ইসলামী জীবন ব্যবস্থার বাস্তব রূপ হল 'শরীআত'। আর শরীআতের প্রধান উৎস হল কোরআন ও সুন্নাহ। শরীআতী কানুনের আরও দু'টি উৎসের সন্ধান পাওয়া যায়: একটি এজমা, অপরটি কিয়াস। সুতরাং কোরআন, সুন্নাহ, এজমা ও কিয়াস- এই চারটি বিষয়বস্তু শরীআতের মৌলিক ভিত্তি হিসেবে পরিগণিত।
'কিয়াস' শব্দের আভিধানিক অর্থ হল, অনুমান করা, তুলনা করা, সাদৃশ্য ভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ইত্যাদি। শরীআতের পরিভাষায় কোরআন, হাদীস ও এজমার (ঐক্যমত) সিদ্ধান্তকে দৃষ্টান্তরূপে গ্রহণ করে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান কল্পে পূর্বের আইন প্রয়োগ করাকে 'কিয়াস' বলে। কিয়াস সেই ক্ষেত্রে প্রয়োগ হয় যে ক্ষেত্রে কোরআন, হাদীস ও এজমায়ে সরাসরি সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় না।
নবী করীম (সাঃ)-এর ইন্তেকালের পরে আল্লাহর 'ওহী' আসা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মুসলমানদের জন্য রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিষয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। নবী করীম (সাঃ) যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন কোন সমস্যা দেখা দিলে তিনি সরাসরি তার সমাধান দিতেন। কিন্তু তাঁর ইন্তেকালের পরে সে সম্ভাবনা রহিত হয়ে যায়। উপরন্তু বিশ্বের দিকে দিকে ইসলাম বিস্তৃতি লাভের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন নতুন সংকট দানা বেঁধে উঠে। এই প্রেক্ষাপটে সাহাবায়ে কেরাম কোরআন ও হাদীস পূর্ব দৃষ্টান্তরূপে গ্রহণ করে কোরআন সুন্নাহ অনুযায়ী নতুন নতুন সমস্যাগুলোর সমাধান দিয়েছেন বিশুদ্ধ বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগ করে। যে সকল ব্যাপারে কোরআন, সুন্নাহ ও এজমায় কোন সিদ্ধান্তের উল্লেখ নেই, কিন্তু মূলনীতি আছে, সেই সকল ব্যাপারে কিয়াস প্রযুক্ত হয়ে থাকে।
প্রকৃতপক্ষে যে প্রশ্নে কোরআন-হাদীস নিশ্চুপ এবং এজমা অনুপস্থিত, সে প্রশ্নের তখন সমাধানের প্রয়োজন, তখন তার সমাধান কোথায় পাওয়া যাবে, সুন্নী মাযহাবের সকল ইমাম সমন্বয়ে বলেন, ঐ সময় সমাধানের জন্য কোরআন, হাদীস ও এজমার আলোকে কিয়াসের মাধ্যমে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। বস্তুত কিয়াস কোরআন ও হাদীসের আইনকে সম্প্রসারণ করে। সুতরাং ইসলামী শরীআতে কিয়াসের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
কিন্তু দুঃখের বিষয় মুসলিম সমাজের কোন কোন মহল কিয়াসকে বিদআত বা নবোদ্ভাবিত বিষয় বলে আখ্যায়িত করে। বস্তুত তা বিদআত নয়। তা ইসলামী ব্যবস্থায় কিছুমাত্র নতুন জিনিস নয়। স্বয়ং রাসূলে করীম (সাঃ) এবং খুলাফায়ে রাশিদীন কর্তৃক তা পূর্ণমাত্রায় ব্যবহৃত হয়েছে।
নিচে এর প্রমাণ উপস্থাপন করা হল:
১। মুজাদ্দিদ আলফেসানী শায়খ আহমদ সরহিন্দী (রঃ) বলেছেনঃ
وَأَمَّا الْقِيَاسُ وَالْإِجْتِهَادُ فَلَيْسَ مِنَ الْبِدْعَةِ فِي شَيْءٍ فَإِنَّهُ مُظْهِرُ لِمَعْنَى النُّصُوصِ لَا مُثْبِتُ لِأَمْرِ زَائِدٍ -
অর্থাৎ কিয়াস ও ইজতিহাদ (গবেষণা বা সামগ্রিক প্রচেষ্টা) কে কোনভাবেই বিদআত বলা যেতে পারে না। কেননা, তা মূল কোরআন-হাদীসের দলীলই প্রকাশিত করে, কোন নতুন অতিরিক্ত জিনিস প্রমাণ করে না।
মাকতুবাতে রব্বানী, দ্বিতীয় দফতর
উল্লেখ্য যে, ইমাম শাফিয়ীর মতে কিয়াস ও ইজতিহাদ শব্দ দু'টির একই ভাবার্থ। যে বিশেষ প্রক্রিয়ায় যাচাই করে কোরআন-সুন্নাহ হতে শরীআতের মাসআলা বা ফিকহ্ বের করা হয়, সে বিশেষ প্রক্রিয়ার নাম 'ইজতিহাদ'। যিনি ইজতিহাদ করেন তাকে 'মুজতাহিদ' বলা হয়। মুজতাহিদগণ যুগোপযোগী ইসলামের যে কোন সমস্যার সমাধান দিয়ে থাকেন। আবার মুজতাহিদকে 'ইমাম' বলা হয়। যাঁর সমাধান সমাজে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়, তিনিই শরীআতের 'ইমাম' বলে গণ্য হন। অন্যদিকে কিয়াস ও ইজতিহাদ ফিকহের সংগে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কিয়াসকে ফিরে অন্যতম মূলনীতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সুতরাং স্পষ্টতই বলা যায়, কিয়াস শরীআতের একটি অকাট্য দলীল। নবী করীম (সাঃ)-এর ইন্তেকালের পরই কিয়াসের প্রসার ঘটে এবং এর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। অবশ্য নবী (সাঃ)-এর জীবদ্দশায়ও সাহাবীগণ কোন কোন সময় কিয়াস অনুসারে আমল করেছেন। তাই বলা যায়, কিয়াস কোন বিদআত নয়। নিচে তার প্রমাণ পেশ করা হল:
২। নবী করীম (সাঃ)-এর তিরোধানের কিছুদিন পূর্বে হিজরী দশম বর্ষে সাহাবী হযরত মুয়ায (রাঃ) কে ইয়ামানে কাযী (বিচারক) নিযুক্ত করে পাঠাবার সময় নবী করীম জিজ্ঞেস করলেন, "তুমি কিসের মাধ্যমে বিচারকার্য সম্পাদন করবে? হযরত মুয়ায উত্তরে বললেন, "কোরআন অনুসারে বিচার করব।' নবী (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, "যদি নির্দিষ্ট বিষয়ে কোরআনে সমাধান না থাকে, তবে কি করবে?" তখন তিনি বললেন, "হুযূর (সাঃ)-এর সুন্নাত মুতাবিক বিচার করব।" হুযূর (সাঃ) তাঁকে পুনরায় প্রশ্ন করলেন, "যদি সুন্নাত হাদীসে তার সমাধান না থাকে?” মুয়ায (রাঃ) বললেন, أجتهد براي আমি আমার ব্যক্তিগত কিয়াস বা রায় অনুসারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব।" তখন আল্লাহর রাসূল মুয়াযের বুকে মৃদু করাঘাত করে বললেন, 'প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আল্লাহর রাসূল (সাঃ)-এর দূত দ্বারা এমন উত্তর দেওয়ালেন যাতে তিনি সন্তুষ্ট হলেন। " (জামে' তিরমিযী, বাবুল আহকাম, হাদীস নং ১২৬৬)
সুনানে আবূ দাউদ শরীফে অনুরূপ হাদীস বর্ণিত আছে। নবী করীম (সাঃ) সাহাবাগণকে ইজতিহাদ ও কিয়াস করার জন্য যে উৎসাহ দান করতেন উপরোক্ত হাদীস হতে এর প্রমাণ পাওয়া যায়।
৩। উপরোক্ত মর্মে হাদীস শরীফে আরও উল্লেখ হয়েছে:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رضِ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا حَكَمَ الْحَاكِمُ فَاجْتَهَدَ فَأَصَابَ فَلَهُ أَجْرَانٍ وَإِذَا حَكَمَ فَأَخْطَا فَلَهُ اجر واحد -
'অর্থাৎ হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন যে, বিচারক যখন ফায়সালা করে, তখন তিনি (প্রয়োজনে) ইজতিহাদ করেন। অতঃপর যখন সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায়, তখন তাঁর জন্য দু'টি পুরস্কার রয়েছে।
ইমাম আবু ঈসা (রহঃ) বলেন, হাদীসটি হাসান ও গরীব।
(জামে' তিরমিযী, বাবুল আহকাম, হাদীস নং ১২৬৫)
উল্লেখ্য যে, বুখারী শরীফে হযরত আমর ইবনুল আস (রাঃ) কর্তৃক অনুরূপ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। মুসলিম শরীফেও অনুরূপ বর্ণিত আছে।
এই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হল যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইজতিহাদ বা কিয়াসের মাধ্যমে বিচারের ফায়সালা করতে অনুপ্রাণিত করেছেন।
৪। হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন:
ماراء الْمُسْلِمُونَ حَسَنًا فَهُوَ عِنْدَ اللَّهِ حَسَنُ وَمَارَا .. الْمُسْلِمُونَ فَبِيْتًا فَهُوَ عِنْدَ اللَّهِ قَبِيحُ (احمد)
অর্থাৎ মুসলিম সমাজ সামগ্রিকভাবে শরীআতের দৃষ্টিতে যা সিদ্ধান্ত করবে, তা আল্লাহর নিকটে ভাল ও উত্তমরূপে গৃহীত হবে এবং মুসলমানগণ যাকে খারাপ ও জঘন্য মনে করবে, তাই খারাপ ও জঘন্য বলে আল্লাহর নিকট গণ্য হবে।
(আহমদ)
ইমাম ইবনুল কাইউম (রহঃ) লিখেছেন যে, "নবী করীম (সাঃ)-এর জীবদ্দশায়ই সাহাবায়ে কেরাম ইজতিহাদ ও কিয়াস করেছেন- এমন অনেক ঘটনাই উল্লেখ হয়েছে। বিশেষত যখন কোন বিষয়ে কোরআন ও হাদীসে শরীআতের মূল দলীল পাওয়া না যাবে, তখন ইজতিহাদ ও কিয়াস করা ছাড়া শরীআত পালনের কোন উপায় থাকে না। (যাদুল মা'আদ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃঃ-৬২৪)
৫। সাহাবায়ে কেরাম আজমাঈন (রাঃ) নিজেরাও কিয়াস ব্যবহার করতেন।
নবী করীম (সাঃ) যখন মৃত্যুশয্যায় তখন হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) নামাযের ইমামতি করেছেন। হযরত নবী করীম (সাঃ)-এর তিরোধানের পর সাহাবীগণ হযরত আবূ বকর (রাঃ)-এর নামাযের ইমামতির উপর কিয়াস করে বলেছেন, যদি আমরা তাঁকে ধর্মীয় নেতৃত্বের জন্য পছন্দ করতে পারি, তাহলে পার্থিব বিষয়ের জন্য কেন তাঁকে খলীফা নির্বাচন করতে পারব না? হযরত উমর (রাঃ) হযরত আবূ মূসা আশআরী (রাঃ) কে বলেছেন, "উপমা ও দৃষ্টান্তগুলো জেনে ও বুঝে লও। অতঃপর বিবেচনাধীন সমস্যাগুলোর সমাধানকল্পে তার ওপর কিয়াস কর।" অবশ্য কালের বিবর্তনে সুবিন্যস্তভাবে হাদীস ও ফিক্ শাস্ত্র বিকাশে কিয়াসও একটি বিশেষ তত্ত্বগত রূপ লাভ করে। ইমাম শাফিয়ী (রহঃ) তাঁর বিশাল গ্রন্থ 'রিসালা'তে সর্বপ্রথম কিয়াসের জন্য বিবিধ নীতিমালা প্রণয়ন করেন। ইমাম শাফিয়ীর পূর্বে ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম মালিকও ব্যাপকভাবে কিয়াস ব্যবহার করেন। তবে ইমাম শাফিয়ী কোরআন ও হাদীসের দলীল প্রয়োগ করে কিয়াসের প্রামাণিকতা অকাট্যরূপে উপস্থাপন করেন। কিয়াস প্রয়োগ যে শরীআতের অন্যতম উৎস তার প্রতি মুসলিম উম্মাহর এজমা হয়ে গেছে। (উচ্চ মাধ্যমিক ইসলাম শিক্ষা, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃঃ-১৬৯)
৬। নাসায়ী শরীফ হাদীস গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছেঃ
عن طَارِقٍ أَنَّ رَجُلًا أَجْنَبَ فَلَمْ يُصَلِّ فَأَتَى النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَذَكَرَ ذَلِكَ فَقَالَ أَصَبْتَ فَاجْنَبُ رَجُلٌ أَخَرُ فَتَيَمَّمُ
وَصَلَّى فَقَالَ نَحْوَا مِمَّا قَالَ لِلْآخَرِ - يَعْنِي أَصَبْتَ
অর্থাৎ হযরত তারিক (রাঃ) হতে বর্ণিত, কোন এক ব্যক্তির ওপর গোসল ফরয হলে, সে নামায পড়ল না। অতঃপর সে ব্যক্তি নবী (সাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে ঘটনা বর্ণনা করল। তখন তিনি বললেন: 'তুমি ঠিক কাজই করেছ।"
অতঃপর অন্য এক ব্যক্তির ওপর গোসল ফরয হল। সে তায়াম্মুম করে নামায পড়ল। অতঃপর এই ব্যক্তি এসে নবী (সাঃ)-এর নিকট ঘটনা বর্ণনা করল। পূর্বোক্ত ব্যক্তিকে নবী (সাঃ) যা বলেছিলেন, এই ব্যক্তিকেও তিনি তাই বললেন। অর্থাৎ তুমিও সঠিক কাজই করেছ।
ফরয গোসলের জন্য পানি না পাওয়া গেলে কী করতে হবে- প্রথমোক্ত ব্যক্তির জানা ছিল না। তাই সে ব্যক্তি নামায পড়া হতে বিরত থেকেছিল। কারণ মাসআলা অজানা থাকার ফলে সে ব্যক্তির পক্ষে আমল করা সম্ভবপর হয়নি। এজন্যই নবী করীম (সাঃ) তাঁর পদক্ষেপ সঠিক বলে বর্ণনা করেন।
পানি পাওয়া না গেলে অথবা পানি ব্যবহার করা ক্ষতিকর হলে ওযূর পরিবর্তে তায়াম্মুম করা জায়েয আছে কিনা তা তারও জানা ছিল না। এমতাবস্থায় ওযূর তায়াম্মুমের ওপর কিয়াস করে দ্বিতীয় ব্যক্তি গোসলের স্থলে তায়াম্মুম করে নামায আদায় করল। প্রকৃতপক্ষে, দ্বিতীয় ব্যক্তির কিয়াস করার এই প্রয়াস একটি সঠিক পদক্ষেপ ছিল। তাই নবী করীম (সাঃ) তার এ কাজকেও একটি সঠিক পদক্ষেপ বলে অভিহিত করেছিলেন।
উক্ত হাদীস দ্বারা বুঝা গেল যে, সাহাবাগণ নবী (সাঃ)-এর সময়ে কিয়াস করতেন। (নাসায়ী শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃঃ-৪৯ (হাশিয়ায়ে ইশফাকী))
৭। কোরআন শরীফের সূরা আলে ইমরানের ৫৯ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে:
إِنَّ مَثَلَ عِيْسُ عِنْدَ اللَّهِ كَمَثَلِ أَدَمَ
অর্থাৎ নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট ঈসার অবস্থা আদমের অবস্থার ন্যায়।
কোরআন পাকের এই আয়াতের অংশ বিশেষ হতে জানা যায় যে, কিয়াস শরীআতের দলীল। কেননা, আল্লাহ তা'য়ালা ইরশাদ করেছেন: হযরত ঈসা (আঃ)-এর জন্ম হযরত আদম (আঃ)-এর জন্মের অনুরূপ। অর্থাৎ আদম (আঃ) কে যেমন পিতা-মাতা ব্যতীত সৃষ্টি করা হয়েছে, ঈসা (আঃ) কেও তদ্রূপ পিতা ব্যতীত সৃষ্টি করা হয়েছে। অতএব, এখানে আল্লাহ তা'য়ালা ঈসা (আঃ)-এর সৃষ্টিকে আদম (আঃ)-এর সৃষ্টির ওপর কিয়াস করার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। (মাযহারী দ্রঃ)
৮। কোরআন শরীফও মানুষকে কিয়াস-এর প্রতি উৎসাহিত করেছে, উৎসাহিত করেছে বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগ ও চিন্তা-গবেষণার প্রতি। আল্লাহ পাকের ইরশাদ: (সূরা হাশর)
فَاعْتَبِرُوا يَأُولِي الْأَبْصَارِ
অর্থাৎ হে চক্ষুষ্মান ব্যক্তিগণ! তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।
এই আয়াতে আল্লাহ পাক কোন বস্তুকে তার সমপর্যায়ের বস্তুর সাথে কিয়াস বা অনুমান করার নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ পাক আরও ইরশাদ করেন: (সূরা মুহাম্মদ)
أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَى قُلُوبٍ أَقْفَالُهَا
অর্থাৎ তবে কি তারা কোরআন সম্বন্ধে অভিনিবেশসহকারে চিন্তা-গবেষণা করে না? না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ?
ইসলামের প্রথম যুগে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের পথ কোরআন শরীফ ও রাসূল পাক (সাঃ)-এর সুন্নাহর ওপরই নির্ভরশীল হতে হয়। প্রাথমিক যুগের খলীফাদের আমলে রাষ্ট্র বিস্তৃতি লাভ করলে ধর্মীয় ও পার্থিব সম্বন্ধীয় সমস্যা সমাধানে সম্পূর্ণ নতুন চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণার প্রয়োজন দেখা দেয়। লোকেরা নতুন মাসআলাসমূহের মীমাংসা করতে কোরআন ও হাদীসের আলোকে নিজেদের বুদ্ধি-বিবেচনা প্রয়োগ করতে বাধ্য হল।
হযরত নবী করীম (সাঃ)-এর তিরোধানের পর সাহাবায়ে কেরামগণ কোরআন ও হাদীসের আলোকে নতুন নতুন সমস্যার সমাধান করতেন। পরবর্তীকালে ইসলামের চার মাযহাবের ইমামগণও কিয়াস প্রয়োগ করে অগণিত সমস্যার সমাধান করেন।
কিয়াসকে ইসলামী শরীআতের দলীল বা উৎস হিসেবে বিবেচনা করা না হলে ইসলাম যে একটি শাশ্বত পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা তা প্রমাণ করা সম্ভব হত না। সুতরাং স্পষ্টত বলা যায় যে, কিয়াস শরীয়াতের দলীল এবং চতুর্থ মৌল উৎস। কোরআন, হাদীস ও যুক্তির কষ্টি পাথরে প্রমাণিত।
৯। ইমাম শা'বী (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, হযরত উমর (রাঃ) কাযী শুরায়হের নিকট লিখেছিলেন যে, প্রথমে কোন মাসআলা কোরআন শরীফে পেলে অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করো না, আর এতে না পেলে হাদীসের অনুসরণ কর। আর এতে না পেলে নিজ মতে কিয়াস কর। আরও ইমাম শা'বী হযরত উমর রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, হাদীসের পরে মুসলমানগণের এজমা মান্য কর, অভাবে কিয়াস করতে পার। (ফতহুল বারী-১৩/২২৪/২২৫)
১০। ইমাম ইবনে হাজার আসক্বালানী (রহঃ) লিখেছেন, যা বহুসংখ্যক মুজতাহিদগণ একবাক্যে স্বীকার করেছেন, তাই দলীল হবে। নিশ্চয়ই সাহাবীগণ, তাবিয়ীগণ ও শহরসমূহের ফকীহগণ কিয়াস করেছেন। (ফতহুল বারী-১৩/২৩২)
১১। 'এনসাফ' নামক কিতাবে উদ্ধৃত হয়েছে:
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) যদি কোন বিষয় জিজ্ঞাসিত হতেন, তবে কোরআন অনুযায়ী হুকুম করতেন, যদি হাদীসে না থাকে, তবে হযরত আবূ বকর ও হযরত উমরের মতানুযায়ী হুকুম করতেন। যদি না থাকে, তবে কিয়াস করতেন। (কামিউল মুবতাদেয়ীন, প্রণেতা, মাওঃ রূহুল আমীন বসিরহাটী)
১২। 'গায়াতুল আওতার' নামক কিতাবে আছে:
سنت سے قول اور فعل اور تقریر رسول كريم صلى الله عليه وسلم مراد هے ۔ تقریر اس سے عبارت هے که کوئ امر حضرت کے سامنے ہو اور حضرت نے اسکو جائز رکھا اس پرانکار نہ کیا اور صحابہ کرام کے اقوال تو سنت میں داخل ھے اور اجماع سے مراد ان لوگونکا اجماع هے جنکے اجماع شمار کے لائق ہے چنانچه صحابه کرام اور تمام مجتهدین عصر کا اتفاق اور تعامل ناس یعنی لوگونکا عمل رائج هو تو اجماع کا تابع ہے اور قیاس سے مراد وہ قیاس ہے جو کتاب اور سنت اور اجماع سے مستنبط ہو۔
অর্থাৎ হযরত রাসূল (সাঃ)-এর কাজ, কর্ম ও যে কাজ রাসূল (সাঃ)-এর সম্মুখে হয়েছে এবং তিনি তা সমর্থন বা অনুমোদন করেছেন- নিষেধ করেন নাই, তাই হাদীস। সাহাবীগণের উক্তিও হাদীসের মধ্যে গণ্য।
এজমা বলতে যে সকল আলেমদের এজমা বুঝতে হবে। সুতরাং সাহাবায়ে কেরাম, মাননীয় মুজতাহিদগণ এবং তাআমুলে নাস বা সর্ব সাধারণ মুসলমানের মধ্যে প্রচলিত আমল যা শরীআতের আলিমগণ নিষেধ করেন নাই। তাও এজমার অন্তর্ভুক্ত। কোরআন শরীফ, হাদীস শরীফ এবং এজমা হতে যা বের হয়েছে, তাই কিয়াস।
ফতওয়ালে সিদ্দীকিয়া, প্রণেতা, মাওঃ শাহসূফী নিসার উদ্দীন আহমদ, পৃঃ-২২৫-২২৬
১৩। ইমাম নববী (রহঃ) 'তাহযীবুল আসমা' গ্রন্থে লিখেছেন: ইমামুল হারামাইন বলেছেন, "বিচক্ষণবিদ্বানগণের 'মত' এই যে, কিয়াস অমান্যকারীগণ উম্মতের আলিম ও শরীআতের বাহক শ্রেণীর মধ্যে গণ্য হতে পারে না।"
'ইকদুল জিদ' গ্রন্থে উল্লেখ হয়েছে, "খারেজী দলকে কাযী করা জায়েয নয়, যেহেতু তারা এজমা অমান্য করে, শিয়া দলকে কাযী করাও জায়েয নয়, যেহেতু তারা কিয়াস অমান্য করে।"
কামিউল মুবতাদেয়ীন কিতাবে মাওঃ রূহুল আমীন (রহঃ) বলেন, খারিজী, শিয়া, মু'তাযিলা ও মরজিয়া এই ভ্রান্ত দলগুলো এজমা ও কিয়াস অমান্য করে থাকে। মাযহাববিদ্বেষীগণ উক্ত মতাবলম্বন করলে 'সুন্নাত জামাআত' হতে খারিজ হয়ে যাবে। (কামিউল মুবতাদেয়ীন, প্রণেতা, মাও: রূহুল আমীন বসিরহাটী)
১৪। মুহাম্মাদী বা আহলে হাদীস মৌঃ সিদ্দীক হাসান সাহেব 'রওজা নাদিয়া' নামক গ্রন্থে লিখেছেন:
فَيُقَالُ أَدِلَّةُ الشَّرْعِ أَرْبَعَةُ الْقُرْآنُ وَالْحَدِيثُ وَالْإِجْمَاعُ وَالْقِيَاسُ
শরীআতের চারটি দলীল- কোরআন, হাদীস, এজমা ও কিয়াস।
মুহাম্মাদীগণের 'তাকভিয়াতুল ঈমান' পুস্তকের ১১৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখিত হয়েছে:
تو یسی بات پر مجتهدون کے قیاس صحیح کے موافق عمل کرنے پر وہ مجتهد بهی ایسا هو که جس کا اجتهاد امت کے اکثر عالم مسلمانوں نے قبول کیا جیسی امام اعظم اورامام شافعی اور امام مالک اور امام احمد رح
অর্থাৎ কোরআন হাদীস ও এজমায়ে যে কোন মাসআলা প্রমাণিত না হয়, উক্ত মাসআলায় ইমাম আ'যম, ইমাম শাফিয়ী, ইমাম মালিক ও ইমাম আহমদ (রহঃ)-র কিয়াসী সিদ্ধান্ত মান্য করতে হবে। কেননা জগতের অধিকাংশ আলিম তাঁদের মাযহাব মান্য করেছেন।
উপরোক্ত পুস্তকের ঈমান অধ্যায়ের ৩ পৃষ্ঠায় আরও উদ্ধৃত হয়েছে:
مجتہدوں سے اپنے اجتہاد سے نکالا وہ بھی سنت میں داخل ہے۔
অর্থাৎ মুজতাহিদগণের কিয়াসী মাসআলাও নবীর সুন্নাতের মধ্যে গণ্য হবে।
সাইফুল মুকাল্লিদীন, প্রণেতা, মাওঃ ইবরাহীম মুহাব্বাতপুরী, পৃঃ-২২০-২২১
১৫। ইমাম আ'যম আবু হানীফা (রহঃ) কোরআন, হাদীস ও এজমা অনুসরণে কিয়াস করে সহস্রাধিক মাসআলা ইসতিম্বাত বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। এ জন্য তাঁকে 'আহলুর রায়' ও কেয়াসকারী বলা হয়ে থাকে। এ কোন অপবাদ নয়, বরং সত্য কথা বলা হয়।
ইমাম শায়বানী মালিকী বলেছেন,
"যে ব্যক্তি ইমাম আ'যমকে কোরআন হাদীসের বিরুদ্ধে কিয়াস ও রায়দানকারী বলবে, সে ব্যক্তি শত্রু, অজ্ঞান, হতভাগা ও অভিশাপগ্রস্ত হবে।"
কোরআন হাদীস এবং শরীআতে যে যে দলীল নির্ধারিত হয়েছে অর্থাৎ এজমা ও কিয়াস, এই চতুষ্টয় হতে আবিষ্কৃত মাসআলাসমূহকে ফিক্হ বলে। এই ফিকহ্-তত্ত্ববিদগণের দু'শ্রেণী হয়েছে- আহলে রায় ও আহলে কিয়াস। আহলে হাদীসগণ কোরআন ও হাদীস মান্য করে থাকেন, সেইরূপ আহলে রায়গণ
কোরআন ও হাদীস মান্য করে থাকেন। আরও যেরূপ আহলে রায়গণ কোরআন ও হাদীসে কোন মাসআলা পেলে কিয়াস করে থাকেন, সেরূপ আহলে হাদীসগণও এরূপ ক্ষেত্রে কিয়াস করে থাকেন। 'আহলে রায়'-এর অর্থ ইজতিহাদশক্তিসম্মত ইমামগণ। যে ইমামগণ কোরআন ও হাদীসের মহাতত্ত্বদর্শী, কোরআন, হাদীস, এজমা ও কিয়াস হতে আহকাম প্রকাশ করার শক্তি রাখেন, তাঁরাই 'আহলে রায়' হবেন।
রবিয়া ইবনে আবী আবদির রহমান, সুফইয়ান সওরী, মালেক ইবনে আনাস, আওযায়ী, ইমাম শাফিয়ী, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম প্রভৃতি সিহাহসিত্তার প্রণেতাগণ আহলে রায় ছিলেন। আরও সাহাবা, তাবিয়ী ও তাবে' তাবেয়ীগণ রায় ও কিয়াস করে অবস্থা বিশেষে শরীআতের ব্যবস্থা বিধান করেছেন। কাজেই যিনি যে পরিমাণ রায় ও কিয়াস করেছেন, তাকে সে পরিমাণ আহলে রায় ও কিয়াসকারী বলা সংগত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কেবলমাত্র ইমাম আ'যমকে আহলে রায় ও কিয়াসকারী বলে দুর্নাম রটনা করা হয়ে থাকে। (কামিউল মুবতাদেয়ীন, প্রণেতা, মাওঃ রূহুল আমীন বসিরহাটী, পৃঃ-২৫, ২৬. ৫৯)
উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে أولى الْأَبْصَارِ বিচক্ষণ জ্ঞানী মানবসমাজকে কিয়াস করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেছেন। আর রাসূলে পাক (সাঃ) সাহাবীগণের শরীআত সম্পর্কিত বিবিধ কিয়াসকে অকুণ্ঠচিত্তে সমর্থন করেছেন। সুতরাং কিয়াস নতুন সৃষ্ট কোন বিষয় নয়, বরং তা কোরআন, সুন্নাহ ও এজমা হতে গৃহীত অবরোহমূলক সিদ্ধান্ত। এজমা ও কিয়াসের বুনিয়াদ কোরআন ও সুন্নাহর ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ জন্যই ইমাম আ'যম আবূ হানীফা (রহঃ), ইমাম শাফিয়ী (রগঃ), ইমাম মালিক (রহঃ) ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহঃ) এবং অন্যান্য বিশিষ্ট মুজতাহিদগণ কিয়াসের মাধ্যমে শরীআতের বহু বিষয়ে ফয়সালা দান করেছেন।
অতএব, 'কিয়াস' শরীআতের একটি অকাট্য বা মৌলিক দলীল। একে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০১০) সূরা ফাতিহা ব্যতীত জানাযার নামায | (০১২) 'তাকলীদ' প্রত্যেকের জন্য অত্যাবশ্যক |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |