভিক ব্যক্তিদের ক্ষে এই প্রযোজ্য। হুযুরের এই নিষেধ ছিল শর্ত সাপেক্ষ। অর্থাৎ মূর্তিবৎ কিয়াম নিষিদ্ধ - মূল কিয়াম নিষিদ্ধ নয়।
কিয়াম বিরোধীদের পেশকৃত তৃতীয় হাদীসের ব্যাখ্যা হচ্ছে- পারস্যবাসীদের ন্যায় নতজানু হয়ে মূর্তিবৎ রাজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকার মত কিয়াম অবশ্যই নিষিদ্ধ। নবী করিম (দঃ) তাদের অনুরূপ মূর্তিবৎ নতজানুর কিয়ামকেই নিষিদ্ধ করেছেন- মূল কিয়ামকে নিষিদ্ধ করেননি। তিনি একথা বলেননি “তোমরা কিয়াম করোনা”- বরং বলেছেন- “পারশ্যবাসী অগ্নি পূজকের ন্যায় কিয়াম করোনা”। যেমন কেউ বললো- “গরুর মত পানি পান করোনা” এর অর্থ হলো- “পানি পান করো তবে গরুর মতো নয়”। অনুরূপভাবে হাদীসের অর্থ হবে- “কিয়াম করো- তবে পারস্যবাসী অগ্নি পাসকদের মত নতজানু হয়ে নয়” । কিয়াম বিরোধীরা ব্যাখ্যা না করেই শাব্দিক অর্থে হাদীস বয়ান করায় ভুলের সৃষ্টি হয়েছে। তারা হাদীসকে ঢাল স্বরূপ ব্যবহার করে মাত্র। যদি তারা সত্য গ্রহণ করতো এবং সঠিক জিনিষ মেনে নিতো- তাহলে হযরত সাআদ ও হযরত আবু হোরায়রার হাদীস দুটিও বর্ণনা করতো। কিন্তু তারা তা করেনা। দুটিকে গোপন করে তাদের স্বপক্ষের বাহ্যিক সহায়ক তিনটি হাদীস তারা আক্ষরিক অর্থে প্রচার করে। এটা আমানতদারী নয় বরং রাসুলে পাকের হাদীস গোপন করার অপরাধ। অত্র হাদীসে সাহাবীগণের কিয়ামের বিশেষ ধরন দেখেই তিনি ঐ ধরনের কিয়াম না করার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু ওহাবীরা বুঝেছে- তিনি সবধরনের কিয়াম নিষেধ করেছেন।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(১৮) হাদীস দ্বারা কিয়াম করা সুন্নাত প্রমাণিত | (২০) ফতোয়া |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |