পরম করুণাময় আল্লাহ্ তা'আলা মানব জাতির হিদায়েতের জন্য যুগে যুগে নবী রাসূল প্রেরণ করেছেন এবং তাঁর হুকুম-আহকাম শিক্ষাদান ও বাস্তবায়নের নিমিত্তে নবী রাসূলগণের প্রতি আসমানী কিতাব নাযিল করেছেন। সে প্রেক্ষিতে তিনি সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হিসাবে হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে পবিত্র কুরআন সহ প্রেরণ করেছেন। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ (সা.) সে কুরআন অনুযায়ী মানুষকে হিদায়াত করেছেন। এবং সকল সমস্যার সমাধান দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ইন্তিকালের পর তাঁর কাছ থেকে সরাসরি শিক্ষাপ্রাপ্ত সাহাবা-ই কিয়াম কুরআন ও হাদীসের আলোকে দীনও শরী'আতের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং যুগ জিজ্ঞাসার জবাব দিতেন। সাহাবীগণের মধ্যে যাঁরা ফকীহ্ ছিলেন, তাঁরা ফাওয়া প্রদানের দায়িত্ব পালন করতেন। তাঁদের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণীর ফকীহ্ ছিলেন।
১. যাঁদের ফাতোয়া ছিল প্রচুর। যেমন-হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.), হযরত আলী মুরতাযা (রা.) হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন মাসউদ (রা.) প্রমূখ।
২. যাঁদের ফাতোয়া প্রথম শ্রেণীর তুলনা কম ছিল। যেমন, হযরত আবু বকর, উম্মুল মু'মিনীন হযরত উম্মে সালামা (রা.) প্রমূখ।
৩. যাঁদের ফাতোয়া দ্বিতীয় শ্রেণীর তুলনায় আরো কম ছিল। এ সকল ফকীহ্ সাহাবীগণের মধ্যে ও কোন কোন মাস'আলায় ইজতিহাদী ইখতিলাফ রয়েছে। তবে তা অতি সামান্য। (আইম্মা আরবাআহ্ঃ মাওলানা কাযী আতহার হোসাইন, পৃষ্ঠা-১১)
সাহাবা ও তাবিঈনের যুগে ইল্মে শরী'আতের ধারকবাহক ফকীহ্ মুক্তীগণ হিজায, সিরিয়া, মিসর, ইরাক ও অন্যান্য এলাকা সমূহে ছাড়িয়ে পড়েন। মদীনাতে উন্মুল মু'মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.), হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন উমর (রা.), সাঈদ ইব্ন মুসায়্যিব (র.), কাসিম ইবন মুহাম্মদ (র.) প্রমূখ। মক্কাতে আবদুল্লাহ্ ইব্ন আব্বাস (রা.), আতা ইব্ন আবু রাবাহ্ (র.), মুজাহিদ (র.), উবাইদ ইব্ন উমাইর (র.) প্রমূখ। বসরাতে আনাস ইব্ন মালিক (রা.), উমর ইব্ন সালামা (র.), আবু মারইয়াম (র.), হাসান বাসরী (র.), মুহাম্মদ ইব্ন সীরীন (র.) প্রমুখ। সিরিয়ায় হযরত আবু দারদা (রা.), আবদুর রহমান ইব্ন গানাম আল-আশআরী (রা.), আবূ ইদ্রীস খাওলানী (র.), শুরাহবীল (র.) প্রমূখ। কৃষ্ণাতে আবদুল্লাহ্ ইব্ন মাসউদ (রা.), আলকামা (র.), আসওয়াদ (র.), মাসরূক-হাম্মাদ ইবন হারিস (র.), সুফইয়ান সাওরী (র.), আবূ হানীফা প্রমূখ। মিশরে আবদুল্লাহ্ ইব্ন আমর ইবনুল আ'স (রা.) বুকাইর (র.) প্রমূখ। অন্যান্য এলাকায় অপরাপর ফক্বীহ্ ও মুক্তীগণ বিদ্যমান ছিলেন। (আইম্মা আরবাআহ্: মাওলানা কাযী আতহার হোসাইন, পৃষ্ঠা-১১)
এ সকল মুস্তী ও ফকীহ্ গণের উসূল ও নীতিমালার মধ্যে কিছুকিছু পার্থক্য ছিল। উলামা-ই-হিজায সনদ ও মতন সংরক্ষণের প্রতি অধিক গুরুত্ব আরোপ করতেন। তাঁদের সহচার্যে যে সকল ফকীহ্ মুফতী গড়ে উঠেছেন তাঁরা ও এ ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছেন। ইমাম মালিক (র.) ছিলেন এ সকল ফকীহগণের ইল্মের ধারক বাহক।
উলামা-ই-ইরাক হাদীসের অর্থ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও রহস্য উদ্ঘাটনের প্রতি অধিক জোর দিতেন। তাঁদের তত্ত্বাবধানের গড়ে উঠেছিলেন অনেক ফকীহ্ ও মুক্তী। এ সকল ফকীহর ইল্মের উত্তরসূরী ও ধারক-বাহক ছিলেন ইমাম আবু হানীফা (র.)। যিনি তাঁর শাগরিদগণকে নিয়ে ফিক'হ্ ও উসূলে ফিকহ্ সংকলন করেন।
ইমাম মালিক (র.) এর পর হিজাযের ফকীহগণের শিরোমণি ইমাম শাফিঈ (র.) ছিলেন উল্লেখযোগ্য। একদিকে তিনি উলমা-ই-হিজায থেকেও শিক্ষা লাভ করেন। যার ফলে তাঁর উপর হিজাযা ও ইরাক উভয় স্থানের প্রভাব পড়ে। তাই তিনি উভয় স্থানের ফকীহগণের ইলমের সমন্বয় সাধন করে ফিকহ্ সংকলন করেন।
দ্বিতীয় শতাব্দির শুরুতে আহমাদ ইবন হাম্বল (র.) শ্রেষ্ট মুহাদ্দিস ও ফকীহ্ ছিলেন। তিনি হিজাযী ইল্মে ধারায় ইলমে ফিকহ্ সংকলন করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি হাদীসের যাহেরি অর্থের উপর গুরুত্ব প্রদান করেন। তাঁর সুযোগ্য শাগরিদ খাল্লাল তাঁর মাসাইল ও ফাওয়াগুলো 'জামিস্টল কাবীর )الجامع الكبير( নামে ২০ খণ্ডে বিরাট গ্রন্থাকারে সন্নিবেশিত করেন।
এ ছাড়া ও বিভিন্ন শহর এলাকায় বহু ফকীহ্ মুক্তী বিদ্যমান ছিলেন। প্রত্যেক শহর ও এলাকার জনসাধারণ স্থানীয় মুক্তী ও ফকীহ্ ও ফকীহগণের অনুসরণের করতে থাকেন। যার ফলে প্রত্যেক এলাকার মুক্তীর ফাওয়া মাসাইল ঐ এলাকার জন সাধারণের জন্য একটি স্বতন্ত্র মাযহাবরূপে গৃহীত হয়। আর-এ ভাবেই মাযহাবগুলোর উৎপত্তি ও সূচনা হয়। প্রসিদ্ধ চারটি মাযহাব ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করার পূর্বে কিছু কাল যাবৎ নিম্নবর্ণিত মাযহাবগুলো প্রচলিত ছিল বলে জানা যায়। যেমন ইমাম সুফইয়ান সাওরী (র.), ইমাম হাসান বাসরী (র.), ইমাম আওযায়ী (র.) এর মাযহাব। মুসলিম জনগণ তাঁদের অনুসরণ করত। এ তিনটি মাযহাব হিজরী তৃতীয় শতাব্দি পর্যন্ত চালু থাকে। এরপর তাঁদের মাযহাব বিলুপ্ত হয়ে যায়। এছাড়া ইমাম আবূ সাউর (র:)-এর মাযহাবও তৃতীয় শতাব্দি পর্যন্ত চালু থেকে পরে বন্ধ হয়ে যায়। তবে ইমাম দাউদ যাহিরী (র.) এর মাযহাব ঐতিহাসিক ইব্ন খালদূন-এর ভাষ্যানুযায়ী হিজরী ৮ম শতাব্দি পর্যন্ত ছিল বিদ্যমান ছিল বলে জানা যায়। তাছাড়া ইস্হাক ইবন রাহওয়ায় (র.) সুফইয়ান ইব্ন উয়াইনা (র.) ইব্ন জারীর তাবাবী (র.) লাইস ইবন সা'দ (র.) এর মাযহাব ও কিছু দিন পর্যন্ত চালু ছিল। মোটকথা পরবর্তী এক সময়ে এ সব মাযহাব বিলুপ্ত হয়ে যায়। শুধু হানাফী, মালিকী, শাফিঈ ও হাম্বালী এ চারটি মাযহাবই অবশিষ্ট থাকে। মাযহাব অনুসারীগণের সংখ্যা ও দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা'আতের আলিমগণ মাযহাবের যে কোন একটির অনুসরণ বা তাক্বীদ করাকে অবশ্য করণীয় বলে ফাতওয়া প্রদান করেন। (আইম্মা আরবাআহ্: মাওলানা কাযী আতহার হোসাইন, পৃষ্ঠা ১৯-২১)
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০৪৭) যিন্দীক (زندیق) | (০৪৯) হানাফী মাযহাবের বিকাশ |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |