প্রসিদ্ধ চার মাযহাবের ইমামগণের মধ্যে ইমাম আযম আবূ হানীফা (র.) হলেন প্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ। তাঁর নাম নু'মান, উপনাম আবু হানীফা। তাঁর বংশ তালিকা এরূপ আবূ হানীফা নু'মান ইব্ন সাবিত ইব্ নু'মান মারযুবান। কারো মতে তাঁর দাদার নাম ছিল যূতী। ইমাম আ'যম আবূ হানীফা (র.) ছিলেন একজন তাবিঈ। তিনি ইমাম আবু হানীফা নামেও সমধিক প্রসিদ্ধ। তিনি হানাফী মাযহাবের প্রবর্তক। পৃথিবীতে তাঁর অনুসারীর সংখা সর্বাধিক।
ইমাম আ'যম আবু হানীফা (র.) কুফা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম সাল সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ বলেছেন, ৬৩ হিজরী, কেউ বলেন ৭০ হিজরী, আবার কেউ বলেছেন ৮০ হিজরী সন। অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে তিনি উমাইয়া খলীফা আবদুল মালিক ইব্ন মারওয়ানের শাসনামালে ৮০ হিজরী সনে জন্মগ্রহণ করেন। তবে প্রখ্যাত গল্পষক লেখক আল্লামা যাহিদ আল-কাওসারী বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্যে ভিত্তিতে ইমাম আবূ হানীফা (র.)-এর জন্ম সন হিসাবে ৭০ হিজরী সালকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। ১
ইমাম আযম আবূ হানীফা (র.)-এর পিতামহ যূতী কাবুলের অধিবাসী একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোক ছিলেন। তিনি হযরত আলী (রা.)-এর যুগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর কুফায় আগমন করেন এবং এখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তবে ইমাম আযম আবূ হানীফা (র.)-এর পৌত্র ইসমাঈল বলেন, আমরা বংশীয়ভাবে পারস্যের অধিবাসী ছিলাম। আমার পিতামহ ইমাম আ'যম আবূ হানীফা (র.) ৮০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেছেন।
ইমাম আ'যম আবু হানীফা (র.)-এর পিতা সাবিত হযরত আলী (রা.)-এর খিদমতে উপস্থিত হন এবং তাঁর নিকট নিজের ও তাঁর বংশধরদের কল্যাণের জন্য দু'আ করার আবেদন জানান। হযরত আলী (র.) তাঁর এবং তাঁর বংশধরদের জন্য দু'আ করেন। সম্ভবত এ দু'আর বরকতেই ইমাম আযম আবু হানীফা (র.) এত বড় জ্ঞানের অধিকারী ও শ্রেষ্ঠ ইমাম হতে
১. আস্সুন্নাতু ও মাকানাতুহ্য ফিত্ তাশরী'ঈল ইসলামী: ড. মুস্তাফা হুসনী আস্ সুবাঈ, ৪০১ পৃষ্ঠা।
পেরে ছিলেন। তিনি কৃষ্ণায় তায়মুল্লাহ ইবন সা'য়ালাবাহ গোত্রের মিত্র ছিলেন বলে তাঁকে তায়মুল্লাহ্ও বলা হয়। ১
সেকালে ইসলামী শহরগুলোর মধ্যে কুফা নগরী ছিল সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। বড় বড় উলামা, মুহাদ্দিসীন ও ফুকাহার সমাবেশের ফলে কুফা নগরী সে কালের ইলমের মারকায় ও কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। নাহু, সরফ, হাদীস, ফিকহ, দর্শন ইত্যাদি জ্ঞান চর্চার মারকায হিসেবে কৃষ্ণা ছিল সারা পৃথিবীর নিকট সুপরিচিত।২ 325
ইমাম আযম আবূ হানীফা (র.) ছিলেন অসাধারণ মেধাশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। তিনি সর্বপ্রথম ইল্মে কালাম শিক্ষা লাভ করেন। তিনি এই বিষয়ে এত গভীরতা ও পারদর্শিতা লাভকরেন যে, লোকেরা তাঁর দিকে ইশারা করে বলত তিনি হলেন, ইলমে কালামের শ্রেষ্ঠ ইমাম। সে কালের যিন্দীক, নাস্তিক ও বাতিল শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে মুনাযারা করে তিনি অত্যন্ত সুখ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর নিজের বক্তব্য যে, শুধুমাত্র মুনাযারা ও বাহাসের উদ্দেশ্যে আমাকে বিশ বার বসরায় গমন করতে হয়েছে। ৩
কোন কোন সময় পূর্ণ এ বছর আবার কোন কোন সময় প্রায় এ বছরকাল বসরায় অবস্থান করে খারিজী, হাসবিয়া ইত্যাদি বাতিল ফিরকার মুকাবিলায় আমাকে বাহাস করতে হয়েছে। সে সময় ইল্মে কালামই ছিল আমার নিকট সবচেয়ে প্রিয়। একেই দীন ও শরী'আতের সবচেয়ে মৌলিক জ্ঞান বলে আমি ধারণা করতাম। এবং এ দ্বারাই দীনের বিরাট খিদমত হয় এ-ই ছিল আমার বিশ্বাস। এরপর আমি ভেবে চিন্তে দেখলাম যে, হযরত সাহবায়ে কিরাম ও তাবিঈন আমাদের তুলনায় দীন ও শরী'আতের ব্যাপারে অধিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অধিকারী ছিলেন। তথাপি তারা তর্ক-বিতর্ক ও বাহাস-মুবাসায় লিপ্ত হননি। বরং দীনের বাপারে তর্ক-বিতককে কঠোরভাবে নিষেধ করতেন। তাঁরা তো শরী'আতের ফিকহী মাসআলা, মাসাইল ও আহকামের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন এবং এ জন্য ইল্মী হাল্কা ও মজলিস কায়েম করেছিলেন। এ সময় আমাকে এক মহিলা একটি মাসআলা জিজ্ঞাসা করলে আমি এর উত্তর না দিতে পেরে বড় লজ্জিত হলাম। তখন আমি ইল্মে কালাম বাদ দিয়ে ফিকহ্ ও হাদীস শিক্ষার জন্য আত্মনিয়োগ করলাম। ৪
তারপর তিনি সে যুগের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফকীহ্ ইমাম হাম্মাদ (র.)-এর ইল্ল্মী হাল্ক্কায় শরীক হয়ে ইল্মে হাদীস ও ইল্মে ফিকহ্ অর্জনে আত্মনিয়োগ করেন। ইমাম হাম্মাদ (র.)-এর দারসের এ মজলিস হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন মাসউদ (রা.)-এর সাথে সম্পর্কযুক্ত
১. আখরারু ইমাম, আবু হানীফা ওয়া আসহাবিহীঃ আবু আবদুল্লাহ্ হুসাইন ইবন আলী আস- সীমিরী, ৩ পৃষ্ঠা; ইখ্য আরবা'আহঃ কাযী আতহার হোসাইন, ৩৪ পৃষ্ঠা। ২. আখবারে আবূ হানীফা ওয়া আসহাবিহী সীমিতী, আইম্মা আরবা 'আহঃ কাযী আতহার হোসাইন। ৩. আসুন্নাতু ও মাকানাতুহা ফিত্ তাশরী'ঈল ইসলামী: ড. মুস্তাফা হুসনী আসু সুবাঈ, ৪০১পৃষ্ঠা। ৪. আইম্মা আরবাআহ্ঃ কাষী আতহার হোসাইন, ৪০ পৃষ্ঠা।
ছিল। কেননা হাম্মাদ (র.) ইব্রাহীম নাঙ্গ, হযরত আল্ল্ফামা (র.) থেকে এবং হযরত আলকামা (র.) হযরত আবদুল্লাহ্ ইন মাসউদ (রা.) থেকে ইলমে হাদীস ও ইল্মে ফিকহ্ শিক্ষা লাভকরেছেন। ইমাম আ'যম আবু হানীফা (র.) ইমাম হাম্মাদ (র.)-এর মৃত্যু পর্যন্ত (১২০ হিঃ) মোট আঠার বছরকাল অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে নিয়মিতভাবে তাঁর নিকট থেকে ইলমে হাদীস ইলমে ফিকহ্ শিক্ষা লাভ করেন। যার ফলে ইমাম হাম্মাদের (র.). মৃ সর্বসম্মতিক্রমে ইমাম আ'যম আবু হানীফা (র.)-কে তাঁর স্থলাভিষি 111/523 কায় অবস্থিত এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব তাঁর উপর ন্যস্ত করেন। পরবর্তী সময়ে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি 'মাদ্রাসাতুর রায়' নামে খ্যাতি অর্জন করে। ইমাম আ'যম আবূ হানীফা (র.) সমগ্র ইরাকের শ্রেষ্ঠ ফকীহ্ হিসাবে সর্বজন কর্তৃক স্বীকৃতি লাভ করেন এবং সারা বিশ্বে তাঁর ইল্ম ও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।১ كاجال
ইমাম আ'যম আবু হানীফা (র.) ২২ বছর বয়স পর্যন্ত শুধুমাত্র ইলমে কালাম শিক্ষায় রত ছিলেন তা-ই নয় বরং সাথে সাথে ইলমে হাদীসও শিক্ষা করেছেন। তবে ঐ সময়ে তিনি ইলমে হাদীস শিক্ষার তুলনায় ইল্মে কালামকে অধিক প্রাধান্য দিয়েছিলেন। ২২ বছর বয়সের পর থেকে তিনি কেবলমাত্র ইলমে হাদীস ও ইল্মে ফিকহ্ শিক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন। হাম্মাদের (র.) সাহচর্যে থাকাকালীন দরসের অবশিষ্ট সময়ে তিনি বিভিন্ন মুহাদ্দিসগণের খিদমতে হাযির হয়ে ইলমে হাদীস শিক্ষা গ্রহণ করতেন। ফিকহু শিক্ষার ক্ষেত্রে ইমাম হাম্মদ (র.) যেমন ছিলেন তাঁর বড় উস্তাদ। তেমনি হাদীস শিক্ষার ক্ষেত্রে আমির শা'বী ছিলেন তাঁর বড় উস্তাদ। একবার ইমাম সাহেব হাদীসের উস্তাদ আ'মাশের দরবারে উপস্থিত হলে উস্তাদ তাঁকে কিছু প্রশ্ন করেন। উস্তাদ আ'মাশ বললেন, তুমি কোন্ দলীলের ভিত্তিতে এ উত্তর দিয়েছ? তখন ইমাম সাহেব বললেন, আপনার কাছ থেকে যে হাদীস শিক্ষা করছি তার ভিত্তিতে উত্তর দিয়েছি। ইমাম আ'মাশ তখন বললেন, হে ফকীহ্ সম্প্রদায়! তোমরা হলে ডাক্তার আর আমরা ঔষধ বিক্রেতা। ইমাম আ'যম আবু হানীফা (র.) বলতেন, ঐ ব্যক্তিরই হাদীস বর্ণনা করবার অধিকার রয়েছে যিনি হাদীস শ্রবণ করে তা মুখস্থ রাখতে পারেন। ইমাম ইয়াহইয়া ইবন মু'ঈন বলেন, ইমাম আ'যম আবূ হানীফা (র.) মুখস্থ ব্যতীত অন্য কোন হাদীস বর্ণনা করেন না।২
সেকালের ইল্মী মারকায-বসরা, মক্কা মুয়ায্যমা ও মদীনা মুনাওয়ারার শ্রেষ্ঠ উলামা-ই-কিরাম ও ইমামগণের সথে ইমাম আ'যম আবু হানীফা (র.)-এর সাক্ষাত ঘটে। আব্বাসী খলীফা মানসুর যখন বাগদাদ নগরী স্থাপন করেন। তখন বাগদাদের উলামা ও মাশাইখের সংগে তাঁর সাক্ষাত লাভ এবং এ সকল উলামা ও মাশাইখের সংগে ইমাম আবূ হানীফা (র.)-এর বিভিন্নভাবে ইল্মী আলোচনা ও পর্যালোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এ সব আলোচনার মাধ্যমে ইমাম আ'যম আবু হানীফা (র.) যেমনিভাবে তাঁদের থেকে ইলমী ফায়দা লাভ করেন অনুরূপভাবে তাঁরাও ইমাম আবূ হানীফা (র.) থেকে যথেষ্ট উপকৃত হন। ফলে
১. আস্সুন্নাতু ও মাকানাতুহা ফিত্ তাশরী'ঈল ইসলামী: ড. মুস্তাফা হুসনী আস্ সুবাঈ, ৪০১ পৃষ্ঠা। ২. আইম্মা আরবাআহ্: কাযী আতহার হোসাইন, ৪২ পৃষ্ঠা।
ইমাম আ'যম আবূ হানীফা (র.)-এর সুখ্যাতি এত ছড়িয়ে পড়ে যে তাঁর ইল্মী হালকা বিশাল সমাবেশরূপে পরিণত হয়। যার এক দিকে ছিলেন আবদুল্লাহ্ ইবন মুবারক ও হাক্স ইব্ন গিয়াস (র.) প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ অপরদিকে ছিলেন ইমাম আবূ ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মদ ইব্ হাসান, যুফার, হাসান ইবন যিয়াদের মত ফকীহগণ।১
ইমাম আ'যম হানীফা (র.) অসংখ্য উস্তাদ থেকে ইল শিক্ষা করেছিলেন। আবূ হাক্স কাৰীরের নির্দেশে ইমাম সাহেবের উস্তাদগণের যে তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছিল তার মধ্যে চার হাজার উস্তাদের নাম লিপিবদ্ধ ছিল। 'উকদুল জুমান' গ্রন্থে তাঁর দুই শ' আশি জন উস্তাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। নিম্নে আবূ হানীফা (র.)-এর কিছু সংখ্যক প্রসিদ্ধ উস্তাদের নাম উল্লেখ করা হল ৪
১. হাম্মাদ ইব্ন আবূ সুলাইমান (র.), ২. আমির ইব্ন শূরাহবীল হিমাইরী কৃষ্ণী (র.), ৩. আল কামা ইব্ন মারসাদ কৃষ্ণী (র.), ৪. হাকাম ইব্ন কুতায়বা কৃষ্ণী (র.), ৫. আসিম ইন্ন আবুন-নাজওয়াদ কৃষ্ণী (র.), ৬. সালমান ইব্ন কুহায়েল কূফী (র.). ৭. আলী ইব্ন আকমার কৃষ্ণী (র.), ৮. যিয়াত ইব্ন আলফাহ কৃষ্ণী (র.), ৯. হায়সাম ইন্ন হাবীব (র.), ১০. আতা ইব্ন আবী রাবাহ মক্কী (র.), ১১. সাঈদ ইবন মাসরুক সাওরী (র.), ১২. আবু জা'ফর আল-বাকের মুহাম্মদ ইব্ন আলী (র.), ১৩. আদী ইব্ন সাবিত আন্সারী, ১৪. আতিয়্যা ইব্ন সাঈদ আওফী (র.), ১৫. আবূ সুফইয়ান সাদী (র.), ১৬. আবূ উমায়্যা আবদুল কারীম (র.), ১৭. আবু মুযারিফ বাসরী (র.), ১৮. ইয়াহ্ ইয়া ইবন সা'ঈদ আন্সারী (র.), ১৯. ইহশাম ইব্ন উরওয়ার মাদানী (র.), ২০. নাফি ইব্ন মাওলা ইবন উমার মাদানী (র.), ২১. আমর ইব্ন দীনার মাক্কী (র.), ২২. আব্দুর রহমান ইব্ন হরমুয আল-আ'নাজ মাদানী (র.), ২৩. কাতাদাহ্ ইব্ন দাআমাহ বাসরী (র.) ২৪. আবু ইসহাক সাবী'ঈ কুফী (র.), ২৫ মুহারিব ইন্ন দিসার কুফী (র.) ২৬. মুহাম্মদ ইব্ন মুনকাদির (র.) ২৭. সিমাক ইন্ন হারব কুফী (র.) ২৮. কায়স ইব্ন মুসলিম কৃষ্ণী (র.) ২৯. ইয়াযীদ ইব্ন সুহায়েব কৃষ্ণী, ৩০. আবদুল আযীয ইব্ন কাফী মাক্কী, ৩১. আবূ যুবায়ের মুহাম্মদ মুসলিম মাক্কী, ৩২. মানসুর ইবন মু'তাসির কৃষ্ণী, ৩৩. সুলাইমান ইব্ন মেহরান (র.) এবং অনেক বিখ্যাত তাবি'ঈ।৩ অধ্যাপনা
ইমাম আবূ হানীফা (র.)-এর প্রধানতম উস্তাদ হাম্মাদ ইব্ন আবূ সুলায়মানের মৃত্যুর পর সর্ব-সম্মতিক্রমে ইমাম আবু হানীফাকে তাঁর স্থলাভিষিক্তি করা হয়। ইমাম সাহেব প্রাথমিক পর্যায়ে স্বীয় উস্তাদের স্থালাভিষিক্ত হয়ে হাল্কা কায়েম করতে ইতস্তত করছিলেন। এমন সময় তিনি স্বপ্নে দেখলেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কবর খনন করছেন। এতে ইমাম সাহেব খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। এরপর তিনি বসরা গমন করে এক ব্যক্তির মাধ্যমে মুহাম্মদ ইব্ন সীরীন (র.)-এর নিকট স্বপ্নের তা'বীর জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি উত্তরে বললেন, "স্বপ্নদ্রষ্টা
১. প্রাগুক্ত ২. তাহযীবুত তাহযীব, ১০ খণ্ড, ৩৩৯ ৭৮পৃষ্ঠা। তাযাকরিআতুলংষ্কাষ, ১ম খণ্ড, ১৫৯ ৭৮পৃষ্ঠা; আইম্মা আরবাআহ্: কাযী আতহার হোসাইন, ৬৭ পৃষ্ঠা। ৩. আখবারু ইমাম আবু হানীফা ওয়া আসহাবিহী ঃ-আবূ আবদুল্লাহ্ হুসাইন ইব্ন আলী আস- সীমিরী, ৩ পৃষ্ঠা; আইম্মা আরবা 'আহ্ঃ কাষী আতহার হোসাইন, ৮৬ পৃষ্ঠা।
রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর হাদীসের ভাণ্ডার বিকশিত করবেন"। এরপর থেকে ইমাম সাহের প্রসন্ন মনে ফিকহ্ ও ফাওয়ার দরস দিতে শুরু করেন।
অল্পদিনের মধ্যেই ইমাম সাহেবের দরস ও তাদরীসের সুখ্যাতি চর্তুদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে আলিমগণ তাঁর দরসে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। ওয়াকী ইব্ন জাররাহ বলেন, ইমাম আবু হানীফা (র.) কি করে ভুল সিদ্ধান্ত দিতে পারেন, যেখানে তাঁর হালকায় সর্ব বিষয়ের যোগ্য ও পারদর্শী ব্যাক্তিবর্গ বিদ্যমান আছেন। যেমন, ইমাম আবু ইউসুফ, মুহাম্মদ ও যুফার (র.) সহ বহুসংখ্যক আলিম ইমাম সাহেবের দরসে শরীক হতেন। এর মধ্যে দশজন এমন যাঁরা কখনও অনুপস্থিত থাকতেন না। তাঁদের মধ্যে চারজন এমন ছিলেন যাঁদের ফিকহ্ কন্ঠস্থ ছিল। যেমন- যুফার, আবু ইউসুফ, আসাদ ইব্ন আমর, আলী ইন্ন মুসহির (র.) প্রমুখ।১
ইমাম আবু হানীফা (র.)- এর হাজার হাজার ছাত্র ছিল। তৎকালে অন্য কোন মুহাদ্দিস বা ফকীহ্ -এর এত সংখ্যক ছাত্র ছিল না। মক্কা মুকাররমা, মদীনা মুনাওয়ারাহ, দামেশক, বাসরা, কৃষ্ণা, ওয়াসিত, মুসিল, জাযীরা, রিক্কাহ, রামল্লাহ্, মিসর, ইয়ামন, বাহরাইন, বাগদাদ, আওয়ায, কিরমান, ইস্পাহান, ইস্তারাবাদ, হালওয়ান, হামদান, দামগান, তারাস্তান, জুরজান, সারসী, নিসা, মারু, বুখারা, সামরকন্দ, তিরমিয, বলখ, কুহেস্তান, খাওয়ারিযাম, সিজিস্তান, মাদায়েন, হিমস্ ইত্যাদি এলাকার হাজার হাজার শিক্ষার্থী ইমাম সাহেবের দরসে অংশগ্রহণ করে শিক্ষা লাভ করেছেন। 'উকদুল জুমান' গ্রন্থের লিখক উক্ত কিতাবে ইমাম আবু হানীফা (র.) এর আটশ' শাগরিদের নাম লিপিবদ্ধ করেছেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে বহু সংখ্যক ফকীহ্, মুহাদ্দিস ও কাযী ছিলেন। ইমাম সাহেবের কিছু প্রসিদ্ধ ছাত্রের মধ্যে কাযী আবূ ইউসুফ ইয়াকুব ইব্ন ইব্রাহীম, মুহাম্মদ ইব্ন হাসান শায়বানী, যুফার ইবন হুযায়ল আম্বরী, হাম্মাদ ইব্ন আবু হানীফা, হাসান ইবন যিয়াদ, আবু ইসমাত নূহ্ ইব্ন মারয়াম, কাযী আসাদ ইবন আমর, আবু মুতী' হাকাম ইব্ন আবদুল্লাহ্ বলখী, মুগীরা ইব্ন মিকসাম, যাকারিয়া ইব্ন আবূ যায়দা মিসআর ইব্ন কুদাম, সুফইয়ান সাওরী, মালিক মিগওয়াল, ইউনুস ইবন আবু ইসহাক, দাউদ তাঈ, হাসান ইব্ন সালেহ্, আবূ বক্স ইন্ন আইয়্যাশ, ঈসা ইবন ইউনুস, আলী ইব্ন মুসহির, হাফস ইব্ন গিয়াস, আবূ আসিম নাবীল, জারীর ইব্ন আবদুল হামীদ, আবদুল্লাহ্ ইবন মুবারক, ওয়াকী' ইবুন জাররাহ্, আবু ইসাহাক ফাযারী, ইয়াযীদ ইবনু হারুন, মাক্কী ইব্ন ইব্রাহীম, আবদুর রায্যাক ইবন হাম্মাদ সান আলী, আবদুর রহমান মুকরী, হায়শাম ইব্ন বশীর, আলী ইব্ন আসিম, জাফর ইব্ন আওন, ইব্রাহীম ইব্ন তাহমান, হামযাহ ইবন হাবীব আয-যায়্যাত,
১. আখবারু ইমাম আবূ হানীফা ওয়া আসহাবিহি: আবূ আবদুল্লাহ্ হুসাইন ইব্ন আলী আস- সীমিরী, ৩ পৃষ্ঠা; আইম্মা আরবা'আহঃ কাষী আতহার হোসাইন, ৮৬ পৃষ্ঠা।
ইয়াযীদ ইব্ন রাফী, যুবায়, ইয়াহইয়া ইন্ন ইয়ামান, খারিজা ইবন মুসআব, মুসত্মাব ইব্ন কুদাম, রাবীয়া ইব্ন আবদুর রহমান রাঈ মাদানী (র.) প্রমুখ।১
ফিকহী মাসাইলের সংকলন ও রচনার প্রচলন নিয়মিতভাবে দ্বিতীয় শতাব্দীতে শুরু হয়। এ সময়ে বিজ্ঞ বিজ্ঞ উলামা, ফুকাহা ও মুহাদ্দিসগণ বিভিন্ন স্থানে কিতাব 114/523 ইমাম আবূ হানীফা (র.) ও কৃষ্ণাতে ইলমে ফিকহ্ সংকলন করেন। জামা'আত নিয়ে 'আল-মাজমাউল ফিকহী )المجمع الفقهي( প্রতিষ্ঠা করেন। এক
এতে তিনি হাদীস ও ফিকহ্ লিপিবদ্ধ করাতেন। পরবর্তীতে তাঁর শিষ্যগণ এই সকল লিপিবদ্ধ মাসাইল তাঁদের ছাত্রদেরকে শিক্ষা দান করেন। এ সংকলিত মাসাইলগুলোকে ইমাম আবূ হানীফার রচনাবলীর মধ্যে গণ্য করা হয়। এ ছাড়া ইমাম সাহেবের স্বরচিত কিতাবও রয়েছে, যেমন-
১. ফিকহিল আকরর )فقه الأكبر(
২. কিতাবু'ল রিসালাতুন ইলাল-বুঝী, )كتاب الرسالة إلى البستى(
৩. কিতাবু'ল আলিম ওয়াল মুতা আল্লিম, )كتاب العالم والمتعلم
৪. কিতাবুর রাদ্দে আলা'ল জাহমিয়া )كتاب الرد على الجهمية
আবদুল্লাহ্ ইব্ন দাউদ ওয়াসিতী মন্তব্য করেন যে, কেউ যদি অন্ধত্ব ও মূর্খতার লাঞ্ছনা হতে বেরিয়ে ফিকহের স্বাদ গ্রহণ করতে চায় সে যেন ইমাম আবু হানীফা (র.)-এর কিতাবসমূহ অধ্যয়ন করে। ২
ইমাম আবূ হানীফা (র.)-এর চারিত্রিক গুণাবলীতে ছিলেন এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। ইমাম আবূ ইউসুফ (র.) খলীফা হারুনুর রশীদের সামনে ইমাম সাহেব সম্পর্কে বলেন, ইমাম আবূ হানীফা (র.) অত্যন্ত পরহেযগার ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সর্বদা নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকতেন। অধিকাংশ সময় তিনি নীরব থাকতেন। তাঁর নিকট কোন মাসআলা জিজ্ঞাসা করা হলে তা জানা থাকলে তিনি তার উত্তর দিতেন। তিনি তিনি ছিলেন অত্যন্ত দানশীল ও দয়ালু। জাগতিক শান-শওকত ও জাকজমক তিনি মোটেও পসন্দ করতেন না। অন্যের অপবাদ দেওয়া হতে সর্বদা বিরত থাকতেন এবং পরোপকারিতা, ন্যায়পরায়ণতা, সত্যবাদিতা, 'সাধুতা, ধৈর্য, সংযম, মায়ের খিদমত ও উস্তাদের প্রতি ভক্তি ইত্যাদি বহু গুণাবলীর তিনি অধিকারী ছিলেন।
