ইসলামী শরীআতে যে চারটি মাযহাবের উৎপত্তি হয়েছে, তন্মধ্যে 'হানাফী মাযহাব' সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বপ্রথম। এ মাযহাবের জনক ও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হযরত ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ)। উমাইয়া খলীফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের রাজত্বকালে তিনি হিজরী ৮০ সনে কুফায় জন্মগ্রহণ করেন। ইমাম আ'যম তাঁর উপাধি। আবূ হানীফা নামেই তিনি সর্বাধিক পরিচিত। তাঁর পিতার নাম ছাবিত। তিনি হযরত আলী (রাঃ)-এর খিলাফত কালে জন্মলাভ করেন এবং তাঁর দরবারে নীত হয়ে দো'আপ্রাপ্ত হন। তিনি ছিলেন একজন ব্যবসায়ী।
ইমাম আবূ হানীফা বাল্যকালে লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করেন। সর্বপ্রথম তাঁকে উচ্চ শিক্ষাদীক্ষার জন্য উৎসাহ ও পরামর্শ দান করেন কুফার প্রখ্যাত আলিম ও মুহাদ্দিস ইমাম শা'বী (রহঃ) তিনি তাঁর সময়কার অনন্য শ্রেষ্ঠ হাদীসবিদ তাবেয়ী ছিলেন। তিনি জীবনে প্রায় পাঁচশত সাহাবীর সাথে সাক্ষাত লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। তন্মধ্যে ৪৮ জন সাহাবীর নিকট হতে তিনি রীতিমত হাদীস শিক্ষা লাভ করেছিলেন। (তাহযীব গ্রন্থ দ্রঃ) ইমাম আবু হানীফা পরবর্তীকালে তাঁর নিকট হতে হাদীস শিক্ষা লাভ করেন। ইমাম শা'বী ইমাম
আবূ হানীফার কেবল উস্তাদই ছিলেন না, বরং হাফেয যাহবীর মতে
هُوَ أَكْبَرُ شُيْخِ لَا بِي حَنِيفَةً
তিনি আবূ হানীফার প্রধান উস্তাদ ছিলেন।
-তাযকিরাতুল হুফ্ফায দ্রঃ
তিনি প্রাথমিক শিক্ষালাভের পর বিশিষ্ট আলিমদের নিকট হতে কোরআন, হাদীস, ফিকহ ও কালামশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। বিভিন্ন বিষয়ে অপরিসীম জ্ঞান লাভের পর তিনি কোরআন ও হাদীস হতে কানূন আহরণের জন্য বিশেষ গবেষণা করেন। তাঁর উস্তাদমণ্ডলীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন হযরত ইমাম হাম্মাদ (রহঃ)। তিনি ছিলেন কুফার বিখ্যাত ইমাম ও যুগশ্রেষ্ঠ উস্তাদ। তিনি নবী করীম (সাঃ)-এর প্রিয় খাদেম ও বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আনাস বিন মালেক (রাঃ) হতে হাদীস শ্রবণ করেন এবং অনেক প্রখ্যাত তাবেয়ীনের সাহচর্য লাভকরে ধন্য হয়েছিলেন। ঐ সময় কুফায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদরাসায় ইমাম, আবূ হানীফা ভর্তি হয়ে বিশিষ্ট উস্তাদগণের নিকট বিভিন্ন শাস্ত্র অধ্যয়ন করে বিশেষ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন এবং চতুর্দিকে সুনাম অর্জন করেন। মূলত ইমাম আবূ হানীফা ফিকহশাস্ত্রে বুৎপত্তি অর্জন করেন ইমাম হাম্মাদের নিকট থেকে। প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে ইল্ম ফিরে যে ধারা প্রবাহিত হয়ে আসছিল, তিনি ছিলেন তার ধারক ও বাহক। এমন যুগবরেণ্য ব্যক্তিত্বের শিষ্যত্ব লাভ করেন আবূ হানীফা দ্বিধাহীন চিত্তে। ইমাম আবু হানীফা তাঁর শিক্ষা জীবন সম্পর্কে নিজেই উক্তি করেছেন:
إِنِّي لَمَّا أَرَدْتُ تَعَلُّمَ الْعِلْمِ جَعَلْتُ الْعُلُومَ كُلَّهَا نُصْبَ عَيْنِي فَقَرَأْتُ فَنًّا فَنًّا۔
অর্থাৎ আমি যখন বিদ্যাশিক্ষালাভের ইচ্ছা পোষণ করলাম, তখন সমগ্র শিক্ষা আমার চোখের নিশানা বানালাম এবং প্রত্যেকটি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করলাম।
১২০ হিজরীতে উস্তাদ ইমাম হাম্মাদ (রহঃ)-এর ইন্তেকালের পর তিনি স্বীয় শিক্ষকের স্থলাভিষিক্ত হয়ে পাঠদান ও ফতওয়ার কাজে মশগুল হলেন। বিভিন্ন স্থান হতে জ্ঞানের অন্বেষণে শিক্ষার্থীগণ ভিড় করতে থাকে। তাঁর জীবদ্দশায় এমন সহস্রাধিক মাসআলা ছিল যেসব সম্পর্কে কোন বিশুদ্ধ হাদীস ছিল না এবং সাহাবীদের বাণীও ছিল না। এ কারণে তিনি মাসআলা-মাসায়েলের ক্ষেত্রে কোরআন, হাদীস এবং তার মূলনীতি, এজমা ও কিয়াসের ওপর অধিক গুরুত্ব দিতেন। ইসলামী আইনের উসূল ও ফিকহের তিনিই ছিলেন প্রথম প্রবর্তক। সেজন্য ইতিহাসে তিনি ইমামু আহলির রায় إِمَامُ أَهْلِ الرَّاءِ নামে সুপরিচিত ছিলেন।
ইমাম হাম্মাদ (রহঃ)-এর জীবদ্দশায় আবূ হানীফা ইলমে হাদীস শিক্ষা লাভের জন্য প্রচেষ্টা শুরু করেন। কেননা, ইলমে হাদীসের ওপর পূর্ণাংগ জ্ঞান ব্যতীত ইলমে দ্বীন অর্জন করা মোটেই সম্ভব নয়। এ সময় ইমলামী দুনিয়ায় পূর্ণোদ্যমে হাদীসের শিক্ষা দানের কাজ অব্যাহত ছিল। এ সময় কমপক্ষে দশ হাজার সাহাবা বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। লোকজন যেখানেই কোন সাহাবীর খোঁজ পেতেন, সেখানেই তাঁরা নবী করীম (সাঃ)-এর পবিত্র বাণী শুনার জন্য এবং শরীআতের কোন মাসআলার ব্যপারে জিজ্ঞেস করার জন্য চতুর্দিক হতে আগমন করতেন। এভাবেই সাহাবায়ে কেরাম আজমাঈনের শাগরিদ হিসেবে খ্যাত তাবেয়ীদের অনেকগুলো জামাআত ইসলামী দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। যে সমস্ত শহরে সাহাবা অথবা তাবেয়ীদের সমাগম অধিক ছিল, সেগুলোর সংখ্যা অন্যূন পঞ্চাশ হবে। হাফেয যাহ্বী এই শহর ও স্থানসমূহের নাম এবং এদের বিবরণ উল্লেখ করে একখানি স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন। এর নাম হল الْأَمْصَارُ ذَوَاتُ الْأَثَارِ - 'হাদীসসমৃদ্ধ শহরসমূহ'। তন্মধ্যে ইমাম ইবনে তাইমিয়ার মতে উল্লেখযোগ্য 'হাদীসসমৃদ্ধ শহর' হল মক্কা, মদীনা, কুফা, বসরা ও সিরিয়া- এ পাঁচটি শহর ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাদপীঠ। এ সব শহর হতে নবীর প্রচারিত জ্ঞান-ঈমান, কোরআন ও শরীআত সম্পর্কিত ইল্ল্ম-এর ফল্গুধারা উৎসারিত হয়েছে।
ইমাম আবু হানীফা উপরোক্ত শহরসমূহে আগমন করে সাহাবা ও তাবেয়ীদের নিকট হতে হাদীস আহরণ করেন। সংক্ষিপ্তকারে নিচে এর বিবরণ প্রদত্ত হল:
إِنَّهُ أَدْرَكَ جَمَاعَةٌ مِّنَ الصَّحَابَةِ كَانُوا بِالْكُوفَةِ بَعْدَ مَوْلِدِه بِهَا سَنَةٌ ثَمَانِينَ فَهُوَ مِنْ طَبْقَةِ التَّابِعِينَ وَلَمْ يَثْبُتُ ذَلِكَ لِأَحَدٍ مِنْ أَئِمَّةِ الْأَمْصَارِ الْمُعَاصِرِينَ لَهُ كَالْأَوْزَعِى بِالشَّامِ وَالْحَمَّادِ بْنِ بِالْبَصَرَةِ وَالثَّوْرِى بِالْكُوفَةِ وَمَالِكُ بِالْمَدِينَةِ الْمُشْرَفَةِ وَاللَّيْثِ بْنِ سعد بمصر -
অর্থ: নিশ্চয়ই তিনি (ইমাম আবু হানীফা) সাহাবাদের এক জামাআতকে দেখতে পেয়েছেন, যারা কুফা নগরে থাকতেন, যখন তিনি ৮০ হিজরী সনে তথায় জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁর সহযোগী সিরিয়ার আওযায়ী, বসরার হাম্মাদ ইবনে সালমা ও হাম্মাদ ইবনে যায়েদ, কুফার সুফইয়ান সওরী, মদীনার মালেক (আনাস বিন মালেক) এবং মিশরের লাইছ ইবনে সা'আদ প্রমুখ ইমাম এই মর্যাদা লাভ করেন নাই।
হাদীস সংকলনের ইতিহাস, মাওঃ আবদুর রহীম, পৃঃ-২৬৩
أَدْرَكَ الْإِمَامُ الْأَعْظَمُ ثَمَانِيَةً مِنَ الصَّحَابَةِ، مِنْهُمْ أَنَسٌ وَعَبْدُ اللَّهِ بْنُ أَبِي أَوْفَى وَسَهْلُ بْنُ سَعْدٍ وَأَبُو الطُّفَيْلِ۔
অর্থঃ ইমাম আ'যম আবূ হানীফা আটজন সাহাবীর সাক্ষাত পেয়েছেন। তন্মধ্যে আনাস বিন মালেক, আবদুল্লাহ বিন আওফা, সহল ইবনে সা'আদ এবং আবূ তোফাইল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
হাদীস সংকলনের ইতিহাস, মাওঃ আবদুর রহীম, পৃঃ-২৬৩
وأَدْرَكَ بالسن نَحْو عِشْرِينَ صَحَابِيًّا
বয়সের হিসাবে তিনি (আবূ হানীফা) প্রায় বিশজন সাহাবীকে পেয়েছেন।
হাদীস সংকলনের ইতিহাস, মাওঃ আবদুর রহীম, পৃঃ-২৬৩
وُضِعَ أَنَّ أَبَا حَنِيفَةَ سَمِعَ الْحَدِيثَ مِنْ سَبْعَةٍ مِنَ الصَّحَابَةِ۔
হানীফা সাতজন সাহাবীর নিকট হাদীস শ্রবণ করেছেন, এটা যথার্থ।
৪হাদীস সংকলনের ইতিহাস, মাওঃ আবদুর রহীম, পৃঃ-২৬৩
وَعَلَى كُلِّ فَهُوَ مِنَ التَّابِعِينَ وَمِمَّنْ جَزَمَ بِذَاكَ الْحَافِظُ الذَّهَبِي وَالْحَافِظُ الْأَسْقَلَانِي
সব দিকেরই বিচারে ইমাম আবু হানীফা তাবেয়ী ছিলেন। হাফেয যাহবী ও হাফেয আসক্বালানী তা দৃঢ়তাসহকারেই ঘোষণা করেছেন।
إِنَّهُ تَابِعِي رُويَةً وَتَبْعُ التَّابِعِينَ رِوَايَة
তিনি সাক্ষাত লাভের দিক দিয়ে তারেয়ী ছিলেন এবং তাবে-তাবেয়ীন ছিলেন হাদীস বর্ণনার দিক দিয়ে। -
বুখারীর শরাহ ফয়যুল বারী দ্রঃ
হাদীস সংকলনের ইতিহাস, মাওঃ আবদুর রহীম, পৃঃ-২৬৩
সুতরাং উপরোক্ত উদ্ধৃতির দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ইমাম আ'যম আবু হানীফা (রহঃ) তাবেয়ী ছিলেন। তিনি যে সকল তাবেয়ীদের নিকট হতে জ্ঞানার্জন ও হাদীস শ্রবণ করেন, তন্মধ্যে নিম্নোক্ত ব্যক্তিগণ উল্লেখযোগ্য:
ইমাম আবূ হানীফা মক্কা শরীফে গমন করে হযরত ইবনে আবি রিবাহ ছাড়াও হযরত ইকরিমার খেদমতে যেয়ে হাদীস শ্রবণ করতেন। হযরত ইকরিমা হযরত ইবনে আব্বাসের গোলাম ও শাগরিদ ছিলেন। তাছাড়া অনেক সাহাবীর নিকট থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। প্রায় ৭০ জন প্রখ্যাত তাবেয়ী হাদীস ও তাফসীর শাস্ত্রে তাঁর ছাত্র ছিলেন। ইমাম শা'বী বলতেন, বর্তমানে হযরত ইকরিমা সবচেয়ে কোরআন ও হাদীস সম্পর্কে জ্ঞানী মানুষ। (বংগানুবাদ মুসনাদে ইমাম আ'যম আবু হানীফা-এর ভূমিকায় লিখিত ইমাম আবু হানীফার জীবনী অধ্যায় ও হাদীস সংকলনের ইতিহাস, মাওঃ আবদুর রহীম, পৃঃ-২৪১)
উপরোক্ত জগদ্বিখ্যাত তাবেয়ীগণ ছিলেন ইমাম আ'যমের উস্তাদ। সুতরাং প্রমাণিত হয় যে, ইলমে হাদীসে ইমাম আ'যম (রহঃ) একটি উচ্চ আসন লাভ করেছিলেন। কেননা, তাঁর উস্তাদ ছিলেন অসংখ্য। আবু হাফ্স উমর বলেন যে, ইমাম আবূ হানীফা কমপক্ষে চার হাজার ব্যক্তি হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন। আল্লামা যাহাবী-এর 'তাযকিরাতুল হুফ্ফায' গ্রন্থে তাঁদের নাম উল্লেখ করেছেন। হাফেয মুহাম্মদ ইবনে ইউসুফ সালেহী শাফিয়ী বলেন:
كَانَ أَبُو حَنِيفَةَ مِنْ كِبَارِ حُفَّاظِ الْحَدِيثِ وَأَعْيَافِهِمْ وَلَوْ لَا كَثَرَةُ اعْتِنَائِهِ بِالْحَدِيثِ مَا تَهَيَّا لَهُ اسْتِنْبَاطُ مَسَائِلِ الْفِقْهِ
ইমাম আবূ হানীফা হাদীসের বড় বড় হাফেয ও গুরুদের মধ্যে গণ্য। তিনি যদি হাদীসের প্রতি খুব বেশী মনোযোগী না হতেন ও ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন না হতেন, তাহলে ফিরে মাসায়েল বের করা তার পক্ষে কখনই সম্ভব হত না।
-তাবাকাতুল হুফ্ফায দ্রঃ।
(হাদীস সংকলনের ইতিহাস, মাওঃ আবদুর রহীম, পৃঃ-২৬৬)
শায়খুল ইসলাম ইয়াযীদ ইবনে হারুন বলেন:
ইমাম আবূ হানীফা অত্যন্ত মুত্তাকী, পবিত্র-পরিচ্ছন্ন গুণসম্পন্ন সাধক, আলিম, সত্যবাদী ও সমসাময়িক কালের সকলের অপেক্ষা হাদীসের বড় হাফেয ছিলেন।"
- মানাকিবে আবু হানীফা দ্রঃ।
(হাদীস সংকলনের ইতিহাস, মাওঃ আবদুর রহীম, পৃঃ-২৬৬)
• ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদুল কাতান বলেছেন:
إِنَّهُ وَاللَّهِ لَا عْلَمُ هَذِهِ الْأُمَّةِ بِمَا جَاءَ عَنِ اللَّهِ وَعَنْ رُسُلِهِ
আল্লাহর শপথ, আবু হানীফা বর্তমান মুসলিম উম্মাহ'র মধ্যে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের হাদীস ও সুন্নাত সম্পর্কে সর্বাপেক্ষা বিজ্ঞ ও জ্ঞানী।
(হাদীস সংকলনের ইতিহাস, মাওঃ আবদুর রহীম, পৃঃ-২৬৬)
• মুহাদ্দিস ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীনকে যখনই ইমাম আবূ হানীফা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হত, তখনই তিনি বলতেন:
ثِقَةً مَامُونُ مَا سَمِعْتُ أَحَدٌ أَضْعَفَهُ
তিনি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য, বিশ্বস্ত, ভুল-ভ্রান্তিমুক্ত। হাদীসের ব্যাপারে কেউ তাঁকে দুর্বল বা অগ্রহণযোগ্য বলেছেন বলে আমি শুনি নাই।
উম্দাতুল ক্বারী দ্রঃ
(হাদীস সংকলনের ইতিহাস, মাওঃ আবদুর রহীম, পৃঃ-২৬৬)
বলখের ইমাম ইবনে আইউব সত্যই বলেছেন:
صَارَ الْعِلْمُ مِنَ اللَّهِ تَعَالَى إِلَى مُحَمَّدٍ رَّسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ثُمَّ صَارَ إِلَى أَصْحَابِهِ ثُمَّ صَارَ إِلَى التَّابِعِينَ ثُمَّ صَارَ إلى أَبي حَنِيفَة -
প্রকৃত ইল্ম আল্লাহর নিকট হতে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নিকট পৌঁছেছে। তারপর তাঁর সাহাবীগণ তা লাভ করেছেন। সাহাবীদের নিকট হতে পেয়েছেন তাবেয়ীগণ। আর তাবেয়ীগণের নিকট হতে তা কেন্দ্রীভূত ও পরিণত হয়েছে ইমাম আবূ হানীফাতে।
(হাদীস সংকলনের ইতিহাস, মাওঃ আবদুর রহীম, পৃঃ-২৬৭)
এ সমস্ত উক্তি দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, হাদীসশাস্ত্রে ইমাম আ'যম বিশ্ববিখ্যাত বিদ্বান ছিলেন। আর এই সকল হাদীস-এর দ্বারা তিনি কিয়াস ও বুদ্ধি প্রয়োগের সাহায্যেই মাসআলার রায় দিতেন। মাসআলার রায় দেয়ার ব্যাপারে তাঁর নীতি কী ছিল, তা তাঁর নিম্নোক্ত উক্তি হতেই সুস্পষ্ট ও অকাট্য প্রমাণিত হয়। তিনি নিজেই নিজের সম্পর্কে বলেছেন:
إني أخُذُ بِكِتَابِ اللهِ إِذَا وَجَدْتُهُ فَمَا لَمْ أَجِدُهُ فِيهِ أَخَذْتُ بِسُنَّةِ. رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَلِأَثَارِ الصِّحَاحِ عَنْهُ الَّتِي قشتْ فِي أَيْدِي التَّقَاتِ فَإِذَا لَمْ أَجِدُ فِي كِتَابِ اللَّهِ وَسُنَّةِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَخَذْتُ بِقُولِ أَصْحَابِهِ مَنْ شِئْتُ وَادْعُ قولَ مَن شِئْتُ -
অর্থাৎ আমি প্রথমে আল্লাহর কিতাবকেই ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে, যখন' তাতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ফায়সালা পাই, তখন সে অনুযায়ীই রায় দেই। তাতে যদি না পাই, তবে অতঃপর রাসূলের সুন্নাত ও বিশুদ্ধ কার্য বিবরণী- যা নির্ভরযোগ্য লোকদের মারফতে প্রচারিত হয়েছে- গ্রহণ করি। কিন্তু আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতেও যদি তা না পাই, তবে তখন আমার নীতি এই হয় যে, সাহাবীদের মধ্য হতে কারো কথা গ্রহণ করি আর কারো কথা ছেড়ে দেই।
-তারীখে তাশ্রী' দ্রঃ।
(হাদীস সংকলনের ইতিহাস, মাওঃ আবদুর রহীম, পৃঃ-২৬৯)
ইমাম আবূ হানীফা যে সকল হাদীস তাবেয়ীদের নিকট হতে শ্রবণ করেছিলেন, তন্মধ্য হতে রাসূলে পাক (সাঃ)-এর আদেশ-নিষেধমূলক হাদীসসমূহের একটি সংকলন প্রণয়ন করেন। এই সংকলনের নাম হচ্ছে, 'কিতাবুল আ-ছার'। দুনিয়ার মুসলিম জাতির নিকট এর চেয়ে প্রাচীনতম হাদীস
গ্রন্থ সম্ভবত আর একখানিও বর্তমান নেই। ইমাম আবু হানীফা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর সময় প্রতিষ্ঠিত কুফার জামে মসজিদের প্রসিদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্রের প্রধান শিক্ষাগুরু নিযুক্ত হয়ে একদিকে যেমন 'ইলমে ফিকহে'র ভিত্তি স্থাপন করেন, অপরদিকে সেই সংগেই তিনি রাসূল (সাঃ)-এর আদেশে-নিষেধমূলক হাদীসসমূহের এই সংকলন রচনা করেন।
ইমাম আ'যমের সংকলিত 'কিতাবুল আসার' সম্পর্কে হাফেয ইবনে হাজার আসক্বালানী লিখেছেন:
والموجُودُ مِنْ حَدِيثِ أَبِي حَنِيفَةً مُفْرَدًا إِنَّمَا هُوَ كِتَابُ الْأَثَارِ الَّتِي رَوَاهَا مُحَمَّدُ بْنُ حَسَنٍ عَنْهُ .
ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ) বর্ণিত স্বতন্ত্র গ্রন্থ বর্তমান। আর তা হচ্ছে-'কিতাবুল আছার'- তা তাঁর নিকট হতে (ইমাম) মুহাম্মদ ইবনে হাসান বর্ণনা করেছেন।
(হাদীস সংকলনের ইতিহাস, মাওঃ আবদুর রহীম, পৃঃ-৩১১)
'কিতাবুল আছার' নামক হাদীস গ্রন্থখানি প্রণয়নের ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) ব্যাপকভাবে হাদীস সংগ্রহ ও ছাঁটাই-বাছাই করেছেন। সদরুল আয়িম্মা মুয়াফিক ইবনে আহমদ মক্কী তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন: ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) চল্লিশ হাজার হাদীস হতে ছাঁটাই-বাছাই করে 'কিতাবুল আছার' প্রণয়ন করেন। মানাকিবে ইমাম আ'যম দ্রঃ।
হাদীস চয়ন ও হাদীস গ্রহণের ব্যাপারে তাঁর এই অসামান্য সতর্কতার কথা সকল হাদীস-পারদর্শী স্বীকার করেছেন। ইমাম ওকী (রঃ) বলেছেন:
لقَدْ وُجِدَ الْوَرْعُ عَنْ أَبِي حَنِيفَةَ فِي الْحَدِيثِ مَالَمْ يُوجَدْ عَن غيره -
অর্থাৎ হাদীস গ্রহণের ব্যাপারে ইমাম আবূ হানীফা কর্তৃক যেরূপ সতর্কতা অবলম্বিত হয়েছে, তদ্রূপ আর কারও দ্বারা অবলম্বিত হয় নাই।
(হাদীস সংকলনের ইতিহাস, মাওঃ আবদুর রহীম, পৃঃ-৩১২)
ঠিক এ কারণেই মনে হয়, মুহাদ্দিসগণ ইমাম আবূ হানীফার সমালোচনা করতে গিয়ে তাঁকে مُشَدِّدُ فِي الرواية হাদীস বর্ণনায় অত্যন্ত কঠোর ও কড়া লোক বলে অভিহিত করেছেন এবং এ জন্যই তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা খুব বেশী হতে পারে নাই। ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন এর কারণ বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখেছেন:
وَالْإِمَامُ أَبُو حَنِيفَةً إِنَّمَا قُلَّتْ رِوَايَتُهُ لِمَا شَدَّ فِي شُرُوطِ الرِّوَايَةِ وَالتَّحمل
ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ) বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম হওয়ার কারণ এই যে, তিনি হাদীস গ্রহণ ও বর্ণনার ব্যাপারে কঠোর নৈতিক শর্ত আরোপ করেছেন।
মুকাদ্দামাতু ইবনু খালদুন দ্রঃ।
(হাদীস সংকলনের ইতিহাস, মাওঃ আবদুর রহীম, পৃঃ-৩১২)
'মানাকিরে ইমাম আ'যম' গ্রন্থে ইমাম আবূ হানীফার সংগৃহীত হাদীসের বিপুলতার সামান্য পরিমাণ বর্ণনা করা সম্পর্কে তাঁর একটি উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে।
তিনি বলেছেন:
عِنْدِي صَنَادِيقُ مِنَ الْحَدِيثِ مَا أَخْرَجْتُ مِنْهَا إِلَّا الْيَسِيرَ الَّذِي يُنْتَفَعُ بِهِ۔
আমার নিকট কয়েক সিন্দুক ভর্তি লিখিত হাদীস সম্পদ মওজুদ রয়েছে। কিন্তু আমি তা হতে অতি অল্প সংখ্যকই প্রকাশ ও বর্ণনা করেছি, যা লোকদের ব্যবহারিক জীবনের উপকার দিবে।
(হাদীস সংকলনের ইতিহাস, মাওঃ আবদুর রহীম, পৃঃ-৩১২)
ইমাম আ'যমের অসংখ্য শাগরিদ ছিল। তন্মধ্যে কয়েকজনের নাম এখানে লিপিবদ্ধ করা হল।
ইমাম আ'যম (রঃ)-এর সংগৃহীত হাদীস 'কিতাবুল আছার' ছাড়া আরও সুবৃহৎ পনেরখানা 'মসনদ' রয়েছে। যাতে মুহাদ্দিস ও ইমামগণ ইমাম সাহেবের রেওয়ায়েতসমূহ একত্রিত করেছেন। তিনি যে সকল হাদীসের ব্যবহার ও ব্যাখ্যা করেন, 'মুসনাদু আবী হানীফা' সেই সকল হাদীসের সংকলন। এদের পনেরখানা 'মুসনাদ'-এর মধ্যে দশ খানা অদ্যবধি বর্তমান আছে। (ফতওয়ায়ে সিদ্দীকিয়া, প্রণেতা, মাওঃ শাহসূফী নিসার উদ্দীন আহমদ, পৃঃ-২৮১-২৮২ এবং সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ, ১ম খণ্ড, পৃঃ-৫৬)
ইমাম আ'যম আবূ হানীফা (রহঃ)-এর জীবনের সবচেয়ে বেশী কৃতিত্ব ও প্রসিদ্ধ কাজ হল ইসলামী ফিহে'র সম্পাদনা করা। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি সুশৃংখলভাবে ইসলামী ফিরে সম্পাদনা করেছেন। মূলত তিনি ছিলেন ফি শাস্ত্রের উস্তাদ ও ইমাম। এ কথা অনস্বীকার্য যে, তাঁর বর্ণিত প্রতিটি মাসআলাই পবিত্র কোরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা সমর্থিত। ইমাম আ'যম বহু সহস্র হাদীস (কারো মতে বিশ হাজার) এর স্পষ্টাংশ ও অস্পষ্টাংশ হতে ৮৩ হাজার মাসায়েল প্রকাশ করেছেন। 'এলাউস সুনান' গ্রন্থে উক্ত হাদীসগুলি সংকলন করা হয়েছে। এ গ্রন্থটি সম্প্রতি ২১ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। প্রসংগত উল্লেখ্য যে, 'জয়লে-জাওয়াহেরে মজিয়া' গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে যে, ইমাম আ'যম ৭০ হাজারেরও অধিক হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাঁর বর্ণিত হাদীসগুলো ৭শত মতান্তরে ৮শত শিষ্য রেওয়ায়েত করেছেন। তা 'জয়লে জাওয়াহেরে মজিয়া' শামী- ১ম খণ্ড ও 'খায়রাতুল হিসান' কিতাবসমূহে লিখিত আছে। (মাযহাব ও তাকলীদ, পৃঃ-৪১)
الْفُقَهَاءَ زَعَمُوا أَنَّ أُصُولَ الشَّرِيعَةِ أَرْبَعُ الْكِتَابُ السُّنَّةُ إِنَّ وَالْإِجْمَاعُ وَالْقِيَاسُ -
ফিরে শাস্ত্রবিদগণ বলেছেন যে, শরীআতের মৌলিক নীতি চারটি: কোরআন, সুন্নাহ, এজমা ও কিয়াস।
(আনওয়ারুল মুকাল্লেদীন, ই, ফা, বা, পৃঃ-২২)
শরীআতের প্রধান উৎস এবং মূলনীতি হলো পবিত্র কোরআন। দ্বিতীয় উৎস হল সুন্নাহ বা হাদীস। নবী করীম (সাঃ) যা বলেছেন, করতে বলেছেন এবং তিনি যে কাজের প্রতি সম্মতি প্রদান করেছেন ইত্যাদির সমষ্টিকে হাদীস ও সুন্নাহ বলা হয়। ইসলামী শরীআতের তৃতীয় উৎস হলো এজমা। নবী করীম (সাঃ)-এর ইন্তেকালের পর শরীআতের এরূপ মাসআলার ব্যাপারে আলোচনা ও পরামর্শের প্রয়োজন হয়ে পড়ে, যা ছিল সংক্ষিপ্ত অথবা নবী করীম (সাঃ)-এর একই আমলের ব্যাপারে বিভিন্ন রেওয়ায়েত বিদ্যমান রয়েছে। তখন ঐ সমস্ত বিভিন্ন রেওয়াতের মধ্যে পরামর্শ করে সাহাবায়ে কেরাম একটি ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তে উপনীত হতেন। তাকেই 'এজমা' বলা হয়। শরীআতের চতুর্থ উৎস হল 'কিয়াস'। কোন বিষয় সম্পর্কে শরীআতের যে নির্দেশ রয়েছে, ঐ নির্দেশ একই পর্যায়ের কারণে অন্য একটি বিষয় সম্পর্কে নির্ধারণ করাকে কিয়াস বলে। কিয়াস একটি অত্যাবশ্যকীয় কানুন। এর অসংখ্য প্রমাণ কোরআন, সুন্নাহ ও এজমায়ে বিদ্যমান। একে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।
কিয়াস হল আইনের বিস্তৃতি। মূল আইন যখন সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে কুলিয়ে উঠতে পারে না, তখন মূল আইন বা বিধান হতে ইল্লাত বা কারণের মাধ্যমে নতুন বিধি আহরণ করতে হয়, এর ফলে আইনের যে বিস্তৃতি ঘটে তাই কিয়াস। ইমাম আবূ হানীফা প্রথম মাসআলা নিরূপণের ক্ষেত্রে কিয়াস বা সাদৃশ্য মূলক যুক্তিগুলোর প্রতি মনোযোগ দিয়েছিলেন।
ইমাম আবূ হানীফা (রঃ)-এর যুগের পূর্ব পর্যন্ত বিভিন্ন মাসআলা সংকলিত ও সম্পাদিত হলেও পৃথক বিষয় হিসেবে সুবিন্যস্ত ছিল না। মাসআলা নির্গত করার এবং দলীল গ্রহণের নিয়ম-কানুনের প্রবর্তন তখনও হয়নি। আহকামের খণ্ড মাসআলা নির্গত করার নীতি হাদীসে বিভিন্নভাবে বিদ্যমান ছিল। ইমাম আ'যম ১২০ হিজরীতে কতগুলো নিয়ম, কায়দা-কানুন ও মূলনীতির অধীনে ফিরে খণ্ড মাসআলাসমূহ সম্পাদনা ও বিন্যস্ত করার কাজ শুরু করেন। এ জন্যেই তাঁকে ফিকহে ইসলামীর 'আবিষ্কারক'-এর উপাধি দেয়া হয়।
ইমাম আবূ হানীফার ফি সম্পাদনার পদ্ধতি ছিল এই যে, প্রতিটি মাসআলা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে কী বিধান রয়েছে, তা তিনি প্রথমে খোঁজ করে বের করতেন। যদি পবিত্র কোরআনে পেতেন তবে তা লিপিবদ্ধ করতেন। যদি না পেতেন, তাহলে নবী করীম (সাঃ)-এর সর্বশেষ আমল ও মতামত কী ছিল, তা দেখে তিনি সর্বশেষ আমল ও মতামত গ্রহণ করতেন। যদি হিজাযী ও ইরাকী সাহাবাদের 'মারফু' হাদীসসমূহের মধ্যে মতপার্থক্য হত, তাহলে ফিক্ সম্পর্কে অভিজ্ঞ বর্ণনাকারীর রেওয়ায়েতকে অগ্রাধিকার প্রদান করতেন। যদি হাদীসের দ্বারা কোন সমাধান না পাওয়া যেত, তখন ফতওয়া প্রদানকারী সাহাবা ও তাবেয়ী ও ফকীহদের ফায়সালা এবং বাণী খোঁজ করতেন এবং যে বিষয়ে ফকীহ সাহাবাদের এজমাতে একমত পাওয়া যেত, তা গ্রহণ করতেন। যদি এর মধ্যে কোন সমাধান না পেতেন, তাহলে ৪র্থ বারে কিয়াস করতেন। কোন কোন মাসআলা সম্পর্কে গবেষণা বা কিয়াস করার সময় লক্ষ্য রাখতেন যে, মাআলা যেন শরীআতের খেলাফ না হয়।
ইমাম আবূ হানীফা মাসআলাসমূহের বিন্যস্ত ও নীতিমালাসমূহের সম্পাদনা শুধু নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি বরং তাঁর বিশিষ্ট চল্লিশজন ফকীহ্ শিষ্যদেরকে নিয়ে একটি পরিষদ গঠন করেন। তাঁরা দীর্ঘ ত্রিশটি বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে হানাফী আইন লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এ সকল শিষ্যের মধ্যে আবু ইউসুফ, মুহাম্মাদ, ইয়াহ্ইয়া, হাক্স বিন গিয়াস, দাউদ তাঈ, আসাদ বিন উমর, আবদুল্লাহ বিন মুবারক, যোফার প্রমুখ ছিলেন অন্যতম। সুদীর্ঘ বাইশ (২২) বছর ফিশাস্ত্র সম্পাদনা পরিষদের একনিষ্ঠ পরিশ্রমে 'কুতুবি আবী হানীফা' শীর্ষক গ্রন্থখানি পূর্ণতা লাভ করেছিল। এতে সর্বমোট ৮৩ হাজার মাআলা ছিল। তন্মধ্যে ৩৮ হাজার ইবাদত সম্পর্কীয় এবং ৪৫ হাজার মাসায়েল্ সামাজিক ও দণ্ডবিধি সম্পর্কীয় ছিল।
ইমাম আবু হানীফার ফিক্হ সম্পাদনা পরিষদ সম্পর্কে প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ওকী বলেন:
"ইমাম আ'যমের এ মহৎ কাজে ইমাম আবূ ইউসুফ, ইমাম যোফার ও ইমাম মুহাম্মদের কিয়াস ও ইজতিহাদের বিশেষজ্ঞ অন্তর্ভুক্ত থাকা সত্ত্বেও এতে কিভাবে ত্রুটি থাকতে পারে? ইয়াহইয়া ইবনে যাকারিয়া, ইবন গিয়াস ছা'বান প্রমুখের মত হাদীসবিশারদ; কাসিম ইবনে মুঈনের মত আরবী ভাষা বিশেষজ্ঞ; দাউদ তাঈ এবং ফুযাইল ইবনে আয়াযের মত তাকওয়াধারী ব্যক্তিবর্গ পরিষদের সদস্য থাকা সত্ত্বেও এ কাজে কিভাবে ত্রুটি থাকতে পারে।"
- জামিউল মাসানিদের টীকা দ্রঃ
বংগানুবাদ মুসনাদে ইমাম আবু হানীফা (ভূমিকা), পৃঃ-৯
ফি-শাস্ত্র সম্পাদনার কাজ সমাপ্ত হওয়ার পর তিনি তাঁর সমস্ত ছাত্রকে একত্রিত হওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। কুফার জামে মসজিদে এক হাজার বিজ্ঞ আলিম একত্রিত হলেন। তাদের মধ্যে ফিক্হ সম্পাদনা পরিষদের চল্লিশজন সদস্যও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ইমাম আ'যম সকলের উদ্দেশে বললেন:
"তোমরাই আমার অন্তরের একমাত্র খুশীর মূল। তোমাদের উপস্থিতি আমার অন্তরের সমস্ত চিন্তা দূরীভূত করে থাকে। আমি তোমাদের জন্য ইসলামী ফিরে ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছি, তোমরা ইচ্ছানুযায়ী এর উপর বিচরণ করতে পার। আমি এমন অবস্থা সৃষ্টি করে দিয়েছি যে, লোকজন তোমাদের অনুসরণ করবে। আমি তোমাদের জন্য আমার গর্দান ঝুঁকিয়ে দিয়েছি। আমি আল্লাহর কসম এবং ঐ জ্ঞানের অংগীকার দিচ্ছি যা তোমাদেরকে দান করা হয়েছে- তোমরা কখনো এই ইলম (জ্ঞান) কে অসম্মান করো না। এ ইলমকে বিকৃত করার হাত হতে রক্ষা করো।"
- মুসান্নিফীন, ২য় খণ্ড দ্রঃ
বংগানুবাদ মুসনাদে ইমাম আবু হানীফা (ভূমিকা), পৃঃ-৯
ইমাম আবু হানীফার বক্তৃতার ফলে সমবেত ফিক্হবিদদের মর্যাদা বৃদ্ধি পেল। তাঁর সম্পাদিত এই ফিকহ 'ফিকহে হানাফী' নামে সমগ্র ইসলামী দুনিয়ায় খ্যাতি লাভ করে।
ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) হাদীস ও ফিশাস্ত্রে মুসলিমজাহানে যেমন প্রভাব বিস্তার করেছিলেন এবং সুনাম অর্জন করেছিলেন, ঠিক তেমনি ইসলামী 'আকাইদ'-এর উপরও তিনি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। বিশেষত মাতুরীদী মাযহাব এবং এই মাযহাবের প্রসিদ্ধ প্রবক্তাগণ সামারকান্দে ইমাম আবু হানীফার 'আকাইদ' বা ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কিত ঐতিহ্য রক্ষার দায়িত্ব বহন করেছিলেন। ইমাম আবূ হানীফা কৃত মাত্র একখানা প্রামাণিক দলীল অর্থাৎ উসমান 'আল্-বাত্তীকে লিখিত তাঁর একখানা পত্র রয়েছে। যাতে তিনি মার্জিতভাবে তাঁর মতের সমর্থন করেন। ইবনে নাদ্রীম-এর তালিকা পরবর্তী জনশ্রুতি অনুযায়ী ফিহে আকবর (২য়) নামক যে গ্রন্থটি ইমাম আ'যম কর্তৃক রচিত হয়, তাতে 'কালাম' শাস্ত্রের উৎপত্তির প্রারম্ভিক অবস্থায় ইসলামী আকাইদের রূপরেখা যেমন ছিল তেমনই বিধৃত হয়েছে। এটা সম্ভবত খৃষ্টীয় দশম শতাব্দীর প্রথমার্ধে রচিত। আরও একখানা স্বতন্ত্র 'ফিকহে আকবর' (১ম) একখানা ভাষ্যের অন্তর্ভুক্ত (মূল ও ভাষা ১৩২১ সনে হায়দারাবাদে মুদ্রিত) অবস্থায় রয়েছে। বিশুদ্ধ মূলগ্রন্থ দুষ্প্রাপ্য। এ গ্রন্থে খারিজী, কাদিরিয়া, শিয়া ও জাহামীদের আকাঈদের বিপরীত সুন্নী মতানুযায়ী ঈমানের দশটি দফা সন্নিবেশিত হয়েছে। সে দশ দফার আরও বিশদ বিশ্লেষণের প্রয়োজনে "ওয়াসিয়াতু আবী হানীফা" নামক একখানা স্বতন্ত্র পুস্তকে তা সম্পন্ন করা হয়। "আল-আলিমু ওয়াল মুতাআল্লিমু' নামক প্রশ্নোত্তর সম্বলিত একটি সংক্ষিপ্ত পুস্তকও তিনি রচনা করেন। সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ দ্রঃ। (ইসলামী বিশ্বকোষ, ১ম খণ্ড, পৃঃ-৫৬)
উমাইয়া ও আব্বাসীয় শাসকদের যুলুম ও উৎপীড়নের প্রতিবাদে ইমাম আ'যম ছিলেন সোচ্চার। শাসকেরা তাঁর ভয়ে ভীত ছিল। আব্বাসীয় খলীফা মনসূর তাঁকে প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহণ করার প্রস্তাব করলে তিনি প্রত্যাখ্যান করায় তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। কারাগারেও তাকে উৎপীড়ন করা হয়। পরিশেষে তাঁকে খাদ্যের সাথে বিষ পান করানো হয়। তিনি বিষের ক্রিয়া অনুভব করলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে সেজদায় রত হন। ঐ অবস্থায় তাঁর প্রাণ বায়ু নির্গত হয়। ১৫০ হিজরীতে রজব মাসে ইমামে আ'যমের জীবনাবসান ঘটে। বাগদাদে তাঁকে দাফন করা হয়।
মুসলিম দুনিয়ার খ্যাতনামা আলিম ও বুযর্গানে দ্বীন ইমাম আ'যম সম্পর্কে অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। তন্মধ্যে কয়েকজনের উক্তি নিচে বিবৃত হল:
فَنِّ حَدِيثٍ مِيں إِمَامُ أَبُو حَنِيفَةَ كَا كِبَارِ مُحَدِّثِينَ مِيں هُونَا أَمْرٌ ثَابِتٌ هے كِه اُنْكَا مَذْهَبُ مُحَدِّثِينَ مِيں مُعْتَبَرٌ خِيَالٌ كِيَا جَاتَا هے۔
অর্থাৎ হাদীস বিষয়ে ইমাম আবু হানীফাকে বড় বড় মুহাদ্দিসগণের মধ্যে গণ্য করা হয়। এর প্রমাণ এই যে, মুহাদ্দিসগণ তাঁর মাযহাবকে নির্ভরযোগ্য মনে করেন।
আনওয়ারুল মুকাল্লেদীন, ই,ফা, বা, পৃঃ-১০২
শায়খুল ইসলাম ইয়াযীদ ইবনে হারূন বলেন:
كَانَ أَبُو حَنِيفَةَ تَقِيًّا نَقِيًّا زَاهِدًا عَابِدًا عَالِمًا صَدُوقَ اللِّسَانِ أَحْفَظَ أَهْلِ زَمَانِهِ۔
ইমাম আবু হানীফা অত্যন্ত মুত্তাকী, পবিত্র-পরিচ্ছন্ন গুণসম্পন্ন সাধক, আলিম, সত্যবাদী ও সমসাময়িককালের অপেক্ষা হাদীসের বড় হাফেয ছিলেন।
হাদীস সংকলনের ইতিহাস, মাওঃ আবদুর রহীম, পৃঃ-২৬৬ভ
إنَّهُ وَاللَّهِ لَأَعْلَمُ هَذِهِ الْأُمَّةِ بِمَا جَاءَ عَنِ اللَّهِ وَعَنْ رَسُلِهِ
আল্লাহর শপথ, (ইমাম আবু হানীফা) তিনি বর্তমান মুসলিম মিল্লাতের মধ্যে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাত সম্পর্কে বেশী জ্ঞানী।
হাদীস সংকলনের ইতিহাস, মাওঃ আবদুর রহীম, পৃঃ-২৬৬ভ
দুনিয়ার সুবিখ্যাত মুহাদ্দিস, মুফাস্সির ও মুজতাহিদগণ ইমাম আ'যমকে শ্রেষ্ঠতম থেকে শ্রেষ্ঠতম মুহাদ্দিস ও আলিম হিসেবে বহু প্রশংসা করেছেন।
তুহফাতুল মু'মিনীন, মাওঃ শামসুদ্দীন মোহনপুরী, পৃঃ-৩৪
হযরত ইমাম আবূ হানীফা অবশ্যই 'ইমাম আ'যম' উপাধির যোগ্য ছিলেন।
তুহফাতুল মু'মিনীন, মাওঃ শামসুদ্দীন মোহনপুরী, পৃঃ-৩৪
ইমাম আ'যম একজন অত্যন্ত সূক্ষ্মদর্শী ফকীহ মুজতাহিদ ছিলেন।
তুহফাতুল মু'মিনীন, মাওঃ শামসুদ্দীন মোহনপুরী, পৃঃ-৩৪
অন্যান্য ফকীহ আলিমগণ প্রত্যেকেই ইমাম আবূ হানীফার শিষ্যসদৃশ।
তুহফাতুল মু'মিনীন, মাওঃ শামসুদ্দীন মোহনপুরী, পৃঃ-৩৪
লোকেরা ফিক্হশাস্ত্রে নিদ্রিত ছিল। ইমাম আ'যম সে বিষয়ে সকলকে জাগ্রত করেছেন।
তুহফাতুল মু'মিনীন, মাওঃ শামসুদ্দীন মোহনপুরী, পৃঃ-৩৪
ইমাম আবু হানীফা চারশত তাবিয়ী শিক্ষকের নিকট শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন, আর চারহাজার লোক তার নিকট হাদীস ও ফিক্হ শিক্ষা করেছিলেন।
তুহফাতুল মু'মিনীন, মাওঃ শামসুদ্দীন মোহনপুরী, পৃঃ-৩৪
পরিতাপের বিষয়, এমন কীর্তিমান মহাপুরুষ ইমাম আ'যম সম্পর্কে মাযহাব বিরোধীরা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে কটুক্তি করে থাকেন। তারা হানাফী মাযহাব ও তাকলীদের বিরুদ্ধাচারণ করে চলেছে। তাই, ধর্মপ্রাণ মুসলমান ও মাযহাব বিরোধীদের নিকট ইমাম আ'যমের কর্মময় জীবনের কিছু কথা তুলে ধরা হল।
আল্লাহপাক আমাদের সকলকে ইমাম আ'যম (রহঃ)-এর আদর্শে, পথে ও মতে চলার তৌফিক দান করুন এবং পরকালে তাঁরই শামিয়ানা তলে 'আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত'-এর সাথে থাকার সুযোগ দান করুন। আমীন। -বি-হুরমাতে সাইয়িদিল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয় সাল্লাম।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০১২) 'তাকলীদ' প্রত্যেকের জন্য অত্যাবশ্যক | (০১৪) আহলে হাদীস সম্প্রদায়ের প্রতি অনুরোধ |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |