গিরিসঙ্কটের কারাগার থেকে মুক্তি লাভের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কয়েক দিন শান্তিতে ছিলেন। হঠাৎ আবু তালিব অসুস্থ হয়ে পড়েন। কারা জীবনের কঠোরতা তাঁর সহ্য হয়নি। গিরিসঙ্কট থেকে বের হওয়ার ছয় মাস পরেই আবু তালিবের মৃত্যু হয়। এ সময় তার বয়স ছিল ৮০ বছর। জীবনের শুরু থেকে যিনি ছায়ার মত সব সময় তাকে বিপদ-আপদে সাহায্য করে, তাঁর ইন্তিকালে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুবই ব্যথাহত হন।
চাচার শোক ভুলতে না ভুলতেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূণ্যময়ী ও প্রাণপ্রিয় স্ত্রী খাদিজাতুল কুব্রা (রা.) অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং আবু তালিবের মৃত্যুর কয়েক দিন পরেই তিনি চির নিদ্রায় নিদ্রিত হন। উল্লেখ্য যে, হযরত খাদিজাতুল কুব্রা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শুধু প্রিয়তমা স্ত্রী ছিলেন না; বরং তিনি ছিলেন তাঁর দাম্পত্য জীবনের পঁচিশ বছরের সুখ-দু:খের সাথী, বিপদ-আপদে সর্বক্ষণ সাহায্যকারী, তিনি সবার আগে দ্বীন-ইসলাম কবুল করেন। আবু তালিব এবং হযরত খাদীজা (রা.) (হযরত খাদীজা ৬৫ বছর বয়সে ইনতিকাল করেন) -এর মৃত্যুতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শোক সাগরে নিমজ্জিত হন। এজন্য তিনি এ বছরটিকে “আমুল-হয্ন” বা ‘শোক বর্ষ’ বলে অভিহিত করেন।
মুশরিকদের জুলুম অত্যাচার যখন সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন নবূওতের দশম বছরে তিনি যায়েদ ইবনে হারেছাকে নিয়ে তায়েফ চলে যান। মক্কা থেকে ৬০ মাইল দূরে অবস্থিত তায়েফ নগরী একটি সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা দেশ।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানকার নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদেরকে সত্য ধর্ম ইসলাম গ্রহণ করার জন্য আহবান করলে, তারা তা প্রত্যাখ্যান করে এবং অশোভন আচরণ করে বলে : “হুঁ! আল্লাহ্ বুঝি আর কাউকে খুঁজে না পেয়ে তোমাকে নবীরূপে পাঠিয়েছেন।”
কেউ বললো : “দেখ! দেখ! আল্লাহর নবী কি এমন করে পায়ে হেঁটে আসে ?”
কেউ বললো : “আমি তোমার সাথে তথাই বলতে চাই না। কারণ, যদি তুমি সত্যিই আল্লাহর রাসূল হও, তাহলে তোমার দাবী অস্বীকার করলে ক্ষতি হবে। পক্ষান্তরে যদি তোমার দাবী মিথ্যা হয় তাহলে এমন ভন্ড মিথ্যাবাদীর সাথে কথা বলার প্রয়োজন নেই।”
তাদের কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিরাশা হলেন। তাঁকে শহর থেকে বের করে দেয়ার জন্য তারা দুষ্টু ছেলে-পিলে, গুন্ডা-বদমায়েশদের লেলিয়ে দেয়। তারা দল বেধে সব দিক থেকে তাঁর উপর ইট, পাটকেল ও পাথর মারতে থাকে। হযরত যায়েদ (রা.) তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে আহত হন এবং নবী (স.)-এর অবস্থা এমন হয় যে, তাঁর সমস্ত শরীর পাথরের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয় এবং ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরে। এমনকি তাঁর উভয় জুতা দেহের প্রবাহিত রক্তে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। এতো কষ্ট পাওয়া সত্ত্বেও তিনি তাদের হিদায়েতের জন্য দু‘আ করেন।
এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিশিষ্ট কুরায়েশ নেতা মুত্ইম ইবন আদী নিরাপত্তা প্রদান করেন। তখন তিনি ব্যাপকভাবে ইসলামের দাওয়াত দেয়া শুরু করেন।
তায়েফ থেকে মক্কাতে ফিরে আসার পর তিনি (স.) হযরত সাওদা (রা.)-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সাওদা (রা.) এবং তাঁর স্বামী আগেই ইসলাম কবুল করেন এবং আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। সেখানেই তাঁর স্বামী ইন্তিকাল করলে সওদা (রা.) বিপদে পড়েন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করে তাঁর নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন।
হযরত আবু বকর (রা.)-এর ইচ্ছা ছিল আল্লাহর রাসূলের সাথে রক্তের সম্পর্ক স্থাপন করা। তাই তিনি খাদীজা (রা.)-এর ইনতিকালের পর তাঁর মেয়ে আয়েশাকে বিবাহ করার জন্য অনুরোধ করেন। তিনি তাঁর এ বাসনা পূর্ণ করেন এবং তখনই বিবাহের ‘আকদ’ সম্পন্ন হয়। এ সময় আয়েশা (রা.)-এর বয়স ছিল মাত্র ৭ বছর। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৯ বছর বয়সের সময় তাকে ঘরে তুলে নেন।
বিভিন্ন গোত্রের লোকেরা যখন উকাজ, মাজিন্না প্রভৃতি মেলায় সমবেত হতো, তখন তিনি তাদের কাছে দ্বীনের দাওয়াত দিতেন। এ সময় মদীনার খাজরাজ বংশের ৬ ব্যক্তি ইসলাম কবুল করেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের প্রসিদ্ধ ও অলৌকিক ঘটনা মিরাজ। অন্তরীণ থেকে মুক্তি পাওয়ার পর নবূওতের দশম সনেই সংঘটিত হয়েছিল, যা বিশ্বজগতের ইতিহাসে আর কখনো ঘটেনি। যার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা এরূপ : এক রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত উম্মে হানীর ঘরে অথবা বায়তুল্লাহ শরীফের পাশে হাতীমে ঘুমিয়ে ছিলেন। হযরত জিব্রাইল (আ.) তাঁকে জাগান এবং সেখান থেকে প্রথমে হাতীমে কা‘বার পাশে এবং পরে যমযম কুপের পাশে নিয়ে যান। তারপর তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ করে ভেতর থেকে ‘কলব’ বা অন্তর বের করে, যমযমের পানিতে ধুয়ে তা ঈমান ও হিক্মত দিয়ে পূর্ণ করে যথাস্থানে রেখে দেন। তারপর তাঁর কাছে একটি জান্নাতী বাহন ‘বুরাক’ আনা হয়; যা গাধার চেয়ে কিছু বড় এবং খচ্চরের চেয়ে একটু ছোট ছিল। তার রং ছিল সাদা এবং ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাতে চড়ে জিব্রাইল (আ.)-এর সাথে বায়তুল মুকাদ্দিসে পৌঁছান এবং সেখানে উপস্থিত সব নবী ও রাসূলের জামাতের ইমামতি করেন। এরপর তিনি সেখান থেকে উর্ধ্ব গগনমন্ডলে উপনীত হন। চলার পথে বিভিন্ন আকাশে তিনি নবীদের সাথে সাক্ষাৎ করে অবশেষে সিদ্রাতুল মুনতাহায় গিয়ে পৌঁছেন। এখানে তিনি আল্লাহ্ তা‘য়ালার বিশেষ কুরবত বা নৈকট্য লাভ করেন। এ সময় পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরজ হয়। নবূওতের দশম বছরে রজব মাসের ২৭ তারিখের রাতে এ মহাঘটনা সংগঠিত হয়। এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বয়স ছিল পঞ্চাশ বছর। মি‘রাজ সম্পর্কে আল্লাহর বাণী :
তিনি পবিত্র মহিমময়, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতের বেলায় ভ্রমণ করিয়েছেন ‘মসজিদে হারাম’ থেকে ‘মসজিদে আকসা পর্যন্ত, যার চারপাশকে আমি বরকতময় করেছি- যাতে আমি তাকে দেখাই আমার কুদরতের কিছু নিদর্শন; নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।
আল্-কুরআন, সূরা বণী ইসরাইল-১৭, আয়াত-১