তারাবীর নামায বিশ রাকআত সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। এই নামায জামাতের সাথে আদায় করা সুন্নাত। নবী করীম (সাঃ) বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাকআতে তারাবীহ নামায আদায় করেছিলেন। তিনি বিশ রাকআতও তারাবীহর নামায আদায় করেছেন। তবে হযরত উমর (রাঃ)-এর খিলাফতকালে সাহাবায়ে কেরামদের এজমা দ্বারা রমযান মাসের মধ্যে বিশ রাকআত তারাবীহ এর নামায জামাতের সাথে আদায় করার রীতির প্রচলন হয়। এই জন্যই হানাফীগণ তারাবীহের নামায বিশ রাকআত আদায় করে থাকেন। নিচে এর প্রমাণাদি আলোকপাত করা হল।
عَنِ ابْنِ عُمَرَ رَضِ اللَّهُ عَنْهُ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُصَلِّي فِي غَيْرِ جَمَاعَةٍ بِعِشْرِينَ رَكْعَةً وَالْوِتْرُ -
অর্থঃ হযরত ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রমযান মাসে (একাকী) বিশ রাকআত (তারাবীহ) নামায আদায় করতেন। অতঃপর বিতর নামায পড়তেন।
উচ্চ মাধ্যমিক ইসঃ স্টাডিজ, কৃত আবদুল মান্নান খান, পৃঃ-৪০৬
عَنْ سَائِبِ ابْنِ يَزِيدَ قَالَ كَانُوا يُقِيمُونَ عَلَى عَهْدِ عُمَرَ ابْنِ الْخَطَابِ فِي شَهْرِ رَمَضَانَ بِعِشْرِينَ رَكْعَةً وَعَلَى عَهْدِ عُثْمَانَ وَعَلِي مِثْلُهُ
অর্থ: হযরত সায়েব ইবনে ইয়াযীদ (রাঃ) বলেন: হযরত উমরের যমানায় তাঁরা সকলেই রমযান মাসে (প্রত্যেক রাত্রি) বিশ রাকআত করে তারাবীহর নামায পাঠ করতেন। উসমান ও আলী (রাঃ)-এর যমানায়ও তদ্রূপ পড়া হতো।
মুওয়াত্তায়ে ইমাম মালেক, পৃঃ-৪৫।
رَوَى ابْنُ أَبِي شَيْبَةَ وَالطَّبَرَانِي وَالْبَيْهَقِي مِنْ حَدِيثِ ابْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يُصَلِّي فِي رَمَضَانَ . عشْرِينَ رَكْعَةً سِوَى الْوَتْرِ
অর্থঃ হযরত ইবনু আবূ শায়বা, তাবরানী ও ইমাম বায়হাকী হযরত ইবনে আব্বাসের হাদীস বর্ণনা করেছেন- নবী করীম (সাঃ) রমযানের রাত্রিতে বিতর ব্যতীত বিশ রাকআত নামায (তারাবীহ) আদায় করতেন।
হাশিয়ায়ে বুখারী শরীফ, পৃঃ-১৫৪।
عَنْ يَزِيدَ بْنِ رُوْمَانَ قَالَ كَانَ النَّاسُ يَقُومُونَ فِي زَمَنِ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ بِثَلَاثٍ وَعِشْرِينَ رَكْعَةٌ
অর্থাৎ হযরত ইয়াযীদ ইবনে রাউমান হতে বর্ণিত আছে- হযরত উমর (রাঃ)-এর সময় মানুষ বিতরসহ তেইশ রাকআত তারাবীহর নামায পড়তেন।
মুওয়াত্তায়ে ইমাম মালেক, পৃঃ-৪৫।
عَنْ أَبِي الْحَسَنِ أَنَّ عَلِيًّا أَمَرَ رَجُلًا يُصَلِّي بِهِمْ فِي رَمَضَانَ )) عِشْرِينَ رَكْعَة -
অর্থ: হযরত আবুল হাসান হতে বর্ণিত আছে- রমযানে মুসল্লিসহ বিশ রাকআত নামায পড়ার জন্য হযরত আলী (রাঃ) এক ব্যক্তিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। (ইবনে আবী শায়বা)
আনওয়ারুল মুকাল্লেদীন, ই,ফা, বা, পৃঃ-৬৪
عَنْ زَيْدِ بْنِ وَهَابٍ قَالَ كَانَ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ مَسْعُودٍ يُصَلِّي لَنَا انا فِي شَهْرِ رَمَضَانَ قَالَ الْأَعْمَشُ كَانَ يُصَلِّي عِشْرِينَ رَكْعَةً وَيُؤْتِرُ بثلاث -
অর্থ: হযরত যায়েদ ইবনে ওয়াহাব হতে বর্ণিত আছে- তিনি বলেছেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) রমযান মাসে আমাদের নামায পড়াতেন। হযরত আ'মাশ বলেন- হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বিশ রাকআত নামায পড়তেন এবং বিতর তিন রাকআত পড়তেন। আইনী গ্রন্থ দ্রঃ।
আনওয়ারুল মুকাল্লেদীন, ই,ফা, বা, পৃঃ-৬৪
اختلفَ أَهْلُ الْعِلْمِ فِي قِيَامِ رَمَضَانَ فَرَأَى بَعْضُهُمْ أَنْ تُصَلَّى إحْدَى وَارْبَعِينَ رَكْعَةٌ مَعَ الْوِتْرِ وَهُوَ قَوْلُ أَهْلِ الْمَدِينَةِ وَالْعَمَلَ عَلَى هُذَا عِنْدَهُمْ بِالْمَدِينَةِ وَأَكْثَرُ أَهْلِ الْعِلْمِ عَلَى مَا رُوِيَ عَنْ عُمَرَ وَعَلي وَغَيْرِهِمَا مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عِشْرِينَ رَكْعَةً وَهُوَ قَوْلُ الثَّورِى وَابْنُ الْمُبَارَكِ وَالشَّافِعِي وَقَالَ الشَّافِعِي وَهُكَذَا أَدْرَكْتُ بِبَلَدِنَا بِمَكَّةَ يُصَلُّونَ عِشْرِينَ رَكْعَةٌ
অনুবাদ: রমযানের কিয়াম (তারাবীহ) সম্পর্কে আলিমগণের মতভেদ রয়েছে। কোন কোন আলিম বলেন: বিতরসহ এর রাকআত একচল্লিশ। তা হল মদীনাবাসীদের অভিমত এবং মদীনাবাসীদেরও এরূপ আমল রয়েছে। অধিকাংশ আলিমের অভিমত হযরত উমর ও হযরত আলী প্রমুখ সাহাবায়ে কেরাম হতে বর্ণনানুযায়ী (তারাবীহ) রাকআত সংখ্যা হলা বিশ। সুফইয়ান সওরী, ইবনে মুবারক ও শাফিয়ীর এই অভিমত। ইমাম শাফিয়ী বলেন, আমাদের নগর মক্কায়ও এ ধরনের আমল দেখেছি। তারা বিশ রাকআত (তারাবীহ) নামায আদায় করেন।
উর্দু মুতারজম তিরমিযী শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃঃ-৩৯৮
صلى النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِهِمْ ثَلَاثُ لَيَالِي وَلَهُمْ يُصَلِّي مَعَهُمْ مَخَافَةَ الْوُجُوبِ فِي رَمَضَانَ بِالْجَمَاعَةِ لِارْتِفَاعِ المانع مَعَ اتَّفَاقِ الصَّحَابَةِ فِي زَمَنِ عُمَرَ رَضِ وَبَعْدَهُ وَيُصَلُّونَ عشْرِينَ رَكْعَةٌ لأَنَّهُ رُوِيَ عَنْ جَابِرٍ رض أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ صلى بِهِمْ فِي هَذِهِ اللَّيَالِي عِشْرِينَ رَكْعَةٌ (رواه ابن ابی شيبة)
আনুবাদ: হযরত ইবনে আবূ শায়বা বর্ণনা করেন: সাহাবাগণসহ নবী করীম (সাঃ) মাত্র তিন রাত্রি তারাবীহ-এর নামায পড়েছিলেন। এই নামাযে নবী করীমের সাথে সাহাবাগণ শরীক হয়েছিলেন বটে, কিন্তু নবী করীম সাহাবাগণকে এই নামাযের জন্য আহ্বান করে একত্র করেন নাই। কারণ এর ফলে এই নামায (তারাবীহ) ওয়াজিব হয়ে যাওয়ার আশংকা ছিল। এই আশংকা দূরীভূত হওয়ার কারণে এবং বিশ রাকআত তারাবীহ সম্পর্কে হযরত উমর (রাঃ)-এর সময় ও পরবর্তীকালে সাহাবাগণের একমত হওয়ার ফলে জামায়াত সহকারে এ নামায পড়া সুন্নাত হিসেবে গৃহীত হয়। কেননা হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে-নবী করীম (সাঃ) সাহাবাগণসহ ঐ রাত্রিগুলোতে বিশ রাকআত তারাবীহ পড়েছিলেন।
আনওয়ারুল মুকাল্লেদীন, ই,ফা, বা, পৃঃ-৬৫
"এই কথাটি প্রসিদ্ধ যে, তারাবীহ এর নামায বিশ রাকআত। বিশ রাকআত সম্বন্ধীয় হাদীস নবী করীম হতে হযরত ইবনে আব্বাস কর্তৃক বর্ণিত। আব্দ ইবন হুমাইদ 'মুসান্নাফ' গ্রন্থে, ইমাম বাগুবী 'মুজাম' গ্রন্থে, ইমাম তাবরানী 'আল-কবীর' গ্রন্থে ও ইমাম বায়হাকী 'সুনান' গ্রন্থে এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। প্রত্যেকেই ইবন আবী শায়বার সনদ অনুসরণ করেছেন। হযরত ইবনে আবদুল বার বলেছেন- এটাই অধিকাংশ উলামার অভিমত এবং কুফাবাসীগণ, ইমাম শাফিয়ী ও অধিকাংশ ফিকহশাস্ত্রবিদ একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এটাই হযরত উবাই ইবনে কা'ব (রাঃ) হতে ব্যক্ত করেছেন। এটাই হযরত উবাই ইবনে কা'ব (রাঃ) হতে বিশুদ্ধভাবে সাহাবাদের মতভেদ ব্যতীত বর্ণিত হয়েছে।"
আনওয়ারুল মুকাল্লেদীন, ই,ফা, বা, পৃঃ-৬৫
قالَ الْعَلَامَةُ الْحَجَرُ مَكَى إِجْمَاعُ الصَّحَابَةِ عَلَى أَنَّ التَّرَاوِيحَ عِشْرِينَ رَكْعَةٌ .
আল্লামা ইবনে হাজার মক্কী বলেন, সাহাবাগণ এ বিষয়ে একমত যে, তারাবীহ নামায বিশ রাকআত।
উমদাতুল ক্বারী, ৫ম খণ্ড, পৃঃ-৩৫৫-৩৫৭
অতএব, ইমাম আযম আবু হানীফা ও তাঁর অনুসারী ফকীহগণের গৃহীত মতানুযায়ী তারাবীহ-এর নামায বিশ রাকআত জামাতের সাথে আদায় করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। হযরত নবী করীম (সাঃ) হতে প্রত্যক্ষভাবে ছাবেত না হলেও পরোক্ষভাবে ছাবেত হয়েছে। কারণ এটা অবশ্যই সহীহ হাদীসে ছাবেত হয়েছে যে, নবী করীম (সাঃ) রমযানের তিন রাত্রি অর্থাৎ ২৩, ২৫ ও ২৭শে রমযানে তারাবীহের নামায সাহাবাদের সংগে পড়েছিলেন। এরপর ত্যাগ করেছিলেন এবং বলেছিলেন, তোমাদের ওপর তা ফরয হবার আশংকা করেছিলাম। মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী প্রভৃতি হাদীস গ্রন্থে অত্র হাদীস বর্ণিত হয়েছে। হযরত উমর (রাঃ) বিশ রাকআত জামাতের সাথে তারাবীহের নামায আদায় করেছেন, তা সহীহ হাদীসে উল্লেখ আছে। সুতরাং তা আমাদের অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়। এর বরখেলাফ করলে আমরা গোনাহগার হবো। কারণ নবী করীম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন:
فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ الْمَهْدِيِّينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعُضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِد (مسند احمد )
"তোমাদের অনুসরণ করে চলতে হবে আমার সুন্নাত এবং হিদায়াতপ্রাপ্ত সত্যপন্থী খলীফাদের সুন্নাত। তোমরা তা শক্ত করে ধরবে, দাঁত দিয়ে কামড়ায়ে ধরে স্থির হয়ে থাকবে। (যেন কোন অবস্থায়-ই তা হাতছাড়া হয়ে না যায়, তোমরা তা হতে বিচ্ছিন্ন ও বিচ্যুত হয়ে না পড়ো।"
অতএব খুলাফায়ে রাশেদীন চতুষ্টয় তারাবীহের নামায বিশ রাকআতের পক্ষে সমর্থন করেছেন, বিধায় আমাদেরকেও তারাবীহ-এর নামায বিশ রাকআত আদায় করতে হবে।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০০৬) বিতর নামায এক রাকআত নয়- তিন রাকআত | (০০৮) ছয় তাকবীরে ঈদের নামায |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |