হযরত আদম ও হাওয়া (عليه السلام) তাঁদের এক সন্তানের নাম আবদুল হারিছ রেখেছিলেন। অথছ হারিছ হচ্ছে শয়তানের নাম। এ প্রসঙ্গে কুরআন করীম ইরশাদ ফরমান:
فَلَمَّا آتَاهُمَا صَالِحًا جَعَلَا لَهُ شُرَكَاءَ
-‘‘যখন তিনি তাদেরকে এক নেক বান্দা দান করেন, তারা একে আল্লাহর শরীক বানিয়েছে।’’
¶ সূরা আ’রাফ, আয়াত নং-১৯০।
এতে বোঝা গেল যে আদম (عليه السلام) এর এ কাজ শিরক ছিল। তাই প্রমাণিত হলো যে নবীগণ শিরকও করে থাকেন। হাকিমের বর্ণনা মতে এ আয়াতে আদম-হাওয়াকে বোঝানো হয়েছে।
এ ধরনের কলঙ্ক থেকে হযরত (عليه السلام) একেবারে পূত-পবিত্র। আপত্তিকাররী এ আয়াত দ্বারা ধোঁকা দিতে চেয়েছে। তাফসীর কারকদের মধ্যে অনেকেই উপরোক্ত আয়াতে جَعَلَا ক্রিয়া পদের কর্তা কুসাই ও তার স্ত্রী বলে মত প্রকাশ করেছেন। কেননা -
خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَجَعَلَ مِنْهَا زَوْجَهَا
আয়াতের অর্থ হচ্ছে: ওহে কুরাইশ, আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে একটি আত্মা অর্থাৎ কুসাই থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং সেই কুসাইর স্ত্রীকে তার স্বজাতি থেকে সৃষ্টি করেছেন। ওর স্ত্রী আল্লাহর কাছে পুত্র প্রার্থনা করায় সে রাগ করে এর নাম আবদুল হারিছ রেখেছিল।
(তফসীরে খাযায়েনুল ইরফান ইত্যাদি দেখুন)
¶ সূরা আ’রাফ, আয়াত নং-১৮৯।
এ ধরণের অর্থে কোন আপত্তি নেই। আবার অনেকেই বলেছেন যে, جَعَلَا ক্রিয়ার মধ্যে مضاف (সম্বন্ধপদ) উহ্য রয়েছে এবং এর কর্তা হচ্ছে আদম-হাওয়ার সন্তান সন্ততি অর্থাৎ আদম ও হাওয়ার কতেক সন্তান র্শিক কাজ শুরু করে দিয়েছিল। (রুহুল বয়ান, মদারেক ইত্যাদি তাফসীর দেখুন) এ কারণেই এর আগে বহুবচন ব্যবহৃত হয়েছে
فَتَعَالَى اللَّهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ
¶ সূরা আ’রাফ, আয়াত নং-১৯০।
যদি এ ক্রিয়া পদের কর্তা আদম ও হাওয়া হতেন, তাহলে يُشْرِكُونَ অর্থাৎ দু’বচনের শব্দ প্রয়োগ করতেন, অধিকন্তু যেখানে একটি মামুলি ভুলের অর্থাৎ গুনদুম খাওয়ায় অসন্তোষের কারণ হয়ে গিয়েছিল, সেখানে র্শিক করার কারণে কঠিন শাস্তি হওয়ার কথা অথচ কোন কিছু হলো না। হাকিমের এ বর্ণনাটা আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা তাঁর দলীলটা হচ্ছে একক রেওয়ায়েত। পক্ষান্তরে নবীগণ নিস্পাপ হওয়াটা হলো সুনিশ্চিত ও চূড়ান্ত অভিমত।
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ ফরমান-
وَعَصَى آدَمُ رَبَّهُ فَغَوَى
আদম (عليه السلام) আল্লাহর নাফরমানী করলো, ফলে ভ্রমে পতিত হলো।’’
¶ সূরা ত্বোহা, আয়াত নং-১২১।
এর থেকে আদম (عليه السلام) এর গুনাহ ও গুমরাহী উভয়টা বোঝা গেল।
এখানে অপ্রকৃত অর্থে ভুলকে পাপ বলা হয়েছে এবং غَوي শব্দের অর্থ গুমরাহী নং বরং বিফল হওয়া অর্থাৎ চিরজীবন লাভের জন্য তিনি গুনদুম খেয়েছিলেন, কিন্তু তা হয়নি বরং গুনদুমের দ্বারা উপকারের পরিবর্তে অপকার হলো অর্থাৎ স্বীয় উদ্দেশ্য সাধন হলো না। এ আয়াত প্রসঙ্গে তফসীরে রূহুল বয়ানে উল্লেখিত আছে যে, যখন আল্লাহ তাআলা তাঁদের ভুলে যাওয়ার কথাটাই বার বার উল্লেখ করেছেন, তখন উক্ত আয়াতের عَصَى শব্দ থেকে গুনাহ প্রমাণ করা মানে খোদার কালামে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা।
হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) চাঁদ সূর্য এমন কি তারকারাজিকে খোদা বলেছেন। যেমন তিনি
قَالَ هَذَا رَبِّي -‘‘এটা আমার খোদা।’’
¶ সূরা আনআম, আয়াত, নং- ৭৭
এ রকম বলাটা সুস্পষ্ট র্শিক। তাই প্রতীয়মান হলো যে তিনি প্রথমে র্শিক করেছিলেন। পরে তওবা করেছেন।
এর উত্তর ভূমিকাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) স্বীয় কওমকে প্রশ্নাকারে জিজ্ঞাসা করেছিলেন এটা কি আমার খোদা? অতঃপর নিজেই দলীল সহকারে এর জবাব দিয়েছেন-
قَالَ لَا أُحِبُّ الْآفِلِينَ
-‘‘অস্তগামী বস্তু সমূহকে আমি পছন্দ করি না।’’
¶ সূরা আনআম, আয়াত, নং- ৭৬
কেননা এর আগে ইরশাদ করা হয়েছে-
وَكَذَلِكَ نُرِي إِبْرَاهِيمَ مَلَكُوتَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَلِيَكُونَ مِنَ الْمُوقِنِينَ
-‘‘এভাবে হযরত ইব্রাহীমকে সৌরজগত ও বিশ্বজগত পরিচালনা ব্যবস্থা দেখিয়েছি, যাতে তিনি বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হন।’’
¶ সূরা আন’আম, আয়াত নং-৭৫।
অতঃপর চাঁদ দেখার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে এবং এর পর বলেছেন:
وَتِلْكَ حُجَّتُنَا آتَيْنَاهَا إِبْرَاهِيمَ عَلَى قَوْمِهِ
-‘‘আমার এ সব যুক্তি প্রমাণ হযরত ইব্রাহীমকে তাঁর কওমের মুকাবেলায় দিয়েছিলাম।’’
¶ সূরা আন’আম, আয়াত নং-৮৩।
এ সাজানো কথামালা থেকে জানা গেলে হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) ভূমণ্ডলের পরিচালন অবলোকন করে মন্তব্য করলেন। অতঃপর তারকারাজির গতিবিধি দেখে নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা এর প্রশংসা করলেন। যদি তাঁর এ সব বক্তব্য র্শিক হতো, তাহলে প্রশংসা করা হলো কেন? বরং অসন্তুষ্ট হওয়ারই কথা ছিল।
হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) তিনবার মিথ্যা বলেছেন:
إِنِّي سَقِيمٌ
-‘‘আমি অসুস্থ।’’
¶ সূরা সাফ্ফাত, আয়াত নং-৮৯।
بَلْ فَعَلَهُ كَبِيرُهُمْ هَذَا
-‘‘সেই বড় মূর্তিটা এ কাজ করেছে।’’
¶ সূরা আম্বিয়া, আয়াত নং-৬৩।
এর কয়েকটি উত্তর রয়েছে।
যে সব অবস্থায় তিনি এ রকম কথা বলেছিলেন, তখন হয়তো জীবনের ঝুঁকি ছিল অথবা মান-সম্মানের প্রশ্ন ছিল। তখনই বোন বলেছিলেন, যখন সেই জালিম বাদশাহ তাঁর কাছ থেকে হযরত সারা (رضي الله عنه) কে জোর জবরদস্তি ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল এবং অন্যান্য সময়ও জীবনের ঝুঁকি ছিল। যেমন বলেছিলেন بَلْ فَعَلَهُ كَبِيرُهُمْ সুতরাং এ ধরনের বলাতে গুনাহ হতে পারে না।
এখানে ভাই ও গাভী শব্দদ্বয় রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এ রকম إِنِّي سَقِيمٌ (সূরা যুমার, আয়াত নং-৩০) এর দ্বারা তাঁর ভবিষ্যত রোগাক্রান্ত হওয়ার কথা বোঝানো হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে
إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُمْ مَيِّتُونَ বা سَقِيمٌ শব্দ দ্বারা মানসিক রোগের কথা বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ আমার মন তোমাদের দ্বারা সন্তুষ্ট নয়। অনুরূপ بَلْ فَعَلَهُ كَبِيرُهُمْ বাক্যে كَبِيرُ শব্দ দ্বারা আল্লাহ তাআলাকে বোঝানো হয়েছে এবং এর দ্বারা ওই দিকে ইশারা করা হয়েছে। কেননা কাফিরগণ আল্লাহ তা’আলাকে বড় খোদা এবং মূর্তিদেরকে ছোট খোদা মনে করে। তাই তিনি বলেছেন- এ কাজ সেই করেছেন, যাকে তোমরা বড় খোদা মনে কর। নবীর কাজকে খোদার কাজ বলা যায়। অথচ ওরা মনে করেছেন তিনি তাদের বড় মূর্তির কথা বলেছেন। অথবা তিনি শব্দটা সন্দেহ বোধক ভাবে বলেছেন অর্থাৎ বড় দেবতা হয়তো ভেঙ্গেছে। সন্দেহ বোধক শব্দ থেকে সত্য মিথ্যা বলার অবকাশ নেই। সব চেয়ে বড় কথা হচ্ছে আল্লাহ তাআলা এ সব ঘটনা বর্ণনা করার পর হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) এর প্রতি কোনরূপ অসন্তোষ প্রকাশ করেননি, বরং এসব তাঁর মনঃপুত হওয়ার সনদ দিয়েছেন।
যেমন মূর্তি ভাঙ্গার বর্ণনার আগে ইরশাদ ফরমান
وَلَقَدْ آتَيْنَا إِبْرَاهِيمَ رُشْدَهُ مِنْ قَبْلُ وَكُنَّا بِهِ عَالِمِينَ
সূরা আম্বিয়া, আয়াত নং-৫১
এতে বোঝা গেল তাঁর এ কাজ সঠিক এবং পথপ্রদর্শক মূলক ছিল অথচ মিথ্যা কখনও সঠিক পথ হতে পারে না।
অসুখের কথা বর্ণনা করার সময় ইরশাদ করেছেন
إِذْ جَاءَ رَبَّهُ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ (৮৪) إِذْ قَالَ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِ مَاذَا تَعْبُدُونَ
সূরা সাফ্ফাত, আয়াত নং-৮৪-৮৫।
এর দ্বারা বোঝা গেল যে তাঁর এ ধরনের কথা সঠিক মানসিকতার পরিচায়ক কিন্তু মিথ্যা কখনও তা হতে পারে না।
হযরত দাউদ (رضي الله عنه) পরস্ত্রী অর্থাৎ উরিয়ার স্ত্রীকে কু-নযরে দেখেছিলেন, যার বর্ণনা সূরা ছোয়াদে রয়েছে। এ ধরনের আচরণ নিশ্চই অপরাধ।
ঐতিহাসিকগণ দাউদ (عليه السلام) এর কাহিনীর মধ্যে অনেক কিছু পরিবর্ধন করেছেন। তা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। এমন কি হাদীছ আহাদের মধ্যে যা বর্ণিত আছে, তাও অগ্রাহ্য। এ জন্য হযরত আলী (رضي الله عنه) ঘোষণা করেছিলেন-যে কেউ দাউদ (عليه السلام) এর কাহিনী গল্প গুজবের মত বর্ণনা করবে, আমি তাকে ১৬০ দোর্রা বেত্রাঘাত করবো। অর্থাৎ অপবাদের শাস্তি হচ্ছে ৮০ দোর্রা, কিন্তু এ ক্ষেত্রে দ্বিগুণ হবে। (তাফসীরে রূহুল বয়ানে সূরা ছোয়াদে দাউদ (عليه السلام) এর কাহিনী দ্রষ্টব্য)
আসল ঘটনা হচ্ছে উরিয়া নামক জনৈক ব্যক্তি একটি মহিলাকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছিল। হযরত দাউদ (عليه السلام)ও সেই প্রস্তাবের উপর প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং মহিলাটি দাউদ (عليه السلام) এর সাথেই বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন। ওই লোকটির সাথে কোন বিবাহ হয়নি।
যেমন- তাফসীরাতে আহমদীয়াতে- لَا يَنَالُ عَهْدِي الظَّالِمِينَ আয়াতের ব্যাখ্যায় বর্ণিত আছে-
وعن داود بكونه اقداما على الفعل المشروع وهو نكاح المخطوبة لاوريا لانظره منكوحته
কিন্তু যেহেতু এ বৈধ কাজ থেকেও নবুয়াতের শান অনেক উর্ধ্বে ও মহৎ, এ জন্যে আল্লাহ তা’আলা তাঁর মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য করে একটি সাজানো মুকদ্দমা নিয়ে দু’জন ফিরিশ্তাকে তাঁর সমীপে পাঠিয়েছেন। মুকদ্দমাটি হচ্ছে তাদের মধ্যে একজনের কাছে ৯৯টি বকরী এবং অপর জনের কাছে একটি মাত্র বকরী আছে। কিন্তু ৯৯ টি বকরীর মালিক ঐ একটিও নিয়ে নিতে চায় এবং তাঁরা নিজেরাই বাদী বিবাদীর অভিনয় করে তাঁর থেকে বায় নিয়ে তাঁকে ইশারা ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন। সুবহান্নাল্লাহ, আল্লাহর কি শান! তার দরবারে কত সম্মান যে কী সুন্দরভাবে ওদেরকে ঘটনাটা বুঝিয়ে দিয়েছেন। (উল্লেখ্য যে এর আগে দাউদ (عليه السلام) এর আরও ৯৯ জন স্ত্রী ছিলেন) উক্ত ঘটনার দ্বারা তার শানই প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু এ বদনসব ধর্মদ্রোহীরা তাঁর বিরুদ্ধে অপবাদ রটিয়েছে। আল্লাহ পানাহ দিন।