নামাযের মধ্যে আল্লাহর সম্মানে কিয়াম করা ফরয এবং মিলাদের মধ্যে নবীজীর সম্মানে কিয়াম করা মোস্তাহাব। মিলাদ শরীফে যখন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র বেলাদাত বা দুনিয়াতে পদার্পনের বর্ণনা করা হয়- ঠিক তখনই দাঁড়িয়ে শুভাগমনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা মুস্তাহাব। এর পূর্বে বা পরে কিয়াম করা জরুরী নয় । কিয়াম মোস্তাহাব বা সুন্নাত হওয়ার ব্যাপারে পর্যাপ্ত দলীল কোরআন, সুন্নাহ ও মোজতাহিদগণের ফতোয়ায় পাওয়া যায়। অনেক ফতোয়া কিয়ামের ব্যাপারে লিখা হয়েছে। নবীর দুশমন ইবনে তাইমিয়া ও তার মুষ্টিমেয় অনুসারীরাই কেবল কিয়ামের বিরোধিতা করে থাকে এবং কোরআন সুন্নাহর অপব্যাখ্যা করে খোঁড়া দলীল পেশ করে ।
সুরা আলে ইমরানের ৮১-৮২ আয়াতের বর্ণনামতে ও তাফসীর অনুযায়ী আল্লাহ পাক স্বয়ং আম্বিয়ায়ে কেরামকে নিয়ে রোজে আজলে মিলাদ ও কিয়ামের আয়োজন করেছিলেন। সেদিন সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরামকে একত্রিত করে সম্মেলন করে ঐ সম্মেলনেই আল্লাহ পাক আখেরী নবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুনিয়াতে শুভাগমন করার কথা ঘোষণা করেন এবং উনাদের নবুয়তের উদ্বোধনও করেন ঐ সময়েই । আম্বিয়ায়ে কেরাম আল্লাহর দরবারে সেদিন কিয়াম করে নবীজীর আগমন বার্তা শুনেন এবং তাঁকে বরণ করে নেয়ার অঙ্গীকার করেন। আল্লাহ তায়ালা বার বার উনাদেরকে অঙ্গীকার করান এবং নবীজীর আগমনের সাথে সাথে তাঁদের দ্বীনের বিলুপ্তির কথাও ঘোষণা করেন ঐ মাহফিলেই। সেদিনের মিলাদ পাঠকারী বা বর্ণনাকারী ছিলেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা । মাহফিল করেছিলেন নবীগণকে নিয়ে। নবীগণ খোদার দরবারে মিলাদ মাহফিলে দন্ডায়মান অবস্থায় নবীজীর শুভাগমনের সুসংবাদ শ্রবণ করেন এবং তাঁকে বরণ করে নেয়ার অঙ্গীকার করেন। মিলাদ মাহফিলে চারটি বিষয় প্রয়োজন। যথা : (১) লোকজনের সমাগম ও সমাবেশ (২) নবীজীর আগমন ও আদি নূরের বর্ণনা (৩) মিলাদ বর্ণনাকারী (৪) শ্রবণকারী ও কিয়ামকারী ।
ঐদিন এই চারটি শর্তই পূরণ হয়েছিল। সুরা আলে ইমরানের ৮১-৮২ আয়াতে এই চারটি বিষয়েরই উল্লেখ আছে চারভাবে। যথা (১) ইবারাতুন নস-এর দ্বারা অঙ্গীকার (২) দালালাতুন নস-এর দ্বারা মাহফিল (৩) ইশারাতুন নস-এর দ্বারা মিলাদ (8) ইকতিজাউন নস-এর দ্বারা কিয়াম। কোরআনের ব্যাখ্যা এই চার পদ্ধতিতেই করতে হয় এবং প্রত্যেকটি দ্বারাই শরীয়তের আহকাম প্রমাণিত হয়। উসুলে ফিকাহ-এর কিতাব নূরুল আনওয়ারে নসকে এই চার শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন মোল্লা জিয়ুন সাহেব (রহঃ)।
এখন শুনুন ৮১-৮২ আয়াতের অর্থ । আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেনঃ
[আরবী]
অর্থঃ (৮১) “হে প্রিয় হাবীব! আপনি স্মরণ করুন ঐ দিনের ঘটনা- (রোজে আজলের সময়ের) যখন আল্লাহ তায়ালা আম্বিয়ায়ে কেরামগণের নিকট থেকে এইভাবে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, “যখন আমি তোমাদেরকে কিতাব এবং হিকমত” অর্থাৎ নবুয়ত দান করবো-অতঃপর তোমাদের কাছে এক মহান রাসুলের শুভাগমন হবে- যিনি তোমাদের প্রত্যেকের নবুয়তের সত্যায়ন করবেন- তখন তোমরা সকলে অবশ্যই তাঁর উপর ঈমান আনয়ন করবে এবং সর্বোতভাবে তাঁকে সাহায্য সহযোগিতা করবে। তোমরা কি এ কথার অঙ্গীকার করছো এবং এই অঙ্গীকারে কি অটল থাকবে? নবীগণ বললেন- হাঁ, আমরা অঙ্গীকার করলাম । আল্লাহ বললেন- তোমরা পরস্পর সাক্ষী থাকো এবং আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী রইলাম । (৮২) এরপরে যে কেউ পিছপা হয়ে যাবে- তারা হবে কাফের”।
(তৃতীয় পারা সুরা আলে ইমরান ৮১-৮২ আয়াত)
এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হলো
সুতরাং মিলাদ ও কিয়াম অত্র আয়াতদ্বয়ের দ্বারাই প্রমাণিত হচ্ছে। শুধু এবারত মান্য করা হলে অন্য তিনটি অমান্য করা হয়। এটা বৈধ নয়। কারণ চার প্রকারেই কোরআন থেকে হুকুম আহকাম বের করতে হয়- শুধু ইবারত দ্বারা আসল জিনিস প্রমাণ করা যায় না। এর উদাহরণ হলো- আল্লাহ তায়ালা হযরত আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়াকে শুধু গাছের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করেছিলেন । কিন্তু দালালত ও ইশারার দ্বারা হযরত আদম (আঃ) বুঝে নিয়েছিলেন যে, মূলতঃ ফল খেতেই নিষেধ করা হয়েছে।
ইবনে কাসির বেদায়া ও নেহায়া গ্রন্থের ২য় খন্ড ২৬১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন যে, নবীজীর জন্মের চার হাজার বৎসর পূর্বেই মিলাদ ও কিয়াম করেছিলেন হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম। তাঁরা পিতা-পুত্র দু'জনে মিলে এক মাসে খানায়ে কাবা তৈরী করে উদ্বোধন করার সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিলাদ সংক্রান্ত আয়াত তিলাওয়াত করাকালীন নবীজীর সম্মানে তাঁরা কিয়াম করেছিলেন। আয়াত খানা কোরআন মজিদের সুরা বাক্কারার ১২৯ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে নিম্নরূপে :
[আরবী]
অর্থঃ (ইবরাহীম বললেন) “হে আমাদের রব! তুমি এই আরব দেশে আমার পুত্র ইসমাঈলের বংশে তোমার প্রতিশ্রুত সেই মহান রাসুলকে প্রেরণ করিও- যিনি তোমার আয়াতসমূহ তাদেরকে পাঠ করে শুনাবেন, তাদেরকে কিতাব ও সুন্নাহর বিশুদ্ধ জ্ঞান শিক্ষা দিবেন এবং বাহ্যিক ও আত্মিক অপবিত্রতা থেকে তাদেরকে পবিত্র করবেন। নিশ্চয়ই তুমি মহা প্রতাপশালী মহা জ্ঞানের আঁধার” ।
(প্রথম পারা সুরা বাক্কারা আয়াত নং-১২৯)
ইবনে কাসির এই আয়াতের পঠভূমি বা শানে নুযুল ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন- এই অনুষ্ঠানটি ছিল কাবা ঘরের উদ্বোধন উপলক্ষে মিলাদ ও কিয়ামের মাধ্যমে। এই অনুষ্ঠানে পিতা-পুত্র উভয়েই কিয়ামরত অবস্থায় ছিলেন। বেদায়া ও নেহায়া গ্রন্থের ইবারত হচ্ছে-
[আরবী]
অর্থঃ উপরোল্লিখিত মিলাদের দোয়া করার সময় হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কিয়াম করেছিলেন
(বেদায়া ও নেহায়া ২য় খন্ড ২৬১ পৃষ্ঠা- হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম অধ্যায়)
ইবনে কাসির কিয়াম বিরোধীদের নিকট অতি শ্রদ্ধেয়- কেননা তিনি ছিলেন ইবনে তাইমিয়ার শাগরিদ। তবে কিছুটা উদারপন্থী । তিনিও মিলাদ কিয়ামের পক্ষে উক্ত মন্তব্য করেছেন। তাই কিয়াম বিরোধী উলামাগণ তাঁর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন ।
এতে একটি বিষয় প্রমানিত হলো যে- কোন শুভ কাজের শুরুতে বা সমাপ্তিতে- বিশেষতঃ উদ্বোধনীতে মিলাদ ও কিয়াম করা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামেরই সুন্নাত। তিনি আমাদের ধর্মীয় পিল। তাঁর অনেক সুন্নাতই ইসলামে বহাল রাখা হয়েছে। যেমন- দাঁড়ি রাখা, মোছ কাটা, নখ কাটা, ওযুতে নাকে পানি দেয়া, গরগরা করা, খতনা করা ইত্যাদি ।
আমরা মিলাদ শরীফে কিয়ামের পূর্বক্ষণে পাঠ করে থাকি
[আরবী]
অর্থাৎ আমরা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র মাতৃগর্ভে আগমন ও নয় মাস পর তাঁর দুনিয়াতে পদার্পণ পর্যন্ত বর্ণনা করে কিয়াম করি। এই সময়ের কিয়াম হচ্ছে মোস্তাহাব। হুযুরের আগমনের শুভ সংবাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে কিয়াম করা মোস্তাহাব।
এই শুভাগমনের বর্ণনা করেছিলেন হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম । ঐ সময়ে তিনি ও তাঁর উম্মত হাওয়ারীগণ সকলেই তাজিমী কিয়াম করেছিলেন। এই ঘটনাটি- অর্থাৎ মিলাদ কিয়ামের এই অনুষ্ঠানটি হয়েছিল নবীজীর আগমনের ৫৭০ বৎসর পূর্বে। সুতরাং মিলাদ কিয়ামের প্রথা নবীজীর পরে নয়-বরং ৫৭০ বৎসর পূর্বে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের প্রথা। এরও সাড়ে তিন হাজার বৎসর পূর্বে মিলাদ কিয়ামের প্রমান পাওয়া যায় হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের যুগে। সুতরাং মিলাদ কিয়াম প্রথা বিদআত নয়- বরং সুন্নাত । তাও আবার সাধারণ মানুষের সুন্নাত নয়- বরং নবীদের সুন্নাত । হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের কিয়ামের প্রমান ইবনে কাছিরের লিখিত ১৬ খন্ডে সমাপ্ত “আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া” গ্রন্থের ২য় খন্ড ২৬৩ পৃষ্ঠায় হযরত ঈসা (আঃ) অধ্যায়ে লিখিত আছে । ইবনে কাছির প্রথমে হযরত ঈসা আলাইহিস সাল্লাম কর্তৃক নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শুভাগমন বা মিলাদের বর্ণনা কোরআন মজিদ থেকে এভাবে উদ্ধৃত করেছেন
[আরবী]
অর্থ : হে হাবীব! স্মরণ করুন। যখন ঈসা আলাইহিস সালাম এভাবে ভাষণ দিয়েছিলেন- “হে বনী ইসরাঈলগণ! আমি তোমাদের প্রতি আল্লাহর প্রেরিত রাসুল। আমি আমার পূর্ববর্তী তৌরাত কিতাবের সত্যায়ন করছি এবং আমার পরে একজন মহান রাসুলের শুভাগমনের সু-সংবাদ দিচ্ছি- যাঁর পবিত্র নাম হবে “আদ”।
(২৮ পারা সুরা আস সফ আয়াত-৬)
হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের উক্ত মিলাদী ভাষণের পরিবেশ বা অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে ইবনে কাছির তাঁর কিতাবে নিম্নোক্ত বক্তব্য পেশ করেছেন।
[আরবী]
অর্থাৎ : “হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম তাঁর উম্মত- হাওয়ারীদেরকে সম্বোধন করে যে মিলাদী বয়ান দিয়েছিলেন- তা ছিল কিয়াম অবস্থায়” ।
এতেই পরিস্কার হয়ে গেলো যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তাওয়াল্লুদ শরীফের বর্ণনাকালীন সময়ে কিয়াম করা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের সুন্নাত । ঐ সময়ে শুধু আগমনী সংবাদ ছিল- যার সম্মানে তিনি কিয়াম করেছিলেন। বুঝা গেল— নবীজীর বাহ্যিক উপস্থিতি কিয়ামের জন্য শর্ত নয়। যারা বলে- যার জন্য কিয়াম করছেন, তিনি কি স্বশরীরে হাযির হয়েছেন? এরূপ তর্ক করা নিরর্থক এবং নবী দুশমনির পরিচায়ক । কিয়াম বিরোধীদের ইমাম ইবনে কাছির যেখানে কিয়ামের সমর্থক এবং ৫৭০ বৎসর পূর্বেকার কিয়ামের ইতিহাস বর্ণনাকারী ও কিয়ামের দলীল পেশকারী- তাঁর মূল্যায়ন করা উচিৎ। তিনি ৭৭৪ হিজরীতে মৃত্যু বরণ করেছেন। নজদী ওহাবী ও তার অনুসারী ওহাবী সম্প্রদায় ঐ যুগকে সম্মান করেন এবং ঐ যুগের মনিষীদের মতামতকেও গুরুত্ব দিয়ে থাকেন ।
আল্লাহপাক কোরআন মজিদে ২৮ পারাতে সুরা মুজাদালায় ইরশাদ করেনঃ
[আরবী]
অর্থাৎ : হে ঈমানদারগণ! যখন তোমাদেরকে বলা হয়- “মজলিসের মধ্যে জায়গা প্রশস্ত করে দাও”- তখন তোমরা জায়গা (ছেড়ে দিয়ে) প্রশস্ত করে দিবে। আর যখন বলা হয়- “দাঁড়িয়ে যাও— তখন দাঁড়িয়ে যাবে"।
(২৮ পারা সুরা মোজাদালাহ্ )
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ুতি (রহঃ) তাফসীরে জালালাইনে বলেন
“যখন তোমাদেরকে নবীজীর মজলিসে অথবা অন্য কোন জিকিরের মজলিসে জায়গা প্রশস্ত করার জন্য বলা হয়- যাতে আগত লোকেরাও তোমাদের সাথে বসতে পারে- তাহলে তোমরা তাদের জন্য জায়গা ছেড়ে দিয়ে আরো প্রশস্ত করে দাও” । আর যদি বলা হয় “নামায বা অন্য যে কোন নেক কাজের জন্য দাঁড়িয়ে যাও, তাহলে তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে যাবে” ।
এই ব্যাখ্যার দ্বারাই প্রমাণিত হয় যে, কোন নেক কাজে বা ভাল কাজে দাঁড়ানোর কথা বললে দাঁড়িয়ে যাওয়া আল্লাহর নির্দেশ। মিলাদ মাহফিলে “যিকরে বেলাদত” বা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুনিয়াতে আগমনের কথা শোনামাত্র আগমনকারী নবীজীর সম্মানার্থে কিয়াম করা আল্লাহর অত্র নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত এবং ফিকাহের ফতোয়া মতে মোস্তাহ্তান । আল্লামা সুয়ুতির এই নীতিমালা মান্য করা প্রত্যেক আলেমের উচিৎ। তাফসীরে "সাভী আলাল জালালাইন”- এ আহমদ সাভী উক্ত আয়াত নাযিলের শানে নুযুল এভাবে বর্ণনা করেছেন-
“নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জঙ্গে বদরের সাহাবীদেরকে সর্বোচ্চ সম্মান দিতেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন সাহাবী নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে একদিন উপস্থিত হলেন এবং মজলিসের সম্মুখভাগে চলে আসলেন। তাঁরা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আশে পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন এবং হুযুরকে সালাম দিলেন। হুযুর (দঃ) সালামের জবাব দিলেন। অতঃপর তাঁরা উপস্থিত অন্যান্য সকল সাহাবীকেও সালাম দিলেন। তাঁরা সালামের জবাব দিলেন সত্য- কিন্তু বসার জন্য স্থান করে দিলেন না। বদরী সাহাবীগণ দাঁড়িয়ে রইলেন এবং বসার স্থানের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিন্তু কোন সাহাবী তাঁদের জন্য জায়গা ছেড়ে দিয়ে হুযুরের নিকট থেকে দূরে সরে যেতে রাজী হলেন না। এ পরিস্থিতি হুযুরের জন্য খুবই পীড়াদায়ক মনে হলো । অতঃপর হুযুর (দঃ) নিজেই তাঁদেরকে সরে যেতে বললেন এবং সম্মানীত বদরী সাহাবীদের জন্য জায়গা প্রশস্ত করে দিতে নির্দেশ দিলেন । হুযুর (দঃ) একজন একজন করে নাম ধরে ধরে বললেন- তুমি দাঁড়াও এবং বদরী সাহাবীর জন্য জায়গা করে দাও। এভাবে যতজন বদরী সাহাবী দাঁড়ানো ছিলেন- ততজনকে তুলে দিয়ে সে স্থানে আগতদের জায়গা করে দিলেন। এতে ঐসব সাহাবী মনে কষ্ট পেলেন। কেননা, তাঁদেরও ইচ্ছে ছিল হুযুরের নিকটবর্তী বসার। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের মনবেদনা টের পেলেন। নবীজীর নির্দেশ মেনে নিয়ে সম্মানীত সাহাবীদের জন্য সম্মান প্রদর্শন করার বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা উক্ত আয়াত নাযিল করে বললেন-
“তোমরা নবীজীর নির্দেশে তোমাদের সম্মানীত বদরী সাহাবীদের জন্য জায়গা ছেড়ে দিয়েছো- আল্লাহ তোমাদের জন্য বেহেস্তের মধ্যে এর চেয়েও প্রশস্ত জায়গা ছেড়ে দেবেন” ।
আল্লামা সাভী মন্তব্য করেন
“আয়াতখানা যদিও কতিপয় সাহাবীর শানে নাযিল হয়েছে- কিন্তু এর দ্বারা সমস্ত উম্মতকেই শিক্ষা দেয়া হয়েছে। শানে নুযুল খাস হলেও হুকুম ছিল আম বা ব্যাপক। সুতরাং ইলমের মজলিস, যিকিরের মজলিস, নামাযের জামাত, যুদ্ধক্ষেত্র ও অন্যান্য নেক কাজের সমস্ত মজলিস অত্র আয়াতের অন্তর্ভুক্ত । যে কোন ভাল মজলিসে দাঁড়াতে বললে তা মেনে নিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হবে”।
(সাভী)
মিলাদ মাহফিলও তদ্রূপ একটি উত্তম মাহফিল। এখানেও হুযুরের আগমনের বয়ান শুনামাত্র তাজিমার্থে দাঁড়িয়ে যেতে হবে। এটাই আয়াতের দাবী । সুতরাং কোরআনের আয়াতের দ্বারাও কিয়াম করা উত্তম বলে প্রমাণিত হলো।
লোক তুলে দিয়ে সেখানে বসার মাসআলাঃ
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, কোন মজলিসে পূর্ব হতে কোন লোক বসা থাকলে তাকে তুলে দিয়ে ঐ স্থানে পরে আগত কোন লোককে বসানো মাকরূহ। এটা হাদীসেও উল্লেখ আছে। যেমন- হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন।
[আরবী]
অর্থাৎ : নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- “তোমাদের কেউ যেন অন্য লোককে তার বসার স্থান থেকে তুলে না দেয় এবং নিজে যেন ঐ স্থান দখল না করে- বরং তোমরা নিজেরা স্বেচ্ছায় আগতদের জন্য জায়গা প্রশস্ত করে দিও। আর জুমার দিনে তোমাদের কেউ যেন আপন ভাইকে তার জায়গা থেকে তুলে দিয়ে নিজে সেখানে না বসে বরং সে যেন বলে- দয়া করে একটু জায়গা করে দিন”।
(মিশকাত বাবুল কিয়াম, তাফসীরে সাভী ২৮ পারা সুরা মুজাদালাহ উল্লেখিত আয়াত)
আল্লামা সাভী এই হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন
এতে বুঝা গেল যে, আগত ব্যক্তি বসা ব্যক্তিকে জোর করে উঠিয়ে দিতে পারবে না। তবে একটু জায়গা করে দিতে অনুরোধ করতে পারবে। কিন্তু বসা ব্যক্তি যদি কোন বুযুর্গ বা গণ্যমান্য বা বয়সে বড় কোন লোকের বসার জন্য স্বেচ্ছায় জায়গা ছেড়ে দেয় অথবা মজলিসের মুরুব্বীদের মধ্যে কেউ যদি কোন মহৎ কারণে কাউকে তুলে দিয়ে অন্যকে সে জায়গায় বসায়- তা হলে ধর্মীয় দৃষ্টিতে কোন ক্ষতি নেই। এটা অবস্থার উপর নির্ভরশীল। দেখুন! নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরে আগত বদরী সাহাবীদের সম্মানে অন্যকে উঠিয়ে দিয়ে সে জায়গায় তাঁদেরকে বসতে দিয়েছিলেন। অবস্থার উপর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দোষণীয় নয় ।
আল্লামা সাভী তারপর বলেন
“তোমাদেরকে দাঁড়িয়ে যেতে বললে তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে যাবে”- আল্লাহর এই নির্দেশ নামায় এবং অন্যান্য ধর্মীয় নেক কাজের ক্ষেত্রে সমভাবে সর্বত্র প্রযোজ্য। যেমন- জেহাদ ও অন্যান্য নেক কাজ। উক্ত আয়াতের আর একটি ব্যাখ্যা হলো- “যখন তোমাদেরকে বলা হবে- “সরে গিয়ে জায়গা করে দাও” তখন তোমরা আসন বা জায়গা ছেড়ে দিয়ে আগত ভাইদের জায়গা করে দিবে”।
(সাভী)
এতেই প্রমানিত হয়- মিলাদে কিয়ামের জন্য ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র দাঁড়িয়ে যেতে হবে । এটাই কোরআনের হুকুম ও নির্দেশ। এরূপ কিয়াম মোস্তাহসান ।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(১৫) মিলাদুন্নবীর বৈধতার ফতোয়া | (১৭) কিয়ামের প্রকারভেদ |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |