মক্কা বিজয়ের পর তা'বুকের যুদ্ধ ৯ম হিজরীর রজব মাসে পরিচালিত হয়। মদিনা শরীফ থেকে দামেস্কের মধ্যপথে রাস্তায় তাবুক অবস্থিত-বর্তমানে সৌদী আরবের বর্ডার। রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের অধীনে খৃষ্টান সামন্ত রাজারা এসব অঞ্চল শাসন করতো। আরব উপদ্বীপ ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে আসার পর সিরিয়ার খৃষ্টানদের মধ্যে মুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উস্কানীমূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি পেতে থাকে। তারা মদিনা আক্রমণ করার পাঁয়তারা করতে থাকে।
এই সংবাদে নবী করিম (দঃ) প্রকাশ্যে তাবুক যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে লোক ও রসদ সংগ্রহ করতে থাকেন। মৌসুম ছিল অত্যন্ত গরম। মদিনা শরীফে ছিল অর্থকরী খেজুর ফসলের মৌসুম। খেজুর পাকার মাস। তদুপরি অপরিচিত দূর দেশে অভিযান। এসব দিক বিবেচনা করে লোক ও অর্থ সংগ্রহ করা খুবই প্রয়োজন ছিল। নবী করিম (দঃ) স্বয়ং চাঁদা আদায়ের জন্য নিয়মিতভাবে মসজিদে নব্বীতে সভার আয়োজন করেন এবং মিম্বার শরীফে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ তহবিলে চাঁদা দানের জন্য আহবান জানান। নবী করিম (দঃ)-এর আহবানে সাড়া দিয়ে সকল সাহাবায়ে কেরাম সাধ্যমত দান করতে থাকেন।
হযরত ওসমান (রাঃ) চাঁদার অপ্রতুলতা দেখে একাই দশ হাজার সৈন্যের যাবতীয় খরচ বহন করার প্রতিশ্রুতি দেন। নবী করিম (দঃ) হযরত ওসমানের এই দানে এতই খুশী হলেন যে, তিনি পবিত্র জবানে ঘোষণা করে দিলেন,
لا يضر عثمانَ شَيْ بَعْدَ الْيَوْمِ
"আজকের পর হতে আর কোন গুনাহ্ই (যদি হয়) ওসমানের জন্য ক্ষতিকর হবে না”।
(বায়হাকী সূত্রে বেদায়া)
এই সুসংবাদটি ছিল শুভ পরিণতির চরম ঘোষণা। হযরত আবু বকর (রাঃ) ঘরের সব কিছু দান করলেন। হযরত ওমর (রাঃ) দান করলেন অর্ধেক সম্পদ।
নবী করিম (দঃ) তাঁদের দু'জনের মুখে এ কথা শুনে হেসে হেসে বললেন:
"তোমাদের দু'জনের কথা ও দামের মধ্যে যতটুকু ব্যবধান- ঈমানের ক্ষেত্রেও ততটুকু ব্যবধান"
(রুহুল বয়ান)
একজন সাহাবী খুবই গরীব ছিলেন। তিনি কাঠ বিক্রি করে দৈনিক দু'ছা গম খরিদ করতেন। এক ছা (৪ সের) গম নিয়ে তিনি নবী করিম (দঃ)-এর খেদমতে পেশ করলেন। হুযুর (দঃ) উক্ত গম সমস্ত মালের স্তুপের উপর ছিটিয়ে দিয়ে বললেন, "তুমি সকলের দানের সাথেই শরীক হয়েছ"।
আবদুল্লাহ ইবনে ওবাই এবং তার দলের মোনাফিকরা এ অবস্থা দেখে ভিতরে ভিতরে সমালোচনা করতে লাগলো। তারা বলতে লাগলো, দেখো- নাম ফুটাবার জন্য অমুকে অমুকে এত টাকা দিয়েছেন। আর এতবড় যুদ্ধের খরচ বাবদ অমুকে দান করেছে মাত্র এক ছা গম। এতে কি হবে? ইত্যাদি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল- যুদ্ধের প্রস্তুতি বানচাল করে দেয়া।
তারা এসে ওযর পেশ করলো- এত গরমের মধ্যে সফর করা আমাদের সহ্য হবে না। তাই ক্ষমা করুন। এক বেহায়া মোনাফিক বললো- তাবুকের যুবতী মেয়েদেরকে দেখলে আমি স্থির থাকতে পারবো না। তাই আমাকে রেহাই দিন। নবী করিম (দঃ) মোনাফিকদের এসব খোড়া ওযর কবুল করে তাদেরকে বাদ দিলেন। কিন্তু মুসলমানদেরকে জোর তাকিদ দিলেন। অনেকেই যাওয়ার জন্য প্রস্তুত-কিন্তু যানবাহন ও অস্ত্রের অভাবে যেতে পারেননি। তাঁরা কেঁদে অস্থির হয়ে পড়লেন। নবী করিম (দঃ) তাঁদেরকে শান্তনা দিয়ে রেখে গেলেন।
এমনিভাবে প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ত্রিশ হাজার সৈন্য নিয়ে তিনি রজবের বৃহস্পতিবার দিন তাবুক পানে রওনা দিলেন। কোরআনের সুরা তৌবায় মুসলমানদের আগ্রহ ও মোনাফেকদের টালবাহানার ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে।
মুসলমানদের মধ্যে দশজন সাহাবী ওযর বশতঃ বিনা অনুমতিতে যোগদান থেকে বিরত ছিলেন। তাঁরা পরে লজ্জিত হয়ে নিজেদেরকে মসজিদে নববীর খুটীর সাথে বেধে নবীজীর দরবারে ক্ষমা ভিক্ষা করেন। কিছুদিন পর আল্লাহর অনুমতিক্রমে নবী করিম (দঃ) তাদেরকে ক্ষমা করে দেন।
কা'ব ইবনে মালেক, হেলাল ইবনে উমাইয়া এবং মুরারা ইবনে রাবিয়া-নামক তিনজন সাহাবী বিনা ওযরেই ফসল তোলার কাজে ব্যস্ততার কারণে-যাবো
যাবো করেও শেষ পর্যন্ত যেতে পারেননি। এর জন্য আল্লাহ তাঁদেরকে ৫০ দিন বয়কটের শাস্তি দিয়ে পরে ক্ষমা করেন। নবীর দরবার থেকে বঞ্চিত হলে আল্লাহর দরবারেও স্থান হয়না। অবশ্য তাঁদের তওবা কবুল হওয়ার পর তারা সমস্ত সম্পত্তি নবীজীর খেদমতে সক্কা করে দেন। নবী করিম (দঃ) এক তৃতীয়াংশ কবুল করে বাকী অংশ ফেরত দিয়ে দেন।
হযরত আবুযর গিফারী (রাঃ) যানবাহনের অভাবে হুযুর (দঃ)-এর সাথে যেতে পারেননি। অবশেষে পায়ে হেঁটে তিনি একা তাবুকে গিয়ে নবীজীর সাথে মিলিত হন। নবী করিম (দঃ) আবুযর (রাঃ) কে একা দেখে বলে উঠলেন- “আল্লাহ আবুযরকে রহম করুন! সে চলবে একা, মরবে একা এবং পুনরোত্থিতও হবে একা"।
নবী করিম (দঃ)-এর উক্ত গায়েবী সংবাদ ছিল আবুযর গিফারী-এর জীবনের শেষ পরিণতি সম্পর্কে। সম্পদের ব্যক্তি মালিকানা সম্পর্কে তিনি সকল সাহাবী থেকে ভিন্নমত পোষণ করতেন এবং নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সকল সম্পদ দান করার প্রবক্তা ছিলেন তিনি। তাই তাঁকে একলা চলতে হয়েছে নির্বাসনে গিয়ে। মদিনার নিকটবর্তী রাবযা নামক স্থানে তাঁকে হযরত ওসমান (রাঃ) কর্তৃক নির্বাসন দেয়া হয় এবং সেখানেই তিনি একাকী ইন্তিকাল করেন। এভাবে নবীজীর ইলমে গায়েবের সংবাদ বাস্তবে পরিণত হয়।
নবী করিম (দঃ) দশ হাজার উট ও ত্রিশ হাজার সৈন্য নিয়ে যখন তাবুকের পথে রওনা হলেন- তখন কতিপয় অলৌকিক মো'জেযা প্রদর্শন করেন। যথাঃ
হযরত ওমর (রাঃ) বলেন-"আমরা তাবুকের যাত্রায় তিনটি কষ্টে পতিত হয়েছিলাম। (ক) পানির কষ্ট (খ) খাদ্যের কষ্ট (গ) গরমের কষ্ট। এই তিন কষ্টের কারণে আমাদের এই সফরকে 'কষ্টের সফর' বলা হতো। পানির অভাবে আমরা এতই কাতর ও কাহিল হয়ে পড়েছিলাম যে, মনে হচ্ছিল যেন আমাদের প্রাণ এখনই বের হয়ে যাবে। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ যানবাহন হিসাবে ব্যবহৃত নিজেদের উট যবেহ করে তার পানির থলে বের করে ঐ পানিটুকু পান করে পিপাসা নিবৃত্ত করতো। কেউ কেউ উটের কলিজা বের করে চিবিয়ে তা পান করতো। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) নবী করিম (দঃ)-এর খেদমতে আরয করলেন- ইয়া রাসুলাল্লাহ (দঃ) আপনি আমাদের পানির জন্য আল্লাহর
কাছে প্রার্থনা করুন। নবী করিম (দঃ) এরশাদ করলেন, "তুমি কি এটাই ভাল মনে করো?” আবু বকর বললেন-হাঁ। নবী করিম (দঃ) আকাশের দিকে দু'হাত তুলে কি যেন বললেন। হাত নামানোর পূর্বেই আকাশ গর্জন করে উঠলো এবং বর্ষণ শুরু হয়ে গেলো। সাহাবীগণ যার যার পাত্র পানিতে পূর্ণ করে নিলেন। আমাদের (সাহাবীগনের) প্রয়োজন শেষ হলো- বর্ষনও বন্ধ হয়ে গেলো"। (বেদায়া নেহায়া)।
ইমাম বায়হাকী ও আবু নোয়াইম (রহঃ) বর্ণনা করেন- তাবুকের পথে একস্থানে বিশ্রামকালে নবী করিম (দঃ)-এর উটটি হারিয়ে যায়। অনুসন্ধানের জন্য তিনি লোক পাঠালেন। একজন মুনাফিক (যায়েদ ইবনে লুছাইত) বলে উঠলো-দেখুন, মুহাম্মদ (দঃ) একদিকে বলছেন তিনি নবী এবং আকাশের গায়েবী খবরও তিনি তোমাদেরকে বলেন- অন্য দিকে দেখছি- তিনি জমিনের খবরই জানেন না। তাঁর উটটি কোথায় আছে- তা তিনি বলতে পারছেন না। নবী করিম (দঃ) তার কথা শুন্তে পেয়ে বললেন-
“এক নিকৃষ্ট ব্যক্তি বলাবলি করছে, আমি নাকি জমিনের গায়েবী খবর জানি না। তোমরা শুন! আমি নিজে নিজে গায়েবী সংবাদ জানিনা বটে, কিন্তু আল্লাহ আমাকে যেসব গায়েবী খবর জানান- তা অবশ্যই জানি"। যাও তোমরা গিয়ে দেখো- "আমার উটটি ময়দানের একটি গাছের সাথে রশি আটকিয়ে আছে। তোমরা গিয়ে উটটি নিয়ে এসো"।
সাহাবায়ে কেরাম উক্ত স্থানে গিয়ে গায়েবী খবর অনুযায়ী উটটি পেয়ে নিয়ে আসলেন। উক্ত মোনাফেক তখন লজ্জায় মরে যাচ্ছিল। সে নবী করিম (দঃ)-এর ইলমে গায়েবের পরিচয় পেয়ে তওবা করে খালেস মুসলমান হয়ে গেলো। (মাওয়াহেব) আমাদের দেশের বাতিল পন্থীরা তাওবা করে না- বরং আরও জিদ করে হুযুরের ইলমে গায়েবকে অস্বীকার করে।
মুসলিম শরীফে হযরত মোয়ায ইবনে জাবাল (রাঃ) সূত্রে হাদীসে বর্ণিত আছে-সাহাবীগণ তাবুকের একটি শুষ্ক কুপের নিকট পৌঁছে অল্প অল্প করে পানি তুলে একটি ভান্ডে রাখলেন। নবী করিম (দঃ) ঐ পানি দিয়ে হাত মুখ ধুয়ে অবশিষ্ট পানিটুকু পুনরায় কূপে ঢেলে দিলেন। অমনি কূপে পানির স্রোত প্রবাহিত হতে লাগলো। এভাবে তিনি পানির অভাব পূরণ করেন। এই পানির সংযোগ ছিল হাউযে কাউছারের সাথে এবং এই পানিই পৃথিবীতে প্রাপ্ত পানির মধ্যে সর্বোত্তম। (বেদায়া নেহায়া)। তিনি তো হাউযে কাউছারের মালিক-জান্নাতেরও মালিক।
নবী করিম (দঃ) তাবুক যাওয়ার পথে ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি সামুদ গোত্রের আবাসস্থল 'হিজর' এলাকা তাড়াতাড়ি অতিক্রম করলেন এবং চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললেন। তিনি এরশাদ করলেন-"যখনই তোমরা কোন ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থান অতিক্রম করবে” তখন কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে পানাহ্ চাইবে- ফেন তোমাদের উপর ঐরূপ আযাব অবতীর্ণ না হয়"।
হিজর অতিক্রমকালে সাহাবীগণের কেউ কেউ ঐ স্থানের কূপ থেকে পানি সংগ্রাহ করে নিলেন। ঐ স্থান অতিক্রম করে যাওয়ার পর নবী করিম (দঃ) ঘোষণা দিলেন- "এই স্থানের পানি দিয়ে তোমরা কেউ অযু করবে না এবং প্যানও করবে না। ঐ পানি দিয়ে যদি কেউ রুটির খামিরা তৈরী করে থাকো- তা হলো তাও নিজেরা খাবে না- বরং ঐ রুটি উটকে খাওয়ায়ে ফেলবে। আজ রাত্রে তোমাদের উপর দিয়ে প্রবল ঝঞ্জা বায়ু প্রবাহিত হবে। সুতরাং তোমরা কেউ তাঁবু থেকে একা বের হবে না"।
নবী করিম (দঃ)-এর নির্দেশ মোতাবেক সবাই ঘরে আবদ্ধ রইলেন। কিন্তু মদিনার বনু সায়েদার দুই ব্যক্তি তাঁবু থেকে বের হলেন- একজন প্রকৃতির ডাকে, আর একজন উটের সন্ধানে। এমন সময় হঠাৎ করে প্রবল বায়ু প্রবাহিত হলো। প্রকৃতির ডাকে যিনি বের হয়েছিলেন, তিনি দম বন্ধ হয়ে পড়ে গেলেনা। আর যিনি উটের অনুসন্ধানে বের হয়েছিলেন, বায়ু তাকে উড়িয়ে নিয়ে 'ভাজ নামক পাহাড়ে নিক্ষেপ করলো। নবী করিম (দঃ) কে এই সংবাদ দেয়া হলে তিনি বেহুঁশ ব্যক্তির জন্য দোয়া করলেন। তিনি সাথে সাথে জ্ঞান ফিরে পেলেন। দ্বিতীয় ব্যক্তি সম্পর্কে ইবনে ইসহাকের বর্ণনা হলো- নবী করিম (দঃ) তাবুক থেকে মদিনায় প্রত্যাবর্তন করার পর নবীজীর সম্মানে তাঈ পাহাড় উক্ত ব্যক্তিকে মদিনায় পৌঁছিয়ে দেয় (বেদায়া-নেহায়া)। উল্লেখ্য, হযরত সালেহ (আঃ) উক্ত 'হিজর' এলাকার নবী ছিলেন। তাঁর উম্মতগণ কুদরতী উটের পা কেটে দিলো তাদেরকে গযবী পাথর (শিলা) মেরে ধ্বংস করা হয়। কুফায় হযরত সালেহ (আঃ)-এর মাযার অবস্থিত। আমি কাফেলা সহ উক্ত মাযার জিয়ারত করেছি।
তাবুকের যুদ্ধে খাদ্যাভাব ছিল প্রকট। সাহাবীগণ খাদ্যের অভাবের কথ্যা নাবী করিম (দঃ)-এর খেদমতে পেশ করেন। নবী করিম (দঃ) হযরত আবু হোরায়রা। (রাঃ) কে ডেকে বললেন- দেখ, কারো কাছে সামান্য খাদ্যবস্তু আছে কিনা?
হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) অনুসন্ধান করে ২১টি খেজুর থলেতে করে নবী করিম (দঃ)-এর খেদমতে পেশ করলেন। প্রিয় নবী (দঃ) ঐগুলোর উপর হাত। মোবারক রেখে দোয়া করলেন এবং লোকদেরকে ডেকে আনলেন। সবাইকে তিনি উক্ত খেজুরের থলে থেকে প্রয়োজন মাফিক খুরমা-খেজুর সরবরাহ করলেন। সকলে খেয়ে তৃপ্ত হলেন। এভাবে পুরো বাহিনী উক্ত খেজুর খেয়ে তৃপ্ত হলেন। তাবুক বাহিনীতে ত্রিশ হাজার সৈন্য ছিল। এরপর থলে খুলে দেখা গেলো ২১টি খেজুরই অবশিষ্ট রয়ে গেছে। সোবহানাল্লাহ! (যিকরে জামীল) নবী করিম (দঃ) এরশাদ করলেন, "হে আবু হোরায়রা! তুমি খেজুরের থলেটি নিয়ে যাও। যখনই তুমি প্রয়োজন মনে করবে, তখন থলের মুখে হাত প্রবেশ করে খেজুর বের করে আনবে। কিন্তু মুখ একেবারে খুলবেনা”। হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বলেন- "নবী করিম (দঃ)-এর বাকী যুগ, হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর আড়াই বৎসরের খেলাফত যুগ, হযরত ওমর (রাঃ)-এর দশ বৎসরের খেলাফত যুগ, হযরত ওসমান (রাঃ)-এর বার বৎসরের খেলাফত যুগ-মোট সাড়ে ২৬ বৎসর উক্ত থলে থেকে নিজের পরিবার পরিজন নিয়ে খেয়েছি এবং আল্লাহর রাস্তায় খরচ করেছি। যেদিন হযরত ওসমান (রাঃ) শহীদ হলেন (৩৫ হিজরী) সেদিন আমার অন্যান্য আসবাবসহ উক্ত থলেটিও লুট হয়ে যায়। আমি কি আপনাদেরকে বলবো-কি পরিমাণ খেয়েছি এবং কি পরিমাণ দান করেছি? নিজেরা খেয়েছি দুইশত ওয়াছাক এবং দান করেছি পঞ্চাশ ওয়াছাক (বায়হাকী)।"
২৪০ সের বা ছয় মনে এক ওয়াছাক (খুচী) হয়। এ হিসাবে আড়াইশ ওয়াছাকে ২৫০x৬=১৫০০ (এক হাজার পাঁচশত মন) হয়। সোবহানাল্লাহ! প্রশ্ন জাগে-এত গায়েবী খেজুর কোথা থেকে আল্লা? বস্তুতঃ আল্লাহ তায়ালা আসমান জমিনের ধনদৌলতের চাবিকাঠি নবী করিম (দঃ)-এর নিয়ন্ত্রণাধীন করে দিয়েছেন। (মিশকাত)। উক্ত ধনদৌলত দেখা যায়না বটে, কিন্তু পাওয়া যায়। দাতা আর গ্রহীতার ভেদ অন্য কেউ অনুধাবন করতে অক্ষম। হতবাক হওয়া ছাড়া গতি নেই। এটা বিশ্বাস করার নামই সুন্নী আক্বিদা।
তাবুক যুদ্ধের সময়ের একটি ঘটনা। হযরত আনাছ ইবনে মালেক (রাঃ) বলেন-আমরা এবং নবী করিম (দঃ) তখন তাবুকে অবস্থানরত। এসময়ে মদিনাবাসী সাহাবী মোয়াবিয়া ইবনে আবু মোয়াবিয়া লাইছী (রাঃ) মদিনায় ইনতিকাল করেন। ঐদিন সূর্যের আলো ছিল তীব্র উজ্জ্বল। এমন সময় হযরত জিবরাঈল (আঃ) হুযুর পাক (দঃ) এর দরবারে এসে এর কারণ এভাবে বর্ণনা করলেন-
"মদিনাবাসী মোয়াবিয়া ইবনে আবু মোয়াবিয়া লাইছী (রাঃ) আজ ইনতিকাল করেছেন। উনার জানাযাতে শরিক হওয়ার জন্য সত্তর হাজার ফিরিস্তা আকাশ থেকে নেমে এসেছে-তাই আজ এত আলো। সূর্য্যের আলোর সাথে ফিরিস্তাদের নূর মিশে এমন আলো ছড়াচ্ছে। মোয়াবিয়া দিনে-রাতে, উঠা-বসায়, চলা-ফেরায় সর্বদা ছুরা ইখলাছ পড়তে ভালবাসতেন"। জিবরাঈল (আঃ) আরয করলেন
فهل لك يا رسولَ الله أن أقبضَ لك الأرضَ فتُصَلِّيَ عليه؟ قال: نعم. قال أنسٌ: فصلى عليه ثم رجع
"হে আল্লাহর রাসূল। আপনি ইচ্ছা করলে আমি জমিনকে সংকুচিত করে দেবো-যাতে আপনি তাঁর জানাযা পড়াতে পারেন"। হুযুর (দঃ) বললেন- তাই করুন।
বর্ণনাকারী হযরত আনাছ ইবনে মালেক )রাঃ) বলেন- فصلى عليه ثم رجع "রাসুল মকবুল (দঃ) মদিনায় জানাযা পড়ায়ে মুহুর্তের মধ্যে আবার তাবুকে ফিরে আসলেন”। (ইয়াযিদ ইবনে হারুন (রাঃ) সুত্রে হযরত আনাছ ইবনে মালেক (রাঃ) থেকে- বায়হাকী)।
ইমাম বায়হাকী অন্য একটি সনদে ওসমান ইবনে হাইছাম সুত্রে হযরত আনাছ (রাঃ) হতে উপরোক্ত বর্ণনার পর আরো কিছু শব্দ যোগ করেছেন। তাহলো-
قال عثمان: فسألتُ أبا ميمونة: أين كان النبي ﷺ؟ قال: بغزوة تَبُوكَ بالشام. ومات معاوية بن معاوية بالمدينة، ورُفِعَ له سريره حتى نظر إليه فصلى عليه.
অর্থ-"বর্ণনাকারী রাবী ওসমান বলেন-আমি আমার উপরের বর্ণনাকারী আবু মাইমুনাকে জিজ্ঞাসা করলাম-আচ্ছা, "মোয়াবিয়া ইবনে আবু মোয়াবিয়ার জানাযা পড়াবার সময় নবী করিম (দঃ) কোথায় ছিলেন? তিনি জওয়াব দিলেন-সিরিয়ার তাবুকে ছিলেন। ঐ সময় মোয়াবিয়া ইবনে আবু মোয়াবিয়া মদিনাতে মৃত্যুবরণ করেন, আর নবী করিম (দঃ) ছিলেন তাবুকে। এমতাবস্থায় মধ্যখানের পর্দা সরে গেলো। নবী করিম (দঃ) তাঁর দিকে চেয়ে চেয়ে নামাযে জানাযা পড়ায়ে ছিলেন"। আনাছ ইবনে মালেক (রাঃ)-এর বর্ণনায় একথাও উল্লেখ আছে যে, "হুযুরের পিছনে সত্তর হাজার করে দুই কাতারে একলক্ষ চল্লিশ হাজার ফিরিস্তা শরিক ছিল"। (আল- বেদায়া ৫ম খন্ড ১৫ পৃষ্ঠা)।
প্রথম বর্ণনায় বুঝা গেল- হুযুর (দঃ) একই সময়ে তাবুক এবং মদিনা উভয় স্থানে উপস্থিত ছিলেন। নবীজীর জন্য জমিন সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল। এই ঘটনার পরও যদি কেউ বলে- নবীজী একসাথে বিভিন্ন স্থানে হাযির হতে পারেন না- তাহলে তাকে অন্ধ জাহেল ছাড়া আর কি বলা যাবে?
নবী করিম (দঃ) ১৯ কিম্বা বিশ দিন তাবুকে অবস্থান করেন। এই অভিযানের সংবাদ পেয়ে খৃষ্টান সামন্ত রাজারা একে একে সন্ধি প্রস্তাব নিয়ে হাযির হলো।
তাদের মধ্যে আয়লার অধিপতি ইউহনা এবং "জারবা ও আজরুহ" শহরদ্বয়ের সামন্তগণ উল্লেখযোগ্য। তারা সকলে নিয়মিত জিযিয়া কর প্রদানের অঙ্গীকার করে নবী করিম (দঃ)-এর সাথে শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করে। নবী করিম (দঃ) তাদেরকে নিরাপত্তানামা লিখে দেন। (বেদায়া নেহায়া)
রোম অধিপতি হিরাক্লিয়াস সেসময় কুসতুনতুনিয়া থেকে সিরিয়ার হিস্স শহরে এসে অবস্থান করছিল। নবী করিম (দঃ) হযরত দাহ্ইয়া কলবী (রাঃ)-এর মাধ্যমে হিরাক্লিয়াসের নিকট হিস্স শহরে পুনরায় একখানা দাওয়াতী পত্র প্রেরণ করেন। হিরাক্লিয়াস তার আমাত্যবর্গকে ডেকে পত্রের মর্ম অবগত করায়ে ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে তাদের মতামত জানতে চাইলে তারা উত্তেজিত হয়ে দরবার ত্যাগ করে। হিরাক্লিয়াস ভীত হয়ে তার প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেয় এবং খৃষ্টান ধর্মের প্রতি তার আনুগত্য পুনঃ ঘোষণা করে। সে বদনসীবই রয়ে গেলো। পূর্বে হিজরী সপ্তম সালেও তার কাছে দাওয়াতীপত্র প্রেরণ করা হয়েছিল।
দুমাতুল জন্দল নামক স্থানের অধিপতি উকাইদির ইবনে আবদুল মালিক নামক খৃষ্টান সামন্তের নিকট খালেদ 'ইবনে ওয়ালিদ (রাঃ) কে চারশত সৈন্য দিয়ে প্রেরণ করা হয়। হযরত খালেদ (রাঃ) দুমাতুল জন্দলে উপস্থিত হয়ে উকাইদির ও তার ভাই হাসসানকে দেখতে পেয়ে তাদের উপর আক্রমণ পরিচালনা করে হাসসানকে নিহত করেন এবং উকাইদিরকে ধরে নিয়ে আসেন। সে জিজিয়া কর আদায় করার শর্তে নবী করিম (দঃ)-এর সাথে সন্ধি চুক্তি করে আত্মরক্ষা করে।
তাবুক যুদ্ধই রাসুলুল্লাহর (দঃ) জীবনের সর্বশেষ বড় যুদ্ধ।
তাবুকের অভিযান শেষ করে নবী করিম (দঃ) মদিনার পথে রওনা হন। মদিনা শরীফের কাছাকাছি পৌঁছে তিনি খবর পেলেন, মোনাফিকরা ইত্যবসরে কুবায় একটি পৃথক মসজিদ তৈরী করে ফেলেছে। এই মসজিদটি মুসলমানদের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে দূর্গ হিসাবে নির্মাণ করা হয়েছিল। এজন্য আল্লাহ তায়ালা এই মসজিদকে 'মসজিদে দিরার' বা ক্ষতিকর মসজিদ বলে আখ্যায়িত করে একে ধ্বংস করে দেয়ার নির্দেশ দেন। মসজিদে কুবার বিরুদ্ধে এই মসজিদটি তৈরী করা হয়েছিল। আবু আমের পাদ্রী এই মসজিদের নির্মাতা। নবী করিম (দঃ) মদিনায় পৌঁছার পূবেই মালেক ও আছেম নামের দুই ভাইকে পাঠিয়ে উক্ত মসজিদটি জ্বালিয়ে দেন। (বেদায়া নেহায়া) (এখনও বাতিল পন্থীরা সুন্নী মসজিদের বিপরীতে বাতিল মতবাদ প্রচারের উদ্দেশ্যে পৃথক মসজিদ তৈরী করে। এগুলোও মসজিদে দিরার হিসাবে গন্য।)
নবী করিম (দঃ) মদিনা শরীফের নিকটবর্তী হয়ে মদিনা শরীফকে উদ্দেশ্য করে বললেন- "ইহা তাবা" এবং ওহোদ পাহাড়কে উদ্দেশ্য করে বললেন- "এটি ওহোদ পাহাড়"- সে আমাকে ভালবাসে এবং আমিও ওহোদকে ভালবাসি"। সে সময় থেকে মদিনা শরীফের সাথে "তাইয়েবা" যোগ হয়ে মদিনা তাইয়েবা হয়। ওহোদ পাহাড় পাথর হয়েও নবীকে ভালবাসে। একারণে নবী করিমও (দঃ) ওহোদকে ভালবাসতেন। যে প্রেমিক রাসুলকে (দঃ) ভালবাসবে, নবী করিমও (দঃ) নিশ্চয়ই তাকে ভালবাসবেন।
রমযানের প্রথম ভাগে মদিনায় আসার পর তিনি আবিসিনিয়ার মুসলমান বাদশাহ আস্হামা নাজ্জাশীর মৃত্যু সংবাদ ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত হন। নবী করিম (দঃ) এবং আবিসিনিয়ার মধ্যখানের যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে গেল। তিনি নাজ্জাশীকে চোখের সামনে রেখে জানাযা পড়ালেন। তাবুক থেকে ফেরত এসে প্রথমে তিনি মসজিদে নববীতে কিছুক্ষণ অবস্থান করেন। মদিনার নারী-পুরুষ-যুবা-শিশু নির্বিশেষে সকলেই ঘর থেকে বের হয়ে নবী করিম (দঃ) কে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন এবং গেয়ে উঠেনঃ
طَلَعَ الْبَدْرُ عَلَيْنَا مِنْ ثَنِيَّاتِ الْوَدَاع
وَجَبَ الشُّكْرُ عَلَيْنَا مَا دَعَا لِلَّهِ دَاعٍ
তাঁরা হিজরতের সময়ও নবীজীর আগমনে এরূপ গেয়েছিলেন। তাবুকের যুদ্ধ হতে ফেরত এসে নবী করিম (দঃ) হযরত আলীকে লক্ষ্য করে এরশাদ করলেন:
رَجَعْنَا مِنَ الْجِهَادِ إِلَّا صَغَرِ إِلَى الْجِهَادِ الْأَكْبَرِ
অর্থ-"আমরা ছোট যুদ্ধ শেষ করে এবার বড় যুদ্ধের দিকে (নফসের বিরুদ্ধে) অগ্রসর হলাম”
(আল হাদীস)
মানুষ শত্রুর চেয়ে নশত্রু অনেক ভয়ঙ্কর। তাই নফছ শয়তানের বিরুদ্ধে জেহাদ করা হলো বড় জেহাদ।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০৬৯) মক্কা বিজয় | (০৭১) মুনাফিক সর্দারের মৃত্যু |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |