মক্কাবাসীগণ পূর্ব হতেই হজ্বের মৌসুমে (শাওয়াল, যিলকদ ও যিলহজ্ব) আরাফাত ও মিনায় অবস্থান করতো এবং শেরেকী পন্থায় আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করতো। নবী করিম (দঃ)ও নিয়মিতভাবে ঐ সময় আরাফাত এবং মিনায় যেতেন এবং আল্লাহর ইবাদাতে মশগুল থাকতেন। হিজরতের পূর্বে তিনি মিনায় মদিনাবাসীদের নিকট ইসলামের দাওয়াত দিতেন। একাধারে তিন বৎসর তিনি হজ্বের মৌসুমে আগত মদিনাবাসী নারী-পুরুষদের সাথে মিনার আকাবায় মিলিত হয়ে হিজরতের কথা পাকাপোক্ত করেছিলেন। তখন মদিনাবাসী মুসলমানের সংখ্যা ছিল ৯০ জন।
হিজরতের পর তিনি ৪ বার ওমরাহ্ ও একবার হজ্ব আদায় করেন। প্রথমবার ৬ষ্ঠ হিজরীতে ওমরাহ্ করতে এসে হোদায়বিয়া হতে ফেরত যান। এটাও ওমরার মধ্যে গণ্য হয়। পরের বৎসর ৭ম হিজরীতে সন্ধির শর্ত অনুযায়ী ওমরাতুল ক্বাযা পালন করেন। ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের পর হোনায়ন ও তায়েফ যুদ্ধ শেষে জি'রানা নামক স্থান থেকে এহরাম বেঁধে ওমরাহ আদায় করেন। ৪র্থ ওমরাহ্ আদায় করেন বিদায় হজ্বের সাথে।
দ্বিতীয় ওমরাহ্ আদায় করার সময় (৭ম হিজরী) মক্কাশরীফ কোরাইশদের দখলে ছিল। সেসময় কা'বার ভিতরে ৩৬৩টি মূর্তি ছিল। এমতাবস্থায় নবী করিম (দঃ) সাহাবীদেরকে নিয়ে আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করেন এবং বাইরে নামায আদায় করেন। এতে সাহাবীগণের মনে খটকা লাগে। নবী করিম (দঃ) তাঁদেরকে শান্তনা দিয়ে বললেন- "আমাদের নিয়ত হচ্ছে আল্লাহর ঘরের বাইরে তাওয়াফ করা- ভিতরের মূর্তির তাওয়াফ করা নয়। আল্লাহ নিয়ত অনুযায়ী বরকত দেবেন"। (পেটের ভিতরে পেশাব পায়খানা রেখেও নামায পড়া যায়।)
এতে একটি মাসআলা জানা গেল যে, কোন পবিত্র স্থানে অপবিত্র কর্মকান্ড অনুষ্ঠিত হলেও উক্ত পবিত্রস্থানের বৈধ অনুষ্ঠানে যোগদান করা উচিত। যদি ওখা কার অন্যায় কাজ বন্ধ করা সম্ভব না হয়, তবে একারণে মূল বৈধ কাজ বাদ দেয়া যাবে না। যেমন- কোন মাযারে নারী-পুরুষ একসাথে যিয়ারত করলে অথবা শরীয়ত বিরোধী কোন কার্যকলাপ সেখানে অনুষ্ঠিত হলে- এই অজুহাতে মূল যিয়ারত বন্ধ করা যাবেনা। কেননা যিয়ারত করা সুন্নাত। শক্তি থাকলে শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপ বন্ধ করা ওয়াজিব। নতুবা নিজে নিজে যিয়ারত করে চলে আসবে। (শামী, বাহারে শরীয়ত)।
নবম হিজরীতে নবী করিম (দঃ) নিজে হজ্ব না করে, হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) কে আমীর বানিয়ে তিনশত লোক পাঠিয়ে প্রথম হজ্ব পালন করান। এ বছর মুশরিকরাও তাওয়াফ করতে এসেছিলো। তাই হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর নেতৃত্বে মুসলমানদের হজ্ব হিল মুসলমান ও মুশরিকদের মিশ্রিত হজ্ব। মুশরিকগণ তাদের শেরেকী প্রথা অনুযায়ী হজ্ব বা তাওয়াফ করেছিল এবং মুসলমানগণ ইসলামী কায়দায় হজ্ব আদায় করেন। এই বৎসরই ছিল মুশরিকদের শেষ সুযোগ। হযরত আলী (রাঃ) কে পাঠিয়ে নবী করিম (দঃ) আরাফাতে ও মিনায় আল্লাহর ঘোষণা প্রচারের ব্যবস্থা করেন এই বলে যে, "দশম হিজরী থেকে মুশরিকদের জন্য হজ্ব ও ওমরায় আগমন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হলো”। এভাবে মক্কা, আরাফাত, মোজদালেফা ও মিনাকে মুশরিকমুক্ত করে নবী করিম (দঃ) দশম হিজরীতে নিজে হজ্ব আদায় করার ব্যবস্থা করেন। বিলম্বের ইহাই মূল কারণ।
সংস্কার কাজ করা যে কত কঠিন ও সময় সাপেক্ষ-হজ্বের এ ঘটনার মধ্যেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। পরিবেশ সৃষ্টি না করে প্রথম থেকেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলে তা বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। একটি হজ্বের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরী করতে ২ বৎসর লেগেছিল।
নবী করিম (দঃ) দশম হিজরীর হজ্ব মৌসুমের পূর্বেই ঘোষণা করে দেন যে, তিনি এ বৎসর হজ্ব আদায় করবেন। সাহাবীগণ যেন সমবেতভাবে নবী করিম (দঃ)-এর সাথে হজ্বে গমনের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন। সারা আরবে সাজসাজ রব পড়ে গেল। আনন্দের ঢেউ খেলে গেলো। সকলের মনে বিগত একুশ বৎসরের যুলুম-অত্যাচার, দেশত্যাগ, যুদ্ধ বিগ্রহ, অবশেষে মক্কা বিজয়, কোরাইশদের চরম পরাজয় ও অপমান- সব কিছুর ছবি চোখের সামনে একে একে ভেসে উঠতে লাগলো। মহানবীর (দঃ) মহান হজ্ব যেন একই সাথে মহা বিজয় মিছিলে পরিণত হতে লাগলো। চতুর্দিকে প্রস্তুতির ধুম পড়ে গেল।
কিন্তু এতসব আনন্দ আয়োজনের মধ্যেও যেন বিদায়ের একটি করুণ সুর বেজে উঠলো। মহানবীর (দঃ) উপর অর্পিত দায়িত্ব যেন চূড়ান্ত সমাপ্তিপথে দ্রুত এগিয়ে চলছে। হজ্বের প্রস্তুতির সাথে সাথে মহানবী (দঃ) মহাপ্রয়াণের প্রস্তুতিও মনে মনে গ্রহণ করতে লাগলেন।
দশম হিজরীর যিলক্বদ মাসের ৫ দিন বাকী থাক্তে নবী করিম (দঃ) এক লক্ষ চব্বিশ হাজার-মতান্তরে একলক্ষ ছাব্বিশ হাজার সাহাবীর হজ্ব কাফেলা নিয়ে হজ্বে রওনা দিলেন এবং জিলহজ্ব মাসের ৪ তারিখে মক্কা মোয়ায্যমায় উপস্থিত হলেন। মক্কা মোয়ায্যমা নবী করিম (দঃ)-এর আগমনে যেন পুনঃজীবন লাভ করলো। নবী করিম (দঃ)-এর পদধূলিতে মক্কা ভূমি পুনরায় গৌরবান্বিত হলো। একলক্ষ ছাব্বিশ হাজার সাহাবায়ে কেরামের উপস্থিতিতে মক্কাভূমি জান্নাতে রূপান্তরিত হলো। সে বৎসরই মক্কার হাজুন কবরস্থানটি "জান্নাতুল মায়াল্লা" উপাধীতে ভূষিত হলো। মক্কার এই দৃশ্য কেয়ামত পর্যন্ত দ্বিতীয়বার আর দেখা যাবেনা। এই জান্নাতী দৃশ্য কল্পনা করেই রাসুল-প্রেমিকদের হৃদয় হজ্বে গমনে আকুল হয়ে উঠে
মদিনা শরীফের মসজিদে নব্বীতে যোহর নামায আদায় করে তিনি রওনা দেন এবং যুল-হোলায়ফা নামক স্থানে গিয়ে আসরের নামায দু-রাকাত-অর্থাৎ কসর আদায় করেন। সেখান থেকেই তিনি ইহরাম পরিধান করে তাল্লিয়া বা লাব্বাইকা দোয়া পাঠ করেন। মদিনা শরীফের ৬ মাইল দূরে যুল-হোলায়ফা মদিনাবাসীদের ইহরামের মীকাত। মক্কা মোয়ায্যমার পথে তিনি ৯ দিন সফর করেন। যেখানে যেখানে তিনি অবতরণ করে নামায আদায় করতেন-ঐ স্থানগুলোতে পরবর্তীতে মসজিদ তৈরী হয়। সাহাবাগণের যুগে অবশ্য সব মসজিদ তৈরী হয়নি। তবুও তাঁরা যখনই এপথে মক্কায় গমনাগমন করতেন, তখন ঐ পবিত্র স্থানসমূহে বরকতের আশায় নামায আদায় করতেন এবং নবী করিম (দঃ)-এর স্মৃতি বিজড়িত পবিত্রস্থান হিসাবে ঐ স্থানের তাযীম করতেন। ইবনে কাছির (৭৭৪ হিজরী) তাঁর অমরগ্রন্থ আলবেদায়া ওয়ান নেহায়া'তে এই স্থানগুলোর উল্লেখ করে কোন্ কোন্ সাহাবী এসব স্থানে নামায আদায় করতেন-তাঁদের নামও উল্লেখ করেছেন। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, পরবর্তী যুগের জাহেল ও মূর্খ লোকদের অবহেলায় ঐসব স্থানের অনেক স্মৃতি চিহ্নই বিনষ্ট হয়ে যায়।
নবী-রাসুল-অলী-আব্দাল ও গাউছ-কুতুবগণের স্মৃতি চিহ্ন সংরক্ষণ করা ইসলামকে সতেজ রাখার একটি প্রকৃষ্ট উপায়। ইহা ইসলামী ঐতিহ্যের প্রমাণ ও প্রতীক। যেখানে মহান সাধকগণের মাযার ও স্মৃতিচিহ্ন বিদ্যমান-সেখানে ইসলামের জোশ ও প্রেরণা উজ্জিবিত। উদাহরণ স্বরূপ- মদিনা মোনাওয়ারা, বাগদাদ শরীফ, আজমীর শরীফ, সিরহিন্দ শরীফ, বেরেলী শরীফ, সিলেট, দিল্লী, পাকপত্তন, কালিয়ার শরীফ, কাচওয়াছা ফয়যাবাদ, ছিরিকোট, লাহোর, পানিপথ- ইত্যাদি স্থানের পবিত্র রওযা ও মাযারসমূহ। এসব মাযার ইতিহাসের জ্বলন্ত স্বাক্ষী ও মুসলিম ঐতিহ্যের প্রতীক। এগুলো হলো প্রেরণার উৎস। মাযার সমূহ ধ্বংস করার অর্থ- গোটা মুসলিম জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধ্বংস করা। সৌদী সরকার তাই করেছে- তারা ইসলামী ঐতিহ্য হত্যাকারী।
বর্তমান সৌদি রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আবদুল আযিয ১৯২৫-২৬ সালে মক্কা, মদিনা, তায়েফ ইত্যাদি স্থানের সাহাবীগণের, নবী পত্নীগণের ও বিবি ফাতেমার (রাঃ) মাযারসমূহ ধূলিস্যাত করে দিয়েছে। এতে করে দিনদিন সৌদি আরবের প্রকৃত ইসলামী প্রেরণা হ্রাস পাচ্ছে এবং বেদ্বীন আমেরিকার গোলামে তারা পরিণত হচ্ছে। ওহাবী রাজতন্ত্র যেদিন খতম হবে, সেদিন স্মৃতিচিহ্ন, স্মৃতিসৌধ ও মাযারসমূহ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে- ইন্শাআল্লাহ। বর্তমানে বিদেশে অবস্থানরত কিছু কিছু সৌদি ওলামা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন।
মক্কা-মদিনার সুন্নী ওলামাগণ কোন্ঠাসা অবস্থায় আহাজারী করছেন। সৌদী বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক অধ্যাপক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ১৯৯৪ সালে সৌদি সরকার অনেক আলেম-উলামাকে জেলে পাঠিয়েছে। উলামা ও মসজিদের ইমামগণ দিনদিন সোচ্চার হয়ে উঠছেন। কমিউনিজম শত বসৎরের মাথায় এসে ভেঙ্গে পড়েছে। ওহাবী ইজমও শত বৎসরের মাথায় এসে ভেঙ্গে যাওয়া আশ্চর্যের কিছু নয়। বর্তমানে (২০০৭) ৮৩ বৎসর চছে।
নবী করিম (দঃ) যিলহজ্ব চাঁদের ৪ তারিখ রোববার সকালে সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে মক্কা-মোয়ায্যমায় প্রবেশ করে খানায়ে কা'বার তাওয়াফ করেন এবং সাফা মারওয়ার সাঈ সমাপ্ত করেন-যারা প্রথমে শুধু ওমরাহ্ করার নিয়তে এহরাম বেঁধেছিলেন, তাঁদেরকে এহরাম খুলে ফেল্ল্ভে নির্দেশ দিলেন। ইহাকে হজ্বে তামাত্তু বলা হয়। ঐ দিনই তিনি মক্কা-মোয়ায্যমার পূর্বপ্রান্তে বাহা বা আত্তাহ্ নামক স্থানে গিয়ে অবস্থান করতে লাগলেন। এ জন্য হুযুর (দঃ) কে আত্তাহীও বলা হয়। ৭ তারিখ বুধবার পর্যন্ত তিনি ঐ স্থানেই অবস্থান করেন। এই সময় বিবি ফাতেমা (রাঃ) ও উম্মুল মোমেনীনগণ হুযুর (দঃ)-এর সাথে ছিলেন।
হযরত আলী (রাঃ) ছিলেন ইয়ামেন দেশে গভর্ণর হিসাবে। নবী করিম (দঃ)-এর নির্দেশে হযরত আলী (রাঃ) ইয়ামেন থেকে এসে তাঁর সাথে আবতাহ্ নামক স্থানে মিলিত হন। যিলহজ্ব মাসের ৮ তারিখ বৃহস্পতিবার হজ্বের উদ্দেশ্যে তিনি মীনায় গমন করেন এবং যোহর থেকে ৫ ওয়াক্ত নামায সেখানে আদায় করেন।
নবী করিম (দঃ) মক্কার হিসাব মতে ৯ই যিলহজ্ব শুক্রবার সকালবেলা মীনা থেকে পূর্বদিকে আরাফাতের উদ্দেশ্যে রওনা হন। সাথে এক লক্ষ ছাব্বিশ হাজার সাহাবায়ে কেরামও মীনা থেকে আরাফাতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। লক্ষ কণ্ঠের গগনবিদারী লাব্বাইক ধ্বনীতে দু'পাশের পর্বতমালা কেঁপে উঠলো। নবী করিম (দঃ) আরাফাতে পৌঁছে মসজিদে নামিরার স্থানে দাঁড়িয়ে ঐতিহাসিক বিদায় হজ্বের ভাষণ (খুতবা) প্রদান করেন। উক্ত ভাষণে তিনি ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব, আরব-আজমের ভেদাভেদহীন সমাজব্যবস্থা, সুদ হারাম, পরস্পর খুনখারাবীর উপর নিষেধাজ্ঞা, নারীদের ইজ্জত-সম্ভ্রম রক্ষা, জীবনের নিরাপত্তা, সম্পদের নিরাপত্তা- ইত্যাদি বিষয়ে এক নীতি-নির্ধারনী সারগর্ভ ভাষণ প্রদান করেন। এই ভাষণকেই হজ্বের খুতবা বা বিদায়ী ভাষণ বলা হয়। যোহর নামাযের পূর্বে এই খুতবা দেয়া হয়। অতঃপর তিনি জাবালে রহমতের পাদদেশে দোয়া মুনাজাতে মঞ্জুল হয়ে পড়েন।
সেদিন তিনি মুসাফির হিসাবে যোহর ও আছর নামায একসাথে পরপর আদায় করেন-জুমা পড়েননি। এই ব্যবস্থাকে 'জয়ে তাকদীম' বলা হয়। কিয়ামত পর্যন্ত আরাফাতের দিন শুধু মসজিদে নামিরার জমাতে এই নিয়ম চালু থাকবে। কিন্তু তাঁবুতে পড়লে যোহর ও আছর ভিন্ন ভিন্ন সময়ে পড়তে হবে।
সন্ধ্যার কিছু পূর্বেই কোরআন মজিদের ঐতিহাসিক আয়াতটি নাযিল হয়। আল্লাহ তায়ালা উক্ত আয়াতে আল্লাহপাক এরশাদ করেন-
"আজকের দিনে আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণতা দান করলাম। আর আমার নেয়ামতও তোমাদের উপর পরিপূর্ণ করে দিলাম। আর ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসাবে তোমাদের জন্য পছন্দ করলাম” (সুরা মায়েদাহ)। আয়াত হিসাবে এই আয়াতটিই সর্বশেষ নাযিল হয়। এরপর মীনাতে নাযিল হয় সর্বশেষ পরিপূর্ণ সুরা আন্-নাস।
আরাফাতে উক্ত আয়াতটি নাযিল হওয়ার সাথে সাথে সাহাবীগন আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেন। কিন্তু হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ), হযরত ওমর (রাঃ) ও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) নীরবে কাঁদতে লাগলেন। কাঁদার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তাঁরা বললেন- এই আয়াতে নবী করিম (দঃ)-এর বিদায়ের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতও রয়েছে। সুতরাং আমরা নবী করিম (দঃ)-এর বিদায়-আশংকায় কাঁছি।
উক্ত আয়াতে নবুয়তধারার পরিসমাপ্তি এবং দ্বীনের পূর্ণাঙ্গতা সম্বদ্ধে আল্লাহপাক যে-শুভ সংবাদ দিয়েছেন-তা কত গুরুত্বপূর্ণ, জনৈক ইয়াহুদী পাদ্রীর উক্তিতে তা পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে।
হযরত ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে উক্ত ইয়াহুদী পাদ্রী তাঁর দরবারে এসে বললো- "হে আমিরুল মোমেনীন! আপনারা আপনাদের কোরআনে এমন একটি আয়াত পাঠ করেন- যদি সেই আয়াতটি আমরা ইয়াহুদী সম্প্রদায়ের উপর অবতীর্ণ হতো-তাহলে আমরা ঐ দিনটিকে ঈদের দিন হিসাবে পালন করতাম”। হযরত ওমর (রাঃ) জিজ্ঞাসা করলেন- "সে আয়াতটি কি? ইয়াহুদী বললো- 'আল্ ইয়াওমা আকমাল্লু লাকুম'... আয়াত। হযরত ওমর (রাঃ) বললেন- উক্ত আয়াতটি যে দিনে, যে তারিখে ও যে সময়ে নাযিল হয়েছিল- তা আমার স্পষ্ট স্মরণ আছে- দুই ঈদের দিনে অর্থ্যাৎ- আরাফাতের দিনে ও জুমার দিনে বিকাল বেলায় নবী করিম (দঃ)-এর উপর উক্ত আয়াতটি নাযিল হয়েছিল (মুসলিম)। অর্থাৎ হজ্ব ও জুমার দিন আমাদের নিকট ঈদের দিন। পবিত্র তারিখে, পবিত্র দিনে, পবিত্র স্থানে ও পবিত্র ক্ষণেই উক্ত আয়াতটি নাযিল হয়েছে"।
(বিঃ দ্রঃ) কিছু জাহেল লোক বলে- দুই ঈদ ছাড়া শরিয়তে তৃতীয় কোন ঈদ নেই। তাদের জানা উচিৎ-জুমা এবং আরাফাতের দিনও ঈদের দিন। এভাবে মিলাদুন্নবীর দিনও ঈদের দিন। ঈদের দিন ৯টি- (১) ঈদে রামাদ্বান (২) ঈদে কোরবান (৩) ঈদে জুমুয়া ৪। ঈদে আরাফাহ (৫) ঈদে লাইলাতুল বারাআত (৬) ঈদে লাইলাতুল ক্বদর (৭) ঈদে আশুরা (৮) ঈদে নুযুলে মায়েদাহ (৯) ঈদে মিলাদুন্নবী বা ঈদে ইয়াওমে বেলাদাত (গুনিয়াতুত্বালেবীন, মাওয়াহিব, মাদারিজ- ইত্যাদি)।
আরাফাতের ময়দানে নবী করিম (দঃ) সন্ধ্যা পর্যন্ত অবস্থান করেন। দিনের মধ্যাহ্ন হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত আরাফাত ময়দানে হাজীগণের অবস্থান করাকে 'উকুফ' বলা হয়। এই কাজটি হজ্বের ফরয। এই সামান্য সময় অবস্থানের ফলে আল্লাহ তায়ালা জীবনের সমস্ত গুনাহ্ ক্ষমা করে দেন। সূর্য্য ডুবে হলুদ রং অপসারিত হওয়ার পর নবী করিম (দঃ) কাস্তয়া নামক উটে আরোহন করেন এবং পিছনে। পালিত পুত্রের সন্তান উসামা ইবনে যায়েদকে (রাঃ) বসান। এই কায়া উটটি হযরত আবু বকর (রাঃ) হিজরতের সময় ক্রয় করে নবী করিম (দঃ) কে দান করেছিলেন। এই উটে সওয়ার হয়েই নবী করিম (দঃ) হাশরের ময়দানে উপস্থিত হবেন বলে এক হাদীসে এসেছে। হযরত আবু বকর (রাঃ) কর্তৃক ক্রয়কৃত অন্য উটটির নাম ছিল আদ্বা। এটিতে চড়ে হাশরে যাবেন বিবি ফাতেমা (রাঃ)। হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর অবদানকে রাসুলে মকবুল (দঃ) এভাবেই সম্মানিত করেছেন।
নবী করিম (দঃ) সকল সাহাবীকে মোযদালিফার দিকে রওনা দেয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন এবং পথিমধ্যে মাগরিব নামায না পড়ার কথা বলে দিলেন। কেননা, আরাফাত ও মোযদালিফার মধ্যখানে আব্রাহার হস্তি বাহিনীর উপর আল্লাহ তায়ালা গযব নাযিল করেছিলেন। মোযদালিফায় এসে নবী করিম (দঃ) ঐ স্থানে অবস্থান করলেন- যেখানে হযরত আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়া (আঃ) প্রথম বাসররাত্রি যাপন করেছিলেন-খোলা আকাশের নীচে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, আরাফাহ্ ও মোযদালিফা-এই দুটি স্থান আদি পিতা-মাতার স্মৃতিবিজড়িত স্থান। হাজীগণ আরাফাত ও মোযদালিফায় গমন করে আদি পিতা-মাতার স্মৃতি স্মরণ করে এবং কিছুক্ষণ পিতৃস্থানে অবস্থান করে। তদ্রুপ মীনা হলো হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও হযরত ইসমাইল (আঃ)-এর কঠিন পরীক্ষাস্থল। এখানে এসে হাজীগণ আল্লাহর পথে আত্মত্যাগের শিক্ষা গ্রহণ করেন। মূলতঃ পূর্ণ হজ্ব ক্রিয়াটিই নবীগণের সম্পাদিত ক্রিয়া-কলাপের অনুষ্ঠান ও অনুকরণ ব্যতীত আর কিছুই নয়- এটাই ইবাদত বলে গণ্য। এখানে তিনি এক আযানেই মাগরিব ও এশার নামায একসাথে পর পর আদায় করেন। ইহাকে 'জয়ে তাখীর' বলে। হজ্বের দিন আরাফাহ্ ও মোযদালেফা ছাড়া অন্য কোন স্থানে দুই নামায একসাথে পড়ার বিধান নেই। ইহাই হানাফী মাযহাবের সিদ্ধান্ত
মোযদালিফায় রাত্রি যাপন করে ৭০টি করে কংকর সংগ্রহ করে ১০ তারিখ প্রত্যুষে ফজর নামায আদায় করে নবী করিম (দঃ) সাহাবায়ে কেরাম সমবিভ্যাহারে মিনার দিকে রওনা হন। এক লক্ষ ছাব্বিশ হাজার সাহাবায়ে কেরাম তাঁর সঙ্গী। তাঁদের কণ্ঠে ধ্বনীত হচ্ছে- লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক! হে আল্লাহ্! আমরা তোমার ডাকে হাযির! কি আবেগময় দৃশ্য! এভাবে কাফেলা মিনায় গিয়ে পৌঁছলো। এ সফরে নবী করিম (দঃ) উটের পিঠে তুলে নিলেন ফযল ইবনে আব্বাস (রাঃ) কে।
মিনায় পৌঁছেই তিনি জামরাতুল উলা বা বড় শয়তানকে ৭টি কঙ্কর মেরে তাঁবুতে ফিরে আসেন। হযরত ইসমাঈল (আঃ) কে যে জায়গায় কোরবানীর জন্য শোয়ানো হয়েছিল- সে স্থানটির নাম মাযাহ্। সেখানে নবী করিম (দঃ) সাহাবীগণকে নিজেদের কোরবানী করার নির্দেশ দেন। সাহাবীগণ কোরবানী কাজ সমাধা করে ইহরাম খুলে ফেলেন। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর কোরবানী অনুষ্ঠানের প্রতি তাঁরা শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন নিজেদের কোরবানী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। ঐ দিনেই তিনি সাহাবীগনসহ মক্কায় গমন করে তাওয়াফে যিয়ারত শেষ করে পুনঃ মিনায় এসে রাত্রি যাপন করেন। এটাই প্রকৃত সুন্নাত। ১১, ১২ ও ১৩ জ্বিলহজ্ব তিনদিন তিনটি জামারায় পাথর নিক্ষেপ করলেন- প্রতিটিতে পর পর ৭টি করে ২১টি। এভাবে ১ম দিনে ৭টি, দ্বিতীয় দিনে ২১টি, তৃতীয় দিনে ২১টি এবং চতুর্থ দিনে ২১ টি মোট ৭০টি পাথর নিক্ষেপ করলেন শয়তানের উদ্দেশ্যে। কেয়ামত পর্যন্ত এই পাথর নিক্ষেপ একটি ওয়াজিব ইবাদতে পরিণত হয়ে গেল। নবীগণের অনুকরণের নামই ইবাদাত। হাজীগনকে ১২ তারিখ পর্যন্ত ৩দিনে ৪৯টি কংকর মারতে হয়। ঐ দিন কোন কারণে সন্ধ্যার পূর্বে মিনা হতে বের হতে না পারলে ১৩ তারিখে আরো ২১ টি মারতে হবে।
মাযবাহে গিয়ে কোরবানীর কাজ শেষ করে মাথা হলক করে ইহরাম খুলে নবী করিম (দঃ) সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে ঐ দিনই ১০ই জিলহজ্ব তারিখে বাইতুল্লাহ যিয়ারত করতে গেলেন এবং তাওয়াফ যিয়ারত শেষে পুনরায় মিনায় ফিরে আসেন। এই তাওয়াফকে তাওয়াফে যিয়ারত বলা হয় এবং এটি হজ্বের শেষ ফরয। হজ্বের ফরয তিনটি। যথা (১) ইহরাম, (১) উকুফে আরাফাহ্, (৩) তাওয়াফে যিয়ারত। নবী করিম (দঃ) হজ্বের সম্পূর্ণ বিধান নিজের আমলের মাধ্যমে উম্মতের সামনে পেশ করেছেন। এজন্য হজ্ব এত মর্যাদাপূর্ণ।
মিনাতে অবস্থানকালেই সুরা নাসর অবতীর্ণ হয়। এতে নবী করিম (দঃ)-এর ইনতিকালের পূর্বাভাস বিদ্যমান। উক্ত সুরা নাযিলের পর মিনার খুতবায় নবী করিম (দঃ) এরশাদ করেন- “সম্ভবতঃ এ বৎসরের পর তোমাদের সাথে আর হজ্ব করতে পারবোনা"। এখানে পরিষ্কারভাবে নবীজীর ইলমে গায়েবের প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৩ই যিলহজ্ব তারিখে ২১টি পাথর নিক্ষেপ শেষে তিনি মক্কায় ফিরে আসেন।
নবী করিম (দঃ) হজ্বের এক পর্যায়ে 'হাজুন' নামক কবরস্থানে গমন করেন। এটি মক্কার সর্বসাধারনের কবরস্থান। এখানেই শায়িত আছেন ইসলামের প্রথম পূণ্যবতী মহিলা উম্মুল মোমেনীন হযরত খাদিজাতুল কোব্রা (রাঃ)। তিনি ধন-সম্পদ জীবন-মরণ সব কিছু বিলিয়ে দিয়ে নবী করিম (দঃ)-এর দ্বীনের খেদমত করেছেন। এমন আত্মত্যাগী নারী দ্বিতীয়জন আর নেই। যখন তিনি ইনতিকাল করেন, তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৫ বৎসর। তখন নবী করিম (দঃ)-এর বয়স হয়েছিল ৫০ বৎসর। তিন বৎসর নির্বাসন জীবন শেষ করে নবুয়তের দশম সালে সবেমাত্র মুক্ত আলোতে নিঃশ্বাস নিবেন এবং স্বামীর সুখ দুঃখের সঙ্গিনী হবেন- এমন সময়ই তিনি রমযান মাসে ইন্তিকাল করলেন। নবী করিম (দঃ)-এর চাচা আবু তালেবও এ সময়েই ইনতিকাল করেন। নবী করিম (দঃ) সেই বৎসরকে (নবুয়তের দশম সাল) শোকের বৎসর বলে আখ্যায়িত করেন। বিবি খাদিজা (রাঃ)-এর ইনতিকালের সময় পর্যন্ত জানাযা নামাযের হুকুম নাযিল হয়নি। তাই জানাযার নামাযও হয়নি। নবী করিম (দঃ) অন্যান্য দোয়া দরুদ পড়ে বিবি খাদিজা (রাঃ) কে কবরে সোপর্দ করেন।
এরপর নবী করিম (দঃ) তায়েফে গিয়ে অত্যাচারিত হলেন। সবশেষে হিজরত করতে বাধ্য হলেন। মদিনার জীবনে চাপিয়ে দেয়া ৭৪টি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেন। ৮ম হিজরীতে মক্কাভূমি পুরুদ্ধার হলো। এভাবে ১৩টি বৎসর পার হয়ে গেলো। এক লক্ষ ছাব্বিশ হাজার সাহাবী নিয়ে এখন (১০ম হিজরী) তিনি হজ্বে আগত। তাঁর অঙ্গুলী হেলনে এখন মক্কা মোয়াযযমা পরিচালিত। কিন্তু সব থাকা সত্ত্বেও যেন অনেক কিছুই নেই। পিতা ইনতিকাল করলেন মাতৃগর্ভে থাকতে। মাতা ইনতিকাল করলেন ছয় বছরের শিশুকালে। দাফন হলেন মদিনা থেকে মক্কায় আসার পথে আবৃত্তয়া নামক স্থানে। পিতার কবর মদিনাতে। মাতার কবরও মক্কা-মদিনার মাঝপথে। বিবি খাদিজা শুয়ে আছেন হাজুন গোরস্থানে। একথা স্মরণ করে হুযুরের হৃদয় হাহাকার করে উঠলো।
নবী করিম (দঃ)-এর বর্তমান বিজয়ীবেশ এবং ভক্ত অনুরক্তের এই বিশাল সমাবেশ তাঁরা কেউ দেখে যেতে পারলেন না। সব কিছু পেয়েও যেন তিনি অনেক কিছুই হারিয়েছেন। একে একে সব স্মৃতি নবী করিম (দঃ)-এর স্মৃতিপটে ভেসে উঠতে লাগলো। তিনি চলে গেলেন প্রিয় সহধর্মিনী বিবি খাদিজার মাযার যিয়ারতে-হাজুন নামক গোরস্থানে। তাঁর মন আজ ভারাক্রান্ত।
এমন সময় তিনি দেখতে পেলেন তাঁর পিতা-মাতা হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) ও বিবি আমেনা (রাঃ) জীবিত হয়ে তাঁর সামনে উপস্থিত। এবার আল্লাহতায়ালা নবীর সম্মানে তাঁর পিতা-মাতাকে জীবিত করে তাঁর সামনে উপস্থিত করে দিলেন। তাঁরা উভয়েই কলেমা শরীফ পাঠ করে মুসলমান সাহাবী হলেন এবং আল্লাহর নির্দেশে পুনরায় মৃত্যুবরণ করলেন। যদিও তাঁরা পূর্ব হতেই মিল্লাতে ইবরাহীমীর উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন এবং মোমিন হানিফ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন-তবুও নবীজীর সম্মানে আল্লাহ তায়ালা তাঁদেরকে পুনঃজীবিত করে মুসলমান ও সাহাবী হবার সুযোগ করে দিলেন। এখন থেকে তারা সরাসরি মুসলমান ও সাহাবী নামে অভিহিত। হযরত ঈছা আলাইহিস সালাম মৃতকে জীবিত করতেন। এটা নবীদের মো'জেযা। নবী করিম (দঃ)-এর হাতেও অনেক মৃত ব্যক্তি জীবন লাভ করেছে। যেমনঃ তাঁর পিতা-মাতা, জাবেরের দুই পুত্র। এক মুহাজির মহিলার একমাত্র মৃতপুত্র গোসল ও কাফনের পর নবীজীর দোয়ায় পুনঃজীবন লাভ করেছেন। মহিলার এই পুত্র পরে বিবাহ শাদী করেছেন এবং
হযরত ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন। (প্রমাণপঞ্জী: ফতোয়ায়ে শামী, হাফেয নাসিরুদ্দীন বাগদাদী, হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) বর্ণিত হাদীস, তাফসীরে রুহুল বয়ান, তাফসীরে নাঈমী, শানে হাবীব, আল আশবাহ ওয়ান নাযায়ের, আল্লামা সোহায়লী প্রভৃতি)।
নবী করিম (দঃ) হাজুনে গিয়েছিলেন কাঁদতে কাঁদতে, কিন্তু প্রত্যাবর্তন করলেন হাসতে হাসতে। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) বর্ণনা করেনঃ “নবী করিম
(দঃ) আমাকে উটের লাগাম ধরে দাঁড়াতে বলে হাজুনে তশরীফ নিয়ে গেলেন কাঁদতে কাঁদতে। আমিও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পর নবী করিম (দঃ) হাসতে হাসতে প্রত্যাবর্তন করলেন। আমি এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি পিতা-মাতার জীবিত হয়ে আগমন এবং নূতন করে ইসলাম, গ্রহণ ইত্যাদি' ঘটনা খুলে বললেন” (বেদায়া ও নেহায়া ৬ষ্ঠ খন্ড, তাফসীরে রুহুল বয়ান ১ম খন্ড ২১৬ পৃষ্ঠা)।
তখন থেকে নবী করিম (দঃ) 'হাজুন' কবরস্থানের নাম রাখলেন জান্নাতুল মায়াল্লা এবং মদিনা শরীফের 'বাক্বীউল গারকাদ' কবরস্থানের নাম রাখলেন জান্নাতুল বাক্বী। হুযুরের রওযা মোবারক ও মিম্বার শরীফের মধ্যবর্তী স্থানের নাম রাখলেন "রিয়াযুল জান্নাত"। দুনিয়ার এই তিনটি জান্নাত পরকালের ৮টি জান্নাতের সাথে যোগ হবে বলেও কোন কোন বর্ণনায় এসেছে (মাওয়াহিব, শানে হাবীব)। নবীজীর রওযা মোবারক হচ্ছে আরশে মোয়াল্লার চেয়েও উত্তম।
নবী করিম (দঃ)-এর পিতা-মাতার পুনঃজীবন লাভের রেওয়ায়াত সম্পর্কে বিখ্যাত মোহাদ্দেছ হাফেয সামছুদ্দিন দামেস্কী একটি আরবী কবিতায় মন্তব্য করেছেন
حَبًّا اللَّهُ النَّبِيُّ مَزِيدُ فَضْلِ عَلَى فَضْلٍ وَكَانَ بِهِ رُوفًا -فَأَحْيَا لَهُ أُمَّهُ وَكَذَا آبَاهُ + لا يمَانٍ بِهِ فَضْلًا لَطِيفًا. فَسَلَّمَ فَالْقَدِيمُ بِهِ قَادْرًا وَإِن كَانَ الْحَدِيث بِهِ ضَعِيفًا . ( روح البيان )
মর্মার্থঃ "আল্লাহ তায়ালা আপন হাবীবের প্রতি অতি মেহেরবান ও স্নেহময়। তিনি আপন হাবীবকে মর্যাদার উপর আরো মর্যাদা দান করেছেন। তিনি আপন হাবীবের প্রতি স্নেহপরবশ হয়ে তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে তাঁর পিতা-মাতাকে পুনঃজীবিত করেছেন। হে শ্রোতা! তুমি নতশীরে হাদীসখানা মেনে নাও। হাদীস শাস্ত্রের কঠোর নীতিমালা অনুযায়ী অত্র হাদীসের সনদ যদিও কিছুটা দুর্বল, কিন্তু মৌলিক হাদীসখানা (মতন) দুর্বল নয়। আর তাঁর পিতা-মাতাকে জীবিত করা আল্লাহর শক্তির বাইরেও নয়"। (রহুল বয়ান সূত্রে)
এখনে আল্লামা দামেস্কী হাদীস বর্ণনাকারীর কারণে রেওয়াতটিকে তৃতীয় পর্যায়ের অর্থাৎ দুর্বল' পর্যায়ের বলে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু হাদীসশাস্ত্রে একটি সূত্র আছে- "যদি একটি দুর্বল রেওয়ায়াত বিভিন্ন সূত্রে গৃহীত ও বর্ণিত হয়, তাহলে তা আর দুর্বল থাকে না- বরং শক্তিশালী হয়ে হাসান পর্যায়ে উন্নীত হয়ে যায়"। হাদীস বিশারদ আলেম মাত্রই এই সূত্রটি জানেন।
নবী করিম (দঃ)-এর পিতা-মাতার ইসলাম গ্রহণ ও পুনঃজীবন লাভ-এর বর্ণনাটি মূলে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত এবং পরবর্তী যুগে এসে বিভিন্ন সূত্রে বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য কিতাবে হাদীসের ইমামগণ তা বর্ণনা করেছেন, যা আমি কিছু পূর্বেই যথাস্থানে উল্লেখ করেছি। সুতরাং- যারা নবী করিম (দঃ)-এর পিতা-মাতাকে কুফরী অবস্থায় মারা গিয়েছেন বলে দাবী করে, তাঁরা ভ্রান্ত ধারণায় নিঃপতিত। এরা রাসুল বিরোধী দল।
ওহাবী গোমরাহ্ আলেমগণ তাদের দলীল হিসাবে বলেন- ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) নাকি তার ফিহে আকবর কিতাবে লিখেছেন-
إِنْ أَبَوَى النَّبِيِّ مَاتَا عَلَى الْكُفْرِ
অর্থ-"নবী করিম (দঃ)-এর পিতা-মাতা কুফরী অবস্থায় ইনতিকাল করেছেন"।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ফিহে আকবর-এর পুরাতন পান্ডুলিপিতে এবারত ছিল এরূপঃ
إِنَّ ابوي النَّبِيِّ مَا مَاتَا عَلَى الكُفْرِ .
অর্থ-"নবী করিম (দঃ)-এর পিতা-মাতা কুফরী অবস্থায় ইনতিকাল করেননি"।
পরবর্তীকালে পাণ্ডলিপি নকল করতে গিয়ে (مَا) "না" বোধক প্রথম অক্ষরটি বাদ পড়ে যায়-যার কারণে "না" বোধক বাক্যটি "হ্যাঁ" বোধক বাক্যে পরিণত হয়ে যায়। আর এতেই এক (মা' খসে পড়ার কারণে সব ভুলের জন্ম হয়। আল্লাহ আমাদেরকে সত্য উৎঘাটনের তৌফিক দিন। (সূত্র: আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ুতি কৃত- مَدَايَةُ الْغَبِي فِي إِسْلَامِ أَبُوي النبي)
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০৭২) ইসলামের প্রথম হজ্জ | (০৭৪) মদিনায় প্রত্যাবর্তন |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |