মি'রাজ থেকে প্রত্যাবর্তন করার পর নবী করিম (দঃ)-এর উপর কোরাইশদের অত্যাচার আর এক মাত্রা বৃদ্ধি পেল। ঐ বছরই (দ্বাদশ বর্ষ) হজ্ব উপলক্ষে আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকেরা হজ্বে আগমন করলো। ইয়াছরিব (মদিনা) থেকে ৭০ জন পুরুষ এবং ২ জন মহিলা মোট ৭২ জনের একটি কাফেলা হজ্বে আগমন করলো। এর পূর্বেও একাদশ বর্ষে ১২ জন ১০ম বর্ষে ৬ জন করে দুটি দল বিগত দু'বৎসরে হজ্ব মৌসুমে এসে ইসলাম গ্রহণ করে মদিনায় ফিরে গিয়েছিলেন।
এবারের (দ্বাদশ বর্ষ) ৭২ জনের তৃতীয় দলটি মিনাতে রাতের অন্ধকারে অতি গোপনে নবী করিম (দঃ)-এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং নবী করিম (দঃ) কে মদিনায় চলে যেতে আমন্ত্রণ জানালেন। জান-মাল দিয়ে তাঁরা নবী করিম (দঃ) ও মোহাজির মোসলমানদেরকে রক্ষা করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করলেন। নবুয়তের দ্বাদশ বর্ষের জিলহজ্ব মাসের প্রারম্ভে এ চুক্তি হয়। এই বায়আতকে বাইয়াতে আকাবা বলা হয়। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। কেননা, এই বায়আতের মাধ্যমেই নবী করিম (দঃ) এবং মক্কার সাহাবাগণের জন্য বিদেশভূমিতে বিকল্প বাসস্থান ও রাষ্ট্র নির্ধারিত হলো। নবী করিম (দঃ) সাহাবাগণকে মদিনায় হিজরত করার নির্দেশ দিলেন। সাহাবাগণ পরবর্তী ২ মাসে একা একা ও দলে দলে মদিনায় গমন করতে লাগলেন।
মদিনায় ইসলামের প্রসার দেখে আবু জাহল প্রমুখ কোরেশগন তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো। নবী করিম (দঃ) জিলহজ্ব চাঁদের শেষ তারিখে হযরত আবু বকর (রাঃ) কে ডেকে ইঙ্গিতে বললেন- "হে আবু বকর, তুমি হিজরতের জন্য প্রস্তুত থাকবে। যেকোন মুহুর্তে আল্লাহর পক্ষ হতে মক্কাভূমি ত্যাগ করার নির্দেশ আসতে পারে। আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) খুশীতে বলে উঠলেন- ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমি কি আপনার সঙ্গী হবো? নবী করিম (দঃ) বললেন, "তুমি আমার জীবনের সাথী, হিজরতের সাথী, কবরের সাথী, হাশরের সাথী এবং বেহেস্তেরও সাথী। আমি প্রথম, তুমি দ্বিতীয়।" এটাই হুযুরের ইলমে গায়েব আতায়ীর প্রমাণ। হুযুর (দঃ)-এর একথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হয়েছে এবং হবে।
এই গোপন ইঙ্গিত পেয়ে হযরত আবু বকর (রাঃ) পরদিন পহেলা মহররম তারিখে ওকাজ বাজার থেকে আটশত দেরহাম দিয়ে দুটি উট ক্রয় করে নবী করিম (দঃ)-এর খেদমতে পেশ করলেন। একটির নাম রাখা হলো কায়া এবং অপরটির নাম রাখা হলো আব্বা। হাশরের দিনে নবী করিম (দঃ) কাস্তয়ায় আরোহন করে হাশরের ময়দানে যাবেন এবং আদ্বায় আরোহন করে বিবি ফাতেমা (রাঃ) হাশরের ময়দানে উঠবেন (রুহুল বয়ান)।
প্রিয় নবীর দরবারে যে দান কবুল হয়- তাই শ্রেষ্ঠ দান। নবী করিম (দঃ) উক্ত কাস্তয়া নামক উটে জীবদ্দশায় আরোহন করতেন। হুযুরের ইনতিকালের পর উক্ত কাস্তয়া শোকে অল্পদিনের মধ্যেই একটি কুয়ায় ঝাঁপ দিয়ে ইনতিকাল করে। দ্বিতীয় উট আদ্দ্বা হযরত ওমরের খিলাফতকালে ইন্তিকাল করে। হুযুর পাক (দঃ)-এর ব্যবহৃত যাবতীয় বস্তুর বিশদ তালিকা আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া এবং মাওয়াহিব গ্রন্থে উল্লেখিত রয়েছে।
দুটি উট খরিদের মাধ্যমে হিজরতের প্রাথমিক প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয়। সে জন্যই মুহররমের পহেলা তারিখ (হিজরতের প্রস্তুতি দিবস) থেকে হিজরী সন গণনা শুরু করা হয়। হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ এরূপ করা হয়েছে। সুতরাং যতদিন হিজরী সন থাকে ততদিন হযরত আবু বকরের স্মৃতিও অটুট থাকবে।
মুহররম ও সফর মাসে কোরাইশ সর্দারগণ মুসলমানদের ব্যাপক হারে মদিনায় যেতে দেখে নানা চিন্তা-ভাবনা করে অবশেষে সফর মাসের শেষ শনিবারে দারুন নাওয়া নামক মিলনায়তনে এক পরামর্শ সভা আহবান করে। কোরাইশদের বিভিন্ন গোত্র ছাড়াও অন্যান্য গোত্রের সর্দারগণ উক্ত মিলনায়তনে বা পরামর্শগৃহে একত্রিত হলো। নবী করিম (দঃ)-এর এই ইসলামী মিশনের বরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া যায়, সে সম্পর্কে তিনটি প্রস্তাব উত্থাপিত হলো। একটি হলো- হুযুর (দঃ) কে আটক করে রাখা। দ্বিতীয় প্রস্তাব হলো- দেশ থেকে বহিষ্কার করা এবং তৃতীয় প্রস্তাব হলো- জীবনে শেষ করে দেয়া। এমন সময় শয়তান নজদ দেশের এক বৃদ্ধের সুরত ধারণ করে উক্ত সভায় হাযির হলো। একারণে শয়তানের এক উপাধী হয় শেখে নজদী।
নজদ দেশ থেকেই পরবর্তীকালে মোহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব নজদী ওহাবী মান্দোলন শুরু করে। পরবর্তীকালে তার বংশধরগণ ইংরেজদের সাথে আঁতাত করে ১৯২৪ইং সালে মক্কা ও মদিনাসহ গোটা আরবে ওহাবী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। বর্তমান শাসকগণ ওহাবী শাসক। তারা আরবের সমস্ত ধর্মীয় স্মৃতি ও নাযার ধ্বংস করে ফেলেছে। বিবি খাদিজার মাযার, বিবি ফাতিমার মাযার ও ইমাম হাসানের মাযারসহ জান্নাতুল বাকী ও জান্নাতুল মায়াল্লার সমস্ত মাযার ও গম্বুজ নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছে। এরা সারা পৃথিবীতে ওহাবী মতবাদ চালু করার লক্ষ্যে 'রাবেতা আলমে ইসলাম' নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিভিন্ন মুসলিম দেশে ইবনেসিনা, ইবনে তাইমিয়া, কিং খালেদ, বাদশাহ ফয়সল- ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে এবং এগুলোর মাধ্যমে মানুষকে ওহাবী মতবাদে দিক্ষিত করছে। যেসব সংগঠন ওহাবী ও মউদুদী মতবাদ প্রচার করে, উক্ত প্রতিষ্ঠান তাদেরকে প্রচুর আর্থিক সাহায্য দিয়ে থাকে। নবী করিম (দঃ) চৌদ্দশত বৎসর পূর্বেই এই শয়তানী ওহাবী ফিৎনার ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। আল্লামা ইবনে আবেদীন তাঁর ফতোয়া শামী গ্রন্থে ওহাবী ফিৎনার বিশদ আলোচনা করেছেন।। নবী করিম (দঃ)-এর খেদমতে স্টেনক' সাহাবী ঐ শনিবার সম্পর্কে জিজ্ঞাস
করলে নবী করিম (দঃ) এরশাদ করলেন:
يوم مكرٍ وَحَدِيعَةٍ إِنَّ قَرِيضًا أَرَادُوا أَنْ تُشْكُرُوا فِيهِ
অর্থ-"শনিবার হচ্ছে মক্কর ও ধোকাবাজীর দিন। এই দিনে কুরাইশগণ (আমার বিরুদ্ধে) ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা তৈরী করেছে"।
(নিহায়া)
যাক, শয়তান শেখে নজদীর সুরতে সভায় হাযির হয়ে আবু জাহলকে লক্ষ্য করে বললো-"আবুজাহল কর্তৃক শেষ প্রস্তাব অর্থাৎ নবীকে জীবনে শেষ করে দেয়াই মঙ্গলজনক এবং বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তবে প্রত্যেক গোত্রকেই একাজে অংশ নিতে হবে"। আবু জাহল সহ উপস্থিত সবাই শেখে নজদীর পরামর্শ মোতাবেক ঐ রাত্রেই নবী করিম (দঃ)-এর গৃহে অভিযান পরিচালনা করার প্রস্তাব পাশ করে সভা ভঙ্গ করলো। কোরআন মজিদের সুরা আনফালে তাদের এই কু-পরামর্শের কথা এভাবে উল্লেখিত হয়েছে:
واذ يمكر بك الَّذِينَ كَفَرُوا ليثبتوك أو يَقْتُلُوكَ أَوْ يُخْرِجُوكَ وَيَمْكُرُونَ وَيَمْكُرُ اللَّهُ وَاللَّهُ خَيْرُ الْمَاكِرِينَ -
অর্থ-"হে রাসুল! ঐ সময়ের কথা স্মরণ করুন, যখন কাফেররা আপনার ব্যাপারে এই দূরভিসন্ধি এঁটেছিল যে, হয় আপনাকে বন্দী করে রাখা হবে, অথবা শহীদ করা হবে অথবা দেশান্তর করে দেয়া হবে। তারা একদিকে দূরভিসন্ধি আআঁটছিল, অপর দিকে আল্লাহ তায়ালা কৌশলপূর্ণ পরিকল্পনা করছিলেন। আল্লাহই (দূরভিসন্ধির বিরুদ্ধে) উত্তম পরিকল্পনাকারী"।
(আনফাল)
দারুন নাওয়া আজও কাফেরদের দূরভিসন্ধির এসেম্বলী ও শয়তানের আস্তানার প্রতীকরূপে চিহ্নিত হয়ে আছে। লাখনো শহরে ওহাবীদের নাওয়াতুল উলামা নামক মাদরাসাটি আবুজাহেলের দারুন নাদওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
দারুন নাদ্ওয়ার সভা ভঙ্গ হওয়ার পরপরই হযরত জিব্রাইল (আঃ) নবী করিম (দঃ)-এর খেদমতে কোরাইশদের দূরভিসন্ধি ও পরিকল্পনার সংবাদ দিলেন এবং বললেন- আজ আপনি নিজ বিছানায় শুবেন না- অর্থাৎ হিজরত করুন।
নবী করিম (দঃ) হযরত আলীকে ডেকে এনে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়তে বললেন এবং নিজের চাদরখানা গায়ে চড়িয়ে দিলেন। হযরত আলী নির্ঘাত মৃত্যু জেনেও বিনাদ্বিধায় হুযুর (দঃ)-এর বিছানায় শুয়ে পড়লেন এবং গায়ের উপর চাদর টেনে দিলেন। পরক্ষণেই নবী করিম (দঃ) বললেন-আমার কাছে মানুষের গচ্ছিত আমানতের মাল তিনদিনের মধ্যে ফেরত দিয়ে তুমি মদিনাতে চলে যাবে। আমি এক্ষণই বের হয়ে যাচ্ছি। কেননা কোরাইশদের একশজন, মতান্তরে সত্তরজন যুবক নাঙ্গা তলোয়ার নিয়ে আমার ঘর ঘেরাও করে রেখেছে- নিদ্রা যাওয়া মাত্র তারা ঘরে ঢুকে আমাকে শহীদ করে ফেলার ফন্দি এঁটেছে। হযরত আলী (রাঃ) একদিকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত- অপরদিকে নবী করিম (দঃ)- এর ইঙ্গিতে বুঝে নিলেন, আপাততঃ আজ তিনি শহীদ হবেন না। কেননা আমানতের মাল ফেরত দেয়ার মধ্যে তিনদিনের জন্য তাঁর বেঁচে থাকার ইঙ্গিত প্রচ্ছন্ন ছিল। নবী করিম (দঃ) এবার এরশাদ করলেনঃ
يَا عَلِيُّ إِنَّكَ لَن تَمُوتُ حَتَّى إِحْمَرَّتْ لِحْيَتَكَ الْبَيَاضُ بِالدَّمِ الْبِدَايَةُ وَالنَّهَايَةُ)
"হে আলী, তুমি সাধারনভাবে মৃত্যুবরন করবেনা- যে পর্যন্ত না তোমার সাদা দাঁড়ি রক্তে রঞ্জিত হয়ে যাবে"
(বেদায়া)
দেখা গেছে- হযরত আলী ৬৩ বৎসর বয়সে আবদুর রহমান ইবনে মুলজিম নামক এক খারেজী মুসলমানের (?) হাতে কুফার জামে মসজিদে ফজরের নামাযে গমনের পথে শহীদ হন। হযরত আলী যে বৃদ্ধ হয়ে শহীদ হবেন- এ সংবাদ নবী করিম (দঃ) আল্লাহ প্রদত্ত এলমে গায়েবের মাধ্যমেই দিয়েছিলেন। কে কখন মারা যাবে-নবী করিম (দঃ) পূর্বেই তা বলে গেছেন। আল্লাহ প্রদত্ত এলমে গায়েব অস্বীকারকারীদের এ ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু তারা তাদের ওহাবী মুরুব্বীদের কথার উপরই অটুট। তারা বলেছে-নবীজী গায়েব জানেন না। অথচ ইলমে গায়েব জানা নবুয়তের জন্য শর্ত।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০৪৮) বিভিন্ন মো'জেযা প্রদর্শনঃ পাহাড়, জমিন ও বেহেস্তের উপর নবীজীর কর্তৃত্ব | (০৫০) গৃহত্যাগ ও ছাওর পর্বত গুহায় আশ্রয় গ্রহণ |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |