وَإِن كُنتُمْ فِي رَيْبٍ مِّمَّا نَزَّلْنَا عَلَىٰ عَبْدِنَا فَأْتُوا۟ بِسُورَةٍ مِّن مِّثْلِهِۦ وَٱدْعُوا۟ شُهَدَآءَكُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ إِن كُنتُمْ صَـٰدِقِينَ
(পারা ১ সূরা বাকারা, রুকু-৩)
অর্থাৎ 'আর আমি আমার খাস বান্দার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি, তাতে তোমাদের কোন সন্দেহ থাকলে তোমরা তার অনুরূপ কোন সূরা আনয়ন কর এবং তোমরা যদি সত্যবাদী হও, তবে আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের সকল সাহায্যকারীকে আহ্বান কর।'
মক্কার কাফিররা বলে বেড়াত যে, কুরআনুল করীম হুযুর পাক (দঃ) নিজ থেকে তৈরী করে শুনাচ্ছেন। এ আয়াতের মাঝে এরই উত্তর দেয়া হয়েছে। মানব তৈরী জিনিষের পরিচয় এই যে, অন্য একজন লোক অনুরূপ আরও একটি জিনিষ তৈরী করতে পারবে। কিন্তু যে জিনিষ কোন মানুষ দ্বারা সম্ভব নয়, বুঝতে হবে যে, তা একমাত্র আল্লাহরই সৃষ্ট।
জোনাকি এবং পিঁপড়া যদিওবা অত্যন্ত দুর্বল, তা সত্ত্বেও কেউ এগুলোকে মানব তৈরী বলে না। অথচ রেলগাড়ীর ইঞ্জিন এবং বিদ্যুৎ যদিওবা খুবই শক্তিশালী, তা সত্ত্বেও সবাই জানে যে, এটি মানব তৈরী জিনিষ। কিন্তু কেন? এজন্য যে, এখন অসংখ্য ইঞ্জিন এবং বিদ্যুৎ তৈরীর কারখানা আছে। কিন্তু পিঁপড়া এবং জোনাকি তৈরীর কারখানা কেউই আবিষ্কার করতে পারেনি, পারবে ও না। আর তাই এ আয়াতে এ কথাই বলা হয়েছে যে, যদি কুরআন করীম মানবের তৈরী হয়, তাহলে তোমরাও এ ধরনের কুরআন তৈরী করে আন।
বাহ্যিকভাবে একথাই দৃষ্ট হচ্ছে যে, এ আয়াতে কুরআন পাকেরই তারিফ হচ্ছে। কিন্তু গভীর দৃষ্টিতে বুঝা যায় বিধিষ্ট কুরানেরও প্রশংসা আছে, সাথে সাথে কুরআন ওয়ালারও প্রশংসা রয়েছে। কেননা হয়র পাক (দঃ) সৃষ্টের কারোও ছাত্র নন, বরঞ্চ তিনি সবার শিক্ষক হয়েই তশরীফ এনেছেন। স্বয়ং রাবুল আলামীন মাধ্যম ব্যতিরেকে তাঁর শিক্ষক এবং তিনি তাঁরই ছাত্র।
[উর্দু]
অর্থাৎ হুযুর আকরম (দঃ) বস্তুবাদী জগতের কারও নিকট থেকে লিখা পড়া শিখেননি। বরঞ্চ তিনি মহান আল্লাহরই প্রত্যক্ষ শাগরেদ।
সাধারণতঃ এটিই নিয়ম যে, মহান শিক্ষকের ছাত্রও মহান হয়। বিজ্ঞ শিক্ষকের নিকট পড়া প্রত্যেকের কাজ নয়। যাঁর শিক্ষা এবং পাঠদানকারী স্বয়ং রাব্বুল আলামীন, সে ক্ষেত্রে শিক্ষা গ্রহণ কারী মাহবুব (দঃ) কেমন জ্ঞান-বিজ্ঞানের অধিকারী হতে পারেন? এজন্যই চ্যালেঞ্জ করে বলা হয়েছে যে, সকল সাহায্যকারীকে আহবান কর এবং দুনিয়ার সমস্ত জ্ঞানীদের সম্মেলন করে কুরআনের মুকাবিলা করার চেষ্টা কর। এতদসত্ত্বেও তোমরা তা পারবে না। কেননা সকল জ্ঞানীগণ মাখলুক থেকে শিখেই জ্ঞানী হয়েছে। তারা মাখলুকেরই ছাত্র। সুতরাং তারা ঐ মহান সত্ত্বার মুকাবিলা কিভাবে করবে, যিনি স্রষ্টার ছাত্র এবং গোটা মাখলুকের মুয়াল্লিম বা শিক্ষক। তাঁর উপর সালাত এবং সালাম বর্ষিত হোক।
মুফাস্সিরগণ এই আয়াতের অন্য এক অর্থ এভাবেও করেছেন যে, [আরবী] এর মধ্যে যে জমির (সর্বনাম) আছে, তা হুযুর পাক (দঃ) এর দিকে ধাবিত। অতএব আয়াতের অর্থ এমন হবে যে, এমন একটি সূরা বানিয়ে আন, যা মুহাম্মদ মুস্তাফা (দঃ) এর মত সত্ত্বার পবিত্র মুখ হতে নিঃসৃত হয়েছে। অর্থাৎ প্রথমে অনুসন্ধান করে এধরনের মর্যাদা পূর্ণ আল্লাহর অন্য কোন মাহবুব বের করে নাও, এর পরে তাঁর মুখ থেকে এধরনের আয়াত পড়িয়ে শুন। (মোদারেক খোযেন, ইত্যাদি) এ কথার অর্থ এই যে, আসমানের নীচে কোথাও হুযুর (দঃ) এর মত সত্ত্বা পাওয়াও যাবে না। সুতরাং কুরআনের মত এধরনের কালামও কেউ শুনাতে পারবে না। যদ্বারা প্রমাণিত হয় যে, হুযুর পাক (দঃ) এর কোন নজির অথবা দৃষ্টান্ত নেই। যেমন হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে [আরবী] অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে আমার মত কে আছ? অন্য জায়গায় ইরশাদ হয়েছে [আরবী] অর্থাৎ আমি তোমাদের কারও মত নই।' এবং জ্ঞানেরও এই দাবী যে, হুযুর পাক (দঃ) এর মত কেউই হতে পারে না।
আমরা সবাই মুমিন, আর হুযুর পাক (দঃ) ঈমান। আমরা সত্যবাদী আর তিনি নিজে আপাদামস্তক সত্যের আধার। মানুষেরা জ্ঞানী আর তিনি নিজেই জ্ঞান। কেননা তাঁকে জানা চেনার নামই হচ্ছে ইলম। আমাদের প্রস্রাব পায়খানা নাপাক অথচ হুযুর (দঃ) এর প্রস্রাব-পায়খানা উম্মতের জন্য পাঁক, আমাদের নিদ্রা ওযু ভেঙ্গে দেয়। কিন্তু তাঁর নিদ্রায় ওযু ভাঙ্গে না। আমরা সবাই শুনে বেহেশত দোযখ এবং আল্লাহর জাত সিফাতের উপর ঈমান এনেছি। আমাদের ঈমান শোনাকৃত, অথচ হুযুর পাক (দঃ) দেখেই ঈমান এনেছেন। আমাদের সকলের উপর পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয, হুযুর (দঃ) এর উপর তাহাজ্জুদ সহ ছয় ওয়াক্ত ফরয। যেমন ইরশাদ হচ্ছে
[আরবী]
অর্থাৎ “রাত্রে আপনি তাহাজ্জুদও পড়ুন। এটি আপনার জন্য অতিরিক্ত।”
সবার জন্য ইসলামের আরকান পাঁচটি। কিন্তু হুযুর পাক (দঃ) এর জন্য চারটি। অর্থাৎ তাঁর উপর যাকাত ফরয নয়। (শামী যাকাত অধ্যায়) আমাদের জন্য চার স্ত্রী পর্যন্ত রাখা জায়েয, কিন্তু হুযুর (দঃ) যতজন চান, রাখতে পারেন। আমাদের সম্পদ উত্তরাধিকারদের মধ্যে বন্টন হয়। কিন্তু হুযুর (দঃ) এর সম্পদ বন্টন হয়না।
আমাদের মৃত্যুর পর আমাদের স্ত্রীগণ অন্যের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে কিন্তু হুযুর পাক (দঃ) এর ওফাত মুবারকের পর তাঁর পবিত্র বিবিগণ কারো সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে না। রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করছেন-
[আরবী]
তাঁর স্ত্রীগণকে তাঁর পরে কক্ষনো বিবাহ করা যাবে না" ।
বস্তুতঃ হুযুর পাক (দঃ) এর সাথে অন্যের ইবাদত এবং মুয়ামিলাত, প্রত্যেক দিক থেকেই সীমাহীন পার্থক্য বিদ্যমান। এর পরও কিভাবে বলা যায় যে, আমরাও হুযুর পাক (দঃ) মতই মানুষ। এ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত বিশ্লেষণ انما انا بشر مثلكم অধ্যায়ে আসবে ইনশাআল্লাহ।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০০৪) আয়াতঃ ১ | (০০৬) আয়াতঃ ৩ |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |