[আরবী]
অর্থাৎ : হযরত আবু সায়ীদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আন্হু বর্ণনা করেন : মদিনার একটি ইহুদী সম্প্রদায়- বনু কুরাইযা হুযুর (দঃ) এর সাথে চুক্তি ভঙ্গ করে খন্দকের যুদ্ধের সময় মদিনা আক্রমন করার অপরাধে মুসলিম বাহিনী কর্তৃক অবরুদ্ধ হয়ে আত্মসমর্পনের উদ্দেশ্যে যখন হযরত সাআদ ইবনে মাআয (রাঃ)-এর বিচার মেনে নিতে রাজী হলো। তখন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত সাআদকে আনার জন্য লোক পাঠালেন। হযরত সাআদ ইবনে মাআয (রাঃ) হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটবর্তী স্থানে তাবুতে ছিলেন। হযরত সাআদ (রাঃ) গাধার পিঠে করে আসলেন। যখন তিনি মসজিদে নববীর নিকটবর্তী হলেন- তখন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে উপস্থিত মদিনাবাসী আনসারগণকে লক্ষ্য করে বললেন- “তোমরা তোমাদের নেতার সম্মানে দাঁড়িয়ে যাও”।
(বুখারী ও মুসলিম এবং মিশকাত বাবুল কিয়াম পৃষ্ঠা- ৪০৩)
ইয়াহুদীদের আত্মসমর্পনের বিচারকার্যের বিশদ বিবরণ বুখারীর যুদ্ধবন্দী অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ আছে। বর্ণিত হাদীসে যা বলা হয়েছে, তা নিম্নরূপঃ
উক্ত পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে বিবেচ্য বিষয় বা مقام استشهاد হলো “সম্মানার্থে দাঁড়ানো” । বর্ণিত হাদীসে قوموا الى سيدكم বাক্যের মধ্যে প্রতিটি শব্দ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। قوموا الى এর অর্থ সম্মানার্থে, সাহায্যার্থে দাঁড়ানো— উভয় অর্থেই ব্যবহৃত হয় । আলোচ্য কিয়ামের উদ্দেশ্যও হচ্ছে প্রধানতঃ সম্মানার্থে দাঁড়ানো, দ্বিতীয়তঃ সাহায্যার্থে। আল্লামা ইবনে কাছির তার বেদায়া ও নেহায়া গ্রন্থে হযরত আবু সায়ীদ খুদরী (রাঃ) হতে الى سيدكم এর পরিবর্বাতে لسيدكم وخيركم বাক্য উদ্ধৃত করেছেন (বেদায়া ও নেহায়া ৩য় খন্ড পৃষ্ঠা-১২৩)। এর অর্থ হলো- “হে আনসারগণ তোমরা তোমাদের সম্মানীত নেতার সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে যাও”। এতেই আরোও সুস্পষ্ট হয়ে গেল الى অর্থ সম্মানার্থে ও সাহায্যার্থে হলেও এখানে সাহায্যার্থে নয়- বরং সম্মানার্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। কেননা, একই রাবীর অন্য রেওয়ায়াতে الى سيدكم এর পরিবর্তে لسيدكم এসেছে। আর “লাম মাজরুর” ব্যবহৃত হয় সম্মান ও তাজীমের জন্য ।
অতএব এক রেওয়ায়াতে দুই অর্থবোধক الى শব্দ থাকলেও অন্য রেওয়ায়াতে ل মাজরুর পরিস্কারভাবে বলে দিচ্ছে যে- “আনসারদের উক্ত কিয়ামটি ছিল তাজীমী কিয়াম” এবং হুযুর (দঃ)-এর নির্দেশও ছিল তাজীমী কিয়ামের জন্য। সুতরাং অত্র হাদীস দ্বারা এবং الى ও ل মাজরুর যুক্ত ইবনে কাছিরের উভয় রেওয়ায়াত দ্বারা পরিস্কারভাবে প্রমানিত হলো যে- তাজীমী কিয়াম করা সুন্নাত।
কিয়াম বিরোধীরা বলে- এখানে “রোগীর সাহায্য করার উদ্দেশ্যে কিয়াম করার জন্য নবীজী সব আনসারদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন” । দেওবন্দীদের এই অপব্যাখ্যার আর কোন অবকাশ নেই। তারা বলে- ঐ কিয়ামের নির্দেশ নাকি নবীজী সাহায্যের জন্য দিয়েছিলেন- তাদের এই ব্যাখ্যা ভুল। ইবনে কাছিরের ব্যাখ্যাই সঠিক। আনসারগণের কিয়াম ছিল সম্মানার্থে- সাহায্যের জন্য ছিলনা। কেননা, হুযুর (দঃ) বলেছেন قوموا তোমরা সবাই দাঁড়িয়ে যাও। রোগীর সাহায্যের জন্য সকল আনসারের দাঁড়ানোর প্রয়োজন ছিলনা। কতিপয় আনসারই যথেষ্ঠ ছিলেন। কিন্তু হুযুর (দঃ) সবাইকে দাঁড়িয়ে যেতে বলার মধ্যেই প্রমাণ পাওয়া যায়- ঐ নির্দেশ ছিল সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে । আবার বলেছেন الى سيدكم তোমাদের নেতার উদ্দেশ্যে । “নেতা” শব্দ দ্বারাই বুঝা যায় যে, নেতার সম্মানের উদ্দেশ্যে দাঁড়ানোর জন্যই হুকুম ছিল। রোগীর উদ্দেশ্যে নয়। রোগীর সাহায্যার্থে হলে এরূপ বলতেন قوموا الى مريضكم অর্থাৎ তোমরা তোমাদের রোগীর সাহায্যার্থে দাঁড়াও। ওহাবীরা الى শব্দটি দ্বারা বুঝাতে চায় যে, উক্ত কিয়ামটি ছিল রোগীর সাহায্যার্থে। তারা শব্দটি الى سيدكم দেখলো- কিন্তু একই রাবীর বর্ণিত لسيدكم শব্দটি দেখলনা কেন ?
তাদেরকে জিজ্ঞেস করতে হয়— আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বলেছেন- اذا قمتم الى الصَّلوة فاغسلوا (যখন তোমরা নামাযের ইচ্ছা করবে তখন ওজু করে নাও)। এখানেও তো তা শব্দটি আছে। এক্ষেত্রে তারা কি ব্যাখ্যা দিবে? এখানে তো নামাযের জন্য দাঁড়ানোর কথা আছে। الى অর্থ যদি সাহায্য হয়- তা হলে নামায কোন্ রোগী হলো যে, তার সাহায্যার্থে দাঁড়াতে হবে? তদুপরি হযরত সাআদ (রাঃ) রোগী হলে দুই তিনজনকে নির্দেশ করতেন এবং বলতেন না قوموا الى مريضكم এ রোগীর সাহায্যার্থে দাঁড়াও। তা না করে নেতা উল্লেখ করে সমস্ত আনসারকে নির্দেশ দেয়ার মধ্যেই তাজীমী কিয়ামের প্রমান পাওয়া যায়। মক্কার মুহাজিরগণকে তিনি দাঁড়াতে বলেন নি।
কিন্তু দুঃখের বিষয়- যারা কিয়াম বিরোধী- তারা এই হাদীস খানার অপব্যাখ্যা করে হযরত সাআদের রোগের বাহানা দিয়ে তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের বিষয়টিকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে এবং অল্প শিক্ষিত অথবা দুর্বল আলেমদেরকে ধোঁকায় ফেলে দিচ্ছে এসব দেওবন্দী এবং ওহাবী ধোঁকাবাজী থেকে আল্লাহ সকলকে রক্ষা করুন।
উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় শেখ আব্দুল হক দেহলভী (রহঃ) বলেন
“হযরত সাআদের আগমনে আনসারগণকে দিয়ে সম্মান প্রদর্শন করানোর মধ্যে এই হিকমত নিহিত ছিল যে, যেহেতু তিনি ছিলেন ঐ দিন বিচারপতির আসনে আসীন এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মীমাংসার প্রধান ব্যক্তি। তাই তাঁর মর্যাদা ও সম্মান প্রদর্শন করাই যুক্তিযুক্ত ছিল” ।
(আশিআতুল লোমআত ফারসী- শেখ আব্দুল হক মোহাদ্দেস দেহলভী)
অত্র হাদীসের ব্যাখ্যায় শেখ আবদুল হক মোহাদ্দেস দেহলভীর আরও মন্তব্য লক্ষ্য করুনঃ
[আরবী]
অর্থঃ “হযরত সাআদ (রাঃ)-এর সম্মানার্থে মদিনা শরীফের আনসারগণকে দাঁড়ানোর নির্দেশ” সম্বলিত হাদীসের দ্বারা সংখ্যাগরিষ্ঠ ওলামায়ে কেরাম ও হাদীস বিশারদগণ হাক্কানী ওলামাদের তাজীম করার বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। মোসলেম শরীফের প্রখ্যাত ভাষ্যকার আল্লামা নবভী (রহঃ) বলেছেন- বুযুর্গ ব্যক্তিদের আগমনকালে দাঁড়ানো মোস্তাহাব। এ বিষয়ে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু তাদের সম্মানে দাঁড়ানোর ব্যাপারে নিষেধমূলক কোন স্পষ্ট বর্ণনা বা হাদীস পাওয়া যায় না। কুনিয়া নামক গ্রন্থ হতে উদ্ধৃতি আছে যে, “বসা অবস্থার কোন ব্যক্তি আগত কোন ব্যক্তির সম্মানার্থে দাঁড়ালে মাকরূহ হবেনা”
(আশিয়াতুল লোমআত শেখ আবদুল হক মোহাদ্দেস দেহলভী)
কিয়াম বিরোধীরা শেখ দেহলভী সাহেবের ব্যাখ্যা উপেক্ষা করে নিজেরা মনগড়া ব্যাখ্যা করে ।
সাহাবায়ে কেরাম নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মানার্থে দাঁড়াতেন । হযরত আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু আন্হু কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে নবীজীর সম্মানে সাহাবাগণের দাঁড়ানোর বর্ণনাটি তিনি এভাবে দিয়েছেনঃ
[আরবী]
অর্থাৎঃ “হযরত আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন- হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববীতে আমাদের মাঝে বসে সব সময় পবিত্ৰ হাদীস বয়ান করতেন । যখন তিনি মজলিস থেকে দাঁড়িয়ে যেতেন- তখন আমরাও তাঁর সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে যেতাম। যে পর্যন্ত না তিনি কোন বিবির ঘরে প্রবেশ করতেন- সে পর্যন্ত আমরা তাঁর সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে থাকতাম।"
(মিশকাত শরীফ বাবুল কিয়াম পৃষ্ঠা-৪০৩)
উক্ত হাদীস পরিস্কার বলে দিয়েছে যে, যখনই নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বসা থেকে দাঁড়িয়ে যেতেন- তখনই সাহাবাগণও আদবের সাথে দাঁড়িয়ে যেতেন । শুধু তাই নয়— বরং ততক্ষণ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতেন- যতক্ষণ হুযুরকে দেখা যেতো । তাহলে বুঝা যাচ্ছে যে, হুজুরের বিদায়ের পরেও তারা বসতেন না- বরং যতক্ষণ দেখা যেত, ততক্ষণ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতেন। এত দীর্ঘ কিয়ামের প্রমান সত্বেও যারা বলে- “কিয়াম করা হারাম ও বিদআত” বা “হুজুর (দঃ) তাঁর জন্য কিয়াম না পছন্দ করতেন” ইত্যাদি- তারা মহাভুলের মধ্যে নিঃপতিত।
উপরে উল্লেখিত দুটি হাদীসে প্রমানিত হলো যে, কোন বুযুর্গ ব্যক্তি বা সম্মানীত ব্যক্তিদের জন্য দাঁড়ানো সুন্নাত। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মানার্থে সাহাবীগণ আদবের সাথে দাঁড়িয়ে থাকতেন- যে পর্যন্ত তিনি দৃষ্টির আড়াল না হতেন। এতেও প্রমানিত হয় যে, সাহাবীগণ নবীজীর বিদায়ের পরেও সম্মানার্থে কিয়াম করতেন। কিয়াম যদি না জায়েয হতো অথবা তিনি যদি নিজের জন্য সব সময় কিয়াম না পছন্দ করতেন- তাহলে সাহাবীগণকে নিষেধ করলেন না কেন?
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(১৭) কিয়ামের প্রকারভেদ | (১৯) কিয়াম বিরোধীদের অপব্যাখ্যামূলক দলীল খন্ডন |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |