তাসলীম বাদ আরয- দুঃখের সাথে বলতে হয় যে, সারা দুনিয়ার বিধর্মীরা আজ ঐক্যবদ্ধ। তারা নিজেদেরকে একটি সমান্তরাল রেখায় ঐক্যবদ্ধ করেছে। ঐ ঐক্যের কারণে আজ তারা উন্নতির শিখরে। ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা তাদেরকে এ সাফল্য এনে দিয়েছে। কিন্তু মুসলিম জাতি আজ সম্পূর্ণ পিছিয়ে। তারা নিজেদের ঐতিহ্যকে হারিয়ে ফেলেছে। তারা আজ বিবাদ-বিসম্বাদে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে; নানা কারণে একতা বিনষ্ট করে ফেলেছে। অথচ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুসলিম জাতিকে নির্দেশ দিয়েছেন:
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا (قرآن)
অর্থাৎ তোমরা একত্রিত হয়ে আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ়ভাবে আকড়িয়ে ধরো, আর দলাদলি করো না।
আল্লাহ পাক আরো নির্দেশ দিয়েছেন:
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ -
অর্থাৎ নিশ্চয়ই ঈমানদারগণ পরস্পর ভাই ভাই, অতএব তোমরা তোমাদের ভাইয়ের মধ্যে আপস-মীমাংসা করে দাও।
(হুজুরাত-১০)
মুসলমানদের মধ্যে ঝগড়া-ফাসাদ ও মত পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক। আর এ মতপার্থক্য নবী করীম (সাঃ)-এর প্রিয় সাহাবীগণের যুগ থেকেই চলে এসেছে। তাঁরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতবিরোধ করেছেন:
যেমন:
"বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ আনসারী বলেছেন, আলিমগণ সহজ মত দ্বীনের প্রচারক ছিলেন, আর সর্বাদা ফতওয়াদাতাগণ মতভেদ করেছেন। একজন এক বস্তুকে হালাল বলেছেন, অন্যজন তা হারাম বলেছেন। কিন্তু তাঁরা একে অপরকে দোষারোপ। করতো না। "
কামিউল মুবতাদেয়ীন, ৩য় খণ্ড, প্রণেতা, মাওঃ রূহুল আমীন বসিরহাটী, পৃঃ-১২-১৩
"সাহাবাগণের মতভেদ হওয়ার জন্য চার মাযহাবের ভিন্ন ভিন্ন মত হয়েছে। সাহাবাগণের ভিন্ন ভিন্ন মতের অনুসরণ করতে এ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে: নবী (সাঃ) বলেন, আমার সাহাবাগণ নক্ষত্র তুল্য, তোমরা তাঁদের মধ্যে যে কোন একজনের অনুসরণ করবে, সত্য পথ প্রাপ্ত হবে।"
কামিউল মুবতাদেয়ীন, ৩য় খণ্ড, প্রণেতা, মাওঃ রূহুল আমীন বসিরহাটী, পৃঃ-১০
"সাহাবা, তাবিয়ী ও তাবেতাবিয়ীগণের মধ্যে একদল নামাযে বিসমিল্লাহ পড়তেন, আরেকদল পড়তেন না; একদল উচ্চস্বরে বিসমিল্লাহ পড়তেন, আরেক দল চুপে চুপে পড়তেন; একদল ফজরে 'কুনূত' পড়তেন, আরেকদল পড়তেন না, একদল লিংগ স্পর্শ ও কামভাবে স্ত্রীলোক স্পর্শ করার জন্য ওযূ করতেন, আরেকদল ওযু করতেন না ইত্যাদি মাসআলাসমূহে তাঁরা মতভেদ করতেন।
কামিউল মুবতাদেয়ীন, ৩য় খণ্ড, প্রণেতা, মাওঃ রূহুল আমীন বসিরহাটী, পৃঃ-১২
উপরোক্ত বর্ণনার দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, সাহাবা, তাবেয়ীন ও পরবর্তী যুগের ইমাম, মুহাদ্দিস ও ফকীহগণের মধ্যে অসংখ্য মতভেদ ছিল। এতদসত্ত্বেও তাঁদের পরস্পরের সৌহার্দ্য, আন্তরিকতা ও শ্রদ্ধাবোধ অক্ষুণ্ণ ছিল। এ সব মতপার্থক্য কোন দোষের বিষয় নয়। কারণ, নবী করীম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন যে, আমার উম্মতের ইখতিলাফ (মতভেদ) রহমতস্বরূপ। আল্লাহ ও রাসূল সেই ইখতিলাফ নিষেধ করেছেন, যা ফিতনা-ফাসাদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সে কারণেই সাহাবায়ে কেরাম ও পরবর্তী যুগের আহলে ইলম (বিদ্বানগণ) দের পরস্পরে ইজতিহাদী মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তাঁদের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও ভালবাসা অক্ষুণ্ণ ছিল।
অতএব দুঃখের সাথে বলতে হয় যে, দীর্ঘকাল যাবত আহলে হাদীস সম্প্রদায় হানাফী মাযহাবের প্রতি এবং ইমাম আ'যম আবূ হানীফা (রহঃ)-এর প্রতি কটাক্ষ ও বিষোদগার করে মসলিম উম্মাহ'র মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ ও রেষারেষির বীজ ছড়াচ্ছে। ভবিষ্যতে এটা দাংগা-হাংগামার রূপ নিতেও পারে। এ সুযোগে ইসলামের দুশমনগণ মুসলিম মিল্লাতের একতা ও সংহতি বিনষ্ট করতে পারে। এটা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। বিশেষত আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অবস্থা শোচনীয়। আজ বাংলাদেশের মুসলমানেরা শতদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একদল আরেকদলকে দেখতে পারে না। এক আলেম আরেক আলেমকে দেখতে পারে না। এক পীর আরেক পীরকে সহ্য করতে পারে না। একভাই আরেক ভাইকে কাফের ও মুরতাদ বলতে দ্বিধাবোধ করে না। না, না, এটা ঠিক নয়। আমরা কিন্তু মুসলমান, আমরা উম্মতে মুহাম্মাদী। আমাদের এক আল্লাহ, এক রাসূল, এক কোরআন, এক কিবলাহ হওয়া সত্ত্বেও আমরা একতাবদ্ধ হতে পারবো না কেন?
ছোট ছোট মুস্তাহাব বিষয় নিয়ে আমরা ঝগড়া করি, অথচ সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন ও মাযহাবের ইমামদের দেখুন- তাঁরা একে অপরকে কতটা শ্রদ্ধা করতেন এবং মুসলিম ঐক্যের প্রতি কতটা সতর্ক ছিলেন। হযরত আলী (রাঃ) ও হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ)-এর মধ্যে যখন যুদ্ধ চলছিল, তখন রোম সম্রাট হযরত মুয়াবিয়ার কাছে প্রস্তাব পাঠান যে, আপনি যদি বলেন তাহলে আপনার বিরোধী পক্ষ আলীর বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। হযরত মুয়াবিয়া তার জবাবে বলেছিলেন,
"হে রোম সম্রাট! শুনে রাখো, যদি তুমি ও তোমার সৈন্যবাহিনী হযরত আলীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অগ্রসর হয়, তবে আমি আমার ভাই আলীর সাথে মিলিত হয়ে উভয়ে একত্রিত হয়ে তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো।"
ইসলামের শত্রুর বিরুদ্ধে তারা কতটা ঐক্যবদ্ধ ছিলেন, এ ঘটনাটি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মুসলমানদের একটাই দল। ইহুদী, নাসারা, বৌদ্ধ, জৈন, নাস্তিক প্রভৃতি দল থেকে বেরিয়ে এসে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু কায়েম করে একটা দল তৈরী হয়ে গেল- সেটা হলো মুসলমান। আর মুসলমানরাই ঐক্যবদ্ধ এক জাতি।
ঐক্যবদ্ধ জীবন ছাড়া ইসলামের অস্তিত্বই কল্পনা করা যায় না। একতাবদ্ধভাবে না থাকলে নামায, রোযা পালন না করা সত্ত্বেও শক্তির আশা অবাস্তব বলা হয়েছে। হাদীস শরীফে এরূপ উল্লেখ হয়েছে। এ কথার উপর জোর দিয়ে নবী করীম (সাঃ) ঘোষণা করেছেনঃ
"জামা'আতের প্রতি আল্লাহর রহমতের হাত সম্প্রসারিত থাকে। যে জামা'আত থেকে বেরিয়ে গেল সে দোযখের অগ্নির মুখে ঝাঁপ দিল।"
- তিরমিযী
অতএব, আহলে হাদীস ভাইদের খেদমতে আরয মাযহাবী কোন্দল, ফতওয়া-ফারায়েয ও হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করে আমরা সকলেই পরস্পর ভাই ভাই হিসেবে ঐক্যবদ্ধ হই এবং পরস্পরকে শ্রদ্ধা করতে শিখি।
আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে এ কর্তব্য যথাযথভাবে পালনের তৌফিক দান করুন। আমীন!
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০১৩) ইমাম আ'যম আবূ হানীফা (রহঃ) সম্পর্কে কিছু কথা | (০১৫) স্বাক্ষরকারী আলিমগণ |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |