হযরত মায়মুনা (রাঃ)-এর ঘর থেকে নবী করিম (দঃ) অসুস্থ অবস্থায় হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর ঘরে দু'জন সাহাবীর কাঁধে ভর দিয়ে তশরীফ নিয়ে আসেন এবং অন্যান্য বিবিগণের অনুমতিক্রমে ইনতিকাল পর্যন্ত এখানেই অবস্থান করেন। ইনতিকালের পর এই ঘরের একাংশের মধ্যেই রওযা মোবারক তৈরী করা হয়। [বর্তমানে রওযা মোবারক মসজিদে নববীর ভিতরে অবস্থিত। তিনদিকে মসজিদ। পূর্বদিক খোলা চত্ত্বর।]
আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, আখেরী চাহারশোম্বার দিন বিকাল থেকেই তিনি পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। সকাল ছিল আনন্দময়, বিকাল হলো বিষাদময়। এ সময় থেকে তিনি ৮ই রবিউল আউয়াল বৃহস্পতিবার যোহর পর্যন্ত অসুখ নিয়েই সমস্ত নামায মসজিদে গিয়ে আদায় করতেন। সাহাবীগণের কাঁধে ভর দিয়ে তিনি মসজিদে যেতেন এবং নামায আদায় করতেন। কোন কোন সময় হযরত আবু বকর (রাঃ) কে ইমামতি করতে বলতেন। কিন্তু তাঁর আগমনের সাথে সাথে হযরত আবু বকর (রাঃ) পিছনে সরে আসতেন এবং বাকী নামায নবীজীর পিছনে মোকাব্বির হয়ে আদায় করতেন।
নামাযকে তিনি এত গুরুত্ব দিতেন। আমরা উম্মত হয়ে আজ নামাযের গুরুত্ব ভুলে গিয়েছি। আফসোস! নামাযে আমাদের দৃষ্টি থাকে মোসল্লার দিকে-কিন্তু হযরত আবু বকর ও সাহাবীগণের দৃষ্টি থাকতো আল্লাহর রাসূলের দিকে।
অসুস্থ অবস্থায় নবী করিম (দঃ) প্রায়ই বলতেন-
"হে আয়েশা! খায়বরের ইয়াহুদী রমনী যয়নবের বিষমিশ্রিত খাদ্যের বিষক্রিয়া এখন আমি অনুভব করছি। আমার মনে হয়-ঐ বিষের জ্বালায় আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে"।
[মোহাদ্দেস আবদুল গনি নাবলুছী (ফিলিস্তিন)- যিনি আল্লামা শামীর ওস্তাদ ও মোস্তাহিদ ছিলেন-তাঁর লিখিত কিতাব "আল হাদিকায়" উল্লেখ আছে- “নবী করিম (দঃ) দুবার নিজের মউতের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিলেন। প্রথমবার খায়বরের বিষক্রিয়া জনিত সম্ভাব্য মৃত্যু তিনি ৪ বৎসর পর্যন্ত বিলম্বিত করেছিলেন। দ্বিতীয় বার ইনতিকালের সময় হযরত আযরাঈল (আঃ) কে বসিয়ে রেখে জিব্রাইল (আঃ) ও আল্লাহর সাথে কিছু কথা বলেছিলেন এবং উম্মতের জন্য কিছু প্রতিশ্রুতি আদায় করেছিলেন”। এই বিলম্ব নবীজীর ইচ্ছায় ও আর নির্দেশে ঘটেছিল। কাযী আয়ায (রহঃ) তাঁর শিফা শরীফের "বাবুল" কারামত ও নবীজীর বৈশিষ্ট্য" অধ্যায়ে লিখেছেন- "আমরা মউতের অধীন, কিন্তু মউত নবীজীর ইখতেয়ারাধীন”। মউত আল্লাহর সৃষ্ট মখলুক। "সকল মখলুককেই আল্লাহ তায়ালা নবীজীর অধীনস্থ করে দিয়েছেন-কেননা তিনি সমস্ত সৃষ্টির মূল” (শিফা শরীফ)।
এই আক্বিদা ও বিশ্বাসের নামই সুন্নী আক্বিদা। হিযরত অধ্যায়ে জমিনের উপর। নবীজীর কর্তৃত্বের হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে। ইখতিয়ার, কর্তৃত্ব ও তাসাররূপ নবীজীর মো'জেযার অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহর রাজ্যে রাসুলে পাকের রাজত্ব সর্ব স্বীকৃত বিষয়"।]
নবী করিম (দঃ)-এর জীবনের শেষ বৃহস্পতিবার ছিল ৮ই রবিউল আউয়াল। ঐ দিন হুযুর (দঃ) যোহরের নামাযের বাকী অংশে কোন রকমে জামাতের ইমামতি করেন। ঐ দিন হযরত আবু বকর (রাঃ) হুযুরের নির্দেশে যোহরের নামায পড়াচ্ছিলেন। এমন সময় হুযুর (দঃ) কে আসতে দেখে পিছনে হঁটে আসলেন। নামায শেষে তিনি সমবেত সাহাবীগণের উদ্দেশ্যে এক অশ্রুপূর্ণ ভাষণ দেন এবং তাঁদের থেকে শেষ বিদায় গ্রহণ করেন। সেদিনের করুণ পরিবেশ আকাশ বাতাসকে অশ্রু ভারাক্রান্ত করে তুলেছিল। সাহাবায়ে কেরামের রোনাজারীতে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল। মদিনায় রোনাজারী ও মাতমের হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল সেদিন। শেষ বৃহস্পতিবারের হৃদয় বিদারক অবস্থার কথা স্মরণ করে পরবর্তী সময়ে ইবনে আব্বাস (রাঃ) প্রায়ই বলতেন-"ইয়াওমুল খামিছ, ওয়ামা ইয়াওমুল খামিছ"।
সেদিনের ভাষণে তিনি হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর অনেক মর্তবা ও মর্যাদা বর্ণনা করেন এবং অবশিষ্ট দিনগুলোতে নবী করিম (দঃ)-এর স্থলে ইমামতি করার জন্য তাঁকে নির্দেশ প্রদান করেন। এর মাধ্যমেই পরবর্তী খিলাফতের বিষয়টি একরকম চূড়ান্ত হয়ে যায়। নামাযের ইমামতি হচ্ছে- ইমামতে ছোগরা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ইমামত বা নেতৃত্ব হচ্ছে ইমামতে কোরা। সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) আকারে ইঙ্গিতে ভবিষ্যৎ নির্ধারণের নীতিমালা আঁচ করে নিলেন।
নামাযের পর নবী করিম (দঃ) যে বিদায়ী ভাষণ প্রদান করেন- তা কয়েকজন সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে। তাঁরা হচ্ছেন: হযরত আইউব বিন বশীর (রাঃ), উম্মে সালমা (রাঃ), আবু সাঈদ (রাঃ), আবুল মোয়াল্লা (রাঃ), জুনদুব (রাঃ), আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) এবং ফযল ইবনে আব্বাস (রাঃ) প্রমুখ। তাঁদের বর্ণিত হাদীসে শব্দের কিছু বেশ কম রয়েছে। সবার বর্ণিত হাদীসের সারমর্ম নিম্নরূপ।
"যোহরের নামায শেষ করে নবী করিম (দঃ) মিম্বারে উঠে উপবেশন করলেন। আল্লাহর হামদ ও সানা পাঠ করে সমবেত সাহাবায়ে কেরামকে লক্ষ্য করে বললেন-
"আল্লাহ তায়ালা আপন এক প্রিয় বান্দাকে দুটি জিনিসের মধ্যে একটি গ্রহণ করার এখতিয়ার ও স্বাধীনতা দিয়েছেন। যথা- (ক) তিনি যতদিন ইচ্ছা জীবিত থেকে দুনিয়ার সুখ শান্তি ও আরাম আয়েশ ভোগ করতে পারবেন, (খ) এখনই আল্লাহর সান্নিধ্যে গিয়ে তাঁর জন্য সংরক্ষিত নেয়ামত ভোগ করবেন। আল্লাহর সেই প্রিয় বান্দা এই দুটির মধ্যে শেষেরটিই গ্রহণ করে নিয়েছেন"।
হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) বলেন-
"দীর্ঘজীবনের এখতিয়ার একমাত্র নবী করিম (দঃ) কেই দান করা হয়েছে- অন্য কাউকে নয়"।
নবী করিম (দঃ)-এর ভাষণের অন্তর্নিহিত মর্ম বুঝতে পেরে সর্বপ্রথম হযরত আবু বকর (রাঃ) কেঁদে কেঁদে আরয করতে লাগলেন-
“ইয়া রাসুলাল্লাহ !আমাদের নিজের জীবন, পিতা-মাতার জীবন, সন্তানাদির জীবন ও অর্থ সম্পদের বিনিময়ে আমরা আপনাকে পেতে চাই"।
নবী করিম (দঃ) হযরত আবু বকর (রাঃ) কে ধৈর্য ধারনের উপদেশ দিলেন। আবু সাঈদ (রাঃ)-এর বর্ণনায় নবী করিম (দঃ) এরশাদ করলেন-
"আমার সান্নিধ্য লাভে এবং দ্বীনের জন্য ধন সম্পদ বিলিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে আমার উপর আবু বকরের চেয়ে অন্য কারো অধিক এহসান আছে বলে আমার জানা নেই। আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে যদি আমি খলীল বা একান্ত বন্ধু বানিয়ে নিতাম, তা হলে আবু বকরকেই খলীল বানিয়ে নিতাম। আল্লাহ আমাকে খলীল বা একান্ত বন্ধু বানিয়ে নিয়েছেন এবং আমিও আল্লাহকে জানপ্রাণ দিয়ে খলীল বা একক বন্ধু বানিয়েছি। তোমরা আমার মসজিদের দিকে তোমাদের ঘরের ছোট ছোট সব দরজা, জানালা বন্ধ করে দাও। একমাত্র আবু বকরের দরজাটি খোলা রাখো। আবু বকরের সাথে আমার ইসলামী বন্ধুত্ব ও ভালবাসা রয়েছে"।
উল্লেখ্য যে, কাযী আয়ায (রহঃ) শিফা শরীফে খলীল শব্দটি বিশ্লেষণ করেছেন এভাবে-“খালা" অথবা "খুল্লাতুন" মূলধাতু হতে খলীল শব্দটির উৎপত্তি।
'খালা'-র অর্থ হলো সব কিছুর বিনিময়ে বন্ধুত্ব। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) সব কিছু আল্লাহর জন্য বিলিয়ে দিয়ে খলীল উপাধী পেয়েছিলেন। তদ্রুপ নবী করিম (দঃ)ও সব কিছু আল্লাহর জন্য বিলিয়ে দিয়ে খলীল উপাধীতে ভূষিত হয়েছেন। অপরদিকে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে হাবীবুল্লাহ বা একান্ত প্রেমাস্পদ উপাধী দান করেছেন।
"খলীল বলা হয়- যিনি আল্লাহর জন্য সব কিছু দান করেন; কিন্তু 'হাবীব বলা হয়-আল্লাহ যার জন্য সব কিছু বিলিয়ে দেন"। "খলীল হচ্ছেন প্রেমিক; আর হাবীব হচ্ছেন প্রেমাস্পদ”। নবী করিম (দঃ) ছিলেন আল্লাহর প্রেমিক এবং প্রেমাস্পদ-উভয়ই (সোবহানাল্লাহ)।
খুল্লাতুন ধাতুর অর্থ হচ্ছে-একান্ত ভালবাসা (Exclusive love)। এ অর্থে নবী করিম (দঃ) আপন জীবন দিয়ে একান্তভাবে আল্লাহকে ভালবাসতেন (শিফা শরীফ)। এই ভালবাসা যদি তিনি আল্লাহর জন্য দান না করতেন, তাহলে আবু বকর (রাঃ) কেই এই স্থানে বসাতেন। এই হাদীসে সমস্ত সাহাবীর উপর হযরত আবু বকরের (রাঃ) গুরুত্ব দান করা হয়েছে।
হযরত আইউব বিন বশীর (রাঃ)-এর বর্ণনা মতে আরো কিছু নসিহতের কথা উল্লেখ আছে। যথা-
"নবী করিম (দঃ) মিম্বারে বসে প্রথমে ওহোদের শহীদানদের জন্য বিশেষ দোয়া করেন। ইসলামের জন্য তাঁদের আত্মত্যাগ ও শাহাদতের কথা স্মরণ করেন"।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর বর্ণনায় আরো আছে-নবী করিম (দঃ) মদিনার আনসারদের সেবা ও অবদানের কথা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে বললেন-
“হে মোহাজিরগণ! তোমরা সংখ্যায় অনেক বেড়ে গিয়েছো এবং দিন দিন তোমাদের আগমনের সংখ্যা বাড়ছেই। কিন্তু আনসারের সংখ্যা পূর্বের ন্যায়ই রয়েছে। তাঁরা আমাকে আশ্রয় দিয়েছে। তোমরা (মোহাজিরগণ) তাঁদের সম্মানিত ব্যক্তিদের সম্মান করবে এবং তাঁরা কোন ত্রুটি করলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবে"।
ফযল ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন: নবী করিম (দঃ) অন্যান্য কথার মধ্যে একথাও বলেছিলেন-
"হে উপস্থিত লোক সকল! তোমাদের বিগতজনেরা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আমার বর্তমান মিম্বারে তোমরা আর কখনও আমাকে দেখতে পাবেনা। আমি যদি তোমাদের কারো পিঠে দ্বারা আঘাত করে থাকি, তাহলে এই নাও আমার পিঠ। তোমরা বদলা নিতে পারো। আমি যদি কারও নিকট থেকে মাল নিয়ে থাকি, তাহলে তোমরা তা আমার থেকে নিয়ে নাও। আর যদি কারও সম্মান লাঘব করে থাকি, তাহলে আমার থেকে তার বদলা নিতে পারো। কেউ যেন আমাকে কাপুরুষ বা বখিল বলতে না পারে। বখিলী আমার শানও নয় এবং চরিত্রও নয়। যদি তোমাদের কারও কোন হক্ক আমার উপর থেকে থাকে, তাহলে সে ব্যক্তি সে হক্ক নিয়ে নিক-সে ব্যক্তিই আমার সবচেয়ে প্রিয় হবে"।
এক সাহাবী দাঁড়িয়ে বললেন-ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি আপনার কাছে তিন দিরহাম পাওনা আছি। একদিন এক ফকির আপনার কাছে কিছু চাইলে আপনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তাকে তিনটি দিরহাম দেয়ার জন্য। ঐ তিনটি দিরহামই আমি পাবো। নবী করিম (দঃ) ফযল ইবনে আব্বাস (রাঃ) কে তা দিয়ে দিতে আদেশ করলেন।
এরপর নবী করিম (দঃ) বললেন- তোমাদের কারও কাছে যুদ্ধেপ্রাপ্ত কোন অবৈধ মাল আছে কি? তাহলে তা বাইতুলমালে জমা দিয়ে দাও। এক সাহাবী দাঁড়িয়ে বললেন- আমার নিকট তিন দিরহাম আছে। নবী করিম (দঃ) বললেন-তুমি কেন তা নিয়েছিলে? ঐ সাহাবী উত্তর করলেন-আমি খুবই দরিদ্র। তাই নিয়েছিলাম। নবী করিম (দঃ) ফযল (রাঃ) কে তা আদায় করে নিতে নির্দেশ দিলেন। নবী করিম (দঃ) পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন- কারও মনে কিছু ঈমানী দুর্বলতা থাকলে বলো-আমি দোয়া করবো। একজন লোক সামনে এগিয়ে এসে বললো-ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি একজন মুনাফিক, মিথ্যাবাদী ও দূরাচার। তার কথা শুনে হযরত ওমর (রাঃ) বললেন-তোমার সর্বনাশ হোক! তুমি নিজের দোষ খোলাখোলি না, বললেও পারতে! আল্লাহ তোমাকে গোপনে ক্ষমা করে দিতেন। নবী করিম (দঃ) হযরত ওমরকে থামিয়ে দিয়ে বললেন-“দুনিয়ার অপমান পরকালের অপমানের তুলনায় অনেক তুচ্ছ। হে আল্লাহ! তুমি তাকে সততা ও ঈমান দান করো"। তারপর হযরত ওমরকে শান্তনা দিয়ে বললেন-ওমর আমার সাথে এবং আমিও ওমরের সাথে আছি। আমার পর "সত্য ওমরের সাথী হবে"। ভাষণ শেষ করে সবার থেকে বিদায় নিয়ে তিনি হুজরা মোবারকে চলে গেলেন। এরপর থেকে হযরত আবু বকর (রাঃ) নামাযে ইমামতি করতে লাগলেন। বৃহস্পতিবার আছর থেকে সোমবার ফজর পর্যন্ত তিনি একাধারে ১৯ ওয়াক্ত নামাযে ইমামতি করেন। তখন থেকে নবী করিম (দঃ) নিজ হুজরায় একাকী নামায পড়তেন।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০৭৭) আখেরী চাহার শোম্বা | (০৭৯) খেলাফতের ইঙ্গিত |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |