ইসলামে যে চারটি মাযহাব প্রচলিত আছে এর মধ্যে হানাফী মাযহার সর্বশ্রেষ্ঠ। ইমাম আবূ হানীফা নু'মান ইবন সাবিত (র.) হলেন এ মাযহাবের প্রবর্তক। তাঁর নামানুসারে এ মাযহাবের নামকরণ করা হয় হানাফী মাযহাব। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মানুষের কাছে এ মাযহাবই সর্বাধিকভাবে সামাদৃত। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মধ্যএশিয়া, তুরস্ক, মিসর প্রভৃতি দেশের মুসলমানদের অধিকাংশই হানাফী মাযহাবের অনুসারী। এ মাযহাব অধিকভাবে প্রসার লাভ করার কারণ হল এ মাযহাবের প্রবক্তা ইমাম আবু হানীফা (র.) ছিলেন মুজতাহিদকূল শিরোমণি। অনেক মুজতাহিদ নিজে মাযহাব প্রবর্তন না করে ইমাম আবু হানীফা (র.)-এর অনুসরণ করেছেন। যেমন ইমাম আবু ইউসুফ (র.), ইমাম মুহাম্মদ (র.), ইমাম যুফার (র.)। (উমদাতুর রি'আয়াহ্,৭ পৃষ্ঠা)।
ইমাম আবূ হানীফা (র.)-ই সর্বপ্রথম ফিকহ্ শাস্ত্র প্রণয়ন ও সংকলন করেন। মুজতাহিদ ও প্রখ্যাত উলামা যথা ইমাম আবূ ইউসুফ (র.), ইমাম মুহাম্মদ (র.), ইমাম যুফার (র.). হাসান ইবন যিয়াদ (র.), আবদুল্লাহ্ ইবন মুবারক (র.), ওয়াকী ইব্ন জাররাহ্ (র.), হাস ইন্ন পিয়াস (র.), ইয়াহইয়া ইব্ন যাকারিয়া (র.), আদি ইব্ন আমর আল-কাযী (র:), নূহ ইব্ন আল-মুতী বাল্বী (র.), ইউসুফ ইব্ন খালিদ (র.) প্রমূখ চল্লিশ জন ফিকহবিদ সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী বোর্ড গঠন করে ফিকহে হানাফী রচনা ও সংকলন করেন। এ মাযহাবের মাসআলা মাসাইলকে সহজ-সরলভাবে প্রণয়ন করা হয়। যা মানুষের সাধ্য ও সামর্থের সাথে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ মাযহাবের উসূল ও নীতিমালা অত্যাধিক ব্যাপক। মাসাইলের সংখ্যাও প্রচুর। সব বিষয়ের সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মাসআলার সামাধান এর মধ্যে রয়েছে। সম্ভবত এ কারণেই ১৭০ হিজরীতে খলীফা হারুনুর রশীদ ইমাম আবূ ইউসুফ (র.)-কে প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত করে রাষ্ট্রীয়ভাবে ফিহে হানাফী বা হানাফী মাযহাব চালু করেন। ফিে হানাফী রাষ্ট্রীয়ভাবে স্থান পাওয়ার কারণে হানাফী মাযহাব ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে।(আইম্মা আরবাআহঃ কাযী মুহাম্মদ আতহার হোসাইন, ১৯-২১ পৃষ্ঠা)
ইমাম আবূ হানীফা (র.)-এর শাগরীদ ছিল অনেক। তাঁরা বিভিন্ন দেশ তথা ইরাক, বলখ, খুরাসান, সমরকন্দ, বুখারা, রায়, সিরাজ, তুনিস, জানজান, ইস্তারাবাদ, বুস্তাম, ফারগানা, দামগান, খাওয়ারিজাম 'ও ভারত ইত্যাদি স্থান সমূহে ছড়িয়ে পড়েন। তাঁরা সর্বত্র ইমাম আবু হানীফা (র.)-এর মাযহাব প্রচার করেন। বিভিন্ন এলাকার উলামায়ে কিরাম মুসলিম জনগণ এ মাযহাব গ্রহণ করেন। তাঁরা তা নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করেন। এবং বিভিন্ন কিতাবাদি রচনা করে এ মাযহাবের প্রসারতা বৃদ্ধি করেন। (উমদাতুর রি আয়াহ্, ৭ পৃষ্ঠা)
বসরায় উসামান বাত্তী (র.) ছিলেন প্রখ্যাত ফকীহ্ ও মুক্তী। ইমাম যুফারের (র.) পূর্বে ইমাম আবূ হানীফার বিশিষ্ট শাগরিদ খালিদ সিম্মী (র.) শিক্ষা-সমাপনের পর বসরায় প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি দারসের মজলিস কায়েম করে ইমাম আবু হানীফার (র.) মাযহাব প্রচার করতে শুরু করেন। কিন্তু তাঁর মজলিসে যখন তিনি উসমান ধাত্তীর মতের খিলাফ ইমাম আবূ হানীফার মত বর্ণনা করতেন তখন উসমান বাত্তির শাগরিদরা তাঁকে শুধু গালমন্দই নয় বরং প্রহার করতেও উদ্ধত হত। তাই খালিদ সিম্ভী (র.) সেখানে ইমাম আবূ হানীফা (র.) -এর মাযহাব প্রচার করতেন ব্যর্থ হন।
এরপর ইমাম যুফার (র.) বসরায় গমন করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান। তিনি প্রথমে নিজের মজলিসকায়েম না করে উসমান বাত্তীর দরসে বসে পড়েন। উসমান বাত্তী (র.) কোন ব্যাপারে মাসআলা বললে তিনি বলতেন, এ ব্যাপরে আরো একটি সুন্দর ও যুক্তিপূর্ণ অভিমত রয়েছে। উসমান বাত্তী (র.) তা জানতে চাইলে তিনি তা ইমাম আবু হানীফার (র.) উসূল ও নীতিমালা ব্যক্ত করেন। শক্তিশালী প্রমাণ ও অকাট্য যুক্তির কারণে উসমান বাত্তী (র.) তা মানতে বাধ্য হতেন। ইমাম যুফার (র.) যখন বুঝতে পারতেন যে, মজলিসে সকল ছাত্র তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। তখন তিনি বলতেন, এটা ইমাম আবূ হানীফা (র.)-এর অভিমত। তা শুনে মজলিসে অংশ গ্রহণকারীরা বলে উঠত, যে-ই বলুক না কেন এটা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য অভিমত। এ কৌশল অবলম্বনে ধীরেধীরে মজলিসের সকল ছাত্র ইমাম যুফারের দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং বাত্তীর দরস বর্জন করে ইমাম যুফারের দরসে ভীড় জমাতে থাকেন। সেখানে ইমাম আবু হানীফা (র.)-এর মাযহাবের প্রসার লাভ করে। (লামহাতুন নাযার ফী সীরাতিল ইমাম যুফার (র.))
আফ্রিকায় ইমাম আবূ মুহাম্মদ আবদুল্লাহ্ ইব্ন ফাররূখ (র.) হানাফী মাযহাব প্রচার করেন। যখন ইমাম আসাদ ইব্ন কুরাত সেখানকার কাযী (বিচারপতি) মনোনীত হন; তখন এ মাযহাবের আরো উন্নতি সাধিত হয়। হিজরী চতুর্থ শতাব্দি পর্যন্ত আফ্রিকায় হানাফী মাযহাবের প্রাধান্য অব্যাহত থাকে। এরপর যখন সেখানে মু'আয ইব্ন বাদিস-এর রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তিনি সেখানে মালিকী মাযহাব চালু করেন। স্পেনে মুসলিম শাসনের প্রথম যুগ থেকেই হানাফী মাযহাব প্রচলিত ছিল। (আইম্মা আরবাআহঃ কাযী মুহাম্মদ আতহার হোসাইন, ১৯-২০ পৃষ্ঠা)
চতুর্থ শতাব্দির প্রসিদ্ধ পর্যটক মুকাদ্দাসী বাশারীর বর্ণনা দ্বারা জানা যায় যে, সেকালে ইয়ামন ও সাতে হানাফী মাযহাব ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। ইরাকের অধিকাংশ ক্বারী ও ফকীহ্ হানাফী মতাবলম্বী ছিলেন। সিরিয়ার প্রত্যেক শহর ও গ্রামে হানাফী মাযহাবের অনুসারী বিদ্যমান ছিল। অনেক সময় প্রাচ্যের দেশসমূহে তথা খুরাসান, সিজিস্তান, পশ্চিম ও পূর্ব তুর্কিস্তান ইত্যাদি স্থানে হানাফী মাযহাবে প্রাধান্য ছিল। জুরজান ও তাবরিস্তানের কিছু এলাকায় হানাফী মুসলিম বিদ্যমান ছিল। আবিসিনিয়া, তাবরীয ও আহওয়ায এলাকা সমূহে হানাফী মাযহাবের প্রাধান্যতা ছিল। এ সকল এলাকার উলামা, ফকীহ্ ও ক্বারী হানাফী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। পারস্যে হানাফী মাযহাবের যথেষ্ট প্রভাব ছিল।
সিন্ধুর শহর ও গ্রামে হানাফী ইমাম ও ফকীহতে পরিপূর্ণ ছিল। হিন্দুস্তানের অধিকাংশ বাদশাহ ও মুসলিম জনগণ হানাফী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন ও আছেন।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০৪৮) মাযহাবের উৎপত্তি ও বিকাশ | (০৫০) শাফিয়ী মাযহাবের বিকাশ |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |