ইমাম শাফি'য়ী (র.) প্রসিদ্ধ চারজন ইমামের অন্যতম। তাঁর নাম মুহাম্মদ, উপনাম আবু আবদুল্লাহ্, পিতার নাম ইদ্রিস, পিতামহ আব্বাস, মাতার নাম ফাতিমা, পূর্ণ নাম ইমাম আবূ আবদুল্লাহ্ মুহাম্মদ ইব্ন ইদ্রীস ইবন উসমান ইব্ন শাফি' ইবন সায়েব ইবন উবায়দ কুরাইশী (র.)। তাঁর বংশ পরম্পরা সর্বশেষে আবদে মানাফের সংগে মিলে নবী করীম (সা.) বংশের অন্তর্ভূক্ত হয়। তিনি ১৫০ হিজরীতে সিরিয়ার গাজা প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন। দু'বছরকালে মাতার সংগে মক্কা মুকাররমায় চলে আসেন। সেখানেই প্রতিপালিত হন এবং প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করেন। প্রথমে কুরআন শরীফ শিখেন। তারপর দশ বছর পর্যন্ত হুজায়ল গোত্রের মধ্যে অবস্থান করেন এবং ইল্মে লুগাত ও কবিতা শিখেন। এ জন্যই ইমাম শাফি'য়ী (র.) হুজায়ল গোত্রের কবিতার সর্বশ্রেষ্ঠ ও নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী রূপে সমাদৃত। কথিত আছে যে, আরবী সাহিত্য ও ভাষায় ইমাম আসমায়ী স্বয়ং হুজায়ল গোত্রের কবিতা ইমাম শাফি'য়ী (র.) হতে শুদ্ধ করে নিতেন। তারপর ইমাম শাফি'য়ী মক্কার মুক্তী মুসলিম ইব্ন খালিদ যুনজীর নিকট ফিকহ্ শাস্ত্র শিক্ষা লাভ করেন। এরপর তিনি মদীনা মুনাওয়ারায় সফর করেন এবং ইমাম মালিক (র.) এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ইমাম মালিক (র.)-এর নিকট তিনি প্রত্যক্ষভাবে পুরো 'মুয়াত্তা' কিতাব অধ্যয়ন করেন। এই কিতাব অধ্যয়নকালে ইমাম মালিক (র.) ইমাম শাফি'য়ীর অসাধারণ প্রতিভা, স্মৃতিশক্তি, অসামান্য বিনয় লক্ষ্য করে তাঁকে অধিকতর স্নেহ ও সম্মান করতেন।
এরপর ইমাম শাফি'য়ী (র.) ইয়ামনের একটি প্রদেশে চাকরী গ্রহণ করেন। চাকরীরত অবস্থায় কোন হিংসুক খলীফা হারুনুর রশীদ এর নিকট তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করেন। তাঁকে বাগদাদে ডেকে আনা হয়। এ সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে আহলে বাইতের প্রাধান্য প্রদানের ও শিয়া মতবাদ অবলম্বনের অভিযোগ আনা হয়। এ ঘটনা ১৮৪ হিজরীর। এরপর তাঁর বিরুদ্ধে
আনিত অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়া এবং ইমাম মুহম্মদ (র.)-এর সুপারিশের কারণে খলীফা সম্মানের সাথে তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেন। এ ঘটনার পর ইমাম মুহাম্মদ (র.)-এর সংগে ইমাম শাফি'য়ী (র.)-এর সম্পর্ক গভীর হয়ে উঠে এবং তিনি ইমাম মুহাম্মদ (র.)-এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ইমাম মুহাম্মদ (র.)-এর ছাত্রদের লিখিত পান্ডুলিপিগুলোও সংগ্রহ করেন। বাগদাদ থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় তিনি ইমাম মুহাম্মদ (র.)-এর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে নিম্নোক্ত বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন,
124/523
عداد قد حملت من علم محمد بن الحسن وقر بعير
"ইমাম মুহাম্মদ ইব্ন হাসানের ইল্ল্ম হতে উটের বোঝা পরিমাণ ইল্ম নিয়ে আমি বাগদাদ হতে প্রত্যাবর্তন করছি"। সেখান থেকে তিনি মক্কা মুকাররমায় ফিরে আসেন এবং সেখানে বসবাস করতে থাকেন। এ সময়ে মাঝে মাঝে তিনি হিজায ও ইরাকে ইল্মী সফরে গমনাগমন করতেন। ১৯৯ হিজরীতে তিনি মিসরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সেখানে তিনি তাঁর ফিকহী মতামত প্রচার করেন এবং সে অনুযায়ী মাসআলা-মাসাইল সংকলন করেন। ২০৪ হিজরীতে তিনি ইন্তিকাল করেন। ১
ইমাম শাফিয়ী (র.) মক্কা, মদীনা, বাগদাদ ইত্যাদি এলাকার বহু ফকীহ্, মুহাদ্দিস হতে ইলমে ফিকহ্ ও হাদীসের শিক্ষা গ্রহন করেন। তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মুসলিম ইন্ন খালিদ যুনজী, মালিক ইন্ন আনাস, মুহাম্মদ ইব্ন হাসান, মুহাম্মদ ইব্ন আলী শাফিয়ী (তাঁর চাচা) সুফইয়ান ইব্ন উআইনাহ্, ইব্রাহীম ইবন সা'দ, সাঈদ ইবন সালিম, ইসমাঈল ইব্ন উলাইয়্যাহ, ইসমাঈল ইবন জাফর (র.) প্রমুখ।২
ইমাম শাফি'য়ী (র.) এর ইল্ল্মী জ্ঞান-ভান্ডার হতে অসংখ্য শাগরিদ ইল্মে ফি ও ইল্মে হাদীস শিক্ষা লাভ করেছেন। এদের মধ্যে প্রসিদ্ধ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হল:
হাসান ইব্ন মুহাম্মদ জাফরানী বাগদাদী, ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল শায়বানী বাগদাদী, আবু সাত্তর ইব্রাহীম হুসাইন ইন আলী কারাবিসী, ইসমাঈল মজুনী, রাবী ইবন সুলাইমান, হারমালাহ ইব্ন ইয়াহ্ইয়া মিসরী, ইউনুস আবদুল আলা ইউসূফ ইব্ন ইয়াহইয়া, সুলাইমান ইন্ন দাউদ (র.) প্রমূখ।
অন্যন্য ইমামগণের ন্যায় ইমাম শাফি'য়ী (র.)-এর মাযহাবের উসূল ছিল কুরআন, সুন্নাহ্, ইজমা ও কিয়াস। ইমাম শাফি'য়ী (র.) ব্যাপকভাবে খবরে ওয়াহিদ উপর আমল করতেন বিধায়, ইমাম আবু হানীফা (র.) ও ইমাম মালিক (র.) এর মাযহাবের তুলনায় তাঁর মাযহাবের ১. আসসুন্নাতু ও মাকানাতুহা ফিত্ তাশরী'ঈল ইসলামী ড. মুস্তাফা হুসনী আস্ সুবাঈ, ৪০১ পৃষ্ঠা। ২. আইম্মা আরবাআহ্ : কার্যী আতহার হোসাইন, ১৪১-১৮১ পৃষ্ঠা। ৩. প্রাগুক্ত, ১৭১ পৃষ্ঠা।
দলীলের ক্ষেত্র ছিল বিস্তৃত। অপরদিকে মুরসাল হাদীসের উপর আমল পরিত্যাগ করার কারণে তাঁর মাযহাব অন্যান্যদের তুলনায় ছিল সংকীর্ণ। অবশ্যই তিনি সাঈদ মত প্রসিদ্ধ তাবিঈনের মুরসাল হাদীস গ্রহন করতেন। ইমাম শাফি'র এর বের 125/523 নীতিমালার মধ্যে আর একটি নীতি ছিল 'ইসতিসহাব' )إستصحاب( )পূর্বে থেকে প্রচলিত রীতি-নীতি) প্রমাণ ও খন্ডন উভয় ক্ষেত্রেই তিনি ইস্তিসহাব হানাফীদের নিকটও গ্রহণযোগ্য। তবে তা শুধু খন্ডনের ক্ষেত্রে প্রমাণের ক্ষেত্রে নয়।১
ইমাম শাফি'য়ী (র.) হাদীস শাস্ত্রেও ছিলেন বিশেষভাবে পারদর্শী। তিনি হাদীস রিওয়াতের (বর্ণনা) নীতিমালা প্রণয়ন করেছেন। তিনি 'আল-উম' ও 'আর-রিসালা' গ্রন্থে সুন্নাহ সম্পর্কে যে উচ্চাঙ্গের আলোচনা করেছেন। পরবর্তী কালের অধিকাংশ উলামায়ে কিরাম তাঁরই অনুসরণ করেছেন।
ইমাম মুহাম্মদ (র.)-এর এ উক্তি দ্বারাই তার যথার্থতা প্রমাণিত হয়। তিনি বলেন,
19 191 190 إن تكلم أصحاب الحديث يوما فبلسان الشافعي
হলে তাঁদের ইমাম শাফি'য়ীর ভাষাই কথা বলতে হবে।২
উপরোক্ত গ্রন্থদ্বয় ব্যতীত মাসনাদে শাফি'য়ী, সুনানে তাঁর আরও দু'টি গ্রন্থ রয়েছে।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০৫৪) ইমাম মালিক (র.) | (০৫৬) ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল (র.) |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |