কুরায়েশ প্রতিনিধিরা আবিসিনিয়া থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসায়, তারা ক্ষোভে, দু:খে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। এবার তাদের ক্রোধ কেন্দ্রীভূত হয় মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে। তারা তাঁর প্রাণনাশের সংকল্প করে। আর এ কাজে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে আবু জেহেল। নবূওতের ষষ্ঠ বছরে একদিন আবু জেহেল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাফা পাহাড়ের কাছে দেখতে পেয়ে সে উম্মাদের মত তাঁকে গালিগালাজ করে, তাঁর দেহে নাপাক গোবর ছুঁড়ে মারে এবং সব শেষে একটা পাথর ছুড়ে মেরে তাঁর মাথা ফাঁটিয়ে দেয়। আঘাতের ফলে তাঁর দেহ রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। এ অবস্থায় তিনি ঘরে ফিরে যান। একজন ক্রীতদাসী এ ঘটনা দেখে, তা তাঁর চাচা হামযার কাছে বলে দেয়। যখন তিনি জঙ্গলে শিকার করা থেকে ফিরছিলেন।
দাসীর কথা শুনে তিনি গর্জন করে উঠে বললেন : কী! এতো বড় স্পর্ধা। মুহাম্মদের গাঁয়ে হাত! আমার ভাতিজা কার কী ক্ষতি করেছে? কী অপরাধ করেছে?
এরপর হযরত হামযা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ও উত্তেজিত হয়ে সোজা কা‘বা ঘরে গেলেন এবং আবু জেহেলের মাথায় ধনুক দিয়ে প্রচন্ড আঘাত করে বললেন : শয়তান! মুহাম্মদের গায়ে হাত দিয়েছিস? জানিস না, সে আমার ভাতিজা?
আবু জেহেল বললো : ধর্মের জন্য একাজ করেছি
উত্তরে হামযা বললো: ধর্মের জন্য? তবে শোন, এখনই আমি মুহাম্মদের ধর্ম গ্রহণ করলাম। তিনি বললেন : “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।”
একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরূপ দু‘আ করেন : “ইয়া আল্লাহ্! আবু জেহেল ও ওমর - এ দুয়ের মধ্যে তোমার নিকট যে অধিকপ্রিয়, তার দ্বারা তুমি পবিত্র ইসলামকে সম্মানিত কর।” (আল্-হাদীস, জামি তিরমিযী, দিল্লী; ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-২০৯) উল্লেখ্য যে, এ দু‘আ হযরত ওমর (রা.)-এর শানে কবুল হয়। হযরত হামযা (রা.) ইসলাম কবুল করার ফলে আবু জেহেল ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়। সে ক্ষিপ্ত হয়ে প্রকাশ্য মজলিসে ঘোষণা দেয়
যে ব্যক্তি মুহাম্মদকে হত্যা করে তাঁর মাথা আমার কাছে এনে দেবে, আমি তাকে একশত উট পুরস্কার দেব।
পুরস্কারের লোভে ওমর তরবারি হাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাথা কাটার জন্য বের হলেন। হঠাৎ পথিমধ্যে নাঈমের সাথে দেখা। নাঈম তার দোস্ত। জিজ্ঞাসা করলো :
কিহে ওমর, খবর কি? কোথায় চলেছ খোলা তরবারি হাতে নিয়ে।
উত্তরে ওমর বললো : সে ব্যক্তিকে হত্যা করতে যাচ্ছি, যে বলে আল্লাহ্ এক।
রাগান্বিত ওমর ও তার কথা শুনে নাঈম (রা.) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে খুবই উদ্বিগ্ন হলেন। তার মনকে অন্য দিকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য সে বললো : তোমার বোন ফাতিমা এবং তার স্বামী সাঈদ ইসলাম কবুল করেছে, এ খবর কি তুমি রাখ? আগে নিজের ঘরের খবর নেও, পরে মুহাম্মদের মাথা কেটো!
কী! আমার বোন ইসলাম গ্রহণ করেছে? এত বড় স্পর্ধা? আচ্ছা, আগে তার খবর নেই। সাথে সাথে ওমর তার ভগ্নীপতির বাড়ীর দিকে ছুটলেন। ওমর যখন বোনের বাড়ীতে গিয়ে পৌঁছলেন, তখন সাঈদ ও ফাতিমা ‘সূরা ত্বা-হা’ পাঠ করছিলেন। কুরআন পাক তেলাওতের শব্দ শুনে ওমর জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে থাকে। ঘর থেকে জিজ্ঞাসা করে :
কে দরজা ধাক্কাচ্ছে? কে?
ওমর জবাব দেয় : আমি খাত্তাবের পুত্র ওমর। সে জিজ্ঞাসা করে : তোমরা এতক্ষণ কি পড়ছিলে? আমি জানতে পেরেছি, তোমরা বাপ-দাদার ধর্ম ছেড়ে মুহাম্মদের ধর্ম গ্রহণ করেছ। বেদ্বীন হয়ে গেছ।
সাঈদ জবাবে বলেন : বাপ-দাদার ধর্মে যদি সত্য না থাকে, আর অন্য ধর্মে যদি তা পাওয়া যায়, তাহলে তা গ্রহণ করা যাবে না কেন ?
একথা শুনে ওমর তার ওপর ঝাপিয়ে পড়ে এবং বেদম মার শুরু করে দেয়। ফাতিমা স্বামীকে বাঁচাতে গেলে ওমর তাকেও মারধর করে।
সে মারের চোটে ফাতিমার মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হলে, সে ওমরকে বলে, আমরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান এনেছি। জীবন গেলেও আমরা তা পরিত্যাগ করবো না। তোমার যা খুশী করতে পার।
ওমর তখন নরম সুরে বললেন : দেখি, তোমরা কী পাঠ করছিলে?
ফাতিমা বললেন : তুমি অপবিত্র। অপবিত্র হাতে কুরআন স্পর্শ করা যায় না, তাই আগে গোসল ও পরে ওযু কর।
ওমর ওযু করলে ফাতিমা (রা.) কুরআনের সেই লিখিত অংশ তার হাতে দেন, যা পাঠ করে তিনি মুগ্ধ হন এবং বলেন : কি চমৎকার ও কত মর্যাদাকর এ পাক কালাম! কোথায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম? আমি অক্ষনি তাঁর কাছে গিয়ে ইসলাম কবুল করবো।
এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আরকাম (রা.)-এর ঘরে অবস্থান করছিলেন। ওমর সেখানে প্রবেশ করলে তিনি (স.) জিজ্ঞাসা করেন : হে ওমর! কি মনে করে আসলে? জবাবে ওমর বলেন : পবিত্র দ্বীন-ইসলাম কবুল করার জন্য এসেছি। সাথে সাথে তিনি বায়আত গ্রহণ করে পড়েন- “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।”
ইসলাম গ্রহণের পর ওমর (রা.) বলেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ (স)! সত্য দ্বীন কবুল করার পর ঘরে বসে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করবো, তা হবে না। আল্লাহর ঘরে হাজির হয়ে উচ্চকণ্ঠে বললো : আল্লাহু আকবর।
রাসূলুল্লাহ (স.) হযরত ওমর (রা.)-এর ঈমানী জয্বা দেখে খুশী হলেন এবং খোলাখুলিভাবে আল্লাহর ঘরে হাজির হয়ে ইবাদত করার অনুমতি দিয়ে তাঁকে ‘আল্-ফারুক’ উপাধিতে ভূষিত করেন। কারণ, আল্লাহ্ তা‘য়ালা তাঁর দ্বারাই হক ও বাতিলের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য নির্ণয় করে দেন। (উল্লেখ্য যে, ইসলাম কবুলের পর হযরত ওমর (রা)-এর দৈহিক কোন পরিবর্তন হয়নি, হয়েছিল মনের (কলবের) পরিবর্তন। লাত-মানতের স্থানে আল্লাহ্ অধিষ্ঠিত হন। একে কুরআনের ভাষায় তায্কিয়া’ বলা হয়েছে, যাকে আত্মশুদ্ধি বলা হয়। (গ্রন্থকার)) (ইবনে কাছীর, ইবনে হিশাম, ইসাবা ও সীরাতে হালবিয়া)