বিতর নামায তিন রাকআত। ইমাম আ'যম আবূ হানীফা (রহঃ)-এর মতে এটা ওয়াজিব। ইমাম শাফিয়ী (রহঃ)-এর মতে বিত্রের নামায সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। এই ব্যাপারে ইমাম শাফিয়ীর তিনটি উক্তি রয়েছে। প্রথমটি হল, ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর অনুরূপ। দ্বিতীয়টি হল, দুই সালামে তিন রাকআত। দুই রাকআত পড়ার পর তাশাহ্হুদ পড়ে সালাম ফিরাতে হবে। অতঃপর এক রাকআত পড়ে তাশাহ্হুদ এবং সালাম ফিরাতে হবে। তৃতীয়টি হল, ইচ্ছা করলে এক সালামে তিন রাকআতও পড়তে পারে অথবা শুধু এক রাকআতও পড়তে পারে। ইমাম আ'যম আবূ হানীফা (রহঃ)-এর অনুসারীগণ বিতর নামায এক সালামে তিন রাকআত পড়ে থাকেন। এটাই অধিক সহীহ হাদীসসম্মত। প্রমাণস্বরূপ নিচে কিছু সহীহ্ হাদীস পেশ করা হল:
عَنِ ابْنِ عُمَرَ رَض قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ اللَّهَ زَادَكُمْ صَلوةٌ وَهِيَ وِتْرُ وَفِي رِوَايَةٍ إِنَّ اللَّهَ افْتَرَضَ عَلَيْكُمْ وَزَادَكُمُ الْوِتْرَ - وَفِي رِوَايَةٍ إِنَّ اللهَ زَادَكُمْ صَلوةٌ وَهِيَ الْوِتْرُ فَحَافِظُوا عَلَيْهَا -
অনুবাদ: হযরত ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন: আল্লাহ তাআলা তোমাদের ওপর ফরয নামাযের পর আরও এক নামায অতিরিক্ত করে দিয়েছেন, তা হল বিতর।' অপর এক বর্ণনায় আছে, আল্লাহ তোমাদের ওপর নামায ফরয করেছেন এবং অতিরিক্ত করে দিয়েছেন বিতর। অন্য এক বর্ণনায় আছে, আল্লাহ তোমাদের জন্য নামায অতিরিক্ত করেছেন, তা হল 'বিতর'। সুতরাং এর হিফাযত কর।
মুসনাদে ইমাম আ'যম আবু হানীফা, হাদীস নং ১৫৩
হযরত ইমাম আ'যম থেকে বিতর সম্পর্কে বিভিন্ন রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে। তিনি 'বিতর'কে ফরয, ওয়াজিব অথবা সুন্নাত মনে করতেন। তবে ওয়াজিব হওয়ার রেওয়ায়েত অধিক সহীহ। কেননা, হাদীসে “ঝাদাকুম” শব্দ রয়েছে। এতে 'বিতর' সুন্নাত না হওয়ার দিকে ইঙ্গিত রয়েছে। বরং এর দ্বারা ওয়াজিব প্রমাণিত হয়। কেননা অতিরিক্ত টা হওয়ার ইংগিত আল্লাহর দিকে করা হয়েছে। নবী করীম (সাঃ)-এর দিকে নয়। সুতরাং এটা সুন্নাত নয়। আর ফরয এই জন্য নয় যে, উপরোক্ত হাদীস অকাট্য দলীল دَلِيْلِ قَطْعِی নয়।
সুতরাং ফরয ও সুন্নাতের মধ্যবর্তী একটি হবে, সেটা হল ওয়াজিব। এখানে ফরযের উপর বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে ফরয হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু এর জন্য دَلِيْلِ قَطْعِى না থাকায় ওয়াজিব হয়েছে। হযরত আবূ আইউব আনসারী হতে আবূ দাউদ শরীফে বর্ণিত হাদীস 'বিতর' ওয়াজিব হওয়া সম্পর্কে আরও স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, أَلُوتْرُ حَقٌّ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ 'বিতর' আদায় করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর হক বা কর্তব্য। হক এর আদায় যেহেতু ওয়াজিব। সুতরাং এর দ্বারাও বিতর ওয়াজিব বলে প্রমাণিত হয়। উক্ত হাদীস গ্রন্থে ইবনে বারীদা (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে : فَمَنْ لَمْ يُؤْتِرٌ فَلَيْسَ مِنَّا যে বিতর আদায় করে না, সে আমাদের মধ্যে গণ্য নয়। হাদীসে এই বাক্যটি তিনবার উদ্ধৃত হয়েছে। সুতরাং এইরূপ কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা বিতর ওয়াজিব হওয়াকে প্রমাণিত করে। মুসলিম শরীফে হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) হতে آوتروا শব্দ বর্ণিত আছে, যা ওয়াজিব হওয়ার কথা প্রমাণ করে। (মুসনাদে ইমাম আ'যম আবু হানীফা, পৃঃ ১৯৫-১৯৬)
ইমাম বাজজার আসওয়াদ হতে, তিনি আবদুল্লাহ হতে, তিনি নবী করীম (সাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, বিতরের নামায প্রতিটি মুসলমানের ওপর ওয়াজিব। নবী করীম (সাঃ), সকল সাহাবা, তাবিয়ীন ও তাবে তাবিয়ীন তা পাঠ করেছেন। অতএব, এটা সুন্নাত নয়- ওয়াজিব। -নূরুল হিদায়া দ্রঃ। ( তুহফাতুল মু'মিনীন, কৃত মাওঃ শামসুদ্দীন মোহনপুরী)
শরহে বিদায়ায় আছে- বিতরের নামায ওয়াজিব। ইমাম আবু হানীফার মতে এটা ফউত হলে কাযা করা এজমা দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। (তুহফাতুল মু'মিনীন, কৃত মাওঃ শামসুদ্দীন মোহনপুরী পৃঃ-১২২)
عَنْ عَلِيّ رَض قَالَ كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُؤْتِرُ بثلاثٍ يَقْرَأُ فِيهِنَّ بِتِسْعِ سُوَرٍ مِّنَ الْمُفَصَّلِ يَقْرَأُ فِي كُلِّ رَكْعَةٍ بثلاث سُورٍ أَخِرُهُنَّ قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ -
অনুবাদ: হযরত আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলে করীম (সাঃ) বিতর (নামায) তিন রাকআত পড়তেন। তিনি প্রত্যেক রাকআতে তিনটি সূরা পড়তেন। সর্বশেষ সূরা কুলহু আল্লাহু আহাদ পড়তেন।
ইমাম আবূ ঈসা তিরমিযী (রহঃ) বলেন, কতক সাহাবায়ে কেরাম ও তাবিয়ীগণ তিন রাকআত বিতর পড়তেন। ইমাম সুফইয়ান সওরী বলেন,
"তোমরা ইচ্ছা করলে পাঁচ রাকআত অথবা তিন রাকআত অথবা এক রাকআত পড়তে পার। কিন্তু আমি বিতর নামায তিন রাকআত পড়াই পছন্দ করি।"
ইমাম ইবনে মুবারক এবং কুফাবাসীগণের এটাই অভিমত। (উর্দু মুতারজম তিরমিযী শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃঃ-২৫৮-২৫৯)
عَنْ عَائِشَةَ رَض قَالَتْ إِنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ان كَانَ يُؤْتِرُ بِثَلَاثٍ لَا فِي آخِرِهِنَّ - (نسائ)
অনুবাদ: হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে- তিনি বলেছেন: নবী করীম (সাঃ) বিতর নামায তিন রাকআত পড়তেন। তিন রাকআত শেষ করে তিনি সালাম ফিরাতেন। (নাসায়ী)
আনওয়ারুল মুকাল্লেদীন, ই,ফা, বা, পৃঃ-৫৯
عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا يُسَلِّمُ فِي رَكْعَتِي الْوِتْرِ -
অনুবাদ: হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেছেন, নবী করীম (সাঃ) বিতরের দুই রাকআতে সালাম ফিরাতেন না। অর্থাৎ এক সংগে তিন রাকআত পড়ে সালাম ফিরাতেন।
আনওয়ারুল মুকাল্লেদীন, ই,ফা, বা, পৃঃ-৬০
عَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ الْوِتْرُ ثَلْتُ كَصَلوةِ الْمَغْرِبِ
অর্থাৎ হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেছেন- বিতর মাগরিবের ন্যায় তিন রাকআত।
উর্দু মুতারজাম মুওয়াত্তায়ে ইমাম মুহাম্মদ, পৃঃ-১১১
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ الْوِتْرُ كَصَلوةِ الْمَغْرِبِ
অর্থাৎ হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, বিতর মাগরিবের নামাযের তুল্য (তিন রাকআত)।
উর্দু মুতারজাম মুওয়াত্তায়ে ইমাম মুহাম্মদ, পৃঃ-১১১
سَأَلْتُ أَبَا الْعَالِيَةِ عَنِ الْوِتْرِ فَقَالَ عَلَّمَنَا أَصْحَابُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّ الْوِتْرَ مِثْلُ صَلوةِ الْمُغْرِبِ هَذَا وَتْرُ اللَّيْلِ وَهُذَا وِتْرُ النَّهَارِ
অর্থাৎ রাবী (হাদীস বর্ণনাকারী) বলেন- আমি আবুল আলিয়াকে বিতর নামাযের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলাম; তিনি বললেন, নবী করীম (সাঃ)-এর সাহাবাগণ আমাদেরকে (তাবিয়ীগণকে) শিক্ষা দিয়েছেন যে, বিতর মাগরিবের নামাযের ন্যায় (তিন রাকআত)। এটা রাত্রির বিতর এবং মাগরিব দিনের বিতর।
মা'আনিউল আছার, পৃঃ-১৬৪
قَالَ الْقَاسِمُ رَأَيْنَا أَنَا سَامُنْذُ أَدْرَكْنَا يُوتِرُوْنَ بِثَلَثٍ
অর্থাৎ ইমাম কাসেম বলেছেন-আমি বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়া অবধি (মদীনা শরীফে) সাহাবাগণকে তিন রাকআত বিতর পড়তে দেখেছি।
(সহীহ বুখারী, ১ম খণ্ড, পৃঃ-১৩৩ (মিসরী ছাপা))
عنِ الْحَسَنِ قَالَ أَجْمَعَ الْمُسْلِمُونَ عَلَى أَنَّ الْوِتْرَ ثَلْثُ لَا يُسَلِّمُ إِلَّا فِي آخِرِ هِنَّ ( رواه ابن ابي شيبه )
অনুবাদ: ইমাম ইবনে আবী শায়বা ইমাম হাসান বসরী (রহঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, মুসলমানদের ঐক্যমত হয়েছে যে, বিতর তিন রাকআত। শেষ ভাগে ব্যতীত কেউই সালাম ফিরাতেন না। (ইবনে আবী শায়বা)
ফতহুল কাদীর, পৃঃ-১৭৭
يُوتِرُ بِثَلَثٍ لَا يَفْصِلُ بَيْنَهُنَّ
অর্থাৎ নবী করীম (সাঃ) তিন রাকআত বিতর পড়তেন। এদের মাঝে সালাম ফিরায়ে (নামায) বিচ্ছেদ করতেন না।
(সাইফুল মুকাল্লেদীন, কৃত মাওঃ ইবরাহীম মুহাব্বাতপুরী, পৃঃ-১৩৯)
عَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَا ا دد اجْزَاتُ رَكَعَةٌ قَط
অর্থাৎ হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে: নবী করীম (সাঃ) ইরশাদ করেন-এক রাকআত নামায কখনও যথেষ্ট নয়।
(আনওয়ারুল মুকাল্লেদীন, ই,ফা, বা, পৃঃ-৫৯)
أَثْبَتَ عُمَرُ بْنُ عَبْدِ الْعَزِيزِ بِالْمَدِينَةِ يَقُولُ الْفُقَهَاءُ ثَلْثًا لَا يُسَلِّمُ إِلَّا فِي آخِرِهِنَّ
অর্থাৎ খলীফা উমর বিন আবদুল আযীয ফকীহ ইমামগণের ফতওয়া অনুসারে মদীনা শরীফে এক সালামে তিন রাকআত 'বিতর'-এর সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।
(মাআনিউল আছর, পৃঃ-১৬৭)
عَنْ عَائِشَةَ يُوتِرُ بِثَلْثٍ لَا يَفْصِلُ بَيْنَهُنَّ
অর্থাৎ নবী করীম (সাঃ) তিন রাকআত বিতর (নামায) পড়তেন, কিন্তু এদের সালামের মাধ্যমে পৃথক করতেন না।
(সাইফুল মুকাল্লেদীন, কৃত মাওঃ ইবরাহীম মুহাব্বাতপুরী, পৃঃ- ১৩৯)
وَمِمَّنْ قَالَ يُوتِرُ بِثَلَثٍ لَا يَفْصِلُ بَيْنَهُنَّ عُمْرَ، عَلِيَّ وَابْنُ مَسْعُودٍ وَحُذَيْفَةُ وَابْنُ عَبَّاسٍ وَأَنَسُ وَأَبُو أَمَامَةً وَعُمَرُ بْنُ عَبْدِ الْعَزِيزِ وَالْفُقَهَاءُ السَّبْعَةُ وَأَهْلُ الْكُوفَةِ -
অর্থাৎ হযরত উমর, আলী, ইবনে মাসউদ, হুযায়ফা, ইবনে আব্বাস, আনাস, আবূ উমামা (রাঃ হুম), উমর বিন আবদুল আযীয ও সাত জন ফকীহ এবং কুফাবাসী আলিমগণ বলতেন- তিন রাকআত বিতর পড়তে হবে- দ্বিতীয় রাকআতে সালাম দিতে হবে না। (আইনী গ্রন্থ, পৃঃ-৪০৫)
أبُو حَنِيفَةَ عَنْ حَمَّادٍ عَنْ إِبْرَاهِيمَ عَنِ الْأَسْودِ عَنْ عَائِشَة قَالَتْ كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُؤْتِرُ بِثَلَثٍ يَقْرَأُ فِي الأولى سبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى وَفِي الثَّانِيَةِ بِقُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ وفِي الثَّالِثَةِ بِقُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ وَفِي رِوَايَةٍ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقْرَأُ فِي الرَّكْعَةِ الأولى مِنَ الْوِتْرِ بِأَمِّ الْكِتَابِ وسَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى وَفِي الثَّانِيَةِ بِامِّ الْقُرْآنِ وَقُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ وَفِي الثَّالِثَةِ بِامِّ الْكِتَابِ وَقُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ وَفِي رِوَايَةٍ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يُوتِرُ بِثَلَثٍ -
অনুবাদ: হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বিতরের নামায তিন রাকআত আদায় করতেন। প্রথম রাকআতে সাব্বিহিসমা ... দ্বিতীয় রাকআতে কুল ইয়া আইয়ুহাল কাফিরুন এবং তৃতীয় রাকআতে কুলহুয়াল্লাহু আহাদ তিলাওয়াত করতেন। অন্য এক বর্ণনায় আছে, হুযুর (সাঃ) বিতরের প্রথম রাকআতে আলহামদু এবং সাব্বিহিসমা দ্বিতীয় রাকআতে আলহামদু এবং কুলইয়া আইউহাল কাফিরূন তৃতীয় রাকআতে আলহামদু এবং কুলহুয়াল্লাহু আহাদ তিলাওয়াত করতেন। অপর এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) 'বিতর' তিন রাকআত পড়তেন।
(বংগানুবাদ মুসনাদে ইমাম আযম আবু হানীফা, ১৯৭-১৯৯)
উপরোক্ত বর্ণনার আলোকে বংগানুবাদ 'মুসনাদে ইমাম আযম আবূ হানীফা' গ্রন্থে যে ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে, অবিকল তা নিচে উদ্ধৃত করা হলঃ
ব্যাখ্যাঃ উপরোক্ত হাদীসের প্রেক্ষাপটে বিতর কত রাকআত এ নিয়ে ইমামদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ)-এর মতে বিতর তিন রাকআত এবং ইমাম মালেক (রাঃ) ও ইমাম শাফিয়ী (রহঃ) বিতর এক রাকআতের পক্ষে মত পোষণ করেছেন। উভয় দল বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হযরত ইবনে উমর (রাঃ)-এর হাদীস দলীল হিসেবে পেশ করেছেন। বাক্য বিভিন্ন হলেও এ সবের অর্থ প্রায় নিকটবর্তী। যেমন এক ব্যক্তি হুযুর (সাঃ)-এর নিকট রাতের নামায সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। তখন তিনি বলেন-
مَثْنَى مَثْنَى فَإِذَا خَشِيتُ الصُّبْحَ فَصَلِّ رَكْعَةٌ لَوْ تَرَكَ صَلوتُكَ
(রাতের নামাজ) দু দু রাকআত, যখন ভোর হওয়ার আশংকা থাকে, তখন এক রাকআত পড়ে লও। এতে তোমার নামায বিতর (বেজোড়) হয়ে যাবে।
অন্য এক রেওয়ায়েতে আছে- فَأَوْتِرُوا بِوَاحِدَةٍ এক রাকআত মিলিয়ে দু'রাকআতকে বিতর করে লও।
ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) স্বীয় মাযহাবের স্বপক্ষে কতিপয় জোরালো দলীল পেশ করেছেন।
প্রথম হাদীস يُوتِرُ بِثلث হযরত নবী করীম (সাঃ) বিতর তিন রাকআত পড়তেন। অতঃপর প্রত্যেক রাকআতের পৃথক কিরাআত নির্ধারিত হলো এবং পৃথক তাহরীমা ব্যতীত তৃতীয় রাকআত মিলিয়ে পড়ার বিধান জারী হলো।
দ্বিতীয় বুখারী ও মুসলিম শরীফের শর্তানুযায়ী হাকিম হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেনঃ
كَانَ رَسُولُ اللهِ صلعم يُوتِرُ بِثَلَثٍ لَا يُسَلِّمُ إِلَّا فِي آخِرِهِنَّ
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বিতর তিন রাকআত পড়তেন এবং শেষে ছাড়া সালাম ফিরাতেন না।
তৃতীয় নাসায়ী শরীফে হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে- নবী করীম (সাঃ) বিতরের দু'রাকআতে সালাম ফিরাতেন না।
৪র্থ দারে কুতনী হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেনঃ
كانَ النَّبِيُّ صلعم لا سَكُم فِي رَكْعَتَيِ الْوِتْرِ
-'রাতের বিতর নামায হলো তিন রাকআত যেমন দিনের বিতর নামায মাগরিব হলো তিন রাকআত।'
এখানে একটি প্রশ্ন হতে পারে যে, এই হাদীস মারফু, সহীহ নয়। সুফইয়ান সওরী ও অন্যান্য ইমামগণ এটি মওকুফ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। সুতরাং এখানে বলা যায়, হাদীস মওকুফ ও আহকামের ক্ষেত্রে মরফুর মর্যাদা রাখে। সুতরাং এখন তৃতীয় রাকআতকে প্রথম দু'রাকআত থেকে পৃথক করার কোন সুযোগ নেই। এই মতের স্বপক্ষে আরও দলীল হলো এই যে, তিনি আবুল আলিয়াকে বিতর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। তখন তিনি বলেছেন, সাহাবায়ে কেরাম আমাদেরকে মাগরিবের নামাযের মত বিতর শিক্ষা দিয়েছেন। এটা হলো রাতের বিতর এবং মাগরিব হলো দিনের বিতর। পঞ্চম, বুখারী কাসিম ইবনে মুহাম্মদ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, আমরা লোকদেরকে বিতরের নামায তিন রাকআত পড়তে দেখেছি। ষষ্ঠ, হযরত উমর (রাঃ)-এর আমলেও এটাই ছিল। হাকিম মুস্তাদরাক নামক হাদীস গ্রন্থে হাবীব মুআল্লিম থেকে বর্ণনা করেন যে, কোন এক ব্যক্তি হযরত হাসান (রাঃ)-এর নিকট বলেন, হযরত ইবনে উমর (রাঃ) বিতরের দু'রাকআতের পর সালাম ফিরিয়ে থাকেন। হযরত হাসান (রাঃ) বলেন- হযরত উমর (রাঃ) হযরত ইবনে উমর (রাঃ) থেকে অধিক ফকীহ ছিলেন। তিনি দু'রাকআতের পর তাকবীর বলে উঠে যেতেন। সপ্তম, ইবনে আবী শায়বা হযরত হাসান (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন:
اجْتَمَعَ الْمُسْلِمُونَ عَلَى أَنَّ الْوِتْرَثَلْتُ لَا يُسَلِّمُ إِلَّا فِي أَخِرٍ مِّنْهَا
"জমহুর মুসলমান এ বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করেছেন, বিতর হলো তিন রাকআত এবং নামায শেষ করা ব্যতীত কেউ সালাম ফিরায়নি।
এর পর ইমাম মুহাম্মাদ (রঃ) মুওয়াত্তায়ে হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, এক রাকআত কখনো যথেষ্ট নয়। উভয় ইমামদ্বয়ের দলীল দেখা যেতে পারে। فَأوتر بواحدة অথবা تُوتِرُ لَكَ صَلوتكَ— দু'হাদীস শাফিয়ী ও মালেকী মাযহাবের দলীল হয়, তাহলে হানাফী মাযহাবেরও এই হাদীস দলীল হবে। কেননা এর অর্থ এটাও হতে পারে যে, ঐ দু'রাকআত নামাযের সাথে এক রাকআত মিলিয়ে তিন রাকআত বিতর করে লও। কিন্তু নতুন তাহরীমার মাধ্যমে বিতরকে এক রাকআত হিসেবে পৃথক আদায় করে নেওয়া এটা হাদীসের অর্থ নয়। হাদীসসমূহের দৃষ্টিকোণ থেকে দু'রাকআতের পর নতুন তাহরীমার মাধ্যমে পৃথক করে এক রাকআত পড়া জায়েয নয়। (বংগানুবাদ মুসনাদে ইমাম আযম আবু হানীফা, ১৯৭-১৯৯)
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সকলকে সহীহ হাদীস অনুযায়ী এক সালামে তিন রাকআত বিতর নামায আদায় করার তাওফীক দান করুন। আমীন!
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০০৫) 'আমীন' চুপে বলা প্রসঙ্গে | (০০৭) তারাবীর নামায আট রাকআত নয়- বিশ রাকআত |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |