আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা'আতের চতুর্থ ফিক্হী মাসলাক হল 'হাম্বলী মাযহাব"। ইমাম আহ্মাদ ইবন হাম্বল (র.) এই মাযহাবের প্রবর্তক। বাগদাদ ছিল এ মাযহাবের কেন্দ্র। 'প্রাথমিক পর্যায়ে এ মাযহাবের প্রচার অন্য তিনটি মাযহাবের তুলনায় কম ছিল। আল্লামা ইব্ন খালদুন এর কারণ বর্ণনা প্রসংগে বলেন যে, ফিকহী হাম্বলীতে ইজতিহাদের ব্যবহার ছিল খুব কম। এ মাযহাবের মাসআলা-মাসাইল নিরূপণে যাহেরী আহাদীস ও নসূসের উপরই অধিকতর নির্ভর করা হতো। যে সকল হানাবিলা ইরাক ও সিরিয়ায় অবস্থান করতেন, তাঁরা ছিলেন আহলে হাদীস ও রেওয়াতের বর্ণনায় অগ্রগামী। আল্লামা ইব্ন কারহুন বলেন যে, ইমাম আহমাদ ইব্ন হাম্বলের মাযহাব বাগদাদ অতিক্রম করে সিরিয়ার অধিকাংশ এলাকায় প্রসারিত হয়। সপ্তম শতাব্দির পর সিরিয়ায় হাম্বলী মাযহাব প্রধান্য লাভ করে। আল্লামা সূয়ূতীর বর্ণনা অনুসারে বুঝা যায় যে, চতুর্থ শতাব্দিতে বাগদাদ ও ইরাকের সীমা অতিক্রম করে অন্যান্য দেশও হাম্বলী মাযহাব প্রসার লাভ করে। ইমাম আবদুল গণী মুদাসী (র.) মিসরে সর্বপ্রথম এ মাযহাব প্রচলন করেন। আল্লামা মুকদাসী (র.) বলেন, চতুর্থ শতাব্দিতে বস্ত্রা, আকওয়ার দায়লাম, বিহার, সুম, খুজিস্তান ইত্যাদি এলাকায় হাম্বলী মাযহাব বিদ্যমান ছিল। আল্লামা ইব্ন আছীর ৩২৩ হিজরীর গণনায় উল্লেখ করে বলেন, সে সময় বাগদাদে হাম্বলী মাযহাবের এত অধিক প্রভাব ছিল যে, মাযহাবের লোকেরা আমীর ওমরাদের বাড়ীতে নবীয শরাব ইত্যাদি পেলে তা ঢেলে দিত। নর্তকী ও গায়িকাদের প্রহার করত। গান-বাজনা, বাদ্যযন্ত্র চূর্ণ বিচূর্ণ করে ফেলত। শরী'আত বিরোধী কাজের উপর তারা এত কঠোরতা অবলম্বন করেছিল যে, বাগদাদবাসী এতে অস্থির হয়ে পড়ে। ফলে বাগদাদে সরাসরীভাবে এ ঘোষণা করা হয় যে, দুই হাম্বলী যেন একত্রিত হতে না পারে এবং হাম্বলী মাযহাবের কোন আলোচনা যেন করা না হয়। এর পূর্বে 'খালকে কুরআনের ফিত্না' এবং আব্বাসী খলীফা ও মু'তাযিলাদের বিবোধিতা হাম্বলী মাযহাব বিকাশে বিরাট বাধা সৃষ্টি করে। বর্তমানে এ মাযহাবের প্রাধান্য নান্দ এলাকা ব্যতীত অন্য কোথায়ও আছে বলে জানা যায় না। বর্তমান যুগে মাযহাবের চতুষ্ঠয়ের অনুসারী মিসরের প্রসিদ্ধ দার্শনিক আল্লামা আহমাদ তাইমুর 'নুযরাতুন তারিখিয়্যাতিন ফি'ল মাযাহিবি'ল আরবাআহ ওয়া ইন্তিশারুহা نظرة تاريخية في المذاهب الأربعة وانتشارها লিখেন-বর্তমানে এপৃথিবীতে মাযহাবের চুতুষ্টয়ের অনুসারী কোথায় কত সংখ্যক আছে তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা কঠিন। তবে প্রশ্চাত্য, তুনিস, আল জাষাইর এবং আফ্রিকার কিছু কিছু এলাকায় মালিকী মাযহাবের প্রাধান্য রয়েছে। এসকল এলাকায় তুর্কী বংশের সংগে সম্পৃক্ত কিছু সংখ্যক হানাফীও বিদ্যমান আছে। মিসরে শাফি'য়ী ও মালিকী মাযহাব অবলম্বী লোকদের সংখ্যা প্রচুর। সাদ ও সুদানে মালিকী মাযহাব পন্থীদের সংখ্যা অনেক। তবে হানাফীর সংখ্যা যথেষ্ট রয়েছে। অবশ্য কিছু সংখ্যক হাম্বলীও সেখানে বিদ্যমান রয়েছে।
উক্ত 'গ্রন্থে তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, সিরিয়ার অর্ধেক হানাফী, এক চতুর্থাংশ শাফি'য়ী এবং এক চতুর্থাংশ হাম্বলী। ফিলিস্তিনে শাফি'য়ীমাযহাবের প্রাধান্য বিদ্যমান। হানাফী এবং মালিকীও রয়েছে। ইরাকে হানাফী মাযহাব অধিক প্রচলিত। তবে শাফিয়ী, মালিকী ও হাম্বলী মাযহাবের অনুসারীও আছে। তুরস্ক, আলবেনীয়া, বালকান এলাকায় হানাফী মাযহাবের আধিক্য বিদ্যমান। কুরদিস্তান ও আরমেনিয়ায় শাফি'য়ী মাযহাবের প্রভাব অধিক। পারস্যে শাফি'য়ী মাযহাবের অনুসারী বেশী। সেখানে কিছু সংখ্যক হানাফীও রয়েছে। পশ্চিম তুর্কীস্তান তথা বুখারা, তাসখন্দ, উজবেকিস্তান, তুর্কমানিয়া, কাযাগায়রাহ, কাযাকিস্তান ও আযারবায়জান ইত্যাদি স্থানের অধিবাসী হানাফী মাযহাবের অনুসারী। পূর্ব তুর্কিস্তানের অধিবাসী হানাফী কিন্তু কিছু সংখ্যক শাফিয়ীও রয়েছে। কাওকায শহরে হানাফীদের প্রভাব অধিক। তবে সেখানে শাফি'য়ীমাযহাবের অনুসারীও কিছু রয়েছে। সিন্ধুতে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। হিন্দুস্তানের পশ্চিম সীমান্ত এলাকায় আরব বংশীয় লোক বসবাস করত। তারা শাফি'য়ীমাযহাবের অনুসারী ছিল। কাওকান, মালাবর ও মনদরাজের অধীবাসী শাফি'য়ী মাযহাবের অনুসারী। হিন্দুস্তানের অন্যান্য এলাকাও পাকিস্তান বাংলাদেশে হানাফী মাযহাব প্রচলিত। মালদ্বীপ এর এক লক্ষ মুসলমান অধিবাসী সকলেই শাফি'য়ী মাযাহাবের অনুসারী। শ্রীলংকা, জাবা, সুমাত্রা, পূর্ব ভারতের দ্বীপসমূহ এবং ফিলিপাইন এলাকার দ্বীপসমূহে শাফিয়ী মাযহাবের অনুসারীই অধিক। থাইল্যান্ডের অধিকাংশ মুসলমানই শাফি'য়ী কিছু হানাফীও রয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার অধিকাংশ মুসলমান শাফি'য়ী মাযহাবের অনুসারী।
আমেরিকার ব্রাজিল এলাকায় পঞ্চশ হাজার হানাফী মুসলমান বাস করে। আমেরিকার প্রায় দেড় লক্ষ মুসলমান বসবাস করছে। (এ সংখ্যা বহুদিন পূর্বের, বর্তমানে আমেরিকায় মুসলমান সংখ্যা পনের লক্ষাধিক)। তার মধ্যে বিভিন্ন মাযহাবের অনুসারী রয়েছে। হিজাযে শাফি'য়ীও হানাফী মাযাহাবের প্রাধান্য, তবে গ্রাম এলাকায় আত্মাফের সংঙ্গে মালিকীও বিদ্যমান রয়েছে। নাজদের অধিবাসীরা সকলেই হাম্বলী। আদন, ইয়ামন ও হাজারামাউত এলাকাবাসী শাফি'য়ী মাযহাবের অনুসারী। আদ শহরে আহনাফও রয়েছে। ওমানে শাফি'য়ী ও হাম্বলী মাযাহাবের অনুসারী রয়েছে। কাতার ও বাহরাইনে মালিকী মাযহাব ব্যাপকভাবে প্রচলিত। সেখানে হানাবেলাও বিদ্যমান রয়েছে। ইহ্সা এলাকায় হাম্বলী ও মালিকী মাযহাবের প্রধান্য। কুয়েতে মালিকী মাযহাবের প্রভাব খুব বেশী।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০৫১) মালিকী মাযহাবের বিকাশ | (০৫৩) ইমাম আ'যম আবু হানীফা (র.) |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |