এ সময় আল্লাহর তরফ থেকে প্রকাশ্যে দ্বীন প্রচারের নির্দেশ আসে, যেমন আল্লাহর বাণী :
فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ
অর্থ : হে নবী! আপনার প্রতি যে নির্দেশ দেয়া হয়, তা প্রকাশ্যে প্রচার করুন এবং মুশরিকদের পরোয়া করবেন না।
— আল্-কুরআন, সূরা হিজর, আয়াত : ৯৪
আল্লাহ্ তা‘য়ালার আরো নির্দেশ :
وَأَنذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ
অর্থ : “হে নবী! আপনি আপনার নিকট আত্মীয়দের সতর্ক করুন।
— আল্-কুরআন, সূরা শূআরা; আয়াত : ২১৪
আল্লাহ্ তা‘য়ালার তরফ থেকে নির্দেশ পাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফা পাহাড়ের উপর উঠে তার গোত্রের লোকদের ডাকতে লাগলেন
হে কুরায়েশরা! হে কুরায়েশ সম্প্রদায়!
তারা জিজ্ঞাসা করলো : কি ব্যাপার মুহাম্মদ! সবাইকে ডাকছ কেন?
তিনি (স.) বললেন : আমি যদি বলি যে, এ পাহাড়ের পেছনে একদল শত্রু আছে, যারা তোমাদের উপর হামলা করবে, তা কি তোমরা বিশ্বাস করবে?
তারা সবাই বললো : হাঁ, কেন করব না? আমরা তো তোমাকে কখনো মিথ্যা বলতে শুনিনি।
তখন তিনি বলেন : আমি তোমাদের এক কঠিন আযাব সম্পর্কে সতর্ক করছি, যা শীঘ্রই তোমাদের ওপর আপতিত হবে। হে কুরায়েশ দল! তোমরা নিজেদের জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও। তোমরা বল : “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। তোমরা জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে।
একথা শুনে আবু লাহাব বলে : তাব্বানলাকা। তুমি ধ্বংস হও। এ জন্যেই কি তুমি আমাদের এখানে জড়ো করেছ।
এরা জবাবে আল্লাহ্ তা‘য়ালা আবূ লাহাবের করুণ পরিণতির খবর জানিয়ে নাযিল করেন :
تَبَّتْ يَدَا أَبِي لَهَبٍ وَتَبَّ (1) مَا أَغْنَىٰ عَنْهُ مَالُهُ وَمَا كَسَبَ
অর্থ : আবু লাহাবের দুটো হাত ধ্বংস হোক এবং সে নিজেও ধ্বংস হোক। তার ধন-সম্পদ এবং সে যা উপার্জন করেছে, তা তার কোন কাজে আসেনি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করেন। তখন কুরায়শ কাফিররা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে এবং তারা এ কাজে বাধা দেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
হক ও বাতিলের দ্বন্দ্ব শুরু
এ পর্যায়ে কুরায়েশ নেতারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা আবু তালিবের কাছে উপস্থিত হয়ে বলে
হয় আপনি আপনার ভাতিজাকে সামলান, নয়তো মাঝখান থেকে সরে দাঁড়ান। তখন আমরাই তার সাথে বুঝাপড়া করবো।
একথা শুনে আবু তালিব তাদের নম্রভাবে বুঝিয়ে শুনিয়ে বিদায় দেন। এরপর তিনি নবী করীম (স.) কে বলেন
ভাতিজা! তোমার খান্দানের বড় বড় নেতারা আশা করে যে, তুমি তাদের দেবতাদের মন্দ বলবে না, আর তারাও তোমার আল্লাহ্কে মন্দ বলবে না।
জবাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : চাচা! আমি কি তাদের সেদিকে ডাকব না, যা প্রতীমাদের থেকে উত্তম?
আবু তালিব বলেন : তুমি তাদের কিসের দিকে ডাকতে চাও?
তিনি বলেন: আমি চাই, তারা বলুক : লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলূল্লাহ।
একথা শুনে কুরায়শ নেতারা ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁকে হুমকী-ধমকী দিয়ে চলে যায়। (সীরাতুর রাসূল, সীরাতে হালবিয়া ও তাবাকাতে ইবনে সা‘দ)
আপোষের ব্যর্থ প্রয়াস ও প্রলোভন
কুরায়েশ নেতারা মনে করে যে, মুহাম্মদ (স.)-কে সম্মান, সম্পদ ও সর্দারীর প্রলোভন দিয়ে দলে আনা যাবে, তাই তারা তাঁকে বলে
যদি তুমি সম্পদ চাও, তাহলে আমরা তোমাকে এতো বেশী সম্পদ দেব, যাতে তুমি শ্রেষ্ঠতম ধনী হও। আর যদি তুমি সম্মান চাও। তাহলে আমরা তোমাকে বড় নেতা মেনে নেব। আর যদি তুমি সুন্দরী মেয়েদের বিয়ে করতে চাও তাহলে সে ব্যবস্থা ও আমরা করব।
জবাবে তিনি বলেন
তোমরা যে প্রস্তাব দিয়েছ, তা পূর্ণ করা তোমাদের পক্ষে সম্ভব। শুনে রাখ, যদি তোমরা আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চন্দ্র এনে দাও, এবং সত্য দ্বীন প্রচার থেকে বিরত থাকতে বল, তবুও আমি সত্য প্রচারে বিরত থাকবো না।
(সীরাতে রাসূল ও সীরাতে ইবন হিশাম)
হত্যার পরিকল্পনা
উল্লেখ্য যে, একদা আবু জেহেল শপথ করে বলে : যখন মুহাম্মদ (স.) নামাযে মগ্ন হবে, তখন একটি ভারী পাথর মেরে তার মাথা চূর্ণ করে দেব। ভোর হওয়া মাত্র আবু জেহেল একটা ভারি পাথর নিয়ে কা’বার পাশে বসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অপেক্ষায় রইলো। নবী করীম (স.) যখন নামাযরত অবস্থায় সিজদায় গেলেন, তখন আবু জেহেল পাথর নিয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে গেল। হঠাৎ লোকেরা দেখতে পেল, আবু জেহেল পিছিয়ে এসেছে এবং তার চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেছে; তার চোখ ঘোলা হয়ে গেছে। লোকেরা তাকে প্রশ্ন করলো : তোমার কী হয়েছে? সে হাঁপাতে হাঁপাতে জবাব দিল :
বল কি, আমি যা দেখলাম, তা কি তোমরা দেখতে পাওনি? যখনই আমি মুহাম্মদের দিকে গেলাম, তখনই এক ভয়ানক উট মুখ হা করে আমার দিকে ছুটে এলো। সে আমাকে গিলে ফেলতে উদ্যত হয়। আমি তা দেখেই তো ভয়ে পিছিয়ে এলাম। তা না হলে তো বাঁচাই মুশকিল হতো!
দুর্বল মুসলমানদের উপরনির্যাতন
কুরায়েশ কাফিররা এরূপ সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা এবার দুর্বল মুসলমানদের ওপর নির্যাতন চালাবে। এ সিদ্ধান্তের পর কোন কোন মুশরিক তাদের মুসলমান দাস ও দাসীর ওপর এরূপ ভয়ানক নিপীড়ন চালালো, যা শুনলে শরীর ও শিউরে ওঠে, গায়ের লোম খাড়া হয় এবং চরম পাষাণ অন্তর ও কেঁপে ওঠে। তাদের বন্দীশালায় বন্ধ করে ক্ষুত পিপাসায় কষ্ট দিতো, রৌদ্রতপ্ত পাথর ও বালুর ওপর শোয়ায়ে রাখতো এবং অগ্নিদগ্ধ লৌহ শলাকা দিয়ে তাদের দেহ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জর্জরিত করে পানিতে ডুবিয়ে রাখতো। এঁদের মধ্যে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের কয়েকজনের নাম হলো : হযরত আম্মার ইবন ইয়াসির (রা.), তাঁর পিতা ইয়াসির (রা.) এবং তাঁর মাতা সুমাইয়া (রা.) তাঁরা প্রথমেই ইসলাম কবুল করেছিলেন। মাখযুম গোত্রের লোকেরা তাদের উপর অমানুষিক নির্যাতন শুরু করে। তারা তপ্ত দুপুরে যখন মরুভূমির পাথর ও বালু আগুন হয়ে যেত, তখন তাদের উলঙ্গ করে তাতে শুইয়ে দিত। কখনো তাদের আগুনের উপর ফেলতো, কখনো পানিতে নিয়ে চুবাতো। তাদের এ অবস্থা দেখে নবী (স.) বলতেন :
হে ইয়াসির পরিবার! সবর কর, তোমাদের জন্য রয়েছে জান্নাত।
হযরত বেলাল (রা.)
তিনি গোপনে ইসলাম কবুল করেন। তাঁর মনিব ছিল উমাইয়া ইবন খাল্ফ। ইসলাম গ্রহণ করার ফলে তাঁর উপর অত্যাচারের ষ্টিম রোলার চালান হয়। তাঁর গলায় রশি বেঁধে মক্কার যুবকদের হাতে তাকে সমর্পণ করা হতো। ইচ্ছামত মারধর করা হতো। তপ্ত দুপুরে মরুভূমিতে নিয়ে বুকের উপর গরম পাথর চাপা দিয়ে বলা হতো :
এখনো মুহাম্মদের দ্বীন ত্যাগ করে লাত, মানাত ও ওজ্জার পূজা করতে রাজী হয়ে যাও। অন্যথায় এভাবেই তোমাকে হত্যা করা হবে।
হযরত বেলাল (রা.) এ চরম কষ্ট ও নির্যাতন সহ্য করতেন এবং বলতেন :
আহাদ! আহাদ! আল্লাহ্ এক তিনি এক।
হযরত খাব্বাব(রা.)
তিনি প্রথম দিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে বায়‘আত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। তাঁর মনিবের নাম ছিল উম্মে আন্মার। তাঁকে যেভাবে শাস্তি দেয়া হতো, তা ছিল এরূপ :
তারা জ্বলন্ত অঙ্গার মাটিতে বিছিয়ে, তার উপর তাঁকে চিৎ করে শোয়াত এবং কয়েকজন পাষন্ড তাঁর বুকে পা দিয়ে তাঁকে চেপে ধরে রাখতো। যখন পিঠের নীচের অঙ্গারগুলো নিভে যেত, তখন তারা তাঁকে ছেড়ে দিত।
একবার হযরত খাব্বার (রা.) এ ঘটনা হযরত ‘উমর (রা.)-এর কাছে বর্ণনা করলে, তিনি তাঁর পিঠের কাপড় উঁচু করে দেখতে পান যে, সেই দহনের চিহ্ন তাঁর সারা পিঠে ধবল কুষ্ঠের ন্যায় বিদ্যমান আছে। (ইবনে হিশাম)