প্রসিদ্ধ চার ইমামের মধ্যে অন্যতম। তাঁর নাম মালিক, উপনাম আবু আবদুল্লাহ্, উপাধি ইমামু-দারিল হিজরাত। তাঁর পিতার নাম আনাস, পিতামহ মালিক। তাঁর বংশানুক্রমিক ধারা এরূপ ইমামু দারিল হিজরত হযরত আবু আবদুল্লাহ্ মালিক ইব্ন আনাস ইব্ন মালিক। হযরত আবদুল্লাহ্ মালিক ইব্ন-আনাস ইবন মালিক ইব্ন আবূ আমির নাফি' ইব্ন আমর ইবন হারিস
১. আখবারু ইমাম আবূ হানীফা ওয়া আসহাবিহি, পৃষ্ঠা ১০।
২. আস্সুন্নাতু ও মাকানাতু হা ফিত্ তাশরী ইল ইসলামী: ডঃ মুস্তফা হুস্ত্রী আস্ সুবাঈ ৪৪৭ পৃষ্ঠা।
৩. আইম্মা আরবাআহঃ কাযী আতহার হোসাইন, ২২২ পৃষ্ঠা।
ইবন উসমান ইব্ন জুসাইল আসবাহী হিময়ারী (র.) তাঁর বংশানুক্রমিক এ ধারা ইয়ামানের প্রসিদ্ধ গোত্র হিময়ার ইব্ন সাবার সঙ্গে মিলিত হয়। তাঁর মাতার নাম আলিয়াহ। তাঁর পূর্ব পুরুষগণ ইয়ামনের শাহী খান্দান হিময়ারের শাখা গোত্র আসবাহের অধিবাসী ছিলেন। সে হিসেবে ইমাম মালিককেও আসবাহী হিময়ারী বলা হয়। তাঁর পিতামহ আবূ আমির ইয়ামন ত্যাগ করে মদীনা মুনাওয়ারায় এসে বসবাস করতে থাকেন। এ বংশে তিনিই সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন এবং রসূল (সা.)-এর একজন সাহাবী হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন। বদর যুদ্ধ ব্যতীত অন্যান্য সকল যুদ্ধেই তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা.) সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর পিতামহ মালিক একজন খ্যাতনামা মুহাদ্দিস ও তাবিঈ। প্রবীণ সাহাবীদের সূত্রে তিনি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাঁর চার পুত্র আনাস, উওয়াইস, আবূ সুহাইল ও রাবী। তাঁরা প্রত্যেকেই স্বীয় যুগের প্রখ্যাত আলিম মুহাদ্দিস হিসাবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। ইমাম সাহেবের পিতা আনাস তাঁদের মধ্যে সকলের বড় ছিলেন। ইমাম মালিক (র.) ৯৩ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। কেউ কেউ জন্ম সন ৯০ অথবা ৯৫ হিজরী উল্লেখ করেছেন। 'তাবাকাতুল ফুকাহা' গ্রন্থে ৯৪ হিজরী উল্লেখ করা হয়েছে। হাফিয যাবাহী (র.) প্রথমোক্ত মতটি অধিকতর বিশুদ্ধ বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তিনি অস্বাভাবিকভাবে দুই বছর কারো মতে তিন বছর মাতৃগর্ভে ছিলেন। ১
ইমাম মালিক (র.) গৌর বর্ণের ছিলেন। শারীরিক গঠন পরিমার্জিত লম্বা ও মোটা ছিল, নাকটা কিছুটা লম্বা ও সরু ছিল। মাথার কেশ ছিল খুব কম। লম্বা ও ঘন দাড়ির অধিকারী ছিলেন। গোফের দুই পার্শ্বে লম্বা রাখতেন। অধিকাংশ সময় তিনি শ্রভ্র পোষাকই পরিধান করতেন। অধিক আতর ব্যবহার করা তাঁর বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল।২
ইমাম মালিক (র.) জন্মের প্রাক্কালে মদীনা মুনাওয়ারায় ইল্মের চর্চা ছিল ব্যাপক। ইমাম মালিক সাহেবের পরিবার ছিল এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকায়। পরিবারে ইল্মী পরিবেশ থাকার ফলে ইমাম মালিক বাল্যকালেই ইলম অর্জনের জন্য আগ্রহী ও উৎসাহী হন। তিনি নিজেই বলেন, আমি আমার মাতাকে বললাম, আমি ইলম শিক্ষার জন্য সফর করব। এতে আনন্দিত হয়ে তিনি বললেন, এসো, তোমাকে ইল্মের পোষাক পরিয়ে দিই। তাকে জামা, পায়জামা, টুপি ও পাগড়ী পরিধান করিয়ে বললেন, ইমাম রাবীয়আর খিদমতে যাও। ইল্ম শিক্ষার পূর্বে আদব শিক্ষা কর। এ সময় তিনি ইমাম নাফি' হতেও ইল্ম হাসিল করেন। তিনি বলেন, আমি বাল্যকালে বাড়ীর চাকরের সংগে ইমাম নাফি'-এর নিকটে যেতাম। তিনি উপর থেকে নেমে সিঁড়িতেই বসে পড়তেন এবং আমাকে হাদীস শুনাতেন। আমি জিজ্ঞাসা করতাম ইবন উমর (র.) অমুক অমুক মাসআলায় কি বলেছেন। তিনি তা বর্ণনা করতেন। তাঁর কাছে দ্বিপ্রহরের রোদে যেতাম। রাস্তায় কোথাও সামান্য ছায়াও পাওয়া যেত না। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আবদুর রহমান ইবন হরমুষের খিদমতে সকালে যেতাম এবং রাত্রে প্রত্যাবর্তন করতাম।
১. আইম্মা আরবাআহঃ কাযী আতহার হোসাইন, ৯৮-১০০ পৃষ্ঠা।
২. আইম্মা আরবাআহ্ঃ কার্থী আতহার হোসাইন, ১৩৭ পৃষ্ঠা।
একদা আমার পিতা আমাকে এবং আমার ভাইকে যিনি ইব্ন শিহাব যুহরীর সমবয়সী ছিলেন এক মাসআলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। আমার ভাই এর সঠিক উত্তর প্রদান করেন এবং আমি উত্তরে ভুল করলাম। তখন আব্বা বললেন, কবুতর তোমাকে ইল্ম হতে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। তাঁর এ উক্তি আমার কাছে অত্যন্ত খারাপ লাগল। এরপর আমি আবদুর রহমান হরমুখের দরসে রীতিমত যেতে লাগলাম। একাধারে সাত বছর পর্যন্ত তাঁর কাছ থেকে ইল্ম হাসিল করলাম। এ সময়ের মধ্যে অন্য কারো দরসে উপস্থিত হইনি। দরসে যাওয়ার সময় খেজুর নিয়ে যেতাম। ছেলেদের সেগুলো প্রদান করে বলতাম, যদি শায়খ (উস্তাদ) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে তবে বলে দিও যে তিনি ব্যস্ত আছেন। একবার আমি তাঁর বাড়ীর দরজায় উপস্থিত হলাম। ইব্ন হরমুয বাদীর মাধ্যমে সংবাদ নিয়ে বললেন, তাঁকে আসতে দাও। সে তো ইমাম। ইব্ন হরমুষের দরস মসজিদে নববীতে অনুষ্ঠিত হত। তিনি হযরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর জামাতা ও তাঁর ইলমের ধারক-বাহক এবং প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও আলিম ছিলেন।
ইমাম মালিক (র.)-এর বাল্যকালের উস্তাদগণের মধ্যে সাফওয়ান ইন্ন সুলাইমান ছিলেন অন্যতম। একদিন তিনি তাঁর শাগরিদ মালিক (র.)-কে এসে স্বপ্নের তা'বীর জিজ্ঞাসা করেন। শাগরিদ আরয করল; আপনি তো বড় বুযুর্গ ও আলিম। এরপরেও আমার কাছে তা'বীর জিজ্ঞাসা করেন। উস্তাদ বললেন, ভাতিজা এতে কোন অসুবিধা নেই। আমি স্বপ্নে দেখেছি যে আমি আয়না দেখছি। ইমাম মালিক তৎক্ষণাৎ বললেন, আপনি আখিরাতের প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের সামান সংগ্রহ করছেন। তাঁর এ তা'বীর শুনে উস্তাদ সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন।
أنت اليوم مويلك ولئن بقيت تكونن مالكاً اتق الله يا مالك إن كنت مالكا وإلا فانت هالك .
আজই তো তুমি (মুওয়ায়লিক) ক্ষুদে মালিক। যদি বেঁচে থাক তবে তুমি অবশ্যই সত্যিকার মালিক হবে। যদি তুমি প্রকৃত মালিক হও তবে আল্লাহকে ভয় করো। অন্যথায় তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে।
তখন থেকে মানুষ তাঁকে আদর করে মুওয়ায়লিক নামে ডাকত। তিনি তাঁকে আবূ আবদুল্লাহ্ উপনাম প্রদান করেছিলেন। তিনি প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও প্রসিদ্ধ ফকীহ্ ছিলেন।
ইমাম মালিক (র.)-এর উস্তাদগণের মধ্যে ইন্ন শিহাব যুহরী (র.) ছিলেন অন্যতম। তাঁর নিকট হতে ইল্মে হাদীস লাভ করেছেন। তিনি 'ওয়াকিবানির রায়ল' নামক স্থানে হাদীস বয়ান করতেন। শিক্ষার্থীরা সেখানে ভীড় জমাত। তিনি বলতেন, ইবন উমর (রা.) এরূপ বলেছেন, মজলিস শেষে শিক্ষার্থীরা জিজ্ঞাসা করতেন, ইবন উমর (রা.) থেকে আপনি কার মাধ্যমে হাদীস পেয়েছেন। তিনি বলতেন, ইবন উমরের পুত্র সালেমের মাধ্যমে। একবার আমি তাঁর ১. আইম্মা আরবাআহ্: কাযী আতহার হোসাইন, ২১২ পৃষ্ঠা।
দরজায় উপস্থিত হলে চাকরের মাধ্যমে আমার আগমনের সংবাদ পেয়ে প্রবেশের অনুমতি প্রদান করেন। প্রবেশ করার পর তিনি আমাকে খানা খেতে আহবান করেন। আমি বললাম, খাওয়ার প্রয়োজন নেই, হাদীস বয়ান করুন। তৎক্ষণাৎ তিনি সতেরটি হাদীস বর্ণনা করে বললেন, এতে তোমার কি লাভ হবে। আমি হাদীস বলেই যাব তুমি তা মুখস্থ করবে না।
ইমাম মালিক (র.) বললেন, আপনার অনুমতি হলে এখনই শুনিয়ে দিি তিনি সতেরটি হাদীস শুনিয়ে দিলেন। এরপর তিনি তাঁর লিখিত চল্লিশটি হাদ 119/523 ন যদি এই হাদীসগুলো মুখস্থ করে শুনাতে পার তবে তুমি হাফিয হয়ে যাবে। অ্যাম বললাম, এ চল্লিশটি হাদীস এখনই মুখস্থ শুনাতে পারব। এরপর তিনি সবগুলো হাদীস মুখস্থ শুনালেন।
ইব্ন শিহাব যুহরী (র.) তাঁর এই অসাধারণ মেধা দেখে তাঁকে বললেন-
قم فأنت من أودعية العلم أو قال إنك لنعم المستودع للعلم .
যাও, তুমি ইল্মের ভাণ্ডার, অথবা বলেছেন, তুমি ইল্মের উত্তম ভাণ্ডার। ইমাম সাহেব বলতেন, মদীনা একজন মুহাদ্দিস পেয়েছে যিনি ফকীহ্ও বটে। আর তিনি হলেন ইব্ন শিহাব যুহরী (র.)।
ইমাম মালিকের পড়া-শোনার যামানা অত্যন্ত অভাব অনটনের মধ্যে কেটেছে। বাহ্যিক জিনিসপত্র তাঁর তেমন কিছুই ছিল না। ঘরের ছাদ ভেঙ্গে বিক্রি করে তিনি কিতাব ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করেছেন। অবশ্য পরবর্তীতে আল্লাহ্ তা'আলা তাঁকে সচ্ছলতা দান
করেছিলেন।১
ইমাম মালিক (র.) ঐ সকল মুহাদ্দিস ও ফকীহ্ হতে ইল্ম হাসিল করতেন, যাঁরা সত্যবাদিতা ও তাকওয়া, তাহারাত, মেধাশক্তি ও ফিকহ্ শাস্ত্রে সুপ্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁর উস্তাদ ছিলেন অনেক। আল্লামা নববী (র.) 'তাহযীবুল আসমায়' লিখেন, ইমাম মালিকের নয়শ' উস্তাদ ছিলেন। তাঁদের মধ্যে তিনশ' তাবিঈন ও ছয়শ' তাবি-তাবিঈন ছিলেন। আল্লামা যুরকানী (র.) বলেন, ইমাম মালিক নয়শ' রও অধিক উস্তাদ থেকে শিক্ষা লাভ করেছেন। তিনি যে সকল উস্তাদ থেকে মুওয়াত্তায় হাদীস বর্ণনা করেছেন তাঁদের সংখ্যাই পঁচানব্বই জন। ইমাম মালিক (র.)-এর সব উস্তাদই ছিলেন মদীনার অধিবাসী। একদা বাদশা হারুনুর রশীদ ইমাম মালিককে বললেন, আপনার কিতাবে হযরত আলী ও ইব্ন আব্বাসের বর্ণনা খুব কম পেলাম। তিনি বললেন, তাঁরা আমার শহরে ছিলেন না। আর আমিও তাঁদের শাগরিদের সাথে বেশী সাক্ষাৎ করতে পারিনি। ইমাম মালিক (র.)-এর প্রসিদ্ধ উস্তাদগণের মধ্যে হতে কিছু সংখ্যক উস্তাদের নাম নিম্নে প্রদত্ত হল:
১. রাবীয়াতুর রায় (র.), ২. নাফি' ইবন উমরের আযাদকৃত গোলাম (র.), ৩. মুহাম্মদ
. আইম্মা আরবাআহ্ঃ কাযী আতহার হোসাইন, ১০৪-১০৫ পৃষ্ঠা।
ইব্ন মুসলিম ইব্র শিহাব যুহরী (র.). ৪. যায়িদ ইব্ন আসলাম (র.). ৫. আমির ইব্ন আবদুল্লাহ্ (র.), ৬. নাঈম ইবন আবদুল্লাহ (র.). ৭. হুময়েদ আত্ তাবীল (র.). ৮. সাঈদ মাকবারী (র.). ৯. আবু হাযিম সালামাহ ইব্ন দীনার (র.), ১০. শরীফ ইব্ন আবদুল্লাহ্ (র.). ১১. সালিহ্ ইব্ন কায়সান (র.), ১২. সাফওয়ান ইব্ন সুলাইম (র.), ১৩. আবুয যিনাদ (র.). ১৪. মুহাম্মদ ইব্ন মুনকাদির (র.). ১৫. আবদুল্লাহ্ ইব্ দীনার (র.) ১৬ আর তাওয়ালা (র.). ১৭. আবদ রাব্বিহ ইবন সাঈদ (র.), ১৮. ইয়াহইয়া ইব্ন আবূ 120/523 দুর রহমান ইব্ন কাসিম (র.), ২০. আইয়্যুব সাতিয়ানী (র.). ২১. সাওর ইব্রাহীম ইবন আবূ আবালাহ মুকদাসী (র.), ২৩. হিশাম ইবন উরওয়াহ্ (র.). ২৪. আয়শা বিনতে সা'দ ইব্ন আবূ ওয়াক্কাস (র.). ২৫. ইয়াযীদ ইবন মুহাজির (র.). ২৬. ইয়াযীদ ইব্ন আবদুল্লাহ্ বুযায়ফা (র.), ২৭. আবুয যুবাইর মাক্কী (র.), ২৮. ইব্রাহীম ইবন উকবা (র.), ২৯. মূসা ইবন উব্বা (র.), ৩০. ইসমাঈল ইব্ন আবূ হাকীম (র.). ৩১. হামীদ ইব্ন আবদুর রহমান (র.), ৩২. হামীদ ইব্ন কায়স মাক্কী (র.), ৩৩. দাউদ ইব্ন হুসাইন (র.), ৩৪. যিয়াদ ইবন সা'দ (র.), ৩৫. যায়িদ ইবন রাবাহ্ (র.), ৩৬. সালিম ইব্ন আবূন্ ন (র.). ৩৭. সুহায়ল ইব্ন আবূ সালিহ্ (র.), ৩৮. আবদুল্লাহ্ ইব্ন আবূ বকর (র.). ৩৯. আবদুল্লাহ্ ইবন ফযল হাশিমী (র.), ৪০. আবদুল্লাহ্ ইব্ন ইয়াযীদ (র.), ৪১. উবায়দুল্লাহ্ ইবন আবদুল্লাহ (র.) প্রমূখ।১ ২২.
খল্ল্ফ ইবন উমর (র.) বলেন, একদা আমি ইমাম মালিক (র.)-এর নিকট বসেছিলাম। এ সময় মদীনার ক্বারী ইবন কাসীর তাঁর নিকট একটি পত্র দিলেন। তিনি পত্রটি পড়ে তা জায়নামাযের নীচে রেখে দিলেন। এরপর তিনি যখন দাঁড়ালেন আমিও তখন তাঁর সংগে দাঁড়ালাম। তিনি আমাকে বসতে বললেন। এবং পত্রটি পড়তে দিলেন। পড়ে দেখলাম। এতে এক স্বপ্নের বৃত্তান্ত লেখা আছে; কতিপয় লোক রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর চর্তুপাশে একত্রিত হয়ে তাঁর কাছে কি যেন চাচ্ছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁদেরকে বললেন, ঐ মিম্বরের নীচে রক্ষিত আছে। মালিককে তা বণ্টন করার জন্য বলে দিয়েছি। তোমরা মালিকের নিকট যাও। লোকেরা আলোচনা করতে করতে প্রত্যাবর্তন করল যে মালিক কি তা বন্টন করছে? একজন বললেন, তাঁকে যখন হুকুম দেওয়া হয়েছে তখন তিনি অবশ্যই তা পালন করবেন। ইমাম মালিক (র.) এই স্বপ্ন শুনে এমনভাবে কাঁদলেন যে, আমি তাঁকে ক্রন্দনরত অবস্থায়ই রেখে এলাম। এ থেকে মালিকের ইল্মী মর্যাদা যে, কত ঊর্ধ্বে তা অনুমান করা যায়।২
ইমাম মালিক (র.) এর শিক্ষা মজলিস খুব শান-শওকতের ছিল। তিনি খুব সুন্দর পরিপার্টি পোষাক পরিধান করে, আতর, সুরমা ব্যবহার করে এবং খুব জাঁকজমকপূর্ণ আসনে ১. আইম্মা আরবাআহ্: কাযী আতহার হোসাইন, ৯৮-১০৮ পৃষ্ঠা। ২. আইম্মা আরবাজাহ: কাথী আতহার হোসাইন, ১১৫ পৃষ্ঠা।
বসে শিক্ষা দান করতেন। হাদীস ও কুরআন পাকের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের লাক্ষাই তিনি এইরূপ করতেন। তিনি আজীবন মদীনায় মুনাওয়ারায় ছিলেন। অন্য মসজিদে নববীতে বসেই তিনি শিক্ষা দান করতেন। বহু দূর দূরান্ত থেকে 121/523 তার নিকট হতে হাদীস ও ফিকহের শিক্ষা লাভ করতো। বিশেষ করে মিশর ও আফ্রিকাবাসীগণ ও তাঁর নিকট হতে ফিকহ শিক্ষা করার জন্য আগমন করত এবং শিক্ষা লাভের পর নিজ নিজ দেশে গিয়ে তা প্রচার করত। ইমাম শাফি'ঈ (র.) ইমাম আবূ ইউসুফ (র.) ও ইমাম মুহাম্মদ
(র.) তাঁর নিকট শিক্ষা লাভ করেছেন এবং তাঁর সূত্রে হাদীস বর্ণনা করেছেন।
ইমাম মালিকের শাগরিদের সংখ্যা অগণিত। ইমাম যাহাবী (র.) লিখেন, তাঁর নিকট হতে এত সংখ্যক মানুষ হাদীস বর্ণনা করেছেন যাঁদের সংখ্যা গণনা করা প্রায় অসম্ভব। কাযী আয়ায (র.) ইমাম মালিকের শাগরিদের সংখ্যা তেরশ' বলে বর্ণনা করেছেন। হাফিয দারু কুতনী শাগরিদদের সংখ্যা এক হাজার বলেছেন। তাঁর কোন কোন উস্তাদও তাঁর নিকট থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। যেমন ইমাম যুহরী, আবুল আসওয়াদ, আয়্যুব সাপ্তিয়ানী, রাবীয়াতুর রায়, ইয়াহইয়া ইব্ন সাঈদ আনসারী, মুহাম্মদ ইব্ন যিব (র.) প্রমুখ।
ইমাম মালিক (র.)-এর প্রথিতযশা শাগরিদগণ হতে কিছু সংখ্যক নাম নিম্নে প্রদত্ত হল:
ইমাম মোহাম্মদ, ইমাম শাফিঈ, ইমাম আবূ ইউসুফ, আবদুল্লাহ্ ইব্ন মুবারক, লায়স ইবন সা'দ, শুবা সুফইয়ান মাওরী, ইব্ন জুরাইজ, ইবন উয়ায়না, ইয়াহইয়া ইবন সা'ঈদ আল-কাতান, ইব্ন মাহদী, আবূ আসিম আন নাবীল, আবদুর রহমান আওযায়ী (র.) প্রমূখ।১
ইমাম মালিকের যুগে হাদীস ও ফিকহের সংকলন আরম্ভ হয়েছিল। ১৪০ হিজরী হতে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ফিকহ্ বিষয়ে কিতাবাদি রচনা শুরু করা হয়। উলামায়ে উম্মাত তখন থেকে ফিকহ্ ও হাদীসের অসংখ্য গ্রন্থাদি রচনা করতে থাকেন। ইমাম মালিক (র.) তাঁদের মধ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর রচনাবলীর মধ্যে নিম্নে বর্ণিত গ্রন্থাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
১. আল মুওয়াত্ )الموطاً(
২. রিসালাতুহু ইলা ইব্ন ওহাব ফি'ল কার )ر سالته إلى ابن وهب في القدر
৩. কিতাবুন নুজুম ওয়া হিসাবু মাদারি'য যামান ওয়া মানাফিলি'ল কামার
كتاب النجوم و حساب مدار الزمان ومنازل القمر
৪. রিসালাতুল মালিক ফি'ল আকায্যিয়াহ )رسالة مالك في الأقضية(
১. আইম্মা আরবাআহ্ঃ কাসী আতহার হোসাইন, ৯৮-১০৮ পৃষ্ঠা।
৫. রিসালাতুহু ইলা আবী গাসসান মুহাম্মদ ইবন মুতাররাফা ফিল ফাওয়া ر سالته إلى أبي غسان محمد بن مطرف في الفتوى)
৬. রিসালাতুহু ইলা হারুনুর রশীদ আল-মাশহুরাতু ফি'ল আদাবে ওয়া'ল মাওয়ায়েয رسالته إلى هارون الرشيد المشهورة في الأدب والمواعظ
৭. আত্-তাফসীর লি-গারীবি'ল কুরআন ) التفسير الغريب القرآن
523 / 122
৮. কিতাবু'স সিয়ার )كتاب السير(
৯. রিসালাতুহু ইলা'ল লায়স ফী ইজমাঈল মাদীনাহ )رسالته إلى الليث في إجماع المدنية(
ইত্যাদি।
ইমাম মালিক (র.) ১৭৯ হিজরী সনে রবিউল আউয়াল মাসের ১১ অথবা ১৪ তারিখ শনিবার ইন্তিকাল করেন। তাঁর বয়স সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। কেউ বলেছেন, ৮৪কেউ কেউ ৮৬ কেউ ৮৭ আবার কেউবা বলেছেন, ৯০ বছর।
ইমাম মালিক (র.)-কে জান্নাতুল বাকীতে দাফন করা হয়। মৃত্যর সময় তিনি মুহাম্মদ ও ইয়াহ্ইয়া নামক দুই পুত্র রেখে যান। তাঁরা মুহাদ্দিস ছিলেন।১
ইমাম মালিক (র.) সুদীর্ঘ প্রায় ৫০ বছর কাল হাদীস ও ফিকহের অধ্যাপনা ও ফায়া দানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি স্বতন্ত্রভাবে ফিকহের কোন কিতাব রচনা করেননি। তবে ইমাম মালিক (র.) মাসআলা-মাসাইল সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নের যে সকল উত্তর প্রদান করেছেন, তাঁর ইন্তিকালের পর তাঁর শাগরিদগণ 'মোদাওয়ানা' নাম দিয়ে এর একটি সংকলন বের করেন। পরবর্তীতে এই সংকলনই ফিকহে মালিকী নামে খ্যাতি লাভ করে।
ইমাম মালিক (র.) ফাওয়া দানের সময় প্রথমে কুরআনের উপর এরপর বিশুদ্ধ হাদীসের উপর নির্ভর করতেন। তিনি হাদীসের সনদের ব্যাপারে হিজাযের মুহাদ্দিসগণকে অগ্রাধিকার দিতেন। মদীনাবাসীদের আমল ও তাঁদের প্রচলিত সামাজিক প্রথাকে তিনি খুব গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতেন। মদীনাবাসীদের আমলে বিপরীত হওয়ার কারণে অনেক হাদীস তিনি গ্রহণ করেন নি।
ইমাম মালিকের মতে تعامل أهل مدينه' অর্থাৎ মাদীনাবাসীদের আমল, প্রথা ও অভ্যাস
ফিকহ্ শাস্ত্রের বিশেষ নির্ভরযোগ্য উৎস। তাঁর মতে মদীনাবাসীদের আমল ও তাঁদের সর্বসম্মত মতামতের পরে হচ্ছে কিয়াসের স্থান। হানাফী মাযহাবের মত তাঁর মাযহাবে কিয়াসের তত
১. আইম্মা আরবাআহঃ কাযী আতহার হোসাইন, ৯৮-১০৮ পৃষ্ঠা।
আধিক্য নেই। তবে হানাফী মাযহাবে )إستحسان( এর মত মালিকী মাযহাবেও )إستصلاح( অথবা )مصالح مرسلة( এর উপর আমল করা হয়। )إستصلاح( এর অর্থ মুসলিহাত বা সামঞ্জস্য বিধান।
জন কল্যাণের উদ্দ্যেশে কোন নিয়ম কানুনকে সামঞ্জস্য পূর্ণ করে গতণ করার নাম ইতিসলাহ্ )إستصلاح(। মোট কথা, মালিকী মাযহাবের মতে মা 1237523 माह জন্য ফিকহ্ শাস্ত্রের উৎস হল:
১. কুরআন, ২. হাদীসে রাসূল (সা.), ৩. আসারে আহলে মদীনা, ৪. তা'আমূলে আহলে মদীনা, ৫. কিয়াস )قیاس( ও ৬. ইসতিল্লাহ্ )إستصلاح
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০৫৩) ইমাম আ'যম আবু হানীফা (র.) | (০৫৫) ইমাম শাফি'য়ী (র.) |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |