'তাকলীদ' শব্দের অর্থ অন্যের আদেশ-নিষেধ, কথা, মতবাদ, চিন্তাধারা ও আদর্শকে নির্দ্বিধায় মেনে চলা। ফিশাস্ত্রের মূল নীতিমালা অর্থাৎ কোরআন, হাদীস, এজমায়ে উম্মত ও সহীহ্ কিয়াসের ভিত্তিতে ইসলামী শরীআতের মহাজ্ঞানের অধিকারী মাযহাবের ইমামগণের প্রদত্ত ব্যাখ্যা-ব্যবস্থাদি দ্বিধাহীন চিত্তে উত্তম ধারণায় মান্য করে চলাকে 'তাকলীদ' বলা হয়।
কোন স্থানে কী ব্যাখ্যা করতে হবে এবং কোন অর্থ কোথায় প্রযোজ্য হবে, মুসলিম পণ্ডিত ও গবেষকগণ তা নির্ধারিত করে দিয়েছেন। অনুরূপ ক্ষেত্রে কোরআন ও হাদীস হতে নিঃসৃত ও গৃহীত মুসলিম বিদ্বানমণ্ডলী কর্তৃক গবেষণামূলক অভিমত মেনে লওয়াকে শরীআতের পরিভাষায় 'তাকলীদ' বলা হয়।
পাক-ভারত ও বাংলাদেশে 'আহলে হাদীস' নামে একটি ধর্মীয় দল আছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা তাকলীদকে অবৈধ (নাজায়েয) বলে প্রচার করে। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে তারা তাকলীদ মেনে চলে। এই সম্প্রদায়ের অজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রই তাদের আলিমদের ব্যাখ্যা ও নির্দেশ মেনে চলে। বাস্তবক্ষেত্রে এইই 'তাকলীদ'।
প্রকৃতপক্ষে মূর্খ, নিরক্ষর ও অল্পশিক্ষিত মানুষের পক্ষে সরাসরি কোরআন ও হাদীস হতে হুকুম-আহকাম আহরণ করা অসম্ভব। এমনকি বর্তমান যুগের অনেক আলিমগণের পক্ষেও কোরআন ও হাদীস হতে গবেষণা করে মাসআলা নির্ণয় করা অত্যন্ত কঠিন। এ জন্যেই তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীনের মধ্যে বিশিষ্ট ইমাম ও মুজতাহিদগণ কোরআন-হাদীস হতে শরীআতের হুকুম-আহকাম ও মাসআলা তন্নতন্ন করে নির্ণয় করেছেন এবং ফিকহশাস্ত্র লিপিবদ্ধ করেছেন। যদি শরীআতের এ সকল মূলনীতি ও মাসআলা ফিক্হশাস্ত্রে সবিস্তারে লেখা না হত, তবে এ যুগে কোরআন ও হাদীস যথাযথভাবে আমল করা কারও পক্ষে সম্ভব হত না। অতএব, সাম্প্রতিক কালে চার মাযহাবের চার ইমামের যে কোন এক জনের তাকলীদ (অনুসরণ) করা প্রত্যেকের জন্য ওয়াজিব।
নিচে এর দলীলাদি উপস্থাপন করা হল:
فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ
যদি তোমরা না জানো, তবে বিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিকট জিজ্ঞেস করে লও।
সূরা নাহল, আয়াত নং ৪৩ (আয়াতের অংশ বিশেষ)
আরও ইরশাদ করেছেনঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ منكم
অর্থাৎ হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ, রাসূল (সাঃ) ও উলিল আমরগণের অনুসরণ কর।
সূরা নিসা, আয়াত নং ৫৯
উলিল আমরের ব্যাখ্যায় তাফসীরে কবীরে লিখিত আছে:
المُرَادُ بِقَوْلِهِ تَعَالَى أُولِي الْأَمْرِ الْعُلَمَاءُ الَّذِينَ يُفْتُونَ فِي أَحْكَامِ الشَّرِيعَةِ وَيُعَلِّمُونَ النَّاسَ دِينَهُمْ وَ هُذَا رَايَةُ التَّعْلَبِي عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ وَقَوْلُ الْحَسَنِ وَمُجَاهِدٍ وَالضَّحَاكِ -
অর্থ: যে সকল উলামা শরীআতের হুকুম-আহকাম সম্পর্কে মীমাংসা করেন এবং জনগণকে দ্বীন শিক্ষা দেন তাঁরাই উলিল আমর'। তা ছা'লাবী ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন। হাসান, মুজাহিদ ও দাহ্হাকেরও একই অভিমত। মাআরেফুল কোরআনে অনুরূপ লিখিত আছে।
তাফসীরে কবীর, ৩ খণ্ড, পৃঃ-১৮০
উল্লিখিত আয়াতসমূহে বিজ্ঞ আলিম ও ইমামদের অনুসরণ করার জন্য মুসলমানগণের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ফিক্হশাস্ত্রের পরিভাষায় এই অনুসরণের নামই হল 'তাকলীদ'।
عَنْ حُذَيْفَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنِّي لَا ادْرِي مَا بَقَائِ فِيكُمْ فَاقْتَدُوا بِالَّذِيْنِ مِنْ بَعْدِى أَبُو بَكْرٍ وَعُمَرُ -
অর্থ: হযরত হুযায়ফা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: আমি জানি না কতদিন আমি তোমাদের মাঝে থাকব। সুতরাং আমার পরে তোমরা (হযরত) আবূ বকর (রাঃ) এবং (হযরত) উমরের অনুসরণ করিও।
মিশকাতুল মাসাবিহ, আবু বকর ও উমর (রাঃ) অনুচ্ছেদ
সুতরাং একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত একজন খলীফার আনুগত্য ও অনুসরণ করার নির্দেশ নবী করীম (সাঃ) দিয়ে গেছেন। তাকেই ব্যক্তি বিশেষের তাকলীদ করা বলা হয়।
عنِ ابْنِ مَسْعُودٍ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ اقْتَدُوا بِالذَيْنِ مِنْ بَعْدِى مِنْ أَصْحَابِي أَبِي بَكْرٍ وَعُمَرَ وَاهْتَدُوا بِهَدْي عَمَّارٍ وَ تَمَسَّكُوا بِعَهْدِ ابْنِ أُمِّ عَبْدٍ وَ فِي رِوَايَةٍ حُذَيْفَةَ مَا حَدَّثَكُمْ ابْنُ مَسْعُودٍ فَصَدِّقُوهُ بَدْلَ وَ تَمَسَّكُوا بِعَهْدِ ابْنِ أَمْ عَبْدٍ -
অর্থ: হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন: আমার পর তোমরা আমার সাহাবীদের মধ্য হতে এ দুজনের- আবু বকর (রাঃ) ও উমরের অনুসরণ করিও। আম্মার (রাঃ)-এর চরিত্র অবলম্বন করিও এবং ইবনে উম্মে আবদের (ইবনে মাসউদ)র নির্দেশ দৃঢ়তার সাথে মেনে চলিও। হযরত হুযায়ফা (রাঃ)-এর এক বর্ণনায় وتمسكوا بعهد ابن ام عبد এর পরিবর্তে রয়েছে, "ইবনে মাসউদ তোমাদেরকে যা কিছু বর্ণনা করেন, তোমরা তাকে সত্য বলে জানিও।"
মিশকাতুল মাসাবিহ, বাবে জামিউল মানাকিব হাদীস নং ৫৯৩৬
আরও এক হাদীসে বর্ণিত আছে:
عن حُذَيْفَةً قَالَ قَالُوا يَارَسُولَ اللهِ لَو اسْتَخْلَفْتَ قَالَ إِنْ اسْتَحْلَفْتُ عَلَيْكُمْ فَعَصَيْتُمُوهُ عَذِّبْتُمْ وَلَكِنْ مَا حَدَّثَكُمْ حُذَيْفَةٌ فَصَدِّقُوهُ وَمَا أَقْرَتَكُمْ عَبْدُ اللَّهِ فَأَقْرَهُ وَهُ -
অর্থ: হযরত হুযায়ফা (রাঃ) বলেন, সাহাবায়ে কেরাম বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি যদি (আপন জীবদ্দশায়) একজন খলীফা নিযুক্ত করতেন। তখন তিনি বললেন, আমি যদি কাউকেও তোমাদের ওপর খলীফা নিযুক্ত করি, আর তোমরা তার বিরোধিতা কর, তাহলে তোমরা শাস্তি ভোগ করবে। (একটি কথা স্মরণ রাখিও,) হুযায়ফা তোমাদেরকে যা বলে, তা সত্য মনে করিও এবং আবদুল্লাহ অর্থাৎ আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ যা কিছু তোমাদেরকে পড়ায়, তোমরা তা পড়।
মিশকাতুল মাসাবিহ, বাবে জামিউল মানাকিব হাদীস নং ৫৯৮১
অপর এক বর্ণনায় উল্লেখ হয়েছে:
فَعَلَيْكُم بِسْتَتِى وَسُنَّةُ الخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ تَمَسَّكُوبِهَا وَعُضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِد (مسند احمد )
এক দীর্ঘ হাদীসে রাসূলে করীম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন: তোমাদের অবশ্যই অনুসরণ করে চলতে হবে আমার সুন্নাত এবং হিদায়াতপ্রাপ্ত সত্যপন্থী খলীফাদের সুন্নাত। তোমরা তা মজবুত করে ধরবে, দাঁত দিয়ে কামড়ায়ে ধরে স্থির হয়ে থাকবে।
সুন্নাত ও বিদআত, কৃত মাওঃ মুহাঃ আবদুর রহীম, পৃঃ-১৯
সুতরাং এ সমস্ত হাদীসের দ্বারা বুঝা যায় যে, ব্যক্তি বিশেষের অনুসরণ বা তাকলীদ করা বৈধ।
عنِ الأسْوَدِ بْنِ يَزِيدَ قَالَ أَتَانَا مُعَادُ بِالْيَمَنِ مُعَلِّمًا وَأَمِيرًا فَسَأَلْنَاهُ عَنْ رَجُلٍ تُوفّى وَتَرَكَ ابْنَهُ وَأَخْتَا فَقَضَى لِلْإِبْنَةِ بالنِّصْفِ وَلأُخْتِ النِّصْفِ وَرَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَى (كتاب الفرائض)
অর্থ: হযরত আসওয়াদ ইবনে ইয়াযীদ হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: হযরত মু'য়ায (রাঃ) দ্বীনী আহকামের শিক্ষক এবং গভর্নর নিযুক্ত হয়ে ইয়ামন প্রদেশে আগমন করেন। আমরা তাঁর নিকট জিজ্ঞেস করি যে, একটি কন্যা ও বোন রেখে এক ব্যক্তি মৃত্যু বরণ করেছেন। তার সম্পদ কিভাবে ভাগ-বাটোয়ারা হবে? তখন হযরত মুয়ায (রাঃ) এই নির্দেশ দিলেন যে, কন্যা ও বোন উভয়কে অর্ধাংশ হারে মৃত ব্যক্তির সম্পদের মালিক হবে। তখন রাসূল (সাঃ) জীবিত ছিলেন।
আনওয়ারুল মুকাল্লেদীন, ই,ফা,বা, পৃঃ-৪
হাদীস দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, নবী করীমের জীবদ্দশায়ই তাকলীদ প্রচলিত ছিল।
عَنْ هُذَيْلِ بْنِ شُرِّبِيلَ فِي حَدِيثٍ طَوِيلٍ مُخْتَرِهِ قَالَ سُئِلَ أَبُو مُوسَى ثُمَّ سُئِلَ ابْنُ مَسْعُودٍ وَأَخْبَرَ بِقَوْلِ أَبِي مُوسَى مُخَالِفَهُ ثُمَّ أَخْبَرَ أَبُو مُوسَى بِقَوْلِهِ فَقَالَ لَا تَسْتَلُونِي مَا دَامَ هَذَا الْبَحْرُ فيكم -
অর্থ: হযরত হুযাইল ইবনে শুরাবীল হতে বর্ণিত এই হাদীসটি সুদীর্ঘ। এর সংক্ষিপ্ত সারমর্ম এই যে, হযরত আবূ মূসা (রাঃ) কে একটি মাসআলা জিজ্ঞেস করা হয়। আবার তা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদকেও জিজ্ঞেস করা হয় এবং আবূ মূসা (রাঃ) প্রদত্ত ফতওয়ার কথাও তাকে অবহিত করা হয়। তখন হযরত ইবনে মাসউদ হযরত আবূ মূসা কর্তৃক প্রদত্ত ফতওয়ার সাথে ভিন্নমত পোষণ করেন। অতঃপর এই বিষয়টি হযরত আবূ মূসার নিকট পেশ করা হলে তিনি বলেন: যতদিন তোমাদের মাঝে এই বিদ্যার সাগর (অর্থাৎ ইবনে মাসউদ) জীবিত থাকবেন, ততদিন তোমরা আমার নিকট মাসআলা জিজ্ঞেস করো না।
আনওয়ারুল মুকাল্লেদীন, ই,ফা, বা, পৃঃ-৫
উক্ত হাদীস হতে এটাই প্রমাণিত হয় যে, ইবনে মাসউদের জীবদ্দশার প্রতিটি মাসআলা তাঁরই নিকট জিজ্ঞেস করা হত। এটাই তাকলীদে শাখসী বা ব্যক্তি বিশেষের তাকলীদ।
عَنْ عِكْرِمَةَ أَنَّ أَهْلَ الْمَدِينَةِ سَأَلُوا ابْنَ عَبَّاسٍ عَنْ امْرَأَةٍ طَافَتْ ثُمَّ حَاضَتْ قَالَ لَهُمْ تَنْفِرُ قَالُوا لَا نَأْخُذُ بِقَوْلِكَ وَنَدْعُ قَوْلَ زَيْدٍ قَالَ
إِذَا قَدِمْتُمُ الْمَدِينَةَ فَاسْتَلُوا فَقَدِمُوا الْمَدِينَةَ فَسَأَلُوا فَكَانَ فِيمَنْ -سأَلُوا أُمَّ سُلَيْمٍ فَذَكَرَتْ حَدِيثَ صَفِيَّةٌ
অর্থ: হযরত ইকরিমা (রাঃ) হতে বর্ণিত হজ্জের সময় ফরয তাওয়াফ আদায় করার পর যদি কোন মহিলার হায়েয শুরু হয়, তখন তার করণীয় কী? এ বিষয়ে মদীনাবাসী সাহাবাগণ হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, সে মহিলা চলে যাবে অর্থাৎ ফরয তওয়াফ আদায়ের পর বিদায়ী তওয়াফ-এর পূর্বে যদি কোন মহিলার হায়েয শুরু হয় তবে বিদায়ী তাওয়াক করতে হবে না। তখন মদীনাবাসীগণ বললেন, আমরা আপনার অভিমত গ্রহণ করে হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত (রাঃ)-এর অভিমত পরিত্যাগ করতে পারি না। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বললেন, তোমরা যখন মদীনায় যাবে, তখন তা জিজ্ঞেস করে নিবে। অতঃপর তাঁরা মদীনায় গিয়ে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। জিজ্ঞাসিত ব্যক্তিদের মধ্যে উম্মে সুলায়ম তখন হযরত সুফিয়ার হাদীস উল্লেখ করেছিলেন।
মুতারজম বুখারী শরীফ (উর্দু), ১ম খণ্ড, পৃঃ-৬৩৫
বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ 'ফতহুল বারী'তে মদীনাবাসীদের এ উক্তি লিপিবদ্ধ হয়েছে:
أَفْتَيْتَنَا أَوْلَمْ تُفْتِنَا زَيْدُ بْنُ ثَابِتٍ بِقَوْلِ لَا تَنْفِرُ -
অর্থ: আপনি আমাদেরকে ফতওয়া প্রদান করেন আর না করেন, হযরত যায়েদ ইবনে ছাবিত বলেছেন, হায়েয আক্রান্ত মহিলা তাওয়াফ আদায় করা ব্যতীত ফিরে যেতে পারবে না।
ফতহুল বারীতে উল্লেখ আছে:
فَقَالَتِ الأَنْصَارُ لَا تُتَابِعُكَ يَا ابْنَ عَبَّاسٍ وَأَنْتَ تُخَالِفُ زَيْدًا فَقَالَ صَلُّوا مَا جِئْتُمْ أُمَّ سُلَيْمٍ
অর্থ: আনসারগণ বললেন, হে ইবনে আব্বাস! আপনি হযরত যায়েদ ইবনে ছাবিতের বিরোধিতা করতেছেন। সুতরাং আমরা আপনার অনুসরণ করব না। অতঃপর ইবনে আব্বাস বললেন, তোমরা (মদীনায়) যেয়ে হযরত উম্মে সুলায়মকে জিজ্ঞেস করিও।
ফতহুল বারী, ৩য় খণ্ড, পৃঃ-৪৩৬ভ
এই সকল প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে জানা গেল যে, মদীনার আনসার সাহাবাগণ হযরত যায়েদ বিন ছাবেতের প্রতি নির্দ্ধিধায় তাকলীদ করতেন। আরও জানা গেল যে, হযরত ইবনে আব্বাস আনসারদের কথায় প্রতিবাদ করলেন না, বরং হযরত যায়েদ ইবনে ছাবিতের নিকটে যেয়ে মাসআলা অনুসন্ধানের কথা বললেন। সুতরাং তাকলীদ সাহাবাগণের যুগেও বিদ্যমান ছিল।
خُذُوا مِنَ الرَّأْيِ مَا يُوَافِقُ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ فَإِنَّهُمْ كَانُوا أَعْلَمَ مِنْكُمْ
অর্থাৎ তোমরা ঐ অভিমত গ্রহণ কর, যা তোমাদের পূর্ববর্তী ব্যক্তিদের অনুকূল। কেননা তাঁরা তোমাদের চেয়ে বেশী বিজ্ঞ ও জ্ঞানী ছিলেন।
মুফতী শফী কর্তৃক রচিত 'কাশফ' গ্রন্থ, ১ম খণ্ড, পৃঃ-১৭৯
এই কথার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তাকলীদের প্রয়োজন রয়েছে। অতএব, সাম্প্রতিক কালে চার ইমামের যে কোন একজনের তাকলীদ করা প্রত্যেকের জন্য ওয়াজিব।
وَمَنْ لَمْ يَبْلُغ دَرَجَةَ الْإِجْتِهَادِ يَلْزَمُهُ التَّقْلِيدُ سَوَاءٌ كَانَ عَامِيًا صَرَفًا أَوْ عَالِمًا بِبَعْضٍ عُلُومِ الْإِجْتِهَادِ -
অর্থ: ইজতিহাদ (গবেষণা) করার যোগ্যতা যার নাই, অন্য কোন মুজতাহিদের (গবেষক) তাকলীদ করা তার জন্য অত্যাবশক। ইজতিহাদ করার মত সম্যক জ্ঞানের অভাব থাকলে যে কোন অবস্থায়ই তাকে অন্যের অনুসরণ করে চলতে হবে।
ফতওয়ায়ে সিদ্দীকিয়া, প্রণেতা, মাওঃ শাহ সূফী নিসারউদ্দীন আহমদ, পৃঃ-২১০
فَإِنَّهُمْ (الْأَئِمَّةُ الْأَرْبَعَةُ) الَّذِينَ اشْتَهَرَتْ إِمَامَتُهُمْ وَتُقِرُّ طَرِيقَتُهُمْ وَثَبَتَتْ مَذَاهِبُهُمْ وَانْتَشَرَ اتِّبَاعُهُمْ
অর্থ: কেননা (৪ ইমাম) যাঁরা ইমাম হিসাবে বিখ্যাত, যাঁদের বর্ণিত অভিমত ও তরীকা প্রতিষ্ঠিত ও বিধিবদ্ধ এবং যাদের অনুসারীবৃন্দ দুনিয়াব্যাপী, অবশ্যই তাঁরা অনুসরণীয়।
ফতওয়ায়ে সিদ্দীকিয়া, প্রণেতা, মাওঃ শাহ সূফী নিসারউদ্দীন আহমদ, পৃঃ-২১১
اعْلَمُ أَنَّ الْحَصَارَ الْمَذَاهِبَ فِي الْأَرْبَعَةِ الْمَعْلُومَةِ إِنَّمَا كَانَتْ بَعْدَ الْخَمْسِ مِائَةٍ بِسَبَبِ مَوْتِ الْعُلَمَاءِ وَقُصُورِهِمْ
অর্থঃ জেনে রাখা উচিত যে, আলিমের মৃত্যু এবং তাঁদের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার ফলে হিজরী পঞ্চাশ শতাব্দীর পর মাযহাবের সংখা চারটিতে এসে সীমিত হয়।
ফতওয়ায়ে সিদ্দীকিয়া, প্রণেতা, মাওঃ শাহ সূফী নিসারউদ্দীন আহমদ, পৃঃ-২০৫
بعض مفسروں نے کہا ہے کہ فرقہ ناجیہ اہل سنت والجماعت چار مذاہب یعنی حنفی، مالکی، شافعی اور حنبلی پر جمع ہوا ہے، اور جو شخص ان چار مذاہب سے خارج ہے وہ اہل بدعت اور ناری ہے۔
অর্থ: কোন কোন তাফসীরকার বলেছেন: হানাফী, মালেকী, শাফিয়ী ও হাম্বলী এই চার মাযহাবের লোক মুক্তির অধিকারী আহলে সুন্নাত দলভুক্ত। যারা এ চার মাযহাবের বহির্ভুত, তারা বিদআতী ও জাহান্নামী।
ফতওয়ায়ে সিদ্দীকিয়া, প্রণেতা, মাওঃ শাহ সূফী নিসারউদ্দীন আহমদ, পৃঃ-২০৭
فَقَدْ صَرَّحَ فِي التَّحْرِيرِ أَنَّ الْإِجْمَاعَ انْعَقَدَ عَلَى عَدَمِ الْعَمَلِ بِمَذَاهِبِ مُخَالِفِي الْأَرْبَعَةِ لِعَدَمِ انْضِبَاطِ مَذْهَبِهِمْ وَانْتِشَارِهَا وَكَثْرَةِ اتِّبَاعِهَا۔
অর্থ: তাহরীর নামক কিতাবে স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে, চার মাযহাবের বিরোধী পঞ্চম কোন দল বা মাযহাব অনুসারে আমল করা অবৈধ- এ সম্পর্কে এজমা হয়েছে। কারণ ৪টি মাযহাব সুসংহত ও বিধিবদ্ধ। এ মাযহাবগুলো খুবই বিস্তার লাভ করেছে এবং এদের অনুসারীর সংখ্যাও অত্যাধিক।
মাযহাব ও তাকলীদ, পৃঃ-২৭
"মুজতাহিদগণের অনুসরণ করা অকাট্য ওয়াজিব।"
আরও ২০৯/২১০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে,
"পয়গম্বর ও ইমামগণের অনুসরণ করা প্রকৃতপক্ষে কোরআন শরীফের অনুসরণ করা।"
তাফসীরে কবীরের ৩/১৮০ পৃষ্ঠায় লিখিত আছে যে,
কোরআন শরীফের সূরা নিসার أُولِي الْأَمْرِ مِنْكُم আয়াতে প্রমাণিত হয় যে, সাধারণ লোকের পক্ষে বিদ্বানগণের (মুজতাহিদগণ) তাকলীদ করা ওয়াজিব।
কামিউল মুবতাদেয়ীন, প্রণেতা, মাওঃ রূহুল আমীন বসিরহাটী, পৃঃ-৭৪২-৭৪৩
"সূরা নাহলের ৪৩ নং আয়াতের অংশ فَاسْتَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِن كُنتُم لَا تَعْلَمُونَ - অতএব জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর, যদি তোমাদের জানা না থাকে' বাক্যটি যদিও বিশেষ বিষয়বস্তু সম্পর্কে বলা হয়েছে, কিন্তু ভাষা ব্যাপক হওয়ার কারণে এ জাতীয় সব ব্যাপারকে শামিল করে। তাই কোরআনী বর্ণনা ভংগির দিক দিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ যুক্তিগত ও ইতিহাসগত বিধি যে, যারা বিধি-বিধানের, জ্ঞান রাখে না, তারা যারা জানে তাদের কাছে জিজ্ঞেস করে নেবে এবং তাদের কথা মত কাজ করা জ্ঞানহীনদের ওপর ফরয হবে। একেই তাকলীদ (অনুসরণ) বলা হয়। এটা কোরআনে স্পষ্ট নির্দেশ এবং যুক্তিগতভাবেও এ পথ ছাড়া আমল অর্থাৎ কর্মকে ব্যাপক করার আর কোন উপায় নেই। সাহাবীদের যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত কোনরূপ মতানৈক্য ছাড়াই এ বিধি পালিত হয়ে আসছে। যারা তাকলীদ অস্বীকার করে, তারাও এ তাকলীদ অস্বীকার করে না যে, যারা আলেম নয়, আলেমদের কাছ থেকে ফতওয়া নিয়ে কাজ করবে। বলাবাহুল্য, আলিমেরা যদি অজ্ঞ জনসাধারণকে কোরআন ও হাদীসের প্রমাণাদি বলেও দেন, তবে তারা এগুলোকে আলেমদের ওপর আস্থার ভিত্তিতেই গ্রহণ করবে। কারণ, তাদের মধ্যে প্রমাণাদিকে বোঝা ও পরখ করার কোন নির্দেশকে শরীআতের নির্দেশ মনে করে পালন করার নামই 'তাকলীদ'। এ তাকলীদ যে বৈধ বরং জরুরী, তাতে কোনরূপ মতবিরোধের অবকাশ নেই।
এ কারণেই আলিম, মুহাদ্দিস ও ফিকহবিদগণ, ইমাম গাযালী, ইমাম রাযী, তিরমিযী, তাহাবী, ইবনে হুমাম, ইবনে কুদামা এবং এ শ্রেণীর আরও লক্ষ লক্ষ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী আলিম আরবী ভাষা ও শরীআত সম্পর্কে গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও ইজতিহাদী মাসআলাসমূহে সর্বদা মুজতাহিদ ইমামদেরকে তাকলীদ করে গিয়েছেন। তাঁরা সকলেই ইমামের বিপরীতে নিজ মতে কোন ফতওয়া দেওয়াকে বৈধ মনে করেনি।"
الحاصل، ائمہ مجتہدین کی تقلید و اتباع بامر اللہ سبحانہ وتعالیٰ ہے، اور ان کی اطاعت، اطاعتِ امرِ اللہ سبحانہ وتعالیٰ ہے، اور ان کی اطاعت عبادتِ اللہ سبحانہ وتعالیٰ ہے، سو عوام مومنین کو اور جس کو رتبۂ اجتہاد حاصل نہیں، ائمہ مجتہدین کی تقلید و اتباع لازم و فرض ہے۔
অর্থ: বস্তুত মুজতাহিদ ইমামগণের তাকলীদ এবং তাঁদের অনুসরণ করার আল্লাহ তা'য়ালার নির্দেশ রয়েছে। তাঁদের অনুসরণ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর অনুসরণ এবং ইবাদাতের মধ্যে গণ্য। সুতরাং সাধারণ মুসলিম এবং যেসব মানুষের ইজতিহাদের যোগ্যতা নেই, তাদের সকলের জন্য মুজতাহিদ ইমামগণের তাকলীদ করা অত্যন্ত জরুরী এবং ফরয।
মাযহাব ও তাকলীদ, পৃঃ-২১
"যে প্রসিদ্ধ মাযহাবগুলোর সত্যতা জ্ঞাণীগণ কর্তৃক সমর্থিত হয়েছে, তা ইমাম আবূ হানীফা, ইমাম মালিক, ইমাম শাফিয়ী ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল এই চতুষ্টয়ের চার মাযহাবের মধ্যে ইমাম আবু হানীফার মাযহাব সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত ও উত্তম। যেহেতু তিনি তাঁদের মধ্যে দক্ষতা, তীক্ষ্ণ মেধা, মাসআলা সিদ্ধান্তে তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, কোরআন হাদীসের স্মধিক অভিজ্ঞতা ও আহকাম সংক্রান্ত বিদ্যায় ন্যায্য মত প্রকাশ ইত্যাদি বিষয়ে বিশেষত্ব লাভ করেছিলেন।
কামিউল মুবতাদেয়ীন, প্রণেতা, মাওঃ রূহুল আমীন বসিরহাটী, পৃঃ-১১৮
"এই নাজি সম্প্রদায় (সুন্নাতুল জামাআত) বর্তমানে চার মাযহাবে সমবেত হয়েছে- হানাফী, শাফিয়ী, মালেকী ও হাম্বলী। যে ব্যক্তি এ চার মাযহাব হতে খারিজ হয়, সে ব্যাক্তি বিদআতী ও দোযখী।"
কামিউল মুবতাদেয়ীন, প্রণেতা, মাওঃ রূহুল আমীন বসিরহাটী, পৃঃ-১১৬ - ১১৭
اور ائمہ اربعہ کے مقلدین اپنے ائمہ کی طرف منسوب ہو کر حنفی، مالکی، شافعی، حنبلی کے نام سے مشہور ہیں، اس کا مطلب صرف یہی ہے کہ ان کو ایک دوسرے سے امتیاز حاصل ہو، ورنہ حقیقت میں ہر ایک فرقہ محمدی ہے، اور ان کا اپنے امام کے مسلک پر چلنا اور ان کی تقلید کرنا عین طریقۂ نبویہ پر چلنا ہے، جو شخص اس نسبت سے عار کرتا ہے اور شریعت کے مخالف سمجھتا ہے وہ خود گمراہ ہے اور لوگوں کو گمراہ کرتا ہے۔
অর্থাৎ ইমাম চতুষ্টয়ের মুকাল্লিদ (অনুসারী) লোকগণ স্ব-স্ব ইমামের নামানুসারে হানাফী, মালেকী, শাফিয়ী ও হাম্বলী বলে কথিত হবার কারণ এই যে, তা মাযহাব চতুষ্টয়ের পৃথক পৃথক নামকরণ হয়েছে। মূলত সকলেই মুহাম্মদী অর্থাৎ হযরত (সাঃ)-এর অনুগামী এবং নিজ নিজ ইমামের তাকলীদ করত তাঁদের অনুসরণ করাই প্রকৃত প্রস্তাবে হযরত (সাঃ)-এর অনুসরণ করা। ইমামগণের সাথে এই সম্বন্ধকে যারা দোষারোপ করে এবং তা শরীআতের বহির্ভূত বলে ধারণা করে তারা নিজেরাও ভ্রান্ত এবং অপরকেও পথভ্রষ্ট করে।
ফতওয়ায়ে সিদ্দীকিয়া, প্রণেতা, মাওঃ শাহসূফী নিসারউদ্দীন আহমদ, পৃঃ-২০৮
উপরোক্ত আলোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, মাযহাব চতুষ্টয়ের ইমামগণের মধ্যে যে কোন একজনের তাকলীদ বা মতানুসরণ করা ওয়াজিব। শরীআতে এর গুরুত্ব এরূপ যে, মানিত এক মাযহাব পরিত্যাগ করে অন্য মাযহাবে যাওয়া কারও পক্ষে জায়েয নেই।
'তাফসীরে আহমদীতে মোল্লাজিওন (রহঃ) উল্লেখ করেছেনঃ "যদি বলতে চাও যে, মাযহাব চতুষ্টয়ের একটির সাথে অপরটির মতভেদ আছে। এই মতভেদ সম্বলিত মাযহাবগুলোর মধ্যে মাত্র যে কোনও একটি সত্য হবে। সবগুলোই সত্য কিরূপে সম্ভব? এর উত্তর এই যে, যেখানে মতভেদ আছে সেখানে একটি সত্য, অর্থাৎ যা ইমাম আবু হানীফা (রঃ) বলেছেন, তাই সত্য। কিংবা যা হযরত ইমাম শাফিয়ী (রঃ) বলেছেন তাই সত্য, অথবা অপর দুটির যে কোন একটি সত্য, এরূপ ধারণা হতে পারে। এ হিসাবে প্রত্যেকটিই সত্য বলে তাকলীদ করা যেতে পারে। সুতরাং চার ইমামের যে কোনও একজনের তাকলীদ করলেই মুকাল্লিদের ওয়াজিব আদায় হবে।
ولكِنْ يَنْبَغِي أَنْ يُقَلِّدُوا أَحَدًا الْتَزَمَهُ وَلَا يَؤُلُ إِلَى أَخَرَ
কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, যার তাকলীদ একবার করা হয়েছে, তাঁকে পরিত্যাগ করে অন্য মাযহাবে যাওয়া জায়েয হবে না।"
দুররুল মুখতারের তা'জিরের অধ্যায়ে লিখিত আছে-
مَنِ ارْتَحَلَ إِلَى مَذْهَبِ الشَّافِعِيِّ يُعَزِّزُ
অর্থাৎ যে ব্যক্তি মাযহাব পরিত্যাগ করে শাফিয়ী (বা অন্য কোন মাযহাব) গ্রহণ করে সে শাস্তির যোগ্য।
'সিরাজিয়া' কিতাবে তা'জিরের অধ্যায়ে লিখিত আছে-
"আবূ হাফ্স কবীর বুখারীর পুত্র, আবদুল্লাহ তৎপুত্র আবু হাম্স শাফিয়ীগণের আধিক্যবশত উক্ত মাযহাব অবলম্বন করেছেন। এতে তার প্রতি শাস্তি ও দেশত্যাগের আদেশ হয়েছিল।"
কানযুল উম্মাল' হতে মাওঃ আবদুল হক মুহাজিরে মক্কী (রহঃ) একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন:
سَيَكُونُ أَقْوَامُ مِّنْ أُمَّتِي يُغَلِطُونَ فُقَهَاءَ هُم بَعْضَ الْمَسَائِلِ أُولَئِكَ شِرَارُ أُمَّتِي
অর্থাৎ আমার উম্মাতগণের মধ্যে শীঘ্রই কয়েকটি সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হবে, যারা ফকীহগণের কোন কোন মাসআলা ভুল মনে করবে, তারা আমার মধ্যে জঘন্য।
ফতওয়ায়ে সিদ্দীকিয়া, প্রণেতা, মাওঃ শাহসূফী নিসারউদ্দীন আহমদ, পৃঃ-২১৮, ২২১
উপরোল্লেখিত কোরআন, হাদীস এবং ইসলামী বিদ্বানগণের উক্তিসমূহের ভিত্তিতে স্পষ্টই প্রতিভাত হয় যে, তথাকথিত আহলে হাদীস সম্প্রদায় মাযহাব মান্য করা ও তাকলীদ করা যে বিদআত ও অবৈধ মনে করেন, তা বাতিলযোগ্য প্রমাণিত হল; বরং সাম্প্রতিককালে সকল মুমিন ও মুসলমানকে চার মাযহাবের যে কোন মাযহাবের অনুসারী হতে হবে।
চার মাযহাবের মধ্যে ছোট খাটো ব্যাপারে মত পার্থক্য থাকলেও এদের মধ্যে মৌলিক বিষয়ে পার্থক্য নেই। তাঁরা একে অন্যের মাযহাবকে অনুমোদন দান করেছেন। চার মাযহাবের ইমাম চতুষ্টয়ের মধ্যে ইজতিহাদের শক্তি ছিল অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। তৎকালীন ইসলামী পাণ্ডিত্যে তাঁদের যে কোন জুড়ি ছিল না, তা সকল বিদ্বানগণ স্বীকার করেছেন। এ কারণেই আলিম 'সমাজ ও মুসলিম জনসাধারণ চার মাযহাবকে স্বীকার করেছেন। তবে একথা সর্বোতভাবে উল্লেখযোগ্য যে, মুসলিমজাহানে দুই তৃতীয়াংশ মুসলমান হানাফী মাযহাবের মুকাল্লিদ বা অনুসারী। আজ হতে প্রায় ১২৫০ বছর পূর্ব হতে মুসলিম জগতের প্রসিদ্ধ মহাজ্ঞানী, মুহাদ্দিস, ফকীহ, মুফাসসির, মুজতাহিদ, এককথায় সর্বশ্রেণীর অগণিত হকপন্থী আলিমগণ ইমাম আযম আবূ হানীফা (রহঃ)-এর শ্রেষ্ঠতম খাঁটি হানাফী মাযহাবের অনুসরণ করে আসছেন। হাশরের ময়দানে ১২০ কাতারের মধ্যে আমাদের প্রিয়নবী (সাঃ)-এর উম্মত আশি কাতার হবে। তাই হানাফী মাযহাব পন্থীদের সৌভাগ্যের বিষয় যে, মহানবীর উম্মত যেমন অন্যান্য সমস্ত উম্মতের তুলনায় দুই-তৃতীয়াংশ হবে, তেমনি বর্তমান হানাফী মাযহাবপন্থী গোটাবিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ। সুতরাং হানাফী দলই সবচেয়ে বড় মুসলিম দল।
কাফের মুশরিক গোটা বিশাল ভারতে যে সমস্ত কামেল অলীগণের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ লোক ইসলামে দীক্ষিত হয়েছে, যাঁদের উছিলাতে আমরাও মুসলমান নামে পরিচিত ও গৌরবান্বিত, তাঁরা ছিলেন সকলেই হানাফী মাযহাবের অনুগামী। সবিশেষ উল্লেখ্য যে, ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত বুযুর্গ ও আলিম খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী আজমিরী, খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া, মুজাদ্দেদ আলফেসানী, শাহ্ বায়জীদ বুস্তামী, শাহ্ মাখদুম, শাহ জালাল, বাকী বিল্লাহ, মোল্লা আলী কারী, মোল্লাজিওন, কাযী সানাউল্লাহ পানিপথী, সৈয়দ আহমদ কিরানবী, কারামত আলী জৌনপুরী, এমদাদ উল্লাহ মুজাহিরে মক্কী, রশীদ আহমদ গাংগুহী, আনওয়ার শাহ, কাশমীরী, মাওঃ থানবী, ফুরফুরার পীর আবু বকর সিদ্দীকী (রঃ) প্রমুখ অগণিত বুযর্গানে দ্বীন ও ইসলামী পণ্ডিতগণ হানাফী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। বিশ্ববিখ্যাত আলিম শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী (রহঃ)-এর মধ্যে ইজতিহাদ করার মত যথেষ্ট যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তিনি ইমাম আ'যম আবু হানীফা (রহঃ)-এর তাকলীদ বা অনুসরণ করেছেন।
পরিতাপের বিষয়, মাযহাব ও তাকলীদ বিরোধীরা সাম্প্রতিক কালে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে মাযহাব ও তাকলীদের বিরুদ্ধাচরণ করে চলছে। তাই ধর্মপ্রাণ মুসলিমদেরকে মাযহাবের গুরুত্ব এবং ইমাম আ'যম (রহঃ)-এর গুরুত্ব বুঝা আমাদের ধর্মীয় কর্তব্য। আল্লাহপাক আমাদেরকে হানাফী মাযহাবের গুরুত্ব অনুভব এবং মাযহাবের রীতিনীতি যথাযথভাবে পালনের তৌফিক দিন।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০১১) 'কিয়াস' শরীআতের একটি অকাট্য দলীল | (০১৩) ইমাম আ'যম আবূ হানীফা (রহঃ) সম্পর্কে কিছু কথা |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |