নবী করিম (দঃ) ৯ম হিজরীর রমযান মাসের প্রথম দিকে তাবুক থেকে মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন। শাওয়াল মাসের শেষের দিকে মদিনার মেনাফেক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং যিলকদ মাসের প্রথমভাগে মৃত্যুবরণ করে জাহান্নামবাসী হয়। ইসলামের ভিতরের এই শত্রুর অসুখের খবর শুনে নবী করিম (দঃ) তাকে দেখাশুনা করতেন। নবী করিম (দঃ)-এর মহানুভবতা ছিল অতুলনীয়।
তার মৃত্যুর দিন নবী করিম (দঃ) তাকে দেখতে গেলেন। কথার এক পর্যায়ে তিনি মোনাফেক আবদুল্লাহকে বললেন- "আমি তোমাকে ইহুদীদের সাথে গোপন যোগাযোগ রক্ষা করতে এবং তাদের প্রতি আন্তরিক ভালবাসা রাখতে নিষেধ করেছিলাম”! আবদুল্লাহ রাগতঃ স্বরে জবাব দিল- "আত্মদ ইবনে জুরারা (সাহাবী) তো ইহুদীদের প্রতি ঘৃণা পোষণ করতো-তার কি লাভহয়েছে- ইয়া রাসুলাল্লাহ? একজনের মৃত্যুর সময় তাকে ভর্ৎসনা করা ঠিক নয়-বরং আমার গোসলের সময় আপনি নিজে উপস্থিত থাকবেন, আমার কাফনের জন্য আপনার গায়ের জামাখানা দিবেন এবং আমার জানাযার নামায আপনি পড়াবেন"।
দয়াল নবী (দঃ) তার এই অন্যায় আব্দারও রক্ষা করলেন। যখন তার জানাযা পড়ানোর জন্য নবী করিম (দঃ) তৈরী হলেন, তখন হযরত ওমর (রাঃ) আর ধৈর্য্য ধারণ করতে পারলেন না। তিনি নবী করিম (দঃ)-এর চাদর মোবারক টেনে ধরে বাধা দিয়ে বললেন- “ইয়া রাসুলাল্লাহ! আল্লাহ তায়ালা এই মোনাফিকদের বিরুদ্ধে আয়াত নাযিল করে তাদের জন্য মাগফিরাত কামনা করতে আপনাকে নিরুৎসাহিত করেছেন। তা সত্বেও কি আপনি তার জানাযা পড়াতে যাবেন? নবী করিম (দঃ) শান্ত স্বরে আল্লাহর আয়াতের মর্মব্যাখ্যা বুঝিয়ে বললেন- "হে ওমর, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, হে রাসুল! মোনাফিকদের জন্য মাগফিরাত কামনা করা এবং না করা- আপনার ইচ্ছাধীন। তবে আপনি যদি ৭০ বারও তাদের জন্য মাগফিরাত কামনা করেন, তাহলে আল্লাহ তায়ালা আপনার এই দুশমনদেরকে কখনও ক্ষমা করবেন না"। এখানে আল্লাহ তায়ালা আমাকে এখতেয়ার দিয়েছেন-মাগফিরাত চাওয়া- না চাওয়ার ব্যাপারে। এখনও পরিষ্কারভাবে নিষেধ করেননি। তাই প্রয়োজন হলে আমি ৭০ বারের চেয়েও বেশী তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবো”। (কেননা, আমি তো রাহমাতুল্লিল আলামীন)
হযরত ওমর (রাঃ) বললেন-
"এই মোনাফিক অমুক অমুক দিন আপনার সম্পর্কে কত জঘন্য উক্তি করেছে! এরপরও কি তার জানাযা পড়াবেন"? নবী করিম (দঃ) হযরত ওমর (রাঃ)-এর ভক্তিপূর্ণ আব্দার উপেক্ষা করেই উক্ত মোনাফিকের জানাযা পড়ালেন
(বোখারী ও মুসলিম)
যখন জানাযার নামায শেষ হয়ে গেল, তখন উপস্থিত এক হাজার মোনাফিক নবীজীর বদান্যতায় মুগ্ধ হয়ে তওবা করে খাঁটি মুসলমান হয়ে গেল (তাফসীর রুহুল বয়ান ও তাফসীর নাঈমী)! এর পরপরই কাফের ও মোনাফিকদের নামাযে জানাযা পড়ানোর পরিষ্কার নিষেধাজ্ঞাসূচক সূরা তৌবার আয়াতটি নাযিল করা হলো (বেদায়া ও নেহায়া-বোখারী শরীফের সূত্রে) আয়াতটি হল:
وَلَا تَصَلَّ عَلَى أَحَدٍ مِّنْهُمْ مَاتَ أَبَدًا ۖ وَلَا تَقُمْ عَلَى قَبْرِهِ -
“হে রাসুল! আপনি (আজ থেকে) মুনাফিকদের মৃত্যুর পর তাদের জানাযা পড়াবেন না এবং তাদের কবরপার্শ্বেও দাঁড়াবেন না”
(সুরা তাওবাহ, ৮৪ আয়াত)
তাই কাফির ও মুনাফিকদের জন্য দোয়া করা হারাম।
হযরত ওমর (রাঃ) এবার বুঝতে পারলেন নবী করিম (দঃ)-এর দূরদৃষ্টি ও অদৃশ্য জ্ঞানের (ইলমে গায়েব) আসল মর্মকথা। এক মোনাফিকের জানাযা পড়ানোর মধ্যে হাজার লোকের ইসলাম গ্রহণের মর্ম ছিল লুক্কায়িত। নবী করিম (দঃ)-এর আসল লক্ষ্য ও মূল উদ্দেশ্যের শুভ ফলাফল দেখে ওমর (রাঃ) লজ্জিত হয়ে যান। পরবর্তীতে হযরত ওমর (রাঃ) বলেছেন- "নবী করিম (দঃ) কে বাধা দেয়ার ঐ দুঃসাহসে এখনও আমি লজ্জিত। প্রকৃত রহস্য আমার জানা ছিল না। আল্লাহ-রাসুলই প্রকৃত রহস্যের সমধিক জ্ঞান রাখেন" (বেদায়া ও নেহায়া ৫ম খন্ড ৩৫ পৃষ্ঠা)।
উল্লেখ্য, এখানে একটি শব্দ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো- اللَّهُ وَرَسُولَهُ أَعْلَمُ অর্থাৎ "আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই সর্বজ্ঞ”।
এটি হযরত ওমরের উক্তি। তিনি 'সর্বজ্ঞ' (ন) শব্দটি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলা-উভয়ের জন্যই সমভাবে ব্যবহার করেছেন। রাসুল (দঃ) কে 'সর্বজ্ঞ' বলা হালো ওহাবী-মউদুদ্দীপন্থী মৌলভীগণ 'শেরেক শেরেক' বলে চিৎকার করে উঠে। আমাদের শুধু একটি প্রশ্ন-কার বিরুদ্ধে এই ফতোয়া? হযরত ওমর (রাঃ) এর বিরুদ্ধে নয়তো? আমরা তো তাঁর অনুসারী মাত্র। সাহাবীগণ সর্বদাই বলতেন-"আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সর্বজ্ঞ'। এই বাক্যে কর্তা দু'জন, কিন্তু ক্রিয়া মাত্র একটি । উক্ত আ'লামু ক্রিয়াটি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। ইহা শিরক নায়- বরং সুন্নাত ।
যারা তিনাটি বিষয়ে বিশ্বাস করবে, তারা পূর্ণ মোমেনঃ
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০৭০) তাবুক যুদ্ধ | (০৭২) ইসলামের প্রথম হজ্জ |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |