[আরবী]
(পারাঃ ৩ সূরা বাকারা, রুকু ৩৪)
অর্থাৎঃ 'কে সে, যে তাঁর অনুমতি ব্যতিরেকে তাঁর নিকট সুপারিশ করবে? তাদের সম্মুখে ও পশ্চাতে যা কিছু রয়েছে তা তিনি অবগত। তিনি যা ইচ্ছা করেন তদ্ব্যতীত তাঁর জ্ঞানের কিছুই তারা আয়ত্ব করতে পারে না।"
এই পবিত্র কালিমাগুলো আয়াতুল কুরসীরই তিনটি বাক্যাংশ। আয়াতুল কুরসীর মধ্যে প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর মোট এগারটি সিফাতের বর্ণনা রয়েছে। তাফসীরে রুহুল বায়ানের মধ্যে এই আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখ আছে যে,
[আরবী] হতে [আরবী] পর্যন্ত তিনটি সিফাত হুযুর আকরম (দঃ) এর জন্যই। এর পূর্বে পাঁচটি সিফাত আল্লাহর, শেষে তিনটি সিফাতও আল্লাহর আর মাঝখানে হযুর আকরম (দঃ) এর তিনটি সিফাত-এর বর্ণনা এসেছে। যেমনিভাবে কালেমায়ে তায়্যেবার মধ্যে প্রথম এবং শেষে আল্লাহর পবিত্র নাম, আর মাঝখানেই রয়েছে প্রিয় নবী (দঃ) এর নাম মুবারক। আয়াতের প্রথমাংশে হুযুর আকরম (দঃ) এর ব্যাপক শাফায়াতের বর্ণনা এসেছে অর্থাৎ কিয়ামতের প্রারম্ভিক লগ্নে যখন আমি আপনি তো দূরের কথা নবীগণ পর্যন্ত নাফসী নাফসী করবেন। ঠিক সে মূহুর্তে একমাত্র হুযুর আকরম (দঃ) ই আল্লাহর অনুমতি প্রাপ্ত হয়ে শাফায়াতকারী হবেন। এভাবে হুযুর আকরম (দঃ) এর মাধ্যমে যখন শাফায়াতের দ্বার উন্মুক্ত হবে তখন আলেম, পীর- মাশায়েখ, অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তান, পবিত্র কা'বা, কুরআন শরীফ, পবিত্র রমযান মাস প্রত্যেকেই শাফায়াত করবেন।
[উর্দূ]
অর্থাৎঃ মাহবুবে খোদা (দঃ) এর সুমহান শান প্রদর্শনই হচ্ছে হাশরের ময়দানের আয়োজন অনুষ্ঠিত হওয়ার একমাত্র কারণ।
হুযুর আকরম (দঃ) ই প্রথম শাফায়াতের কপাট খুলবেন। মনে রাখা আবশ্যক যে, শাফায়াতের মোট চারটি অবস্থা। উপরস্থ কর্তৃক নিম্নস্থের নিকট সুপারিশ করেন। যেমন কালেক্টর সাহে'ব হাসিলদারের নিকট কারো জন্য সুপারিশ করেন, দ্বিতীয়তঃ একই মর্যাদার লোকের কাছে সুপারিশ করা যেমন কালেক্টর সাহেব হজ্ব বিভাগের নিকট কারো জন্যে সুপারিশ করেন।
তৃতীয়তঃ নিম্নস্থ কর্তৃক উপরস্থের নিকট সুপারিশ করা, কিন্তু তা এ মানসিকতা প্রসূত যে, যদি রাষ্ট্রপ্রধান আমার সুপারিশ বিবেচনা না করেন, তবে আমি হুকুমতের মধ্যে তুলকালাম কান্ড সৃষ্টি করব। বস্তুতঃ উপরোক্ত এই তিন প্রকারের সুপারিশ রাব্বুল আলামীনের মহান দরবারে অসম্ভব। কাফিররা উপরোক্ত সুপারিশসমূহে বিশ্বাসী ছিল কারণে আয়াতে তা অসম্ভব বলা হয়েছে। চতুর্থতঃ নিম্নস্থ কর্তৃক উপরস্থের নিকট শুধুমাত্র উপরোস্থের ভালবাসা আর করুণার উপর ভিত্তি করে তাঁর দরবারে সুপারিশ করা, আর এ ধরণের শাফায়াতকে অনুমতি সাপেক্ষ শাফায়াত বলা হয়। আল্লাহর মাহবুবরা এ ধরণের শাফায়াতই করবেন।
দ্বিতীয় বাক্যে ইরশাদ হয়েছে যে, শাফিউল মুজনেবীন (দঃ) সমস্ত বান্দাদের পূর্বাপর সকল অবস্থা জানেন, অর্থাৎ দুনিয়ায় কে মুসলমান ছিল কে কাফির ছিল আর কে মুনাফিক ছিল, তিনি তা জানেন এবং এটাও জানের যে, ভবিষ্যতে কে জাহান্নামী হবে এবং কে জান্নাতী হবে। জাহান্নামী হলে কোন স্তরের জাহান্নামী আর জন্নাতী হলে জান্নাতুল ফেরদাউসে থাকবে, না আদনে, না অন্য কোথাও। অর্থাৎ কি ধরণের মর্যাদায় থাকবে তাও তিনি জানেন। হুযুর আকরম (দঃ) এর জন্য এগুলো জানা আবশ্যকও বটে। কেননা ডাক্তার যদি রোগীর রোগ বুঝতে না পারেন অথবা রোগের বিধান সম্ভব কি সম্ভব নয়, তা বুঝতে না পারেন, তবে তিনি কি করে চিকিৎসা করবেন। ঠিক একইভাবে শাফিউল মুজনেবীন (দঃ) যদি কে শাফাআতের উপযুক্ত আর কে শাফায়াতের উপযুক্ত নয় তা বুঝতে না পারেন, তবে তিনি শাফায়াত করবেন কি করে। দুনিয়ার মধ্যেও হুযুর আকরম (দঃ) অনেককে জান্নাতী এবং জাহান্নামী হওয়ার সংবাদ দিয়ে দিয়েছেন। আশারায়ে মুবাশশারাহ হযরত ফাতিমা যুহরা হযরত হুসাইন (রাঃ) কে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়ে আরও বলেছেন হযরত ফাতিমা (রাঃ) জান্নাতী বিবিদের সরদার আর হযরত ইমাম হাসান এবং হুসাইন (রাঃ) জান্নাতী যুবকদের সরদার। জিহাদের ময়দানে এক ব্যক্তি অত্যন্ত বীরত্বের সাথে কাফিরদেরকে কতল করতেছিল। অনেক সাহাবী তার বীরত্বের প্রশংসা করছিলেন। হুযুর পাক (দঃ) ইরশাদ করলেন। এতদসত্ত্বেও সে জাহান্নামী। দেখা গেল শেষ পর্যন্ত সে আত্মহত্যা করেছিল।
মিশকাত শরীফের 'তাকদীরের উপর ঈমান' অধ্যায়ে আছে, একদিন, প্রিয় নবী (দঃ) দুই হাতে দু'টি কিতাব নিয়ে সাহাবীদের মজলিসে তাশরিফ আনলেন, এবং বলতে লাগলেন, এই কিতাবের মধ্যে জান্নাতীদের নাম তাদের পিতার নাম এবং তাদের বংশের নামও রয়েছে। আর অন্যটির মধ্যে জাহান্নামীদের নাম, বংশ ইত্যাদি আছে। বলতে বলতে তিনি জাহান্নামী এবং জান্নাতীদের মোট সংখ্যাও বলে দিলেন। কিন্তু এক হাদীছে এসেছে যে, মুনাফিকরা হাউজে কাওছারে আসার পথে ফেরেশতাগণ তাদেরকে বাধা দিবে। তখন আমি বলব, হে ফেরেশতারা। তাদেরকে আসতে দাও। তারা আমার সাহাবী। ফেরেশতাগণ আরয করবে। আপনি জানেন না, তারা আপনার পরে কি করেছে। এই হাদীছের এ জাতীয় কথাবার্তাগুলো শুধুমাত্র বেদ্বীনদেরকে লজ্জিত করার জন্যই। অন্যথায় এ দুনিয়ায় তাদের জাহান্নামী হওয়া সম্পর্কে রাসূল (দঃ) সংবাদ দিয়ে দিয়েছেন, অথচ কিয়ামতের ময়দানে তাঁর স্মরণ থাকবে না, তা কি করে সম্ভব। এ সম্পর্কিত বিস্তারিত আলোচনা আমি আমার কিতাব 'জায়াল হক' এর মধ্যে করেছি, যেটি প্রকাশিত হয়েছে।
আর তৃতীয় বাক্যে ইরশাদ হয়েছে, অন্যান্যরা শফিউল মুজনেবীন-এর জ্ঞান থেকে তিনি যতটুকু চান, ঠিক ততটুকুই পেতে পারেন। অর্থাৎ ওলী গাউছ কুতুব এমনকি নবী এবং ফেরেস্তাগণ হুযুর (দঃ) এর জ্ঞানকে অতিক্রম করতে পারবে না। হাঁ তিনি যতটুক ইচ্ছে করেন, তাঁদেরকে বলে দিতে পারেন। বাস্তবিকই সাইয়েদুল মুরসালীন (দঃ) এর জ্ঞান হচ্ছে একটি বিরাট সমুদ্র। আর সেই সমুদ্র হতে জ্ঞান আহরণ করার জন্য বিভিন্ন জন বিভিন্ন পাত্র সংরক্ষণ করেন। যে বদনা নিয়ে আসে, সে বদনা পরিমাণ পানি পায়। যে কলস নিয়ে আসে, সে কলস পূর্ণ করে নিবে, মশকওয়ালা মশক পরিপূর্ণ করে নিবে আর কেউবা শুধুমাত্র এক আজল পান করবে। আবার কোন বদনসীব সেখান থেকে ও শুন্য হস্তে ফিরে আসবে। সিদ্দীক আকবর (রাঃ) ফারুক আজম (রাঃ) উছমান গনী এবং হায়দর কাররার হযরত আলী (রাঃ) সেই একই সমুদ্র হতে ফয়েজ অর্জন করেছেন। কিন্তু প্রত্যেকেই নিজ নিজ শক্তি অনুযায়ী তা অর্জন করেছেন। 'কাসিদায়ে বুরদার' মধ্যে এ কথাটি বড় চমৎকারভাবে বলা হয়েছে-
[আরবী]
অর্থাৎ সমস্ত নবীগণ হুযুর আকরম (দঃ) এর মা'রেফাতের সমুদ্র হতে এবং তাঁর ইলমের লাগাতার বর্ষণ হতে এক বিন্দু নেয়ার জন্যে তাঁর প্রতি অভিলাষী।
এ বিষয়বস্তুকে জনাব কাসেম নানুতবী তার 'তাহজীরুন নাস' কিতাবের মধ্যে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে আলোচনা করেছেন। বস্তুতঃ এ আয়াতের মধ্যে হুযুর আকরম (দঃ) এর শাফায়াত, ইলম এবং আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে আল্লাহর নিয়ামত বণ্টন করার ক্ষমতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনাই হয়েছে।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০১৪) আয়াতঃ ১১ | (০১৬) আয়াতঃ ১৩ |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |