নবী করিম (দঃ) নবুয়ত পরবর্তীকালে নিজেই সাহাবীদেরকে নিয়ে নিজের মিলাদ পড়েছেন এবং নিজ জীবনী আলোচনা করেছেন। যেমন- হযরত ইরবায ইবনে ছারিয়া (রাঃ) একদিন নবী করিম (দঃ) কে তাঁর আদি বৃত্তান্ত বর্ণনা করার জন্য আরয করলে নবী করিম (দঃ) এরশাদ করেন-
আমি তখনই নবী ছিলাম- যখন আদম (আঃ)-এর দেহের উপাদান-মাটি ও পানি পৃথক পৃথক অবস্থায় ছিল। অর্থাৎ আদম সৃষ্টির পূর্বেই আমি নবী হিসেবে মনোনীত ছিলাম। আমাকে হযরত ইবরাহীম (আঃ) দোয়া করে তাঁর বংশে এনেছেন- সুতরাং আমি তাঁর দোয়ার ফসল। হযরত ঈছা (আঃ) তাঁর উম্মতের নিকট আমার আগমনের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। তাঁরা উভয়েই আমার সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত ছিলেন। আমার আম্মা বিবি আমেনা আমার প্রসবকালীন সময়ে যে নূর তাঁর গর্ভ হতে প্রকাশ পেয়ে সুদূর সিরিয়ার প্রাসাদসমূহ আলোকিত করতে দেখেছিলেন- আমিই সেই নূর
— মিশকাত
এভাবে হযরত আবু বকর (রাঃ), হযরত ওমর (রাঃ), হযরত ওসমান (রাঃ), হযরত আলী (রাঃ) খলিফা চতুষ্টয় নিজ নিজ খেলাফত যুগেও নবীজীর পবিত্র বেলাদত শরীফ উপলক্ষে মিলাদ মাহফিল করতেন এবং মিলাদের ফযিলত বর্ণনা করতেন বলে মক্কা শরীফের তৎকালীন (৯৭৪হিঃ) বিজ্ঞ মুজতাহিদ আলেম আল্লামা ইবনে হাজার হায়তামী (রহঃ) স্বীয় রচিত “আন-নি’মাতুল কোবরা আলাল আলম” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
এছাড়াও অন্যান্য সাহাবী নবীজীর জীবদ্দশায় মিলাদুন্নবী মাহফিল করতেনঃ
১) হযরত আবু আমের আনসারীর (রাঃ) মিলাদ মাহফিলঃ
অনুবাদঃ হযরত আবু দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে- তিনি বলেন, আমি একদিন নবী করিম (দঃ)-এর সাথে মদিনাবাসী আবু আমেরের (রাঃ) গৃহে গমন করে দেখতে পেলাম- তিনি তাঁর সন্তানাদি ও আত্মীয়স্বজনকে একত্রিত করে নবী করিম (দঃ)-এর পবিত্র বেলাদত সম্পর্কিত জন্ম বিবরণী শিক্ষা দিচ্ছেন এবং বলছেন যে "আজই সেই পবিত্র জন্ম তারিখ"। এই মাহফিল দেখে নবী-করিম (দঃ) খুশী হয়ে তাঁকে সুসংবাদ দিলেন- "নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তোমার জন্য (মিলাদের কারণে) রহমতের অসংখ্য দরজা খুলে দিয়েছেন এবং ফিরিস্তাগণ তোমাদের সকলের জন্য মাগফিরাত কামনা করছেন”
(আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ুতির সাবিলুল হুদা ও আল্লামা ইবনে দাহ্ইয়ার আত-তানভীর-৬০৪ হিঃ)।
আরবী হাদীসখানা প্রমাণ স্বরূপ হুবহু নিম্নে পেশ করা হলো-
عن أبي الدرداء قَالَ مَرَرْتُ مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى بَيْتِ عَامِرِ الْأَنْصَارِي وَهُوَ يُعَلِّمُ وَقَائِعُ وَلَادَتِهِ لأَبْنَائِهِ وَعَشِيرَتِهِ وَيَقُولُ هُذَا الْيَوْمُ فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم إِنَّ اللَّهَ فَتَحَ عليك ابواب الرحمة وملائكته يستَغْفِرُونَ لَكُمْ
(سَبِيلِ الْهُدى لجلالُ الدِّينِ السُّيُوطِيِّ وَالتَّنْوِيرُ )
২) হযরত ইবনে আব্বাছ (রাঃ) কর্তৃক মিলাদ মাহফিলঃ
অনুবাদঃ একদিন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) নিজগৃহে মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছিলেন। তিনি উপস্থিত সাহাবীগণের নিকট নবী করিম (দঃ)-এর পবিত্র বেলাদত সম্পর্কিত ঘটনাবলি বয়ান করছিলেন। শ্রোতামণ্ডলী শুনতে শুনতে মিলাদুন্নবীর আনন্দ উপভোগ করছিলেন এবং আল্লাহর প্রশংসা ও নবীজীর দরূদ পড়ছিলেন। এমন সময় নবী করিম (দঃ) সেখানে উপস্থিত হয়ে এরশাদ করলেন- “তোমাদের সকলের প্রতি আমার সুপারিশ ও শাফাআত অবধারিত হয়ে গেল।
— আদ দুররুল মুনাযযাম
সোবহানাল্লাহ! হাদীস শরীফখানা নিম্নে দেওয়া হলো।
عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا كَانَ يُحَدِّثُ ذَاتَ يَوْمٍ فِي بَيْتِهِ وقائع ولادته صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَيَبْشِرُونَ وَيَحْمَدُونَ وَيُصَلُّونَ إِذْ جَاءَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَقَالَ حَلَّتْ لَكُمْ شَفَا عَلَى
(الدَّرْ المنظم)
৩) হযরত হাসসান (রাঃ)-এর কিয়ামসহ মিলাদঃ
সাহাবী কবি হযরত হাসসান বিন সাবিত (রাঃ) দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নবী করিম (দঃ)-এর উপস্থিতিতে তাঁর গৌরবগাঁথা পেশ করতেন এবং অন্যান্য সাহাবী সমবেত হয়ে তা শ্রবণ করতেন।
কিয়াম করে মিলাদ মাহফিলে নবী করিম (দঃ)-এর প্রশংসামূলক কবিতা ও না’ত পাঠ করা এবং সালাম পেশ করার এটাই বড় দলীল। এরূপ করা সুন্নাত এবং উত্তম বলে মক্কা-মদিনার ৯০ জন ওলামা ১২৮৬ হিজরীতে নিম্নোক্ত ফতোয়া দিয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রে প্রেরণ করেছেন।
اعْلَمْ أَنَّ ذِكْرَ مَوْلِدِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَجَمِيعَ مَنَاقِبِهِ وحضور سَمَاعِهِ سُنَةٌ رُوِيَ أَنَّ حَسَّانَا يُفَا خَرُ قِيَا مَا مِنْ رَّسُول اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِحَضْرَتِهِ وَالنَّاسُ يَجْتَمِعُونَ السماعه
হে মুসলমান ! আপনারা জেনে রাখুন যে, মিলাদুন্নবী (দঃ)-এর আলোচনা ও তাঁর শান মান বর্ণনা করা এবং ঐ মাহফিলে উপস্থিত হওয়া সবই সুন্নাত। বর্ণিত আছে যে, হযরত হাসসান বিন সাবিত (রাঃ) কিয়াম অবস্থায় রাসুলুল্লাহ (দঃ)-এর পক্ষে হুযুরের উপস্থিতিতে হুযুর (দঃ)-এর গৌরবগাঁথা পেশ করতেন, আর সাহাবীগণ তা শোনার জন্য একত্রিত হতেন।
— ফতোয়ায়ে হারামাঈন
একজনের কিয়ামই সকলের জন্য দলীল স্বরূপ।
হযরত হাসসান বিন সাবিত (রাঃ)-এর কিয়ামের কাছিদার অংশ বিশেষ ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। ঐ কাছিদায় তিনি রাসূল করীম (দঃ)-এর আজন্ম নির্দোষ ও নিষ্পাপ হওয়া এবং হুযুরের ইচ্ছানুযায়ী তাঁর আকৃতি বা সুরতে মোহাম্মাদী সৃষ্টির তত্ত্ব পেশ করেছেন। নবী করিম (দঃ) তাঁর এই কাছিদা শুনে দোয়া করতেন-
হে আল্লাহ! তুমি জিব্রাইলের মাধ্যমে হাসসানকে সাহায্য কর।
অর্থাৎ আমার পক্ষে আমার প্রশংসা বাক্য সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলার তৌফিক দাও। এতে আমার দুশমনগণ ভালোভাবে জব্দ হবে।
৪) সুদূর অতীতে মিলাদুন্নবীর চিত্রঃ মাওয়াহিবের বর্ণনা
সুদূর অতীতকালে কীভাবে মুসলমানগণ ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করতেন- তাঁর একটি বিস্তারিত বর্ণনা আল্লামা শাহাবুদ্দীন কাসতুলানী (রহঃ) মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া কিতাবে বিধৃত করেছেন। মিলাদুন্নবী (দঃ) সমর্থক বিজ্ঞ মোহাক্বেক ওলামায়ে কেরাম এবং ফকিহগণ নিজ নিজ গ্রন্থে দলীল স্বরূপ আল্লামা কাসতুলানীর (রহঃ) এই দুর্লভ প্রমাণাদি লিপিবদ্ধ করেছেন। ঈদে মিলাদুন্নবী (দঃ) পালনকারী এবং সমর্থক ওলামা ও নবীপ্রেমিক মুসলমানদের অবগতির জন্য উক্ত মন্তব্য কোটেশন আকারে অনুবাদসহ নিম্নে পেশ করা হলো।
ولا زال أهل الإسلام يحتفلون بشهر مولِدِهِ عَلَيْهِ الصَّلُوةُ وَالسَّلَامُ وَيَعْمَلُونَ الْوَلَائِمُ وَيَتَصَدَّ قُوْنَ فِي لَيَالِيْهِ بِأَنْوَاعِ الصَّدَقَاتِ ويظهرون السرور ويَزِيدُونَ فِي الْمُبَرَّاتِ وَيَعْتَنُونَ بِقرانة مَوْلِدِهِ الْكَرِيمِ وَيَظْهَرُ عَلَيْهِمْ مِّنْ بَرَكَاتِهِ كُلُّ فَضْلٍ عَمِيمٍ ومِمَّا جُرِّبَ مِنْ خَواصِهِ أَنَّهُ أَمَانَ فِي ذَلِكَ الْعَامِ وَبُشْرَى عَاجِلَةٌ بِنَيْلِ الْبَغْيَةِ وَالْمَرَامِ فَرَحِمَ اللَّهُ إِمْرَأُ اتَّخَذَ لَيَالِي شَهْرٍ مَوْلِدِهِ المباركة أعيادا
( مواهب اللدنيَّة وَالْأَنْوَارُ الْمُحَمَّدِيَّةُ صفحة ١٩)
সমগ্র মুসলিম উম্মাহ সুদূর অতীতকাল থেকে নবী করিম (দঃ)-এর পবিত্র বেলাদত উপলক্ষে মাসব্যাপী সর্বদা মিলাদ-মাহফিল উদযাপনব করতেন। যিয়াফত প্রস্তুত করে তারা লোকদের খাওয়াতেন। মাসব্যাপী দিনগুলোতে বিভিন্ন রকমের সদকা খয়রাত করতেন এবং শরীয়তসম্মত আনন্দ উৎসব করতেন। উত্তম কাজ প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি করতেন। তাঁরা পূর্ণমাস শান-শওকতের সাথে বিশেষ আয়োজনের মাধ্যমে মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠান করতেন- যার বরকতে বরাবরই তাদের উপর আল্লাহর অপার অনুগ্রহ প্রকাশ পেতো। মিলাদ মাহফিলের বৈশিষ্ট্য সমূহের মধ্যে এটা একটি পরীক্ষিত বিষয় যে, মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠানের বরকতে ঐ বছর আল্লাহর পক্ষ হতে নিরাপত্তা কায়েম থাকে এবং তড়িৎগতিতে উহা মনোবাঞ্ছা পূরণের শুভ সংবাদ বাহন করে নিয়ে আসে। অতএব- যিনি বা যারা মিলাদুন্নবী মাসের প্রতিটি রাত্রকে ঈদের রাত্রে পরিণত করে রাখবে- তাঁদের উপর আল্লাহর খাস রহমত বর্ষিত হবে
— মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া, মা ছাবাতা বিচ্ছুন্নাহ্
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০১৪) ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন উপলক্ষে জুলুছ বা মিছিল বের করা | (০১৬) আবু লাহাবের খুশী ও তার শাস্তির বিরতি |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |