হযরত ইউসুফ (عليه السلام) আযীয মিসিরের স্ত্রী জুলেখার সাথে পাপাচারের ইচ্ছে করেছিলেন। যেমন- আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন
وَلَقَدْ هَمَّتْ بِهِ وَهَمَّ بِهَا لَوْلَا أَنْ رَأَى بُرْهَانَ رَبِّهِ
¶ সূূূরা ইউসুুফ, আয়াত নং-২৪।
অর্থাৎ জুলেখার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন যদি না তিনি তাঁর প্রতিপালকের নিদর্শন প্রত্যক্ষ করতেন, জানি না কি অঘটন ঘটে যেত। দেখুন, এটা কত বড় গুনাহ ছিল, যা হযরত ইউসুফ (عليه السلام) থেকে প্রকাশ পেয়েছে।
হযরত ইউসুফ (عليه السلام) পাপাসক্ত তো দূরের কথা, এর কল্পনা থেকেও তিনি পবিত্র ছিলেন। যে বলে যে তিনি এ রকম উদ্দেশ্য করেছিলেন, সে কাফির।
তাফসীরে রূহুল বয়ানে সেই আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে
فمن نسب الى الأنبياء الفواحش كالعزم على الزنى ونحوه الذي يقوله الحشوية فى يوسف كفر لانه شتم لهم كذا فى القنية
¶ ইসমাঈল হাক্কী, তাফসিরে রুহুল বায়ান, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-২৩৮।
আপত্তিতে উল্লেখিত আয়াতের দু’ধরনের তাফসীর করা হয়েছে-এক وَلَقَدْ পর্যন্ত পড়ে বিরতি দিন এবং هَمَّ থেকে পৃথক আয়াত শুরু করুন। তখন আয়াতের অর্থ দাঁড়াবে জুলেখা ইউসুফ (عليه السلام) এর প্রতি আসক্ত হয়েছিল এবং তিনিও আসক্ত হতেন, যদি খোদার নিদর্শন না দেখতেন। এখন আর কোন আপত্তি রইলো না। আকলী বলুন বা নকলী বলুন, সবদিক থেকে সঠিক অর্থ হয়েছে।
তাফসীরে খাযেনের মতে এর আসল ইবারত হচ্ছে
لَوْلا أَنْ رَأى بُرْهانَ رَبِّهِ
¶ সূূূরা ইউসুুফ, আয়াত নং-২৪।
তাফসীরে মাদারিক শরীফে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বর্ণিত আছে-
ومن حق القارىء إذا قدر خروجه من حكم القسم وجعله كلاماً برأسه أن يقف على به ويبتدىء بقوله وهم بها
-‘‘ক্বারীদের উচিৎ به এর পর বিরতি দেয়া এবং وهم بها থেকে আয়াত শুরু করা।
¶ ইমাম নাসাফী, তাফসীরে মাদারেক, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৬০১।
কিয়াসও তাই বলে, কেননা কুরআন করীম এ জায়গায় জুলেখার সব রকমের প্রস্তুতির বর্ণনা করেছেন
وَغَلَّقَتِ الْأَبْوَابَ وَقَالَتْ هَيْتَ لَكَ
সে তাঁকে সব রকমভাবে মোহিত করার চেষ্টা করেছে। তাঁকে কাছে ডেকেছে এবং দরজাও বন্ধ করেছিল।
¶ সূরা ইউসুফ, আয়াত নং-২৩।
কিন্তু হযরত ইউসুফ (عليه السلام) এর অনিচ্ছা, ঘৃণা ও নিষ্পাপের কথাও সাথে সাথে বর্ণিত হয়েছে-
قَالَ مَعَاذَ اللَّهِ إِنَّهُ رَبِّي أَحْسَنَ مَثْوَايَ إِنَّهُ لَا يُفْلِحُ الظَّالِمُونَ
-‘‘আল্লাহর দোহাই, সে আমার মুরব্বি, আমার প্রতি তার অনেক ইহসান রয়েছে। এ ধরনের আচরণ অন্যায় এবং অন্যায়কারী কখনও কামিয়াব হয় না।’’
¶ সূরা ইউসুফ, আয়াত নং-২৩।
এর পর আরও বর্ণিত আছে
كَذَلِكَ لِنَصْرِفَ عَنْهُ السُّوءَ وَالْفَحْشَاءَ
¶ সূরা ইউসুফ, আয়াত নং-২৪।
এ আয়াতে الْفَحْشَاءَ এর দ্বারা যেনা এবং سُّوءَ এর দ্বারা যেনার উদ্দেশ্য করা বোঝানো হয়েছে। এতে প্রমাণিত হলো যে আল্লাহ তা’আলা তাঁকে যেনার ধারণা থেকেও পবিত্র রেখেছেন। শেষ পর্যন্ত জুলেখাও স্বীকার করেছে-
الْآنَ حَصْحَصَ الْحَقُّ أَنَا رَاوَدْتُهُ عَنْ نَفْسِهِ وَإِنَّهُ لَمِنَ الصَّادِقِينَ
-আমিই তাঁকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছিলাম। তিনি সত্যবাদী।’’
¶ সূরা ইউসুফ, আয়াত নং-৫১।
এমনটি দুগ্ধপোষ্য শিশুর দ্বারাও তাঁর নির্দোষিতা ও জুলেখার পঙ্কিলতার সাক্ষ্য প্রদান করা হয়েছে
وَشَهِدَ شَاهِدٌ مِنْ أَهْلِهَا
¶ সূরা ইউসুফ, আয়াত নং-২৬।
আযীয মিসিরও তাই বলেছেন
يُوسُفُ أَعْرِضْ عَنْ هَذَا وَاسْتَغْفِرِي لِذَنْبِكِ إِنَّكِ كُنْتِ مِنَ الْخَاطِئِينَ
ওহে জুলেখা, তুমি পাপী, তুমি স্বীয় গুনাহ থেকে তওবা কর।
¶ সূরা ইউসুফ, আয়াত নং-২৯।
দেখুন, দুগ্ধ পোষ্য শিশু, আযীয মিসির, স্বয়ং জুলেখা, এমনকি আল্লাহ তা’আলাও তাঁর নিষ্পাপ হওয়ার সাক্ষ্য দিয়েছেন। যদি জুলেখার মত তিনিও পাপাসক্ত হতেন, তাহলে তিনিও দোষী সাব্যস্ত হতেন এবং এসব সাক্ষ্য মিথ্যা পরিণত হতো। আর যদি এতটুকুই হতো যে জুলেখাই পাপের সূচনা করেছিল। পরে তিনিও জড়িত হয়ে পড়েছেন। যদি ইউসুফ (عليه السلام) অবৈধ কাজ করার খেয়াল করতেন, তাহলে তাঁর তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনার কথা নিশ্চয় বর্ণিত হতো।
যেমন- তাফসীরে মদারেকে আছে
ولأنه لو وجد منا ذلك لذكرت توبته واستغفاره
আসলে উপরোক্ত আয়াতের যথার্থ অর্থ হচ্ছে যে তিনিও (যেনার) মনস্থ করতেন, যদি খোদার নিদর্শন না দেখতেন।
¶ ইমাম নাসাফী, তাফসিরে মাদারেক, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১০৪।
তাফসীরে কবীরে উল্লেখিত আছে যে لولا এর জবাব এর আগে উল্লেখিত বলেও ধরে নেয়া যায়। যেমন- উক্ত আয়াতের আগে বর্ণিত আছে
إِنْ كَادَتْ لَتُبْدِي بِهِ لَوْلَا أَنْ رَبَطْنَا عَلَى قَلْبِهَا
¶ (সূরা কাসাস, আয়াত নং-১০)
উক্ত আয়াতের অপর ব্যাখ্যা হলো به তে ওয়াক্ফ না করে بها পর্যন্ত একই বাক্য মনে করতে হবে এবং আয়াতের অর্থ দাড়াবে- নিশ্চয় জুলেখা ইউসুফ (عليه السلام) এর প্রতি আসক্ত এবং ইউসুফ (عليه السلام) জুলেখার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। আয়াতে উল্লেখিত هم শব্দদ্বয়ের অর্থের মধ্যে নিশ্চয় পার্থক্য রয়েছে هَمَّتْ بِهِ দ্বারা যেনার খেয়াল বোঝানো হয়েছে এবং هَمَّ بِهَا দ্বারা হৃদয়ের অনিয়ন্ত্রিত আকর্ষণকে বোঝানো হয়েছে, যেখানে কোন ইচ্ছে শক্তি প্রকাশ পায় না। অর্থাৎ জুলেখা ইউসুফ (عليه السلام)কে কামনা করেছিল এবং ইউসুফ (عليه السلام) এর মনে অনিয়ন্ত্রিত সহানুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল, যা কোন অপরাধ বা গুনাহ নয়। যেমন- রোযায় ঠাণ্ডা পানি দেখলে মনে তৃষ্ণা জাগে, কিন্তু পান করার ইচ্ছেমতো দুরের কথা, কল্পনাও করা হয় না, কেবল শীতল পানি ভাল লাগে। যদি উভয় শব্দ একই অর্থবোধক হতো, তাহলে একই শব্দ দু’বার বলা হতো না। বরং وَلَقَدْ هَمَّتْ بِهِ (উভয়ে মনস্থ করেছিলেন) (সূূরা ইউসুফ, আয়াত নং-২৪) বললেই যথেষ্ট হতো। দেখুন وَمَكَرُوا وَمَكَرَ اللَّهُ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত নং-৫৪) আয়াতে প্রথম مكر শব্দের অর্থ এক রকম এবং দ্বিতীয় مكر শব্দের ভাবার্থ অন্যরকম।
তাফসীরে খাযেনে বর্ণিত আছে-
قال الإمام فخر الدين الرازي: إن يوسف عليه الصلاة والسلام كان بريئا من العمل الباطل والهم المحرم
-‘‘ইমাম ফখরউদ্দিন (رحمة الله) বলেছেন যে নিশ্চয় হযরত ইউসুফ (عليه السلام) খারাপ ধারণা ও অসৎ কাজ থেকে পবিত্র ছিলেন।’’
¶ ইমাম খাযেন, তাফসিরে খাযেন, ২/৫২২
লক্ষ্যণীয় যে জুলেকা দরজার পাশে আযীয মিসিরকে দেখে ইউসুফ (عليه السلام) এর নামে যেনার অভিযোগ করেননি, বরং বলেছেন যে ইউসুফ (عليه السلام) যেনার উদ্দেশ্য করেছিলেন, যেমন- কুরআনে উল্লেখিত আছে-
قَالَتْ مَا جَزَاءُ مَنْ أَرَادَ بِأَهْلِكَ سُوءًا إِلَّا أَنْ يُسْجَنَ
-‘‘যে তোমার স্ত্রীর সাথে অবৈধ কাজ করার উদ্দেশ্য করে, তার জেল ব্যতীত অন্য কি শাস্তি হতে পারে?’’
¶ সূূরা ইউসুফ, আয়াত নং-২৫।
এর প্রতিবাদে হযরত ইউসুফ (عليه السلام) বলেছিলেন-
هِيَ رَاوَدَتْنِي عَنْ نَفْسِي
-‘‘অসৎ কাজের উদ্দেশ্য সেই করেছিল।’’
¶ সূূরা ইউসুফ, আয়াত নং-২৬।
দুগ্ধপোষ্য শিশুও ওর সাফাই গাওয়াকে ফাঁস করে দিয়েছিল। আযীয মিসির নিজেই হযরত ইউসুফ (عليه السلام) এর জামা ছেড়া দেখে বলেছিলেন انه من كيد كن মিসরের মহিলারাও জুলেখার অভিযোগকে মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করেছিল। এমন কি শেষ পর্যন্ত জুলেখা নিজেও তার দোষ স্বীকার করেছিল। তাই, যদি هَمَّ بِهَا এর অর্থ ইউসুফ (عليه السلام) যেনার উদ্দেশ্য করেছিলেন- এ রকম করা হয়, তাহলে বলতেই হয় যে আল্লাহ তা’আলা জুলেখার কথাকেই সত্যায়ন করেছেন এবং অন্যান্যদের বক্তব্যকে অস্বীকার করেছেন। কিন্তু এ ধরনের ভাবার্থ আসল বক্তব্যের বিপরীত। এ বর্ণনাটা যেন স্মরণ থাকে। ইন্শা আল্লাহ অনেক কাজে আসবে।
হযরত মুসা (عليه السلام) একজন কিব্তিকে জ্যান্ত মেরে ফেলেছিলেন। এবং বলেছেন-
هَذَا مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ
-‘‘এটা শয়তানী কাজ।’’
¶ সূরা কাসাস, আয়াত নং-১৫।
বোঝা গেল যে, তিনি জুলুমপূর্বক হত্যা করেছেন, যা বড় অপরাধ।
হত্যা করার উদ্দেশ্য মুসা (عليه السلام) এর ছিল না বরং জালিম কিব্তি থেকে মজলুম ইস্রাঈলীকে রক্ষা করাটাই উদ্দেশ্য ছিল। যখন কিব্তি লোকটাকে ছেড়ে দিচ্ছিল না, তখন তিনি (عليه السلام) ওকে হটিয়ে দেয়ার অভিপ্রায়ে একটি থাপ্পড় মেরে ছিলেন। কিন্তু নবুয়াতের বলে বলীয়ান উক্ত থাপ্পড় সে বরদাস্ত করতে পারেনি, যার ফলে মারা যায়। তাই এ হত্যাটা ছিল অনিচ্ছাকৃত বা ভুল বশতঃ এবং নবীদের ভুল হতে পারে। অধিকন্তু, এ ঘটনাটা নবুয়াত প্রাপ্তির আগে ঘটেছিল। যেমন রূহুল বয়ানে বর্ণিত আছে كان هذا قبل النبوة আর সেই কিবতিটা সংগ্রামী কাফির ছিল যাকে হত্যা করা অপরাধ ছিল না। তিনিতো মাত্র একজন কিব্তিকে হত্যা করেছেন; কিছুদিন পর সমস্ত কিব্তিকে ডুবিয়ে মারা হয়েছে। তবে তিনি (عليه السلام) যে এ কাজকে শয়তানী কাজ বলেছেন, এটা হচ্ছে তাঁর আজেযী ও একান্ত অনুতপ্ত ভাবের প্রকাশ মাত্র। কেননা আগাম কাজকেও তিনি অপরাধ মনে করেছেন। অর্থাৎ এ কাজটা নির্দিষ্ট সময়ের আগে হয়ে গেল। কিব্তিদের ধ্বংসের সময় সেও ধ্বংস হয়ে যেত। فَغَفَرَلَهُ এবং إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي শব্দদ্বয় দ্বারা ধোঁকায় পতিত হয়ো না। এ শব্দগুলো ভুল ক্রটির বেলায়ও প্রযোজ্য হয়। অথবা উক্ত আয়াত দ্বারা কিব্তির জুলুমকে বোঝানো হয়েছে অর্থাৎ এ জুলুম শয়তানী কাজ।
আল্লাহ তা’আলা আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামকে লক্ষ্য করে বলেছেন-
وَوَجَدَكَ ضَالًّا فَهَدَى
-‘‘আপনি পথভ্রষ্ট ছিলেন, পরে হেদায়েত প্রাপ্ত হয়েছেন।’’
¶ সূরা দ্বোহা, আয়াত নং-৭।
বোঝা গেল যে তিনি প্রথমে পথভ্রষ্ট ছিলেন, পরে হিদায়েত প্রাপ্ত হয়েছেন।
যে এ আয়াতে উল্লেখিত ضَالٌّ এর অর্থ গুমরাহ বলে, সে নিজেই গুমরাহ। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ ফরমান-
مَا ضَلَّ صَاحِبُكُمْ وَمَا غَوَى
-‘‘তোমাদের মাহবুব সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম না কখনও গুমরাহ হয়েছে, না বিপথগামী।’’
¶ সূূূরা নাজম, আয়াত নং-২।
উক্ত আয়াতে ضَالٌّ এর অর্থ খোদার প্রেমে বিভোর এবং هداى অর্থ সলুকের পদমর্যাদা। অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা আপনাকে তাঁর প্রেমে বিভোর পেয়েছেন, তাই আপনাকে সলুকের মর্যাদা দান করেছেন। হযরত ইউসুফ (عليه السلام) এর ভাইয়েরা হযরত ইয়াকুব (عليه السلام) এর কাছে আরয করেছিল -
إِنَّكَ لَفِي ضَلَالِكَ الْقَدِيمِ
¶ সূরা ইউসুফ, আয়াত নং-৯৫।
এখানে ضَالٌّ এর অর্থ হচ্ছে প্রেমে বিভোর। হযরত আবদুল হক মুহাদ্দিছ দেহলবী স্বীয় ‘মুদারেজুন নাবুয়াত’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের পঞ্চম অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন- আরবীতে ওই ধরনের উচ্চ বৃক্ষকে ضَالٌّ বলে, যার দ্বারা পথহারা লোক পথের সন্ধান পায়। অর্থাৎ ওহে মাহবুব, আল্লাহ তা’আলা আপনাকে সুউচ্চ বৃক্ষের মত পথের দিশারী হিসেবে পেয়েছেন, যাকে আরশ ফরশ সব জায়গা থেকে দেখা যায়। সুতরাং আপনার ওসীলায় সবাইকে সঠিক পথের সন্ধান দেয়া হয়েছে। [এখানে هداى ক্রিয়ার কর্ম সাধারণ লোক, নবী (আ.) নয়] এ রকম আরও অনেক অর্থ করা হয়েছে।