১. আসুন্নাতু ও মাকানাতুহ্য ফিত্ তাশরী 'ঈল ইসলামী: ড. মুস্তাফা হুসনী আস্ সুবাঈ। ৪০১পৃষ্ঠা।
২. আইম্মা আরবাআহ্ঃ কাযী আতহার হোসাইন, ৪০ পৃষ্ঠা।
ইমাম আবু হানীফা (র.) তৎকালীন শাসকগণ কর্তৃক অমানুষিকভাবে নির্যাতিত হন। উমাইয়া খিলাফতের সময় ইব্ন হুবায়রা তাঁকে কাযীর পদ গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করেন।
কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। যার কারণে ইমাম আবু হানীফা (র.)-কে দৈনিক দশটি বেত্রাঘাত করা হয়। এতসত্ত্বেও তিনি কাযীর পদ গ্রহণ করতে সম্মত হন নাই। এরপর আব্বাসী খিলাফত আমলে পুনরায় কাযীর পদ গ্রহণের জন্য তাকে অনুরোধ করা হয়। এবারও তিনি তা অস্বীকার করেন। যার কারণে খলীফা আবূ জা'ফর মানসূরের নির্দেশে তাঁকে গ্রেফতার করে কারাগারে রাখা হয়। কথিত আছে যে, কারাগারে তাঁকে বিষ পান করানো হয়েছিল।
তিনি ১৫০ হিজরী সনে কারাগারেই ইন্তিকাল করেন। বাগদাদের খেষরান নামক কবর স্থানের পূর্ব পার্শ্বে মসজিদ সংলগ্ন স্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। পরবর্তীতে ইমাম আ'যমের স্মরণে তাঁর মাযারস্থ অঞ্চলটি আ'যামিয়্যা নামে পরিচিত লাভ করে।১
ইমাম আবু হানীফা (র.) যদিও ইল্মে কালাম, ইলমে হাদীস, ইলমে ফিকহ্ ইত্যাদি সব বিষয়েই পারদর্শী ছিলেন। তবে ইল্মে ফিককে অধিক উপকারী মনে করে তিনি এর জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে দেন। সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে আবদুল্লাহ্ ইবন মাসউদ (রা.) ছিলেন ফিকহ শাস্ত্রে বিশেষ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। আবদুল্লাহ্ ইবন মাসউদের (রা.) ইল্মের বিশেষ উত্তরাধিকারী হাম্মাদ ইব্ন আবূ সুলাইমানের সাহচর্যে দীর্ঘদিন অবস্থান করে ইমাম আবু হানীফা (র.) হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদের (রা.) ফিক্ হাসিল করেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সূত্রে হযরত আলী, হযরত ইবন উমর, হযরত ইব্ন আব্বাস, হযরত যায়িদ ইব্ন সাবিত ও হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) থেকে বর্ণিত ফিকহী জ্ঞান লাভ করেন। ২
إني أخذت بكتاب الله وإذا وجدته فما لم أجد فيه أخذت بسنة رسول الله صلى الله عليه وسلم الآثار الصحاح عنه التي فشت في ايدى الناس عن الثقات فاذا لم أجد في كتاب الله وسنة رسول الله صلى الله عليه وسلم أخذت بقول أصحابه من شئت وأدع قول من شئت ثم لا أخرج عن قولهم إلى قول غيرهم فإذا انتقى الأمر إلى إبراهيم والشعبي وابن سرين وسعيد بن المسيب وعد رجلاً قد اجتهدوا على أن
أجتهد كما اجتهدوا.
১. আইম্মা আরবাআহ্ঃ কাযী আতহার হোসাইন, ৯২ পৃষ্ঠা। ২. প্রাগুক্ত
অর্থাৎ আমি ফিকহী বিষয়ে প্রথমত কিতাবুল্লাহ্ (কুরআন) থেকে হুকুম গ্রহণ করি। যদি কিতাবুল্লাহর মধ্যে সে সম্পর্কে হুকুম না পাই তবে সুন্নাত অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ্ থেকে বর্ণিত সহীহ হাদীস হতে হুকুম গ্রহণ করি। আর যদি কিতাবুল্লাহ্ ও সুন্নাতে রাসুলুল্লাহ্ (সা.) সে হুকুম না পাই তবে সাহাবীগণের মধ্যে যাঁর কথা গ্রহণযোগ্য মনে করি তাঁর কথা গ্রহণ করি। তাঁদের অভিমত বর্তমান থাকতে তা পরিত্যাগ করে অন্য কারো অভিমত গ্রহণ করি না। যখন সাহাবাদেরও কোন অভিমত না পাওয়া যায় এবং মাসআলার সিদ্ধান্ত ইব্রাহীম নাখঈ, শা'বী, ইব্ন সীরীন, হাসান, আতা, সাঈদ ইব্ন মুসায়্যিব প্রমূখ ফকীহগণের ইজতিহাদের উপর নির্ভরশীল হয় তখন আমিও ইজতিহাদ করি যেমন তাঁরা ইজতিহাদ করেন।১
ইমাম আবু হানীফা (র.)-এর ইজতিহাদের পদ্ধতি এই ছিল, যে সব বিষয়ে কিতাবুল্লাহ্, সুন্নাতে রাসূলুল্লাহ্ ও সাহাবাগণের কোন অভিমত পাওয়া যেত না সে সব বিষয়ে তিনি কিয়াস দ্বারা সমাধান করতেন। খতীবে বাগদাদী 'তারীখে বাগদাদে' আবদুল্লাহ্ ইব্ন মুবারক, তাঁর বক্তব্য বর্ণনা করেন যে, কোন বিষয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর হাদীস পাওয়া গেলে তা আমাদের শিরোধার্য। আর সাহাবাগণের বিভিন্ন মত পাওয়া গেলে তার মধ্যে কোন একটি মত নির্বাচন করে নিই। তাঁদের মত বর্জন করে অন্যভাবে সমাধান করি না। আর যদি তাবিঈনের অভিমত হয় সে ক্ষেত্রে আমরাও তাদের মত ইজতিহাদ করি। ২
ইমাম আবু হানীফা (র.) শরয়ী দৃষ্টিভঙ্গীতে সকল বিষয়ের, সমাধান কল্পে প্রখ্যাত চল্লিশজন ফকীহ্ নিয়ে ইল্মে ফিকহের একটি মজলিস কায়েম করেন। তাঁদের মধ্যে ইমাম আবূ ইউসুফ (র.), মুহাম্মদ (র.), যুফার (র.) ইমাম দাউদ তায়ী (র.), ইমাম আসাদ ইবন উমর (র.), ইমাম ইউসুফ ইব্ন খালিদ সিমতী (র.), ইয়াহইয়া ইব্ন যাকারিয়া ইব্ন আবূ যায়দা প্রমূখ ফকীহগণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই মজলিসে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তগুলো লিপিবদ্ধ করা হত। তাঁদের মধ্য থেকে একজনও যদি কোন ভিন্ন মত পোষণ করতেন তবে তিন দিন পর্যন্ত সে বিষয়ের আলোচনা করা হতো এরপর একমতে পৌঁছতে পারলে লিপিবদ্ধ করা হত।৩
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০৫২) হাম্বলী মাযহাবের বিকাশ | (০৫৪) ইমাম মালিক (র.) |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |