এবার হযরত আবু বকর সিদ্দিকের (রাঃ) ঈমানের পরীক্ষা শুরু হলো। নবী করিম (দঃ) হযরত আলীকে বিছানায় শোয়ায়ে এক মুষ্টি ধূলা হাতে নিয়ে সুরায়ে ইয়াসিনের "ওয়া জাআলনা" পূর্ণ আয়াতটি তিলাওয়াত করে তাতে ফুঁক দিয়ে শত্রুদের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে নিক্ষেপ করলেন। আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেকটি শত্রুর মাথায় ও চোখে সে ধূলা পৌঁছিয়ে দিলেন। তারা চক্ষু রগড়াতে লাগলো। এ সুযোগে নবী করিম (দঃ) তাদের সামনে দিয়েই বের হয়ে গেলেন- অথচ তাদের কেউ নবী করিম (দঃ) কে দেখতে পেলোনা। আল্লাহ রাখে তো-মারে কে? নবীজীর কাজে স্বয়ং আল্লাহ্ শরীক হয়ে গেলেন।
নিজ ঘর থেকে বের হয়ে নবী করিম (দঃ) সোজা হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর বাড়ীতে গিয়ে দরজার কড়া নাড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে 'লাব্বাইকা ওয়া ছা'দাইকা'- বলে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) দরজা খুলে দিলেন। নবী করিম (দঃ) বললেন, তুমি কি নিদ্রা যাওনি হে আবু বকর? হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) আরয করলেন-
"ইয়া রাসুলাল্লাহ! যেদিন আপনি আমাকে প্রস্তুত থাকতে ইঙ্গিত করেছিলেন- সেদিন থেকেই প্রতিরাত্রে আমি আপনার এন্তেজারে দরজায় দন্ডায়মান ছিলাম। একদিনের জন্যও আমি রাত্রিতে বিছানায় পিঠ লাগাইনি"।
অন্তরে মহব্বতের আগুন একবার জ্বলে উঠলে এমনিভাবেই চোখের ঘুম হারাম হয়ে যায়। অন্ধকারে প্রয়োজনীয় টাকা পয়সা ও আসবাবপত্র তৈরী করে হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর দুই মেয়ে-হযরত আসমা ও হযরত আয়েশা (রাঃ) ঐগুলি বেঁধে দিচ্ছিলেন। হযরত আসমা (রাঃ) নিজের দোপাট্টা ছিঁড়ে এক অংশ দিয়ে বোঝা বেঁধে দিলেন। তাঁর এই ত্যাগে মুগ্ধ হয়ে নবী করিম (দঃ) তাঁকে "জাতুন নাতাকাইন" বা দুই দোপাট্টার অধিকারিনী উপাধীতে ভূষিত করলেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) পরবর্তী সময়ে "সিদ্দিকা" উপাধীতে ভূষিতা হয়েছিলেন- যখন তাঁর পবিত্র চরিত্রের আয়াত নাযিল হয়েছিল। একই ঘরে পিতা হলেন সিদ্দিকে আকবর, এক মেয়ে হলেন সিদ্দিকা এবং অন্য মেয়ে আসমা (রাঃ) হলেন জাতুন নাতাকাইন।
হযরত আবু বকরের (রাঃ) বংশের চার পুরুষ সাহাবী ছিলেন। এই গৌরব অন্য কোন সাহাবীর নসিব হয়নি। হযরত আবু বকর (রাঃ), তাঁর পিতা-মাতা, ছেলে- মেয়ে এবং জামাই যোবাইর ও নাতী আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর- সকলেই সাহাবী হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন। 'সাহাবী ইবনে সাহাবী ইবনে সাহাবী ইবনে সাহাবী'- অর্থ্যাৎ আবদুল্লাহ ইবনে আম্মা বিনতে আবুবকর ইবনে আবু কোহাফা (রাঃ)- সকলেই সাহাবী ছিলেন। এই দুর্লভ সৌভাগ্য হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর বংশের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নবী করিম (দঃ) যখনই হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর কথা উল্লেখ করতেন, তখনই বলতেন- ইউসুফু নবীউন, ইবনু নাবীয়্যিন, ইবনে নাবীয়িান, ইবনে নাবীয়্যিন- অর্থাৎ "ইউসুফ ইবনে ইয়াকুব ইবনে ইসহাক ইবনে ইব্রাহীম আলাইহিমুস সালাম"।
রাত্রির ঘন অন্ধকার ভেদ করে নবী করিম (দঃ) ও হযরত আবু বকর (রাঃ) মক্কা শহর ত্যাগ করে দক্ষিণে অবস্থিত ছাওর পর্বতের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। নবী করিম (দঃ) পায়ের আঙ্গুলের উপর ভর দিয়ে পথ চলছিলেন- যেন পাছে পদচিহ্ন বিশেষজ্ঞরা চিনে না ফেলে। কিছুদূর যাওয়ার পর কদম মোবারক পাথরের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয়ে রক্ত ঝরে পড়তে লাগলো। এ অবস্থা দেখে হযরত আবু বকর (রাঃ) নবী করিম (দঃ) কে নিজ কাঁধে তুলে নিলেন। কিন্তু তিনি কোন ওজন অনুভব করলেন না। নবী করিম (দঃ) একটু মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, "আবু বকর। নূরের কোন ওজন হয়না"। সুবহানাল্লাহ!
ছাওর পর্বতের চূড়ায় পৌঁছে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) নিজে প্রথমে একটি গুহায় নামলেন। গুহা পরিষ্কার করে চারিদিকের ছিদ্র কাপড় ছিড়ে বন্ধ করলেন। একটি ছিদ্র বন্ধ করার মত কিছু ছিলনা। তিনি নিজ পা দিয়ে সে ছিদ্রটি বন্ধ করলেন। নবী করিম (দঃ) তাঁর কোলে মাথা মোবারক রেখে শুয়ে পড়লেন এবং চোখ মোবারক বন্ধ করে আবু বকরকে যিকর খফীর তাওয়াজ্জুহ দিতে লাগলেন। "আল-হাদিকাতুন নাদিয়া ফিত্ তারিকাতিন নক্শবন্দিয়া" নামক আরবী গ্রন্থে উল্লেখ আছে-
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا صَبُّ اللَّهُ شَيْءٌ فِي صَدْرِي . إِلَّا صَبْبْتَهُ فِي صَدْرٍ أَبِي بَكْرٍ -
অর্থ-"আমার অন্তরে আল্লাহ যে বাতেনী নেয়ামত ঢেলে দিয়েছেন- আমি তা আবু বকরের অন্তরে ঢেলে দিলাম"।
সে কারণেই তাঁর থেকে দু'টি মশহুর তরিকা বের হয়েছে। একটি হচ্ছে তরিকায়ে নকশবন্দীয়া- অন্যটি তরিকায়ে মোজাদ্দেদীয়া। অপরদিকে হযরত আলী (রাঃ) নবীজীর চাঁদর গায়ে দিয়ে নবীজীর বিছানায় শুয়ে মৃত্যু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। সেজন্যে তিনিও নবী করিম (দঃ)-এর ইলমে মারেফাতের প্রধান নেয়ামত লাভ করেছিলেন এবং তাঁর থেকেও দুটি প্রধান তরিকা কাদেরিয়া ও চিশতিয়া বের হয়েছে। তাঁর শানে নবী করিম (দঃ) এরশাদ করেছেন-
أنا مدينة العلم وعلى بابها
অর্থ-"আমি হচ্ছি যাবতীয় ইলেমের শহর, আর আলী হলো সেই শহরের প্রধান দরজা”।
(মিশকাত)
"সেজন্যেই হযরত আলীর (রাঃ) মা'রেফাত বিদ্যা প্রাধান্য পেয়েছে। তবে হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর ইলমে বাতেনকেও অস্বীকার করা যাবে না। যেমন শিয়া সম্প্রদায় এককভাবে হযরত আলী (রাঃ) কে ইলমে বাতেনের একমাত্র দরজা বলে আকিদা পোষণ করে থাকে। এটা গলদ। আহলে সুন্নাতের কেহই হযরত আলী (রাঃ) কে ইল্মে বাতেনের একক উৎস বলে দাবী করেনা- বরং প্রধান উৎস বলেন। কেউ একক উৎস বা দরজা দাবী করলে সেও শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত হবে এবং হাদীসের ভুল ব্যাখ্যা করা হবে। বেদায়া ও নেহায়া গ্রন্থে উক্ত হাদীসের (بابها) শব্দটির ব্যাখ্যা করা হয়েছে "বিশেষ ও প্রধান দরজা হিসেবে"- একক হিসেবে নয়। কেননা, তাহলে অন্য সাহাবীদের এলমে বাতেনকে অস্বীকার করা হয়। এটা আহলে সুন্নাতের আকিদার পরিপন্থী ও বাস্তবের বিপরীত। (মিরকাত এবং মিশকাত হাশিয়া)
যা হোক- হযরত আবু বকর (রাঃ) নবী করিম (দঃ) কে নিয়ে গুহায় প্রবেশ করার সাথে সাথে 'উম্মে গায়লান' নামক এক লতা বৃক্ষ অন্যস্থান থেকে এসে গুহার মুখ ঢেকে ফেললো। মাকড়সা এসে জাল বুনলো এবং এক জোড়া কবুতর এসে বাসা বাঁধলো- ডিম পাড়ল। হযরত আবু বকর (রাঃ) যে ছিদ্রে পা রেখেছিলেন, তার ভিতরে ছিল একটি সাপ। এই সাপটি এক হাজার বছর ধরে নবীজীর দীদারের আশায় এই গুহায় অবস্থান করছিল। সাপটি ছিল আশেকে রাসুল! সাপটি তিনবার ফোঁস ফোঁস করে হযরত আবুবকর (রাঃ) কে পা সরিয়ে নিতে হুশিয়ারী দিচ্ছিল। অবশেষে সাপ্টি হযরত আবু বকরের পায়ে দংশন করলো। সর্পবিষ সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়লো। এমতাবস্থায়ও তিনি নড়াচড়া করলেন না- নবী করিম (দঃ)-এর আরামের ব্যাঘাত হবে মনে করে। হঠাৎ করে তাঁর দুফোটা তপ্তঅশ্রু নবী করিম (দঃ)-এর পবিত্র চেহারায় ঝড়ে পড়লো। অমনি নবী করিম (দঃ)-এর ধ্যান ভঙ্গ হলো। জিজ্ঞেস করলেন- আবু বকর! কি হয়েছে? আবু বকর বললেন, সাপে দংশন করেছে। নবী করিম (দঃ) একটু থুথু মোবারক দংশিত স্থানে মালিশ করে দিলেন। সাথে সাথে বিষের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলো। আশেকের বিচার করা কি সম্ভব? সাড়ে বার বৎসর পর যখন হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর ইনতিকালের অসুখ দেখা দিল, তখন সাপের পুরানো বিষ পুনরায় ক্রিয়াশীল হলো। এভাবে তিনি শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করলেন। আল্লামা আবদুল গনি নাবলুসী (রঃ) 'হাদিকা' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, আবু বকরের মৃত্যু সাওর গুহায় অবধারিত ছিল, নবী করিম (দঃ) তাকে সাড়ে বার বৎসর পিছিয়ে দিলেন। এটা নবী করিম (দঃ)-এর বিশেষ মো'জেযা ও ইখতিয়ার। শিফা শরীফে কাযী আয়ায (রহঃ) উল্লেখ করেছেন- "আল্লাহ পাক নবী করিম (দঃ) কে মউতের উপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রদান করেছিলেন"। আমরা মউতের নিয়ন্ত্রণাধীন, কিন্তু মউত হচ্ছে নবী করিম (দঃ)-এর ইখতিয়ারাধীন। "পাহাড়-পর্বত, আসমান-জমিন, বেহেস্ত-দোযখ, চন্দ্র-সূর্যকে নবী করিম (দঃ)- এর নিয়ন্ত্রণাধীন করে রেখেছেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা"।
إنَّ اللهَ جَعَل الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ وَالسَّمَاءُ وَالْأَرْضَ وَالْجِبَالَ مُطِيعًا لِلنَّبِيِّ صلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ شِفَاءٌ قَاضِي عَيَاضٍ)
অর্থ-"আল্লাহ তায়ালা সূর্য, চন্দ্র, আসমান, জমীন, পাহাড়-পর্বত নবী করিম (দঃ)-এর অধীন ও অনুগত করে দিয়েছেন"।
(শেফা কাযী আয়ায)
এদিকে নবী করিম (দঃ)-এর ঘরে ঢুকে কোরাইশ যুবকরা বিছানায় হযরত আলী (রাঃ) কে শায়িত দেখে নবী করিম (দঃ) কোথায় গিয়েছেন- তা জিজ্ঞেস করলো। হযরত আলী (রাঃ) নির্ভিকভাবে উত্তর দিলেন- কোথায় গিয়েছেন, তা জানিনা। তবে ঘর থেকে বের হয়ে গেছেন। কোরাইশরা চতুর্দিকে অনুসন্ধানের জন্য লোক পাঠালো। উমাইয়া ইবনে খালফ একদল যুবক ও পদরেখা বিশেষজ্ঞ নিয়ে পদচিহ্ন ধরে সাওর পর্বতে এসে উপস্থিত হলো। এখানে এসে পদচিহ্ন মুছে গেছে। সবাই অনুমান করলো নিশ্চয়ই এই গুহাতেই নবী করিম (দঃ) আশ্রয় নিয়েছেন। উমাইয়া ইবনে খাল্ল্ফ বললো- গুহার মুখে লতা, মাকড়সার জাল আর কবুতরের বাসা দেখা যাচ্ছে। এখানে প্রবেশ করলে তো এসব থাকার কথা নয়। এ বলে সে দলবলসহ অন্যদিকে ছুটে গেল। এভাবে আল্লাহ তায়ালা আপন হাবীবকে রক্ষা করলেন।
ঐসময়ে হযরত আবু বকর (রাঃ) নবীজীর জীবনের আশংকায় সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। হুযুর পুরনূর (দঃ) অটল ও শান্তস্বরে জবাব দিলেন "চিন্তাগ্রস্ত হয়োনা- আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন” (সুরা তওবা)
[তাফসীরে নঈমীতে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, 'আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন'- বাক্যটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, এই বাক্যটিতে কোন কাল বা সময়ের উল্লেখ নেই। এটি জুমলায়ে ইছমিয়া। সর্বকাল অর্থে এটি ব্যবহৃত হয়। সুতরাং আল্লাহ সব সময়ই তাঁর রাসুল ও হযরত আবু বকরের সাথে আছেন এবং থাকবেন। (তাফসীরে নাঈমী)]
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০৪৯) হিজরতের পটভূমিকা | (০৫১) বকরীর শুকনো বাঁটে দুধের নহর |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |