পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠানের মূল ভিত্তি হচ্ছে কোরআন ও হাদীস। সর্বপ্রথম আল্লাহ তায়ালা রোজে আজলে আম্বিয়ায়ে কেরামের সম্মেলন ডেকে নবী করিম (দঃ)-এর শান-মান, তাঁর উপর ঈমান আনয়নের প্রয়োজনীয়তা, দুনিয়াতে তাঁর আগমনী বার্তা প্রচার করা— ইত্যাদি বিষয়ে তাঁদের অঙ্গীকার আদায় করেছিলেন। এভাবে আল্লাহ তায়ালা নিজেই ঐ মাহফিল পরিচালনা করেছিলেন । সুরা আলে-ইমরানের ৮১-৮২ নং দীর্ঘ দুটি আয়াতে আল্লাহ পাক এ মিলাদ অনুষ্ঠান করার ঘোষণা দিয়েছেন। সুতরাং মিলাদ মাহফিলের অনুষ্ঠান স্বয়ং আল্লাহর সুন্নাত বা তরিক্বা । মাহফিলটি ছিল নবীগণের । যা-তা মাহফিল নয় । সুতরাং কেয়ামসহ মিলাদ মাহফিল করা নবীগণেরও সুন্নাত বা তরিকা। এই মাহফিল ছিল হুজুর আকরাম (দঃ)-এর আবির্ভাবের কোটি কোটি বছর পূর্বেকার ।
সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরাম দুনিয়াতে এসে তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রধান দায়িত্ব হিসাবে হুজুর (দঃ)-এর সানা সিফাত কেয়াম অবস্থায় বর্ণনা করেছেন এবং শেষ যুগে তাঁর আবির্ভাবের (মিলাদের) আগাম শুভ সংবাদ ঘোষণা করেছেন । হযরত আদম (আঃ) নিজ পুত্র শীস পয়গাম্বরকে নসিহত ও অসিয়তের মাধ্যমে নবীজীর নূরের তাজীম মান ও বিভিন্ন পদমর্যাদার উল্লেখ করে তিনি আরবদেশে হযরত ইসমাইলের (আঃ) বংশে নবীজীকে প্রেরণের জন্য খোদার কাছে আরজি পেশ করেছিলেন। এটা হয়েছিল কেয়াম অবস্থায় । (সূত্র ইবনে কাছির বেদায়া ও নেহায়া, ২য় খন্ড ২৬১ পৃষ্ঠা)
সুতরাং মিলাদ ও কিয়ামের মূল প্রমাণ ও ভিত্তি পাওয়া যায় কোরআন মজিদের সুরা বাক্বারার ১২৯ নম্বর আয়াতে। আর এই মিলাদ ও কিয়ামের বয়স হলো নবীজীর জন্মেরও চার হাজার বছর পূর্বে। সুতরাং মিলাদ ও কিয়ামের প্রচলন নবীজীর পরে নয় বরং জন্মের বহু পূর্ব হতে। মিলাদ ও কিয়ামের জন্য নবীজীর উপস্থিতি কোন শর্ত নয় । মিলাদ ও কিয়াম হচ্ছে আগমনী শুভ সংবাদে নবীজীর প্রতি তাজীম প্রদর্শন করা। হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর পর হযরত ইছা (আঃ) নবী করিম (দঃ)-এর মিলাদ পাঠ করেছেন বনী ইস্রাইলকে নিয়ে। তাদের মাহফিলে ভাষণরত অবস্থায় দাঁড়িয়ে তিনি ঘোষণা করেছিলেন-
“আমি এমন এক মহান রসুলের আবির্ভাবের শুভ সংবাদ তোমাদেরকে দিচ্ছি- যিনি আমার পরেই আগমন করবেন এবং তাঁর পবিত্র নাম হবে আহমদ (দঃ)” ।
সুরা আস-সাফ ৬ নম্বর আয়াতে এই মিলাদ মাহফিলের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছিল জেরুযালেমে এবং নবীজীর জন্মের ৫৭০ বৎসর পূর্বে।
সুতরাং আমরা গভীর পর্য্যালোচনায় দেখতে পেলাম- মিলাদ ও কিয়াম যে কোন আকৃতি ও প্রকৃতিতেই হোকনা কেন- তা হচ্ছে নবীগণের সুন্নাত। আকৃতি ও প্রকৃতি যুগে যুগে পরিবর্তন, - বিবর্ধন ও পরিমার্জন হতে পারে- কিন্তু মূলনীতির কোন পরিবর্তন হতে পারেনা। যেমন- জেহাদ ও রণকৌশল পরিবর্তন হতে পারে এবং তার উপাদানও পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু মূল জেহাদ ও যুদ্ধের নীতিমালার কোন পরিবর্তন হতে পারে না। আমাদের প্রিয় নবী (দঃ) নিজেই নিজের মিলাদ পাঠ করেছেন সাহাবীদের নিয়ে। সাহাবায়ে কেরামের সমাবেশে মিম্বারে দাঁড়িয়ে, এমন কি যুদ্ধ ক্ষেত্রেও তিনি দন্ডায়মান অবস্থায় তাঁর পবিত্র বেলাদতের দিন তারিখ ও বংশ মর্য্যাদা বয়ান করেছেন এবং নিজের উপর নিজে দরূদ ও সালাম পাঠ করেছেন। যেমন আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া, শিফা শরীফ ইত্যাদিতে বর্ণিত আছে
“হুজুর (দঃ) ভাষণ দানরত অবস্থায় তাঁর নূরের সৃষ্টি, দুনিয়াতে নবীগণের মাধ্যমে তাঁর আগমন, তাঁর বংশ মর্য্যাদা এবং বংশ তালিকা ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং মসজিদে প্রবেশ কালে প্রথমে নিজের উপর দরূদ শরীফ ও তার পর মসজিদে প্রবেশের দোয়া পাঠ করেছেন। (কিতাবু শিফা দরুদ অধ্যায় দ্রষ্টব্য) মসজিদে প্রবেশ কালে তিনি বলতেনঃ “সাল্লাল্লাহু আলা মোহাম্মদ -- আল্লাহুম্মাফতাহলী আবওয়াবা রাহমাতিকা”। অনুরূপভাবে মসজিদ থেকে বের হতে পাঠ করতেনঃ “সাল্লাল্লাহু আলা মোহাম্মদ- আল্লাহুম্মা ইন্নি আছআলুকা মিন ফাদলিকা”।
(শিফা শরীফ)
উল্লেখ্য যে, তিনি কেয়াম বা দন্ডায়মান অবস্থায়ই এই দরুদ ও দোয়া পাঠ করতেন। মুসলমানগণও তাঁর পবিত্র আগমনী বর্ণনা আদ্যোপান্ত পাঠ করে শুভ সংবাদের শুকরিয়া স্বরূপ তাজীমের সাথে কেয়াম করে এবং দরূদ ও সালাম পাঠ করে থাকেন। ইহাই প্রচলিত মিলাদ ও কিয়াম। সুতরাং যারা মিলাদ ও কিয়ামকে খারাপ বলে মনে করে, তারা প্রকারান্তরে খোদা,-নবী ও রাসুলগণকেই খারাপ বলে ও সমালোচনা করে।
সাহাবায়ে কেরামগণের মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠানের ধরন ও নিয়ম সম্পর্কে আমার পুস্তক “ঈদে মিলাদুন্নবী”তে বিস্তারিত দলীলসহ আলোচনা করেছি। ইতিপূর্বেও অত্র পুস্তকে সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে। কোরআন ও হাদীসে মিলাদ এবং কিয়ামের মূল সূত্র বর্ণিত হয়েছে মাত্র। পরবর্তীকালে যুগের চাহিদা অনুযায়ী স্বতন্ত্রভাবে মিলাদ ও কিয়ামের পৃথক মাহফিলের প্রচলন শুরু হয়েছে। যেমন প্রচলন হয়েছে জামাতের সাথে বিশ রাকআত তারাবিহ, কোরআন একত্রিকরণ, কোরআন সংকলন, জুমুয়ার প্রথম আজান, আরবী ব্যাকরণ, কোরআনের নোকতা ও হরকত সংযোজন, রুকু, পারা মনজিল ইত্যাদি- যা নবীযুগে ছিলনা। নবী যুগের পরে সংযোজিত হওয়ার কারণে এগুলো বিদআতে হাসানার অন্তর্ভুক্ত হয়ে কোনটি ওয়াজিব, কোনটি সুন্নাত, কোনটি মোস্তাহাব হয়েছে। তারাবিহ জামায়াতের সাথে প্রচলন করেছেন হযরত ওমর (রাঃ) এবং এটি সুন্নাতে মোয়াক্কাদা। জুমার প্রথম আজান প্রচলন করেছেন হযরত ওসমান (রাঃ) এবং এটি সুন্নাত। আরবী ব্যাকরণ প্রচলন করেছেন হযরত আলী (রাঃ) এবং এটি শিক্ষা করা ওয়াজিব। কোরআনের নোকতা, হরকত সংযোজন করেছে হাজজাজ বিন ইউসুফ উমাইয়া শাসক ৮৬ হিজরীতে এবং এটা মোস্তাহাব। সব মিলিয়ে এগুলোকে বিদআতে হাসানা বলা হয়। তাই বলে কি এগুলো পরিত্যাজ্য? কখনও নয়। মিলাদ এবং কিয়ামের প্রচলনও অনুরূপভাবে মোস্তাহাব পর্যায়ের বিদআত- যদিও তা ৬০৪ হিজরীতে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে। ইমাম ইবনে হাজর হায়তামী (রহঃ) বলেন :
[আরবী]
অর্থ : বিদআতে হাসানার কাজ মোস্তাহাব হওয়ার উপর সকল ওলামার ঐক্যমত হয়েছে এবং মিলাদ শরীফের আমল এবং উহার উদ্দেশ্যে লোকদের মাহফিল করাও অনুরূপ মোস্তাহাব ।
তাফসীর রুহুল বয়ান ৯ম খন্ড পৃষ্ঠা ৫৬
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(১১) আনুষ্ঠানিক মিলদুন্নবীর ইতিহাসঃ ইজমার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত | (১৩) মিলাদের উপর লিখিত প্রথম স্বতন্ত্র কিতাব |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |