[আরবী]
(পারাঃ ২ সূরা বাকারা, রুকু ১৭)
অর্থাৎ- "এবং এভাবে আমি তোমাদেরকে সকল উম্মতদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি, যাতে তোমরা মানবজাতির জন্য সাক্ষীস্বরূপ এবং রাসূল তোমাদের জন্য সাক্ষীস্বরূপ হবে।”
এ পবিত্র আয়াতে বাহ্যিক অর্থে হযুর পাক (দঃ) এর উম্মতের প্রশংসাই করা হচ্ছে, কিন্তু একথা অত্যন্ত সুস্পষ্ট, এ উম্মত যে সম্মান আর মর্যাদা পেয়েছে, তা একমাত্র প্রিয় নবী (দঃ) এর গোলামীর কারণেই পেয়েছে। এ আয়াতে নানাবিধ মমার্থ রয়েছে। প্রথম তো এই যে, কিয়ামতের দিন অন্যান্য নবীগণের উন্মতেরা আল্লাহর সুমহান দরবারে আরয করবে যে, হে খোদা। তোমার কোন পয়গম্বর আমাদের কাছেই আসেনি এবং কেউ তোমার হুকুম আহকামও আমাদের নিকট পৌছায়নি। তখন এ সকল নবীগণ আরয করবেন-হে খোদা! এরা মিথ্যাবাদী। আমরা তোমার সমস্ত বিধান তাদেরকে শুনিয়েছি, জানিয়েছি। এতদসত্ত্বেও তারা ঈমান গ্রহণ করেনি। নবীগণকে হুকুম করা হবে আপনারা আপনাদের দাবীর স্বপক্ষে সাক্ষী আনয়ন করুণ।
তাঁরা তখন হযুর আকরম (দঃ) এর উম্মতগণকেই নিজেদের সাক্ষী হিসেবে পেশ করবেন। আর এ উম্মতে মুহাম্মদী (দঃ) তখন সাক্ষী প্রদান করতঃ বলবে, খোদা। তোমার এই সকল নবীগণ আপন দাবীতে সত্য। বরঞ্চ এই সকল কাফিররাই মিথ্যাবাদী। বাস্তবিকই নবীগণ দ্বীনের আওয়াজ পৌঁছিয়েছেন। এ কথার উপর কাফিররা অভিযোগ এনে বলবে-তোমরা তো আমাদের সময় ছিলে না। হাজার হাজার বৎসর পর সৃষ্টি হয়ে না দেখে না শুনে কিভাবে সাক্ষী দিচ্ছ। মুসলমানরা আরয করবে। আমরা আমাদের পয়গম্বর (দঃ) এর থেকেই শুনেছি যিনি সকল অবস্থা দেখেছেন। এমতাবস্থায় মুসলমানদের দাবীর সত্যতা প্রমাণের জন্য হযুর আকরম (দঃ) তাশরীফ আনবেন এবং বলবেন, হে খোদা! বাস্তবিকই আমি তাদেরকে বলেছি যে, অতীত নবীগণ স্ব-স্ব কওমের কাছে দ্বীনের আওয়াজ পৌঁছিয়েছেন। হুযুর (দঃ) এর এই সাক্ষীর ভিত্তিতেই নবীগণের পক্ষে আহকামুল হাকেমীন রায় প্রদান করবেন।
উপরোক্ত আয়াতে যে ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে, তদ্বারা কতকগুলো দিক বুঝা যাচ্ছে। প্রথম তো এই যে, এই উন্মতে মুহাম্মদিয়া (দঃ) হচ্ছে সকল নবীগণের জন্য সাক্ষী। এবং সাধারণ নিয়ম এই যে, বাদী তার সাক্ষীকে খুব ভালবাসে। যদ্বারা বুঝা গেল যে, হুযুর পাক (দঃ) এর উম্মত হচ্ছে সকল নবীদের কাছেই প্রিয়। দ্বিতীয়তঃ হুযুর পাক (দঃ) তাঁর পূর্বাপর সমস্ত ঘটনাবলী স্বয়ং চোখে দেখেছেন নতুবা প্রথমে তো শুনা সাক্ষী মুসলমানরা দিয়েছিল। এখন প্রয়োজন হয়েছিল এমন কারো সাক্ষী, যিনি সবকিছু স্বচক্ষে অবলোকন করেছেন। আর এ জন্যই প্রিয় নবী (দঃ) এর মি'রাজ হয়েছিল। অর্থাৎ সমস্ত নবীগণ বেহেশত-দোযখ আল্লাহর জাত-সিফাত সম্পর্কে না দেখে সাক্ষী দিয়েছেন, আর হুযুর আকরম (দঃ) স্বচক্ষে দেখেই এ সমস্ত কিছুর বর্ণনা দিয়েছেন। তৃতীয়তঃ হুযুর (দঃ) তাঁর সমস্ত উম্মতদের সার্বিক অবস্থা এবং তাদের কর্মতৎপরতা সম্পর্কে সবসময়ই অবগত রয়েছেন। কেননা রাসুল আলামীনের দরবারে প্রিয় নবী (দঃ) দু'টি সাক্ষী প্রদান করবেন। প্রথম তো এই যে, মুসলমানরা সত্যিই বলছে। দ্বিতীয়তঃ আমার উম্মতগণ সাক্ষ্য দেয়ার মর্যাদা রাখে। কেননা এরা ফাসিক বা বদকার নয়। যাদের সাক্ষী শরীয়তের বিধান অনুযায়ী অগ্রহণযোগ্য, নতুবা “আলাইকুম” ইলমী কায়েদা সম্মত হচ্ছে না। علیٰ এ জন্যই বলা হয়েছে যে এখানে شهید (সাক্ষী) এর মধ্যে رقیب (তীক্ষ্ণদৃষ্টি) এর অর্থ শামিল আছে।
সুতরাং হুযুর আকরম (দঃ) যাদের ঈমানের সাক্ষী দিয়ে দিয়েছেন, তারা অবশ্যই জান্নাতীই হবে। হযরত সিদ্দীক আকবর (রাঃ) এবং হযরত উমর ফারুক (রাঃ) এর ঈমান অকাট্য। কেননা তাঁদের ঈমানের সাক্ষী ঐ সত্ত্বাই প্রদান করেছেন, যিনি আল্লাহর একত্ববাদের পক্ষেও সাক্ষী দিয়েছেন। সুতরাং তাঁদের ঈমানের ব্যাপারে রসূল (দঃ) এর সাক্ষ্যকে অস্বীকার করা মূলতঃ আল্লাহকেই অস্বীকার করার শামিল।
এ আয়াতের আর এক অর্থ এমনও হতে পারে যে, হে মুসলমানরা। দুনিয়ায় তোমরা সবাই সাক্ষী হতে পার। এ জন্যই ইসলামী আদালতে কাফিরদের ব্যাপারে মুসলমানের সাক্ষী গ্রহণযোগ্য হবে, কিন্তু মুসলমানের কোন বিষয়ে কাফেরের সাক্ষী কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না। এটাও এই উম্মতের একটি সুমহান মর্যাদা।তার
এই আয়াতের তৃতীয় অর্থ এটাও হতে পারে যে, মুসলমানরা যদি কোন জীবিত অথবা মৃত: বান্দাকে ভাল ধারণা করে সে আল্লাহর দরবারেও ভাল হয়। আর মুসলমানরা যদি কাউকে খারাপ জানে সে আল্লাহর কাছেও খারাপ হয়ে থাকে। মিশকাত শরীফের 'আল-মসয়ে বিল জানাযা' অধ্যায়ে আছে যে, হুযুর পাক (দঃ)এর সম্মুখ দিয়ে মৃত লোকের একটি কফিন যাচ্ছিল। মুসলমানরা তার প্রশংসা করল। প্রিয় নবী (দঃ) ইরশাদ করলেন, এই মৃত লোকটির জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে গেছে। আরও একটি কফিন যাওয়ার কালে মুসলমানরা তাকে খারাপ বলে বলাবলি করল। হয়ুর (দঃ) বললেন, এর জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে গেছে। তারপর ইরশাদ করলেন- তোমরা জমিনে আল্লাহর সাক্ষী। অতএব যে মুসলমানকে সাধারণ মুসলমানরা ওলী মনে করে, তিনি বাস্তবিক পক্ষেই আল্লাহর ওলী।
এ আয়াত দ্বারা এটাও প্রমাণিত হল, যে কাজের ব্যাপারে শরিয়তে আদেশ এ নিষেধ কিছুই নাই, অথচ মুসলমানগণ সেটাকে ছওয়াবের কাজ মনে করে, সেটা আল্লাহর নিকট ও ছওয়াবের কাজ হিসেবে গণ্য হবে। যেমন পবিত্র মীলাদ মাহফিল, ফাতিহা এবং অন্যন্য যাবতীয় ভাল কাজ। যেমন হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
[আরবী]
অর্থাৎ "যে ভাল কাজকে মুসলমানরা ভাল মনে করে তা আল্লাহর নিকটও ভাল।"
বস্তুতঃ মুসলমানগণ প্রত্যেকটি বিষয়ে এবং উভয় জাহানে আল্লাহর পক্ষে সাক্ষী।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০১১) আয়াতঃ ৮ | (০১৩) আয়াতঃ ১০ |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |