[আরবী]
(প্রথম পারা, সূরা বাকারা, রুকু ৪)
অর্থাৎ "এবং তিনি হযরত আদম (আঃ) কে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন, তৎপর সে সমুদয় ফিরিশতাদের সম্মুখে প্রকাশ করলেন।"
এ আয়াত করীমায় হযরত আদম (আঃ) এর ইয্যত এবং সম্মানের বর্ণনা দেয়া হচ্ছে এবং তাঁর বিপুল জ্ঞানের আলোচনা করা হচ্ছে। পরওয়ারদেগার আলম তাঁকে পূর্বাপর ছোট বড় সকল কিছুই দেখিয়েছেন, সকল কিছুর নামও শিখিয়েছেন এবং সব বস্তুর উপকার অপকার সহ সামগ্রিক অবস্থার ইল্ম তাঁকে দিয়েছেন। এই ব্যাপারে বিস্তারিত তাফসীরে মাদারেকে দেখুন। এটাও বুঝা গেল যে, কিয়ামত পর্যন্ত কোন জিনিষের যতগুলো নাম বিভিন্ন ভাষায় পাওয়া যাবে, এর সবগুলোই হযরত আদম (আঃ) কে বলা হয়েছে। যেমন পানিকে আরবীতে মাউন ماء বলে, ফারসীতে আব। উর্দুতে পানি, ইংরেজীতে ওয়াটার (Water) হিন্দিতে জল, তিলঙ্গি ভাষায় পান্টিন এবং আরও কোন্ কোন্ ভাষায় কি বলা হয় তার কোন ইয়ত্ত্বা নেই। মোট কথা, এর সকল নামই হযরত আদম (আঃ) কে শিখানো হয়েছে। (দেখুন তাফসীরে কবির)। বস্তুত সকল জিনিষই তাঁর নিকট প্রকাশ করে দেয়া হয়েছে। আর এই জ্ঞানের বিশেষত্বের কারণেই তাঁকে আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের মুকুট পরানো হয়েছে এবং ফেরেশতাগণ দ্বারা তাঁকে সিজদা করানো হয়েছে।
কিন্তু একই সাথে এই আয়াতে করীমায় সরওয়ারে কায়েনাত (দঃ) এর প্রশংসা ও চমৎকারভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। কেননা একথা সর্বসম্মত যে, হুযুর আকরম (দঃ) হচ্ছেন সকল নবীগণের ইলমের খনি। বরঞ্চ পরওয়ার দেগারে আলম নবীগণকে যে বিশেষত্ব দিয়েছেন, তা হুযুর পাক (দঃ) এর মাধ্যমেই প্রদান করেছেন। সরকার দো আলম (দঃ) ইরশাদ করছেন
[আরবী]
আল্লাহ্ প্রদানকারী আর আমি বন্টনকারী।
রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করছে
[আরবী]
অর্থাৎ এ সমস্ত নবীগণ তো ওরাই, যাঁদেরকে আল্লাহ পথ দেখিয়েছেন। সুতরাং আপনিও তাঁদের পথেই চলুন"।
বুঝা গেল, হযুর পাক (দঃ) এর মাঝে সকল আম্বিয়াকেরামের সমস্ত গুণাবলীর সমাহার ঘটেছে।
কিন্তু উক্ত আয়াত এই অর্থ পরিগ্রহ করবে না যে, হে রাসুল (দঃ) আপনি দ্বীনের ব্যাপারে পূর্ববর্তী নবীদের অনুসরণ করুন। কেননা আকীদা বা বিশ্বাসের ব্যাপারে উম্মতদেরও তাকলীদ বা অপরের অনুকরণ না জায়েয। বরঞ্চ এ ব্যাপারে নিজেই বিচার বিশ্লেষণ করতে হবে। এ জন্যই আল্লাহ তায়ালা কুরআন শরীফে একত্ববাদ রিসালত, কিয়ামত অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বিজ্ঞান ভিত্তিক যুক্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। সুতরাং আকীদা বা বিশ্বাসের ব্যাপারে হুযুর পাক (দঃ) অন্যান্য নবীগণের অনুকরণ কিভাবে করতে পারেন? এখন বাকি থাকলো দ্বীনি কার্যক্রম। হুযুর পাক (দঃ) এর দ্বীনই পূর্ববর্তী দ্বীনগুলোকে রহিত করেছে। ইসলাম যেখানে নাসেখ (অন্যান্য দ্বীনকে রহিতকারী সেখানে দ্বীনি ব্যাপারে অন্য দ্বীনের অনুকরণ কিভাবে সম্ভব? অতএব [আরবী] هذا দ্বারা অন্যান্য নবীগণের সত্ত্বাগত বৈশিষ্টের কথাই বুঝানো হয়েছে। বস্তুতঃ হযরত নূহ (আঃ) এর শুকরিয়া, হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর সুন্নাত, হযরত মুসা (আঃ) এর ইখালাস, হযরত ইসমাঈল (আঃ) এর সত্যবদীতা, হযরত ইয়াকুব (আঃ) এবং হযরত আইয়ুব (আঃ) এর সবর, হযরত ঈসা (আঃ) এর বিনম্রতা সকল কিছুই একত্রিত ভাবে হযুর পাক (দঃ) কে প্রদান করা হয়েছে। অতএব । এর মর্মার্থ এই দাঁড়ালো যে, ইয়া রাসুলাল্লাহ (দঃ) আপনি সকল নবীগণের সমস্ত গুণাবলীর অধিকারী হয়ে যান। (রুহুল বায়ান, সূরা নূহ)
[উর্দূ]
অর্থাৎ "হযরত ইউসুফ (আঃ) এর সৌন্দর্য, হযরত ঈসা (আঃ) এর মত মৃতকে জীবিত করার শক্তি, এবং হযরত মুসা (আঃ) এর ঝলমলানো হাত, তথা সমস্ত নবীগণের সম্মিলিত সৌন্দর্য এবং গুনাবলীর আপনি একাই অধিকারী"
শরহে কাসিদায়ে বুরদার মধ্যে ইমাম বুসিরী (রাঃ) ইরশাদ করছেন-
[আরবী]
অর্থাৎ "হে মাহবুব (দঃ) আপনি সম্মানের সূর্য আর সকল নবীগণ আপনার জ্যোতির তারকা, সকলই আপনার থেকে নেয়া আলো অন্ধকারে লোকদের কাছে প্রকাশ করছে।"
[উর্দূ]
অর্থাৎ- 'সকল নবী এবং রাসূলগণ তারকা, আর হে নবী (দঃ) আপনি সূর্য। এগুলো সারা রাত ঝলমল করে, অথচ আপনার উদয়ের সাথে সাথেই অদৃশ্য হয়ে যায়।'
দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মৌলবী কাসেম নানুতবী সাহেব তাঁর 'তাহজির উন নাস' কিতাবে লিখেছেন যে, আদি অন্ত সব জ্ঞান হুযুর আকরম (দঃ) এর জ্ঞানের মধ্যে একত্রিত হয়েছে। যেমন শ্রবন শক্তি এবং দৃষ্টি শক্তি পৃথক পৃথক হওয়া সত্ত্বেও তা সাধারণ অর্থে বাকশক্তির মধ্যে একত্রিত ভাবেই আছে। ঠিক একইভাবে হুযুর পাক (দঃ) হাকীকী আলিম, আর বাকী নবীগণ সাধারণ অর্থে আলিম। শায়খ ইবনে আরবী 'ফতুহাতে মক্কিয়ার' দশম অধ্যায়ে লিখেছেন যে, হযরত আদম (আঃ) হুযুর পাক (দঃ) এর প্রথম প্রতিনিধি ছিলেন। পবিত্র কুরআনের আয়াত, হাদীছ শরীফ এবং উলামাগণের কথাবার্তা দ্বারা একথা সুষ্পষ্ট হয়ে গেছে যে, হযরত আদম (আঃ) এর জ্ঞানের পরিসীমা এত বিস্তৃত হওয়া সত্ত্বেও তা আমাদের প্রিয় নবী (দঃ) এর জ্ঞানের সমুদ্রের একটি ফোটা মাত্র। অথবা বিশাল গ্রন্থের একটি লাইন মাত্র। এখন হুযুর পাক (দঃ) এর জ্ঞান কত বিস্তৃত, তা একমাত্র তিনি নিজেই জানেন। অথবা সেই জ্ঞান প্রদানকারী পরওয়ার দেগারই জানেন। এ সম্পর্কীয় বিশ্লেষণ পরেও আসবে। এরপরও হযরত আদম (আঃ) কেই ফেরেস্তারা সিজদা করেছে এবং তাঁকেই আল্লাহর খিলাফতের মুকুট প্রদান করা হয়েছে। বস্তুতঃ এসব কিছুই ঐ নূরে মুহাম্মদী (দঃ) এর বরকতে হয়েছে, যা হযরত আদম (আঃ) এর ললাট মুবারকে বিদ্যমান ছিল। মূলতঃ সেই নূরে মুস্তাফা কেই সিজদা করানো হয়েছে। এবং সেই নূরের ওসীলায় হযরত আদম (আঃ) এ সকল জ্ঞানের অধিকারী হয়েছেন। (দেখুন মাদারেজুন নবুয়্যত, ২য় খন্ড)