খোলাফায়ে রাশেদীনের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারটা তাঁদের খেলাফতের ক্রম অনুযায়ী জানতে হবে। হজরত আলী রা. অপেক্ষা হজরত ওসমান রা. হজরত ওসমান রা. এর চেয়ে হজরত ওমর রা. এবং হজরত ওমর রা. এর চেয়ে হজরত আবু বকর সিদ্দীক রা. শ্রেষ্ঠ ।
বিষয়টি হজরত মোজাদ্দেদে আলফে সানি র. অতি সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে বুঝিয়েছেন। তিনি বলেছেন
‘শায়েখায়েনের (হজরত সিদ্দীকে আকবর এবং হজরত ফারুকে আজম) শ্রেষ্ঠত্ব সাহাবা এবং তাবেয়ীগণের এজমা বা ঐকমত্য দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। যেমন আলেমগণ তাঁদের পূর্ববর্তী ইমামগণ থেকে সূত্রপরম্পরায় বর্ণনা করেছেন, যাঁদের মধ্যে ইমাম শাফী র. ও আছেন' ।
শায়েখ ইমাম আবুল হাসান আশআরী বলেছেন
নিশ্চয় সমস্ত উম্মতের উপর হজরত আবু বকর সিদ্দীক রা. শ্রেষ্ঠ, তৎপর শ্রেষ্ঠ হজরত ওমর রা.। এই সিদ্ধান্ত সঠিক, যথার্থ এবং অকাট্য ।
ইমাম জাহাবী বলেছেন, হজরত আলী রা. এর খেলাফতের সময়েই তাঁর নিকট থেকে বহুসংখ্যক ব্যক্তির মাধ্যমে একথা প্রকাশ্যে বর্ণিত হয়ে আসছে যে, হজরত আবু বকর রা. এবং হজরত ওমর রা. এই উম্মতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ' । তারপর তিনি এও বলেছেন ‘এই কথাটি হজরত আলী রা. এর সূত্রে আশিজনেরও বেশী বর্ণনাকারী বর্ণনা করেছেন'। এরপর তিনি বলেছেন, রাফেজীগণকে আল্লাহ্তায়ালা ধ্বংস করুন। তারা কতই না অজ্ঞ। ইমাম বোখারী হজরত আলী রা. থেকে বর্ণনা করেছেন ‘হজরত আলী রা. একবার বললেন, হজরত নবীয়ে করিম স. এর পরে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি মান্যবর আবু বকর, তারপর মান্যবর ওমর। তারপর আর একজন। তাঁর পুত্র মোহাম্মদ হানাফিয়া বললেন, তারপর আপনি? উত্তরে তিনি বললেন ‘আমি মুসলমানদের মধ্যে একজন মাত্র'।
ইমাম জাহাবী ও অন্যান্য ইমামগণ হজরত আলী রা. থেকে সহীহ্ হাদিস বর্ণনা করেছেন— তিনি বলেছেন,
‘সাবধান হও! আমার নিকট এই তথ্য উপনীত হয়েছে যে, অনেকেই আমাকে মান্যবর আবু বকর এবং মান্যবর ওমর থেকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে । এরকম মতাবলম্বী কাউকে পেলে আমি তাকে মিথ্যা দোষারোপকারী বলবো এবং তার প্রতি ওই শাস্তি প্রয়োগ করবো, যেরকম শাস্তি অপবাদকারীকে দেয়া হয়'।
ইমাম দারাকুতনী র. হজরত আলী রা. থেকে এই মর্মে হাদিস বর্ণনা করেছেন যে,
‘যে ব্যক্তিকে আমি শ্রদ্ধেয় আবু বকর এবং শ্রদ্ধাই ওমর অপেক্ষা আমাকে শ্রেষ্ঠ বলতে দেখবো, তাকে বেত্রাঘাত করবো— যেরকম বেত্রাঘাত করা হয় অপবাদকারীকে'।
এরকম কথা তাঁর নিকট থেকে এবং অন্যান্য সাহাবীগণের নিকট থেকে অনেকভাবে বর্ণিত হয়েছে। এছাড়াও শিয়াদের শীর্ষস্থানীয় ইমাম আবদুর রাজ্জাকও বলেছেন
‘আমি শায়েখায়েনকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করছি, যেহেতু হজরত আলী নিজে তাঁদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। নতুবা আমি তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি দিতাম না। আর আমার ধ্বংসের জন্য এটাই যথেষ্ট যে, আমি হজরত আলীকে ভালোবাসি এবং তাঁর বিরুদ্ধাচরণও করি'।
- এই বিষয়গুলি ‘সওয়ায়েক’ নামক গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত করা হলো ।
হজরত ওসমান রা. এর শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অধিকাংশ আলেমের মত এই যে, হজরত শায়েখায়েনের পর হজরত ওসমান রা. শ্রেষ্ঠ। তারপর হজরত আলী রা.। মুজতাহিদ ইমাম চতুষ্টয়ের মতও এরকম। এ বিষয়ে ইমাম মালেক র. এর দ্বিধা ছিলো। কিন্তু কাযী আয়াজ র. বলেছেন, পরে তিনি হজরত ওসমান রা. এর শ্রেষ্ঠত্বের দিকেই প্রত্যাবর্তন করেছিলেন । ইমাম কুরতুবী র. বলেছেন ‘এটাই সত্য ইনশাআল্লাহু তায়ালা' ।
ইমামে আজম র. বলেছেন ‘সুন্নত জামাতের দলভুক্ত হওয়ার চিহ্ন শায়েখায়েনকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করা এবং খাতানায়ন (হজরত ওসমান এবং হজরত আলী) কে ভালোবাসা’– একথায় হজরত ওসমান রা. এর শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়ে ইতস্ত তঃভাব বোঝা যায়। কিন্তু না। এরকম উক্তির অন্য কারণ আছে। অর্থাৎ খাতানায়নের খেলাফতের সময় অনেক রকম বিপর্যয় ঘটেছিলো, যার কারণে সাধারণের মন কলুষিত ও তমসাচ্ছন্ন হয়েছিলো। এসব দিকে লক্ষ্য রেখেই ইমাম আবু হানিফা খাতানায়নের প্রতি ‘ভালোবাসা' শব্দ প্রয়োগ করেছেন এবং তাঁদের মহব্বতকেই সুন্নতের চিহ্ন বলে ব্যক্ত করেছেন। এরকম নয় যে, হজরত ওসমান রা. এর শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে তিনি দ্বিধান্বিত ছিলেন। কেমন করে দ্বিধা থাকা সম্ভব? হানাফী মাজহাবের গ্রন্থসমূহ এই মন্তব্যে ভরপুর যে ‘খোলাফায়ে রাশেদীনের শ্রেষ্ঠত্ব খেলাফতের ক্রমানুসারে'।
ফলকথা, শায়েখায়নের শ্রেষ্ঠত্ব সঠিক ও অকাট্য। হজরত ওসমান রা. এর শ্রেষ্ঠত্ব সেরকম অকাট্য নয়। অবশ্য প্রশস্ত পথ এটাই যে, হজরত ওসমান রা. এর শ্রেষ্ঠত্ব অস্বীকারকারীকে, বরং শায়েখায়নের শ্রেষ্ঠত্ব অস্বীকারকারীকেও যেনো আমরা কুফরের নির্দেশ প্রদান না করি। বরঞ্চ বেদাতী এবং পথভ্রষ্ট বলে জানি যেহেতু এরকম ব্যক্তিকে কাফের বলার বিষয়ে আলেমগণের দ্বিমত আছে এবং এ বিষয়ে ঐকমত্যের ব্যাপারটিও সন্দিগ্ধ। কিন্তু তাঁদের ক্রমানুসারের শ্রেষ্ঠত্ব অস্বীকারকারী ব্যক্তি হতভাগ্য এজিদের সঙ্গী। অতএব, সাবধানতাহেতু তাকেও মালউন বা অভিশপ্ত বলতে ইতস্ততঃ করেছেন ।
খোলাফায়ে রাশেদীনকে কষ্ট প্রদানের কারণে আমাদের নবী স. ওই রকমই ব্যথিত হন, যেমন হজরত ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন রা. এর জন্য কষ্ট পেয়েছিলেন' ।
হজরত মোজাদ্দেদে আলফে সানি র. আরো বলেন ‘শরহে আকায়েদে নাসাফীর মধ্যে মাওলানা ছাআ'দউদ্দিন এই শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়ে যা ইনসাফ বলে ধারণা করেছেন, তা প্রকৃতপক্ষে ইনসাফ পদবাচ্য নয় এবং তিনি যেভাবে তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বকে নাকচ করতে চেয়েছেন, তা অমূলক । কেননা, আলেমগণের নির্ধারণ এই যে, সওয়াব বা পুণ্যের আধিক্য অনুযায়ী আল্লাহ্তায়ালার নিকট শ্রেষ্ঠ হওয়াই এখানে উদ্দেশ্য। প্রশংসার প্রাচুর্য অনুসারে নয়। যেহেতু সাহাবা এবং তাবেয়ীগণ থেকে তাঁদের পরবর্তীগণ হজরত আলী রা. এর যেরকম প্রশংসা বর্ণনা করেছেন, অন্য সাহাবীগণের সেরকম প্রচুর প্রশংসা বর্ণিত হয়নি। ইমাম আহমদ র. বলেছেন, হজরত আলীর মতো অন্য কোনো সাহাবীর এরকম প্রচুর প্রশংসা বর্ণিত হয়নি। এতদসত্ত্বেও তিনি পূর্ববর্তী খলিফাত্রয়ের শ্রেষ্ঠত্বের নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব, জানা গেলো যে, প্রশংসাপ্রশস্তি ছাড়াও শ্রেষ্ঠত্বের অন্য কারণ বিদ্যমান। ‘ওহী’ বা প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হওয়া যাঁদের প্রত্যক্ষগোচরে ছিলো, তাঁরাই প্রকাশ্যে এবং প্রকারান্তরে তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং তাঁরাই হচ্ছেন রসুল স. এর সাহাবীবৃন্দ (রদ্বিআল্লাহু আনহুম)। অতএব আকায়েদে নাসাফীর ব্যাখ্যাকারের ‘শ্রেষ্ঠত্বের উদ্দেশ্য যদি সওয়াবের আধিক্য হয়, তাহলে ইতস্ততঃ করার কারণ বর্তমান আছে'- এই বাক্যটি পরিত্যাজ্য। কেননা ইতস্ততঃ করার অবকাশ থাকতো, যদি সাহেবে শরিয়ত রসুল স. এর নিকটে এ বিষয়ে প্রকাশ্য প্রমাণ না থাকতো। অথবা ইঙ্গিতে অবগতি লাভ সম্ভব না হতো। অবগতির পর আর ইতস্ততঃ ভাব কেনো? অবগতি ব্যতিরেকে শ্রেষ্ঠত্বের নির্দেশ দানই বা কী করে সম্ভব?
তিনি আরো বলেন ‘ফতুহাতে মক্কিয়া' রচয়িতা বলেছেন, তাঁদের খেলাফতকালের ক্রম তাঁদের আয়ুষ্কাল অনুযায়ী'। তাঁর এই বাক্যটিও তাঁদের সমতুল্য হওয়ার ইঙ্গিত করে না। যেহেতু খেলাফত পৃথক বস্তু এবং শ্রেষ্ঠত্ব পৃথক । যদি সমতুল্য হওয়াটা মেনে নেওয়া হয়, তাহলেও তাঁর এরকম বাক্য এবং এরকম অন্যান্য সকল বাক্য হবে সামঞ্জস্যবিহীন শরিয়তগর্হিত বাক্যের মতো, যা ধর্তব্য নয়। তাঁর অধিকাংশ কাশ্যজাত মারেফত বা জ্ঞান- যা সুন্নত জামাতের এলেমের বিপরীত, তা সত্যতা থেকে দূরে। অতএব, ব্যাধিগ্রস্ত অন্তরবিশিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া এরকম বাক্যের অনুগমন কেউই করবে না' ।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(২৭) সত্যের মাপকাঠি | (২৯) সাহাবীগণের মর্যাদাঃ এক |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |