ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ বা রুকনের মধ্যে হজ্ব হচ্ছে নুযুলের ধারাবাহিকতায় পঞ্চম ও শেষ রুকন। নবুয়তের ২১ বছরের শেষ মাথায় ৯ম হিজরীতে শাওয়াল মাসে হজ্বের আয়াত নাযিল হয়। আয়াতটি হলো-
وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا
অর্থ-"যে ব্যক্তির হজ্বে যাওয়ার সামর্থ আছে-আল্লাহ তার উপর হজ্জ ফরয করেছেন"।
তাই অষ্টম হিজরীতে মক্কা বিজয়, হোনায়ন যুদ্ধ এবং তায়েফ যুদ্ধ শেষে নবী করিম (দঃ) মদিনায় প্রত্যাবর্তন করার পর ৯ম হিজরী শাওয়াল মাসে হজ্ব ফরয করা হয় ও উক্ত আয়াত নাযিল হয়। সুতরাং ৮ম হিজরীতে শুধু ওমরাহ্ করেই হুযুর (দঃ) মদিনায় ফিরে আসেন।
আল্লাহর ঘরের ব্যবস্থাপনা পূর্ব হতেই কোরাইশদের মাধ্যমে সম্পন্ন হতো। তাই তাদের নির্ধারিত মাসে ও তারিখেই- অর্থ্যাৎ ৯ম হিজরীর যিজ্জ্বদ মাসে প্রথম হজ্ব আদায় করতে হয়েছে। এ বছর বার্ষিক তাওয়াফের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল বনু কেনানার উপর। তারা নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী একমাস পূর্বেই জিলকদ মাসের ১০ তারিখে তাওয়াফের তারিখ ঘোষণা করলো। ইমাম হাদ্দাদী (রাঃ) বলেন- "ইসলামের প্রথম হজ্ব বনু কেনানার ব্যবস্থামতে বিলজ্বদ মাসের ১০ তারিখ অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তী বছর- অর্থাৎ দশম হিজরীতে বিদায় হজ্ব নবী করিম (দঃ)-এর ব্যবস্থাপনায় যিলহজ্ব মাসের ৯ তারিখেই অনুষ্ঠিত হয়” (তাফসীরে রুহুল বয়ান সুরা তৌবা ১০ম পারা পৃষ্ঠা ৩৮৩)।
মক্কা বিজয়ের বছর ৮ম হিজরীতে হজ্ব ফরয না হওয়া সত্ত্বেও নবী করিম (দঃ) মক্কার মুসলিম শাসক আত্তাব ইবনে উসাইদ-এর নেতৃত্বে স্থানীয় মুসলমানদের নিয়ে আরাফায় গমন করে উকুফ করার জন্য তাঁকে নির্দেশ দিয়ে এসেছিলেন। (বেদায়া-নেহায়া)।
৯ম হিজরীতে রাসূল করিম (দঃ) মুসলমানদের হজ্ব আদায় করার জন্য হযরত আবু বকর (রাঃ) কে আমীর নিযুক্ত করেন। হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর সাথে তিনশত সাহাবীকে মদিনা শরীফ থেকে প্রেরণ করা হয়। রাসূল করিম (দঃ) ২০টি উট কুরবানীর জন্য সাথে দিয়ে দেন। হযরত আবু বকর (রাঃ) অরো ৫টি উট সংগ্রহ করে নেন। হযরত আবু বকর (রাঃ) কাফেলা নিয়ে হজ্বের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার পর শাওয়াল মাসে সুরা তৌবার প্রথম ৪০টি আয়াত নাযিল হয়। আল্লাহর ঘরে ভবিষ্যতে কারা কারা হজ্ব ও ওমরাহ্ করতে পারবে না- এ সংক্রান্ত নির্দেশ এই ছুরায় ছিল। আল্লাহ তায়ালা উক্ত ছুরার ২৮ ও ২৯ নং আয়াতে মুশরিকদের জন্য এ বছরের পর হতে হজ্ব ও ওমরায় আগমন চিরদিনের জন্য নিষিদ্ধ করে দেন। শুধু ৯ম হিজরীর হজ্বে তারা অংশগ্রহণ করতে পারবে বলে অনুমতি দেয়া হয়।
তাই আল্লাহর এই গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ পাঠ করে শুনানোর জন্য নবী করিম (দঃ) ছুরা তৌবার প্রথম চল্লিশটি আয়াত লিখে এবং অন্যান্য নির্দেশসহ আপন জামাতা হযরত আলী (রাঃ) কে প্রেরণ করেন। পথিমধ্যে হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর সাথে তিনি মিলিত হন। আমীরুল হজ্ব হিসাবে হযরত আবু বকর (রাঃ) এ বছর আরাফাতের ময়দানে বনু কেনানার নির্ধারিত ১০ই যিলক্বদ তারিখেই হজ্বের খুতবা প্রদান করেন।
হযরত আলী (রাঃ) নবীজীর প্রতিনিধি হিসাবে সুরা তৌবার ৪০ আয়াত সম্বলিত নির্দেশ পাঠ করে শুনান। মীনাতেও তিনি উক্ত ঘোষণা পাঠ করে শুনান।
ঘোষণাপত্রে চারটি বিষয় ছিল। যথা (১) “এ বছরের পর কোন মুশরিক তাওয়াফ করার জন্য মক্কায় আসতে পারবে না, (২) কোন উলঙ্গ ব্যক্তি আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করতে পারবেনা, (৩) মোমেন ব্যতীত কেউ বেহেস্তে প্রবেশ করবেনা, (৪) যাদের সাথে নবী করিম (দঃ)-এর চুক্তি রয়েছে-উক্ত চুক্তির মেয়াদের পর তা আর নবায়ন করা হবে না এবং যাদের সাথে চুক্তি নেই অথবা চার মাসের কম সময়ের জন্য চুক্তি আছে-তাদেরকে চারমাস সময় দেয়া হবে। সে মোতাবেক চারমাস রবিউস সানীর ১০ তারিখে উত্তীর্ণ হয়ে যাবে"।
এই ঘোষণার ফলে মুশরিকদের তাওয়াফ চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সম্পাদিত চুক্তির মেয়াদকাল পর্যন্ত তাদের আগমন ও তাওয়াফ বহাল রাখা হয়।
রাজনৈতিক এই সিদ্ধান্তের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। পরবর্তী বছরে নবী করিম (দঃ) বিদায় হজ্বে এক লক্ষ ছাব্বিশ হাজার সাহাবী নিয়ে হজ্ব আদায় করেন। একজন মুশরিকও এই হজ্বে শরিক হতে পারেনি। হজ্ব ও ওময়াহ্ সংক্রান্ত বিস্তারিত হুকুম আহকাম বিদায় হজ্বেই ঘোষণা করা হয়।
যে মক্কা মোয়ায্যমা হতে নবী করিম (দঃ) একদিন বিদায় হতে বাধ্য হয়েছিলেন-আজ সেই বিতাড়নকারীরাই চিরদিনের জন্য বিতাড়িত হলো-আল্লাহর নির্দেশে। "আল্লাহর মাইর-মানুষের বাইর"। তিনি প্রিয় নবী (দঃ)-এর জন্য মক্কা মোয়ায্যমাকে চিরদিনের জন্য নিষ্কন্টক করে দিলেন।
"পবিত্র হজ্ব গুনাহসমূহ ধুয়ে এভাবে পরিষ্কার করে দেয়-যেভাবে পানি ময়লাকে ধূয়ে পরিষ্কার করে দেয়” (মিশকাত ও বুখারী)।
হজ্বে মকবুলের পুরষ্কার হচ্ছে জান্নাত-কিন্তু মদিনার রওযা মোবারকের যিয়ারত হচ্ছে জান্নাতের মালিকের সাক্ষাৎ এবং শাফাআত পাওয়ার গ্যারান্টি। বস্তুতঃ যিয়ারতের দ্বারা রাসুলও (দঃ) পাওয়া যায় এবং জান্নাতও পাওয়া যায়। এখানে একটি প্রশ্ন জাগতে পারে। তা হলো-৯ম হিজরীতে হুযুর (দঃ) হজ্ব করেননি কেন? এ প্রশ্নের একাধিক জওয়াব আছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য জওয়াব হলো-তিনি জানতেন আগামী বৎসর ১০ হিজরী পর্যন্ত তিনি হায়াত পাবেন- তাই বিলম্ব করেছিলেন। ইহাই মৃত্যু সম্পর্কীয় ইলমে গায়েব। হুযুর (দঃ)- কে আল্লাহ পাক পঞ্চগায়েবের ইলেমও দান করেছেন। পঞ্চগায়েবের ইলেম আল্লাহর জন্য যাতী এবং রাসুলে পাকের জন্য আতায়ী।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০৭১) মুনাফিক সর্দারের মৃত্যু | (০৭৩) বিদায় হজ্ব ১০ম হিজরী |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |