“পবিত্র রবিউল আউয়াল মাসে ঈদে মিলাদুন্নবীর (দঃ) অনুষ্ঠান বর্তমানে প্রচলিত নিয়মে আনুষ্ঠানিকভাবে আরম্ভ হয় ৬০৪ হিজরীতে। তৎকালীন ইমাম ও মোজতাহিদ তকিউদ্দীন সুবকী মিশরী (রহঃ) ছিলেন সে যুগের শ্রেষ্ঠ মুজতাহিদ ও ইমাম। একদিন তাঁর দরবারে সে যুগের বিখ্যাত ওলামায়ে কেরামের সমাবেশ ঘটেছিল। ইমাম তকিউদ্দীন (রহঃ) তাঁদের উপস্থিতিতে নবী করিম (দঃ)-এর প্রশংসামূলক ইমাম ছরছরি (রহঃ) রচিত দুলাইন কবিতা পাঠ করেন। পংতি দুটি ছিল নিম্নরূপঃ
[আরবী]
অর্থাৎ “সুন্দরতম কিতাবের পাতায় স্বর্ণাক্ষরেও যদি নবী মোস্তফার নাম অঙ্কন করা হয়, তবুও তাঁর বিশাল মর্যাদার তুলনায় তা অতি তুচ্ছ। অনুরূপভাবে শুধু তাঁর নাম শুনেও যদি উচ্চ পর্যায়ের লোকেরা সারিবদ্ধভাবে কিয়ামসহ দাঁড়িয়ে যায়, অথবা আরোহী অবস্থায় নতজানু হয়ে যায়, তবুও তাঁর মহান মর্যাদার তুলনায় তা অতি সামান্যই হবে” ।
—ছরছরি
ছরছরির কবিতার উক্ত পংতি দুটো পাঠ করার সময়ে ইমাম তকিউদ্দীন সুবকী ও উপস্থিত ওলামায়ে কেরাম নবীজীর সম্মানে দাঁড়িয়ে গেলেন । মজলিশে নবী প্রেমের ঢেউ খেলে গেলো। সকলেই ভাবের আবেগে আপ্লুত হলেন। মিলাদ শরীফে কেয়ামের বৈধতার ক্ষেত্রে ইমাম তকিউদ্দীন সুবকি ও উপস্থিত ওলামায়ে কেরামের উক্ত কেয়ামের অনুসরণ করাই যথেষ্ট। কেননা, এই কেয়াম হলো শুভ সংবাদ উপলক্ষে তাজীমী কেয়াম। নবীজীর উপস্থিতি এখানে শর্ত নয়— যদিও তিনি উপস্থিত হতেও পারেন। (তাফসীরে রুহুল বয়ান ৯ম খন্ড-৫৬ পৃষ্ঠা দেখুন)
প্রথা ও অনুষ্ঠান হিসাবে নূতন হলেও মিলাদ ও কিয়ামের মূল ভিত্তি হচ্ছে কোরআন ও সুন্নাহ! কেননা রোজে আজলে আল্লাহ তায়ালা মিলাদ বর্ণনাকালে আম্বিয়ায়ে কেরামের মাহফিলের ইনতেজাম করেছিলেন এবং নিজে ছিলেন সভাপতি। অনুরূপভাবে আম্বিয়ায়ে কেরাম আপন আপন উম্মতের মাহফিলে মিলাদুন্নবীর আলোচনা করেছেন বলে কোরআনেই সুরায়ে সাফ ২৮ পারায় উল্লেখ আছে। পরবর্তীকালে (৬০৪ হিজরী) শুধু আনুষ্ঠানিকতার বিষয়টি নূতন হওয়ার কারণে বিদআতে হাসানা ও মোস্তাহাব-এর পর্যায়ভুক্ত হয়েছে বলে সকল উলামায়ে কেরাম ঐক্যমত পোষণ করেছেন। এ কারণে মিলাদ ও কিয়াম সকল উলামায়ে কেরামের ইজমার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও সর্বত্র অনুসৃত । মুসলমানদের সর্বোৎকৃষ্ট শ্রেণীর উলামাদের ইজমার গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে কোরআন মজিদে-এরশাদ হয়েছে :
[আরবী]
অর্থাৎ “রাসুলের কাছে হেদায়াত প্রকাশিত হওয়ার পরে যে কেউ তাঁর বিরুদ্ধাচারণ করে— এবং সব মুসলমানের অনুসৃত পথের বিরুদ্ধে যে কেউ বলে, আমি তাকে ঐ পথেই চালাবো যে পথ সে অবলম্বন করেছে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো । আর জাহান্নাম হচ্ছে নিকৃষ্টতম স্থান” ।
সুরা নিসা আয়াত ১১৫
উক্ত আয়াতে রাসুলের বিরোধিতা এবং মুসলমানদের অনুসৃত ঐক্যমতের বিরোধিতা- উভয়টির পরিণামই জাহান্নাম । মিলাদ ও কিয়াম সকল মুসলমানের অনুসৃত পথ। সুতরাং-এর বিরোধিতার পরিণামও ভয়াবহ। সকলের অনুসৃত পথকে ইজমায়ে উম্মত বলা হয়। নবী করিম (দঃ) এরশাদ করেছেন :
[আরবী]
অর্থাৎ “আমার সকল উম্মত একটি গোমরাহীর কাজে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না”।
সুতরাং মিলাদ ও কিয়াম যে গোমরাহী নয়- সকল উম্মতের দ্বারা তা অনুসৃত ও গৃহীত হওয়াই-এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। নূরুল আনওয়ার গ্রন্থে ইজমা অধ্যায়ে উপরের আয়াতকে ইজমায়ে উম্মতের একটি অকাট্য দলীল হিসাবে পেশ করা হয়েছে। একবার কোন বিষয়ে ইজমা হয়ে গেলে পরবর্তী যুগে কেউ-এর বিরোধিতা করলে বা ইখতিলাফ করলেও তা গ্রহণযোগ্য হবেনা- বলে উক্ত কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে- যদিও বিরোধিদলের সংখ্যা পরবর্তীকালে বেশীই হোক না কেন। পরবর্তী কালে মিলাদ ও কেয়ামের বিরুদ্ধে মালেকী মাযহাবের শেষ যুগের একজন আলেম আল্লামা তাজুদ্দীন ফাকেহানী মালেকী মিলাদ ও কিয়ামকে বিভিন্ন কারণে নিকৃষ্টতম বেদআত বলে উল্লেখ করেছেন । যেমন- গান-বাজনার সংযোজন, মেয়েলোকদের বেপর্দায় উপস্থিতি, উচ্চস্বরে তাদের না'ত পাঠ করা ও কসিদা পাঠ করা— ইত্যাদি। এগুলো তার যুগে মিলাদ ও কেয়ামের মধ্যে অনুপ্রবেশের কারণেই তিনি সে যুগের প্রচলিত মিলাদ কেয়ামকে নাজায়েয বলেছেন । মালেকী মাজহাবের অন্যান্য ওলামায়ে কেরাম সহ চার মাজহাবের শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরাম তাজুদ্দীন ফাকেহানীর উক্ত ফতোয়া খন্ডন করে মিলাদ-কেয়ামের পক্ষে বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। ইবনে হাজর আসকালানী ও জালালুদ্দীন সুয়ুতি তাদের মধ্যে অন্যতম। সুতরাং কিছু কারণে তাজুদ্দীন ফাকেহানীর বিরোধিতা ইজমার সিদ্ধান্ত বাতিল করতে পারে না ।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(১০) মিলাদ ও কিয়াম ফেরেস্তাগণের সুন্নাত | (১২) মিলাদ ও কিয়ামের মূল ভিত্তি (এক নজরে) |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |