ইবনে দিহইয়ার পরে মিলাদুন্নবীর উপর অজস্র নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ রচিত হয়েছে। তন্মধ্যে আমরা নীচে কয়েক খানা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ও গ্রন্থকারের বক্তব্যের সারাংশ সহ পাঠক সমাজের কাছে উপস্থাপন করবো। তাতেই প্রমাণিত হয়ে যাবে মিলাদুন্নবী মাহফিলের বৈধতা এবং খুলে যাবে বিরোধীদের মুখোশ ।
[আরবী]
অর্থ : ছিবতু ইবনুল জাওজী মিরআতুজ জামান গ্রন্থে বর্ণনা করে বলেছেন যে, “বাদশাহ মুজাফফর উদ্দীন কর্তৃক আয়োজিত কোন এক মিলাদ মাহফিলে যোগদানকারী জনৈক ব্যক্তি আমি ইবনুল জাওজীর কাছে এই বর্ণনা দিয়েছেন যে, তিনি উক্ত মাহফিলে পরিবেশনের উদ্দেশ্যে প্রস্তুত কৃত পাঁচ হাজার ভূনা ছাগল, দশ হাজার মুরগী, এক লক্ষ পনির, ত্রিশহাজার হালুয়ার প্লেট গননা করেছেন। ঐ মাহফিলে গণ্যমান্য ওলামা ও সুফীগণ শরীক হতেন। বাদশাহ ঐ সব ওলামা ও সুফীগণের সাথে সৌজন্য মূলক আচরণ করতেন এবং তাদেরকে বিভিন্ন উপঢৌকন উপহার দিয়ে সম্মান প্রদর্শন করতেন।
(মিরআতুজ্জামান- ছিবতু ইবনুল জাওজী)
[আরবী]
অর্থ : “বাদশাহ মুজাফফর উদ্দীন প্রতি বৎসর মিলাদুন্নবী উপলক্ষে ত্রিশ হাজার স্বর্ণ মুদ্রা ব্যয় করতেন ।”
[আরবী]
অর্থ : আল্লামা শামছ ইবনে জাজরী বলেন : “মিলাদুন্নবী মাহফিলে মিশর এবং সিরিয়া বাসীগণ অন্যান্য লোকদের তুলনায় অধিক দান খয়রাত করে থাকেন। তিনি (শামছ) মিশরের সুলতান জাহের বারকুক এবং তাঁর আমির উমারাগণকে মিশরের দূর্গে মিলাদুন্নবীর রাতে প্রচুর খাদ্য বিতরণ, তিলাওয়াতে কোরআন, ফকির মিসকীন, কারী ও, নাত পরিবেশনকারী গণের প্রতি প্রচুর দান-খয়রাত করতে প্রত্যক্ষ করেছেন। এক্ষেত্রে বাদশাহ দশ হাজার মিছকাল স্বর্ণমুদ্রা ব্যয় করতেন। অন্যান্য ওলামাগণ বলেছেনঃ সুলতান জাহের আবু সাঈদ জকমক মিলাদুন্নবীতে উপরোক্ত বাদশাহর চেয়েও বেশী খরচ করতেন। স্পেন ও হিন্দুস্তানের বাদশাহগণও-এর কাছাকাছি বা-এর চেয়েও বেশী খরচ করতেন”-
(সূত্র আন নে'মাতুলকোবরা)
[আরবী]
অর্থঃ আল্লামা ইবনে হাজর হায়তামী তাঁর আন-নে’মাতুল কোররা গ্রন্থে লিখেছেন : ইমাম আবু শামা- ওস্তাদ ইমাম নাওয়াভী (রহঃ) মিলাদুন্নবীর রাতে বাদশাহ মুজাফফর উদ্দীন কর্তৃক বিভিন্ন উত্তম কার্য্যাবলী সম্পাদনের জন্য তাকে প্রচুর প্রশংসা করেছেন ।
(তাঁর গ্রন্থের নাম “আল বাওয়ায়েছ আলা ইনকারিল বিয়ে ওয়াল হাওয়াদিস”)। আর এই ইমামের মত লোকের প্রশংসাই সবচেয়ে বড় দলীল যে, মিলাদুন্নবীর অনুষ্ঠান উত্তম।
(আন নে'মাতুলকোবরা)
[আরবী]
অর্থঃ ইবনে জাওজী বলেছেনঃ মিলাদুন্নবী অনুষ্ঠানের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য এই ঐ বৎসরের জন্য অনুষ্ঠান স্থলটি বিপদ আপদ থেকে নিরাপদে থাকবে এবং অনুষ্ঠান কারীর মকসুদ শীঘ্র পূরন হওয়ার ব্যাপারে শুভ সংবাদ বহন করে আনবে” ।
[আরবী]
অর্থঃ মোহাক্কিক ওলামা গণের শিরোমনি নূরুদ্দীন আলী হলবী তাঁর গ্রন্থ 'ইনসানুল উয়ুন ফি সীরাতিল আমিনিল মামুন' (দঃ)- এর মধ্যে এবং ইমাম বুরহান উদ্দীন ইবরাহীম হলবী 'রুহুস সিয়ার' গ্রন্থে উপরে বর্ণিত মিলাদুন্নবীর ফজিলত অধিকাংশ বর্ণনা করার পর আরও অতিরিক্ত লিখেছেন যে, নবী করিম (দঃ)-এর পবিত্র বেলাদত (ভুমিষ্ট) বর্ণনা শ্রবন করে দাঁড়িয়ে কেয়াম করা মোস্তাহসান বা উত্তম। তাঁরা -এর সপক্ষে দলীলও পেশ করেছেন।
(সূত্র : জওয়াহিরুল বিহার ৩য় খন্ড ৩৩৯ পৃষ্ঠা)
[আরবী]
অর্থঃ হাফেজুল হাদীস আল্লামা ইবনে হাজর আসকালানী (রহঃ) জনৈক প্রশ্নকারীর জবাবে বলেনঃ 'আমার মতে মিলাদন্নবী পালনের প্রথা সুন্নাতের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। উহা হলো আশুরার রোজা। বোখারী ও মুসলিম শরীফে হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, নবী করিম (দঃ) হিজরত করে মদিনায় এসে দেখতে পেলেন - ইয়াহুদীরা আশুরার দিনে রোজা পালন করছে। তিনি এর কারণ তাদের নিকট জানতে চাইলেন। তারা উত্তরে বললোঃ এই দিনেই আল্লাহ তায়ালা ফেরাউনকে নদীতে ডুবিয়ে মেরেছেন এবং মুসা আলাইহিস সালামকে মুক্তি দিয়েছেন। আমরা (ইয়াহুদীরা) উক্ত নেয়ামতের শুকরিয়া স্বরূপ এই দিনে রোজা পালন করে থাকি । আল্লামা ইবনে হাজর এই হাদীস বর্ণনা করে বলেন : -এর দ্বারাই প্রমাণিত হলো যে আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক কোন নেয়ামত প্রদানের বিনিময়ে ঐ নির্ধারিত দিবসে শুকরিয়া আদায় করা উত্তম। নবী করিম (দঃ) -এর আবির্ভাবের চেয়ে বড় নেয়ামত আর কি হতে পারে? এই নেয়ামত প্রাপ্তির শুকরিয়া আদায় হতে পারে বিভিন্ন এবাদতের মাধ্যমে- যথাঃ নফল নামাজ, নফল রোজা, দান-খয়রাত, তিলাওয়াত ইত্যাদি।"
জাওয়াহিরুল বিহার ৩৪০ পৃঃ
[আরবী]
অর্থঃ “আল্লামা বুরহান উদ্দীন হলবী তার রূহুস সিয়ার গ্রন্থে হাফেজ ইমাম ইবনে হাজর আসাকালানীর মন্তব্য এভাবে উদ্ধৃত করেছেনঃ- “নবী করিম (দঃ)-এর জন্ম উপলক্ষে উত্তম কাজ, আনন্দ প্রকাশ ও তাঁর প্রতি মহব্বৎ প্রদর্শনের ইচ্ছা পোষণকারী ব্যক্তিদের পক্ষে একাজ করাই যথেষ্ট যে, নেককার বুজুর্গ ব্যক্তি এবং ফকির মিসকিনকে একত্রিত করে নবীজীর মহব্বতে তাঁদেরকে খানা খাওয়াবে এবং হাদিয়া দেবে । আরো অধিক কিছু করতে চাইলে নবী প্রশংসাকারী গায়ক ও শায়ের ডেকে এনে এমন সব নাত ও কবিতা পরিবেশন করাবে, যা মানুষকে উত্তম চরিত্রের দিকে উদ্বুদ্ধ করে, মনকে ভাল কাজের দিকে আকর্ষন করে এবং বিদ্আত ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে”।
(জাওয়াহিরুল বিহার পৃষ্ঠা ৩৪০)
মিলাদ মাহফিলে ওয়াজ ও নাত পেশ করা উত্তম ।
[আরবী]
অর্থঃ “হাদীস ও ফেকাহ বিশারদ ইমামগণ নবী করিম (দঃ)-এর বেলাদত শরীফ (আবির্ভাব) বর্ণনাকালে পাঠক ও শ্রোতা সকলের জন্য দাঁড়িয়ে যাওয়া বা কেয়াম করাকে মোস্তাহসান বলে ফতোয়া দিয়েছেন। সুতরাং যাদের মকসুদ ও উদ্দেশ্য হচ্ছে নবীজীর তাজিম প্রদর্শন, তাদের জন্য এই কেয়াম হচ্ছে শুভ সংবাদ বহন কারী”
(মৌলুদে বরজিঞ্জি)
বরজিঞ্জি আল্লামা ইবনে কাছিরেরও পূর্বের মোজতাহিদ ও ইমাম ছিলেন। (বেদায়া ও নেহায়া দ্রষ্টব্য)
[আরবী]
অর্থঃ “আল্লামা আবু শামা (রহঃ) বলেনঃ আমাদের যুগে নবী করিম (দঃ)-এর জন্ম দিবস উপলক্ষে প্রতি বৎসর ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখে দান সদকা, বিভিন্ন নেকীর কাজ ও আনন্দ-উল্লাসের (জুলুছ ও মাহফিলের মাধ্যমে) অনুষ্ঠানাদি করার যে সুন্দর ও উত্তম রেওয়াজ প্রচলিত হয়েছে, এগুলো উক্ত অনুষ্ঠানকারীর অন্তরে নবী করিম (দঃ)-এর প্রতি মহৎ ও তাজীমেরই প্রমাণবহ এবং নবী করিম (দঃ)-এর আবির্ভাবের মাধ্যমে আল্লাহর অশেষ এহসানের প্রতি শোকর আদায়েরই ইঙ্গিত বাহী কাজ । তদুপরি, এই মিলাদুন্নবীর অনুষ্ঠান কাফের ও মোনাফিকদের প্রতি মোমেনদের মনের ঘৃণা প্রকাশও বটে- যা ঈমানেরই অঙ্গ”।
(আল বাওয়ায়েছ আলা ইনকারিল বিদয়ী ওয়াল হাওয়াদিছ- আল্লামা আবু শামা)
[আরবী]
অর্থঃ হাফেজ আবুল খায়ের সামছুদ্দীন ইবনে জাজরী বলেন : “যে আবু লাহাবের বিরুদ্ধে কোরআন মজিদ নাজিল হয়েছে, এমন ব্যক্তিকেও জাহান্নামে (কবরে) থাকা অবস্থায় কিছু পুরস্কৃত করা হচ্ছে । অর্থাৎ তার আঙ্গুলের মাথা হতে পানি বের করে তাকে পান করানো হচ্ছে— এবং প্রতি সোমবারের পূর্ব রাত্রিতে তার কবরের আজাব হালকা করে দেয়া হচ্ছে একটি মাত্র কারণে। তা হচ্ছে- সে আপন দাসী ছোয়াইবা কর্তৃক নবী করিম (দঃ)-এর জন্মের শুভ সংবাদ শুনে খুশী হয়ে তাকে আজাদ করে দেয় । এমতাবস্থায় নবী করিম (দঃ)-এর একজন তৌহিদ পন্থী উম্মতের অবস্থা কেমন হতে পারে- যিনি নবীজীর জন্ম উপলক্ষে খুশী হন এবং সামর্থ অনুযায়ী খরচ করেন? আমি (সামছ) নিজের জীবনের শপথ করে বলছি- দয়াল আল্লাহর পক্ষ হতে তার একমাত্র পুরস্কার হচ্ছে- আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহের মাধ্যমে এই বান্দাকে জান্নাতুন নায়ীমে প্রবেশ করাবেন” ।
(জাওয়াহিরুল বিহার- আল্লামা ইউসুফ নাবহানী পৃষ্ঠা ৩৩৮ সূত্র নাসরুদ)
খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগেও মিলাদুন্নবী পাঠ করার রেওয়াজ ছিল বলে ইবনে হাজর হায়তামী বর্ণিত রেওয়ায়াতে প্রমাণিত হয়। রেওয়ায়াতটি নিম্নরূপঃ
[আরবী]
অর্থ : হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) বলেছেন : “যে ব্যক্তি মিলাদুন্নবী (দঃ) পাঠ করার জন্য এক দিরহাম পরিমাণ অর্থ খরচ করবে, সে ব্যক্তি বেহেস্তে আমার সাথী হবে” । হযরত ওমর (রাঃ) বলেছেন : “যে ব্যক্তি মিলাদুন্নবীর তাজীম ও সম্মান করলো, সে ইসলামকেই জীবিত রাখলো”। হযরত ওসমান (রাঃ) বলেছেন : “যে ব্যক্তি মিলাদুন্নবী পাঠ করার জন্য এক দিরহাম পরিমাণ অর্থ খরচ করলো, সে যেন বদর ও হোনায়নের যুদ্ধে শরীক হলো”। হযরত আলী (রাঃ ও কঃ) বলেছেন : “যে ব্যক্তি মিলাদুন্নবীর সম্মান করবে এবং মিলাদুন্নবী পাঠ করার উদ্যোক্তা হবে, সে দুনিয়া থেকে (তওবার মাধ্যমে) ঈমানের সাথে বিদায় হবে এবং বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে”।
(আন নে'মাতুল কোবরা ৭-৮ পৃষ্ঠা)
আল্লামা ইবনে হাজর হায়তামী মক্কী (রহঃ) মোহাদ্দেস ও মুক্তী হিসাবে সমগ্র মুসলিম জাহানে প্রসিদ্ধ । তিনি নিজ সনদে উক্ত রেওয়ায়াত খানা নিজ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। সুতরাং রেওয়ায়াতটি নির্ভরযোগ্য। উক্ত রেওয়ায়াতে কয়েকটি বিষয় প্রমাণিত হয়েছে। যথা :
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(১৪) বাদশাহ মুজাফফর উদ্দীন কেমন লোক ছিলেন? | (১৬) মিলাদের মধ্যে কিয়াম |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |