সফর মাসের শেষ বুধবার ছিল চাঁদের ৩০ তারিখ। এদিন নবী করিম (দঃ)-এর অসুখ হঠাৎ কমে গেল। তিনি সকালবেলা উঠেই হযরত আয়েশা (রাঃ) কে ডেকে বললেন-"আমার জ্বর কমে গেছে। তুমি আমাকে গোসল করিয়ে দাও"। সেমতে তাঁকে গোসল করানো হলো। তিনি সুস্থ বোধ করলেন। এটিই ছিল দুনিয়ার শেষ গোসল। ইমাম হাসান, ইমাম হোসাইন ও বিবি ফাতেমা (রাঃ) কে ডেকে আনা হলো। নাতীদ্বয়কে নিয়ে তিনি সকালের নাস্তা করলেন। হযরত বেলাল (রাঃ) ও সুফফাবাসীগণ বিদ্যুতের ন্যায় এ সংবাদ মদিনার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দিলেন। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে আনন্দের ঢেউ খেলে গেলো। তাঁরা বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মত দলে দলে আসতে লাগলেন এবং হুযুর (দঃ) কে এক নযর দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে রইলেন।
হুযুরের রোগমুক্তির সংবাদে সাহাবায়ে কেরাম কত খুশী ও আনন্দিত হয়েছিলেন- তাঁর কিছুটা আন্দাজ করা যায় পরের ঘটনার মাধ্যমে। হযরত আবু বকর (রাঃ) পাঁচ হাজার দিরহাম ফকির মিসকিনদের মধ্যে বিলিয়ে দিলেন। হযরত ওমর (রাঃ) দান করলেন সাত হাজার দিরহাম। হযরত ওসমান (রাঃ) দান করলেন দশ হাজার দিরহাম। হযরত আলী (রাঃ) দান করলেন তিন হাজার দিরহাম। সবচেয়ে বেশী দান করলেন ধনী ব্যবসায়ী হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ)-তিনি একশত উট আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিলেন। সুবহানাল্লাহ! নবী করিম (দঃ)-এর একটু শান্তি ও আরামের সংবাদে সাহাবীগণ কিভাবে জানমাল উৎসর্গ করে দিতেন- এটা তাঁরই আংশিক প্রমাণ। "হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) প্রতি বৎসর ঈদে মিলাদুন্নবীর (দঃ) দিনে একটি মূল্যবান লাল উট যবেহ করে যিয়াফত দিতেন" (Endless Blessings- বা সাআদাতে আবাদিয়া দ্রষ্টব্য-তুরস্ক)।
নবী করিম (দঃ)-এর সাময়িক রোগমুক্তির দিবসকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য পারশ্যসহ মধ্য এশিয়া ও পাক ভারত উপমহাদেশে অত্যন্ত ভাবগম্ভীর
পরিবেশে এই দিবসটি পালন করা হয়। বুযুর্গানে দ্বীনের তরিকা অনুযায়ী এদিনে নবীজীর স্মরণে এবং রোগবালাই থেকে মুক্তির নিয়তে আখেরী চাহার শোম্বা দিবসে গোসল করে দু'রাকআত শুকরিয়া নামায আদায় করা হয়। এছাড়াও বৈধ সমস্ত নেক আমল করা হয়। কোরআন মজিদের ৬টি আয়াতে শেফা ও সাত সালামের আয়াত চিনির প্লেটে বা কলা পাতায় লিখে পানিতে ধৌত করে ঐ পানি পান করলে পাইলস্ বা গেজ রোগ নিরাময় হয় বলে বুযুর্গানে দ্বীন ফাযায়েলের কিতাবে লিখে গেছেন।
আখেরী চাহার শোম্বা বা সফরের শেষ বুধবার দিবসটি পালন করে মুসলমানরা ইসলামের একটি স্মরণীয় দিনকে এখনও প্রেরণার উৎস করে রেখেছে। মূলতঃ এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই ইসলামী জোশ্ বারবার চাঙ্গা হয়ে উঠে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, নবী করিম (দঃ)-এর স্মৃতিবিজড়িত এই দিবসটি পালন করতে একশ্রেণীর ওলামা নিষেধ করেন এবং এটাকে বিদ্আত বলে মানুষকে ভয় দেখান। তাদের উদ্দেশ্য একটিই- সেটি হলো- ইসলামের স্মরণীয় ঘটনাসমূহ মুসলমানদের হৃদয় থেকে মুছে ফেলা। নবী-অলীদের স্মৃতিবিজড়িত চিহ্ন সংরক্ষণ করা ও দিবস পালনের মধ্যে অজস্র কল্যাণ নিহিত রয়েছে।
এজন্যই কোরআন মজিদে পূর্ববর্তী নবীগণের বিভিন্ন স্মরণীয় দিনের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে- যাতে মানুষ ঐগুলো থেকে হেদায়াতের আলো লাভ করতে পারে। ঐসব স্মরনীয় দিনগুলোকে আল্লাহ্ পাক কোরআন মজিদে "আইয়ামিল্লাহ” বা "আল্লাহর স্বরণীয় দিবস" বলেছেন। আখেরী চাহারশোম্বার গোসলটি ছিল নবী করিম (দঃ)-এর জীবনের শেষ গোসল। এরপর ছিল জানাযার গোসল।
আখেরী চাহার শোম্বার দিন বিকাল থেকেই পুনরায় জ্বর দেখা দেয়। এই জ্বরেই নবী করিম (দঃ) ১২দিন পর ইনতিকাল করেন। (ইন্নালিল্লাহ.....)। সুতরাং সফরের শেষ বুধবার একদিকে খুশীর দিন-অপরদিকে শোকেরও দিন। সকালে আনন্দ- বিকালে বিষাদ। কিন্তু দুটি একসাথ হলে প্রথমটিই পালন করতে হয়-যেমন ১২ ই রবিউল আউয়াল।
স্বরণীয় দিনগুলোর উল্লেখ করে আল্লাহ্ পাক এরশাদ করেন-
"হে বনী ইসরাঈল! তোমরা ঐদিনের ঘটনা স্মরণ করো-যেদিন আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে ফিরআউনের অত্যাচার থেকে নাজাত দিয়েছিলেন এবং ফিরআউনকে সদলবলে ডুবিয়ে মেরেছিলেন"
-সূরা বাক্বারা।
তাই তারা আশুরার দিনে রোযা রাখতো। আমরাও হুযুরের বেলাদত দিবস পালন করি।
"হে প্রিয় হাবীব! ঐদিনকে স্মরণ করুন-যেদিন আল্লাহতায়ালা সমস্ত নবীকে একত্রিত করে আপনার সম্পর্কে এই মর্মে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, যখন তোমাদেরকে নবুয়ত, কিতাব ও হিকমত দিয়ে সম্মানিত করা হবে, আর সবার পরে তোমাদের নবুয়তের সত্যায়নকারী মহান রাসুলকে প্রেরণ করবো- তখন তোমরা তাঁর উপর অবশ্য অবশ্যই ঈমান আনবে এবং অবশ্য অবশ্যই তাঁকে সর্বোতভাবে সাহায্য সহযোগিতা করবে"।
(সূরা আলে ইমরান ৮১ আয়াত)
উক্ত দুইটি ঘটনায় বুঝা যায়- স্মরণীয় দিনগুলো তথা আশুরা ও ঈদে মিলাদুন্নবী দিবস বারবার স্মরণ করা ও পালন করা আল্লাহরই নির্দেশ। কারণ ইহাই সবচেয়ে বড় স্মরণীয় ও খুশীর দিন।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০৭৬) বিদায়ের প্রত্যক্ষ লক্ষণ | (০৭৮) আল্লাহর সাথে মহামিলনের প্রস্তুতি |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |