আপত্তি সমূহের বিস্তারিত জবাবের আগে ভূমিকা স্বরূপ মোটামুটি একটি জবাব নবীগণ নিষ্পাপ হওয়াটা নিশ্চিত ও সর্বসম্মত বিষয়। যেসব হাদীছ দ্বারা নবীগণের গুনাহ প্রমাণ করা হয়, যদি সে সব হাদীছ মুতওয়াতির ও সুস্পষ্ট না হয়, বরং হাদীচে মশহুর বা হাদীছে আহাদ হয়ে থাকে, কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হবে না, যদিওবা তা বিশুদ্ধ হয়ে থাকে।
তাফসীরে কবীরে সূরা ইউসুফের তাফসীর প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে- যে সব হাদীছ আম্বিয়া কিরামের বিপক্ষে, সে সব গ্রহণীয় নয়। নবীকে গুনাহগার সাব্যস্ত করার চেয়ে বর্ণনাকারীকে ভ্রান্ত বলাটা অনেক সহজ। এবং সে সব কুরআনী আয়াত ও হাদীছে মুতওয়াতির, যে গুলোর দ্বারা নবীগণের মিথ্যা বলা বা অন্য কোন গুনাহ প্রমাণিত হয়, সে সব হাদীছ বা আয়াতের অবশ্যই তাবিল (ব্যাখ্যা) করতে হবে; সে সবের বাহ্যিক অর্থ কখনও হতে পারে না বা এ সব ঘটনা নবুয়াতের আগের বলে ধরে নিতে হবে।
তাফসীরাতে আগমদীয়ায় لَا يَنَالُ عَهْدِي الظَّالِمِينَ (সূরা বাক্বারা, আয়াত নং-১২৪) আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে উল্লেখিত আছে -
واذا تقرر هذا فما نقل عن الانبياء مما يشعر بكذب او معصية فما كان منقولا بطريق الاحاد فمردود و ما كان منقول بطريق التواتر فمصروف عن ظاهره ان امكان و الا فمحمول على ترك الاولى او كونه قبل البعثت
-‘‘এ ইবারতের অর্থ তাই, যা উপরে বর্ণিত হয়েছে) ‘মুদারেজুন নাবুয়াত’ কিতাবের প্রথম খণ্ডের চতুর্থ অধ্যায়ে উল্লেখিত আছে-এ ধরনের আয়াত মুতশাবিহাত আয়াতের মত, তাই এ সব ক্ষেত্রে নীরব থাকা বাঞ্ছনয়ি। দেখুন, আল্লাহ তা’আলা কুদ্দুস, গণী, আলীম, কাদিরে মতলক ইত্যাদি পরিপূর্ণ গুণে গুণান্বিত হওয়া সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও সর্বসম্মত অভিমত রয়েছে, কিন্তু কতেক আয়াতের বাহ্যিক অর্থ এর বিপরীত প্রতিভাত হয়।
¶ আল্লামা মোল্লা জিওন, তাফসিরে আহমদিয়া, পৃষ্ঠা-৩৩।
যেমন- আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ ফরমান-
يُخَادِعُونَ اللَّهَ وَهُوَ خَادِعُهُمْ
-‘‘ওরা আল্লাহকে ধোঁকা দেয় এবং আল্লাহ তাদেরকে।’’
¶ সূরা নিসা, আয়াত নং-১৪২।
অন্যত্র ইরশাদ ফরমান-
مَكَرُوا مَكْرَهُمْ
-‘‘তারা ফন্দি করেছিল এবং আল্লাহও ফন্দি করেছেন।’’
¶ সূরা ইবরাহিম, আয়াত নং-৪৬।
আর এক জায়গার ইরশাদ ফরমান-
فَأَيْنَمَا تُوَلُّوا فَثَمَّ وَجْهُ اللَّهِ
-‘‘তোমরা যে দিকে মুখ কর, সে দিকেই আল্লাহর মুখ আছে।’’
¶ সূূরা বাক্বারা, আয়াত নং-১১৫।
আরও ইরশাদ ফরমান-
يَدُ اللَّهِ فَوْقَ أَيْدِيهِمْ
-‘‘তোমাদের হাতের উপর আল্লাহর হাত।’’
¶ সূরা ফাতহ, আয়াত নং-১০।
ইরশাদ ফরমান-
ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ
-‘‘অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন।’’
¶ সূরা রা’দ, আয়াত নং-২।
আল্লাহ তা’আলা হাত, মুখ, ধোকা, ফন্দি ইত্যাদি থেকে পাক-পবিত্র, কিন্তু উপরোক্ত আয়াতে বাহ্যতঃ সে সব প্রমাণিত হয়। সুতরাং সে সব আয়াতের তাবিল অবশ্য কর্তব্য। এর আসল অর্থ আল্লাহর উপর ছেড়ে দেয়া চাই। এসব আয়াত দ্বারা যদি কেউ আল্লাহকে কলঙ্কিত মনে করে, সে বেঈমান। অনুরূপ যদি কেউ কতেক আয়াতের বাহ্যিক অর্থ করে আম্বিয়া কিরামকে ফাসিক বা মুশরিক মনে করে, সে ধর্মদ্রোহী। এ একটি উত্তরই ইন্শাআল্লাহ সমস্ত আপত্তির গোড়া কেটে দেবে। তবুও আমি আরও কিছু বিস্তারিতভাবে আপত্তি সমূহের উত্তর দিচ্ছি।
ইবলিস হযরত আদমকে সিজ্দা না করে খোদার নাফরমানী করেছে। হযরত আদম (عليه السلام)ও গুনদুম খেয়ে একই অপরাধ করেছেন। উভয়কে একই রকম শাস্তিও দেয়া হয়েছে, ইবলিসকে ফিরিশতাদের জামাত ও বেহেশ্ত থেকে বহিঙ্কার করা হয়েছে এবং আদম (عليه السلام) কেও দুনিয়াতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। অবশ্য আদম (عليه السلام) পরে তওবা করে ক্ষমা পেয়েছেন, কিন্তু ইবলিস তওবা করেনি। তাই বোঝা গেল যে আদম (عليه السلام) নিষ্পাপ ছিলেন না।
শয়তান আদমকে সিজ্দা না করে গুনাহগারও হয়েছিল এবং শাস্তিও পেয়েছে। কিন্তু হযরত আদমের গুনদুম খাওয়ার মধ্যে কোন অপরাধ ছিল না এবং তাঁকে কোন শাস্তিও দেয়া হয়নি। কেননা শয়তান সুস্পষ্টভাবে সিজ্দা করতে অস্বীকার করেছে, বরং খোদার নির্দেশকে ভুল মনে করে খোদার সাথে তর্ক করার দুঃসাহস দেখিয়েছে-
خَلَقْتَنِي مِنْ نَارٍ وَخَلَقْتَهُ مِنْ طِينٍ
-‘‘তুমি আমাকে আগুন দ্বারা সৃষ্টি করছে আর ওকে সৃষ্টি করেছে মাটি দ্বারা।’’
¶ সূূূূরা ছোয়াদ, আয়াত নং-৭৬।
শাস্তিস্বরূপ আল্লাহর তরফ থেকে ইরশাদ হলো-
قَالَ فَاخْرُجْ مِنْهَا فَإِنَّكَ رَجِيمٌ (৭৭) وَإِنَّ عَلَيْكَ لَعْنَتِي إِلَى يَوْمِ الدِّينِ
-‘‘তুমি এখান থেকে বের হয়ে যাও, কারণ তুমি অভিশপ্ত, এবং কিয়ামত পর্যন্ত তোমার প্রতি লানত রইল।’’
¶ সূরা ছোয়াদ, আয়াত নং-৭৭-৭৮।
দুনিয়াটা শয়তানের জন্য ‘কালা পানি’ পাঠিয়ে দেয়ার মত শাস্তি। সে কিয়ামত পর্যন্ত এখানে লাঞ্চনা, গঞ্জনা, ও ‘লা হওলা’ এর বেত্রাঘাত ভোগ করবে। অথচ আদম (عليه السلام) সম্পর্কে কুরআন করীম বার বার ঘোষণা করেছেন- ‘তিনি ভুলে গিয়েছিলেন’ ‘গুনাহের কোন ধারণাও করেননি’ ইত্যাদি।
যেমন কুরআন করীম ইরশাদ ফরমান-
فَنَسِيَ وَلَمْ نَجِدْ لَهُ عَزْمًا
-‘‘তিনি ভুলে গিয়েছিলেন, আমি তাঁকে অটল পাইনি।’’
¶ সূরা ত্বোহা, আয়াত নং-১১৫।
অন্যত্র ফরমান-
فَأَزَلَّهُمَا الشَّيْطَانُ
-‘‘অতঃপর শয়তান তাঁদেরকে ধোঁকা দিয়েছে।’’ ৫৭৯
¶ সূূরা বাক্বারা, আয়াত নং-৩৬।
আর এক জায়গায় ইরশাদ করা হয়েছে-
فَوَسْوَسَ لَهُمَا الشَّيْطَانُ
-‘‘শয়তান তাঁদেরকে কুমন্ত্রণা দিয়েছে।’’ ৫৮০
¶ সূরা আ’রাফ, আয়াত নং-২০।
মোট কথা হলো এ ঘটনার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী শয়তানকে করা হয়েছে। আর তাঁদের বেলায় বলা হয়েছে ধোঁকা খেয়েছেনম ভুল করেছেন। ধোঁকাটা হচ্ছে- আল্লাহ তা’আলা তাঁদেরকে বলেছিলেন-ওই বৃক্ষের কাছে যেও না’। শয়তান তাঁদেরকে ধোঁকা দেয়ার মানসে বলেছিল আপনাদেরকেতো ওদিকে যেতে নিষেধ করেছে, কিন্তু ফল খেতেতো আর বারণ করেনি। ঠিক আছে, আমি এনে দিচ্ছি, আপনারা খেয়ে নিন।’ মিথ্যা কসম খেয়ে আরও বললো এ ফল খুবই উপকারী এবং আমি একজন আপনার একান্ত শুভাকাঙ্খী। হযরত আদম (عليه السلام) মনে করেছিলেন যে খোদার নামে কেউ মিথ্যা কসম খেতে পারে না বা উপরোক্ত لاتقربا কে হালকা নিষেধাজ্ঞা সূচক নির্দেশ মনে করেছেন। এর বিস্তারিত বিশ্লেষণ আমার তফ্সীরে নঈমীর প্রথম পারায় উক্ত আয়াতের তফসীর দেখুন। এ পর্যন্ত যা বললাম, তাতে উভয়ের কার্যক্রমের পার্থক্যটা প্রতিভাত হলো। এবার আলোকপাত করতে হয় দুনিয়াতে অবতরণের রহস্য নিয়ে। আল্লাহ তা’আলা তাঁকে পৃথিবীতে খিলাফতের জন্য সৃষ্টি করেছিলেন।
যেমন কুরআন করীম ইরশাদ ফরমান -
إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً
বেহেশতের মধ্যে তাঁকে কিছু দিনের জন্য রাখা হয়েছিল;
¶ সূরা বাক্বারা, আয়াত নং-৩০।
এ জন্য যে তিনি যেন তথাকার ঘরবাড়ী, বাগবাগিচা ইত্যাদি দেখে অনুরূপ যাতে পৃথিবীতে আবাদ করতে পারেন। তাই বেহেশ্তটা তাঁর জন্য ছিল ট্রেনিং সেন্টারের মত, যেথায় কোন শিক্ষানবীশকে সব সময়ের জন্য রাখা হয় না। আর তাঁকে কাঁদায়ে পাঠানো হয়েছিল এ জন্য যে ফিরিশ্তাগণ এ কান্না ছাড়া বাকী সব রকমের ইবাদত করেছেন। এ ক্রন্দনের বদৌলতেই মানুষ ফিরিশ্তা থেকে আফযল হলো। আসলে খোদার প্রেমে বান্দাকে কাঁদানোই উদ্দেশ্য ছিল; বেহেশ্তটা ছিল একটা উপলক্ষ মাত্র। অনেক সময় আল্লাহর প্রিয়জনদের ভুল নেক বান্দাদের জন্য কল্যাণ কর হয়ে থাকে।
درد دل كے واسطے پيدا كيا انسان كو
ورنه طاعت كے لئے كچه كم نه تهے كرو بياں
اے خيال يار كيا كر ناتها او ركيا كرديا
تو توپرده ميں رها اور مجه كور سوا كرديا
-‘‘ব্যথিত হৃদয়ের জন্যই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে, নতুবা খোদার বন্দেগীর জন্য মখলুকের অভাব নেই। ওগো, কি করার ছিল আর তুমি কি করে দিয়েছ? তুমিতো পর্দার অন্তরালে রয়েছ; আর এদিকে আমাকে নাজেহাল করেছ।’’
এ ভেদ তিনিই বুঝবেন যিনি প্রেমানন্দ সম্পর্কে অবগত।
দেখুন, আল্লাহ তা’আলা শয়তানকে বলেছেন-
قَالَ اخْرُجْ مِنْهَا
এখান থেকে বের হয়ে যাও।’’
¶ সূরা আ‘রাফ, আয়াত নং-১৮।
আর আদম (عليه السلام) এর বেলায় বলা হয়েছে-
اهْبِطُوا مِنْهَا جَمِيعًا
তোমরা সকলে এখান থেকে অবতরণ কর।’’
¶ সূরা বাক্বারা, আয়াত নং-৩৮।
এরপর বলা হয়েছে- তোমরা মাত্র কিছু দিনের জন্য পৃথিবীতে অবতরণ করছ, পুনরায় তোমাদের কোটি কোটি সন্তান সহকারে এখানে ফিরে আসবে। বুযুর্গানে কিরাম বলেন আদম (عليه السلام)কে বেহেশত থেকে বের করা হয়নি বরং আমরাই তাঁকে ওখান থেকে বিচ্ছিন্ন করেছি কেননা তাঁর পৌরুষে কাফির ফাসিক সবার রূহ ছিল। এবং সে গুলো বেহেশ্তের অনুপযোগী ছিল। তাই নির্দেশ দেয়া হলো ওহে আদম (عليه السلام), পৃথিবীতে গিয়ে ওসব দুষ্ট আত্মাকে ওখানে রেখে এসো। (মিরকাতের الايمان بالقدر অধ্যায়ে ও রূহুল বয়ানের فَأَزَلَّهُمَا الشَّيْطَانُ আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০৫২) আকলী দলীল সমূহ | (০৫৩/২) নবীগণের নিষ্পাপ হওয়া সম্পর্কে উত্থাপিত আপত্তি সমূহ এবং এসবের জবাব |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |