هُوَ ٱلۡأَوَّلُ وَٱلۡآخِرُ وَٱلظَّٰهِرُ وَٱلۡبَاطِنُۖ وَهُوَ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمٌ
(সুরা হাদীদ, পারা ২৭, রুকু: ১)
অর্থাৎ- "তিনিই আদি, তিনিই অন্ত, তিনিই ব্যক্ত, তিনিই গুপ্ত এবং তিনিই সর্ব বিষয়ে সম্যক অবহিত।”
শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিছ দেহলবী (রহঃ) 'মাদারিজুন নবুয়্যত' কিতাবের ভূমিকায় ইরশাদ করেছেন যে, উক্ত আয়াত খানিতে আল্লাহর হামদও রয়েছেএবং সাথে সাথে এতে মুহাম্মদ মুস্তাফা আহমদ মুজতবা (দঃ) এর না'ত বা প্রশংসাও বিদ্যমান। হযুরে পাক (দঃ) সবার পূর্বের আবার সবার শেষের। তিনি সকলের নিকটই প্রকাশ্য, আবার সবার নিকট গোপনও। এবং তিনি সকল কিছুরই ইলম রাখেন।
প্রথমত: দুনিয়া এবং আখিরাত সর্বস্থানেই তিনি সর্বপ্রথম, সকলের পূর্বে তার নূর মুবারক সৃষ্টি করা হয়েছে
[আরবী]
'আল্লাহ সর্বপ্রথম আমারই নূর সৃষ্টি করেছেন।'
বাহ্যিকভাবে তো হযরত আদম (আঃ) হুযুর পাক (দঃ) এর পিতা। যেমন বাহ্যিক অর্থে বৃক্ষ হতে ফুল হয়, কিন্তু মূলতঃ ফুল হতেই বৃক্ষহয়। কবির ভাষায়-
[উর্দূ]
অর্থাৎ (ইয়া রাসুলাল্লাহ) 'আপনিই বাহ্যিকভাবে আমার ফল, কিন্তু হাকীকতে আপনিই আমার মূল। এই ফুলের স্মরণে মানব পিতা আদম (আঃ) এর এটিই শ্লোগান।'
হযুর আকরম (দঃ) এই পৃথিবী নামক বাগানের ফুল। সর্বপ্রথম তাঁকেই নবুয়্যত প্রদান করা হয়েছে। তিনি নিজেই ইরশাদ করেছেন:
[আরবী]
'আমি ঐ সময় হতেই নবী যখন হযরত আদম (আঃ) মাটি-পানিতেই ছিল।'
'ইয়াউমুল মিছাক' বা প্রতিশ্রুতির দিবসে আমি কি তোমাদের রব নই? এর উত্তরে সর্বপ্রথম হুজুর আকরম (দঃ)ই بلی বলেছিলেন।
কিয়ামত দিবসে সর্বপ্রথম তার নূরানী কবরই উন্মুক্ত করা হবে, এবং সেদিন সর্বাগ্রে তিনিই সিজদার অনুমতি প্রাপ্ত হবেন। সর্বপ্রথম হুযুর পাক (দঃ) শাফায়াত করবেন এবং শাফায়াতের দ্বার তাঁরই পবিত্র হস্তে উন্মুক্ত হবে। সর্বপ্রথম হুযুর পাক (দঃ)ই জান্নাতের উদ্বোধন করবেন এবং তিনিই সর্বাগ্রে জান্নাতে প্রবেশ করবেন, পরে অন্যান্য নবীগণ। সর্বপ্রথম হুযুর পাক (দঃ) এর উম্মতগণই জান্নাতে প্রবেশ করবে, পরে অন্যান্য নবীগণের উম্মতগণ।
বস্তুত, প্রত্যেক স্থানেই প্রথম হওয়ার তাজ তাঁরই পবিত্র মাথায় শোভিত। দিনের মধ্যে প্রথম দিন অর্থাৎ জুমআ হুযুর পাক (দঃ) কেই প্রদান করা হয়েছে। এভাবে সর্বক্ষেত্রে প্রথম হয়া সত্বেও সরকার দো আলম (দঃ) আখেরীও বটে। সর্বশেষে তাঁরই প্রকাশ হয়েছে।
خاتم النبيين বা আখেরী নবী তাঁরই উপাধি। সর্বশেষে হুযুর পাক (দঃ) ই কিতাব প্রাপ্ত হয়েছেন। সর্বশেষে তাঁর দ্বীনেরই প্রকাশ ঘটেছে এবং সর্বশেষ দিন অর্থাৎ কিয়ামত পর্যন্ত হুযুর পাক (দঃ) এর দ্বীনকেই বলবৎ রাখা হয়েছে।
কবির ভাষায়:
[উর্দূ]
অর্থাৎ- কত তারকা যে উদিত হয়ে অস্তমিত হয়েছে, তার কোন ইয়ত্তা নেই, একমাত্র আমাদের প্রিয় নবীই উদিত হয়ে আর অস্তমিত হননি।
'হুজুর আকরম (দঃ) ই প্রথম এবং শেষ। এ সত্যকে সুপ্রকাশিত করাই ছিল মিরাজের পথে বায়তুল মুকাদ্দসে আসরার নামাযের মূলভেদ। কেননা যারা অতীতে (নবুয়াতের) বাদশাহী করে গিয়েছিলেন তাঁরাও সেদিন হাত বেধে সাইয়্যেদুল মুরসালীন (দঃ) এর পেছনে উপস্থিত ছিলেন।"
এখন রয়েছে জাহের এবং বাতেন শব্দদ্বয়। হুযুর আকরম (দঃ) সকলের নিকট ব্যক্ত এবং সব সময়ের জন্যই ব্যক্ত। সকলের কাছে তো এভাবে ব্যক্ত যে, তাঁকে মুসলমানেরাও জানে, আর কাফিররাও চিনে।
"তারা রাসূলকে এভাবে চিনে, যেভাবে তারা তাদের সন্তান সন্ততিদেরকে চিনে।" এখানে হুযুর আকরম (দঃ) এর জানা-চেনাকে সন্তান সন্ততির দৃষ্টান্ত দিয়ে দেখানো হয়েছে, পিতার দৃষ্টান্ত নয়। এর তিনটি কারণ রয়েছে- পুত্র পিতাকে অকাট্য দলিল ছাড়াই লোকদের নিকট শুনেই জানে। অথচ পিতা স্বীয় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া, স্ত্রীর গর্ভধারণ, জন্ম ইত্যাদি অকাট্য দলিলাদি দ্বারা পুত্রকে অকাট্যভাবেই জানে।
তদ্রুপ কাফিররাও হুজুর পাক (দঃ) কে শুধু লোক মুখে শুনে নয়, বরং অকাট্য দলিলাদি দ্বারাই চিনে। একই সাথে পুত্র দুনিয়ায় আসার পর পিতাকে চিনে। কিন্তু পিতা জন্মের পূর্ব হতেই পুত্রকে জানে। অনুরূপভাবে কাফিররাও হুযুর (দঃ) কে তাঁর দুনিয়ায় আগমনের পূর্ব হতেই চিনতো। এবং তার আগমনের জন্য দুআও করতো। উপরন্তু সন্তান দুনিয়ায় এসেই পিতাকে চিনে না বরঞ্চ একটু জ্ঞান হলেই চিনে, কিন্তু পিতা স্বীয় পুত্রকে প্রথম অবস্থা হতেই জানে।
একইভাবে হুযুর পাক (দঃ) কে তাঁর ছোটবেলা হতেই সমগ্র সৃষ্টি জানতো। যেমন পাহাড় তাঁকে সালাম দিত। পাথর সুসংবাদ দিত। বৃক্ষাদি তাঁকে ছায়া দেয়ার জন্য ঝুঁকে পড়তো। চন্দ্র তার সাথে কথা বলতো। আর কাফিররাও তার নবুয়্যতের সাক্ষী প্রদান করতো।
কবির ভাষায়:
[উর্দূ]
অর্থাৎ- তাঁর পবিত্র আকলের কারণে তাঁর মাথার উপর মর্যাদার তারকা ঝলমল করতো।'
পশু পক্ষী তাঁকে চিনে। উট তাকে সিজদা করে। বনের হরিণ তাঁর নিকট আশ্রয় তালাশ করে। চন্দ্র সূর্য তাকে জানে। বরঞ্চ চন্দ্রতো তাঁর ইশারা পেয়েই দু'টুকরা হয়ে যায়। আর অস্তমিত সূর্য পূণঃ উদিত হয়। কেননা মাহবুবে খোদা (দঃ) এর ইশারাও তা-ই ছিল।
মর্তবাসী তাঁকে চিনে। আরশওয়ালার কাছেও তাঁর পরিচয় আছে। হযরত আদম (আঃ) চক্ষু খোলা মাত্র মহান আরশে আল্লাহর নামের পার্শ্বে তাঁর মাহবুব (দঃ) এর নাম মুবারকও লিখিত পেয়েছেন। জান্নাতী এবং জাহান্নামী সবাই হুযুর আকরম (দঃ) কে চিনে। জান্নাতের প্রতিটি স্থানে স্থানে হুরদের চক্ষুতে, গেলমানদের বক্ষে, বস্তুত প্রত্যেকটি জায়গায়ই লিখিত আছে: لا إِلَهَ إِلَّا اللهُ مُحَمَّدٌ رَّسُولُ اللهُ
কবির ভাষায়:
[উর্দূ]
অর্থাৎ "জান্নাতের সর্বত্র সারা জাহানের বাদশাহ হযুর আকরম (দঃ) এর নাম মুবারক খোদিত। জান্নাত তারই কর্তৃত্বে। সে মহান সত্ত্বার উপর সালাম।”
জাহান্নামীরাও স্বীকার করতঃ বলবে:
[আরবী]
'তারা বলবে, আমরা নামাজী ছিলাম না।'
তারা বুঝবে যে সাইয়্যেদুল আবরার (দঃ) এর বিরোধিতাই আজকে তাদেরকে এস্থানে নিয়ে এসেছে। মোট কথা, যেখানেই আল্লাহর চর্চা, সেখানেই আল্লাহর রাসুল (দঃ) এরও যিকর। গোটা আলমে তাঁরই নূর মুবারক এবং সকল জায়গাতেই তাঁর প্রকাশ। তার উপর সালাত এবং সালাম বর্ষিত হোক।
মাহবুব (দঃ) এর প্রত্যেকটি কাজ মুবারক কিয়ামত পর্যন্ত প্রত্যেকেরই জানা। তার হায়াত মুবারকের প্রতিটি অবস্থা যেমন পবিত্র বিলাদত, দুধ পান করা, লালিত পালিত হওয়া, নবুয়্যত পূর্বকার ঘটনাদি, নবুয়্যতের ঘোষণার পরে মক্কী এবং মদনী জিন্দেগী, চলা ফেরা, খাওয়া দাওয়া, নিদ্রা জাগরণ, হাসি কান্না—বস্তুত তার পবিত্র জীবনের প্রতিটি অধ্যায় প্রত্যেক স্থানে প্রকাশিত। আরবে যেমনি তার প্রকাশ, অনারবেও তার প্রকাশ, পাঞ্জাবেও তিনি প্রকাশিত, কাবুলেও তিনি বিরাজিত। এমন কোন জায়গা আছে যেখানে হাদীছ শাস্ত্র পৌঁছেনি?
হুযুর পাক (দঃ) এভাবে ব্যক্ত হওয়া সত্ত্বেও মজার ব্যাপার এই যে, তার মূল সত্ত্বা আল্লাহ ছাড়া আর কেউই বুঝতে পারেনি। কেননা ঐগুলো ছিল তার প্রকাশ্য শান। আর এটি তার গুপ্ত শান।
হাফিজ সিরাজী বলেনঃ
[উর্দূ]
অর্থাৎ- মাহবুবের আসল অবস্থান সম্পর্কে কেউই জানেনা। হাঁ, এতটুকু জানে যে, ঘন্টার ধ্বনি আসছে' অর্থাৎ ওহী আসছে।'
আর উর্দু কবির ভাষায়:
[উর্দূ]
অর্থাৎ- 'আমি শুনেছি আমার আকা-মাওলা (দঃ) মদীনায়ই থাকেন, কিন্তু এটি ভুল, তিনি প্রত্যেক আশেকেরই অন্তরে রয়েছেন।'
দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মৌলবী কাসেম নানুতবী 'কাসায়েদে কাসেমী'র মধ্যে লিখেন:
[উর্দূ]
অর্থাৎ- ইয়া রাসুলাল্লাহ! "আপনার আসল সত্ত্বা মানবীয় পর্দা দ্বারা ঢাকা। আল্লাহ ছাড়া আপনাকে আর কেউই জানেনি। আল্লাহ ভিন্ন অন্য কেউ আপনাকে কীভাবে জানবে? কেননা সূর্যের আলো যেমন সূর্যকে আচ্ছাদন করে রেখেছে, আপনার নূরও তেমনি দৃষ্টির জন্য অন্তরায়।"
বস্তুত, মানব আকারে হুযুর পাক (দঃ) এর মানবীয় সত্ত্বারই প্রকাশ হয়েছে। নতুবা হাকীকতে মুহাম্মদী (দঃ) সম্পর্কে আল্লাহ ভিন্ন আর কেউই কিছু জানে না। যেভাবে সূর্যকে তার আলো এভাবে আচ্ছাদন করে রেখেছে যে, অন্য কেউ সূর্যকে চোখ ভরে দেখতে পায় না। ঠিক একইভাবে নূরনবী (দঃ) এর নূর মুবারক তার মূল সত্ত্বার জন্য পর্দা হয়ে গেছে।
রব তাআলা এজন্যেই তার হাবীব (দঃ) কে নূর আখ্যায়িত করত। ইরশাদ করেছেন:
[আরবী]
অর্থাৎ- হে মুসলমানগণ, তোমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ হতে নূর এবং সুস্পষ্ট কিতাব এসেছে।
এ আয়াতের উপর আলোচনা পরে আসবে।
আয়াতে হুযুর আকরম (দঃ) এর পঞ্চম সিফাত বর্ণিত হয়েছে এভাবে:
[আরবী]
এবং সিফাত, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য জ্ঞান, এবং সৃষ্টির আদি-অন্ত সমস্ত জ্ঞানের আধার হচ্ছেন হুযুর পাক (দঃ)।
আল্লাহর সৃষ্টিতেঃ
[আরবী]
(সমস্ত জ্ঞানীগণের উপর মহান জ্ঞানী) হচ্ছেন আল্লাহর পিয়ারা মাহবুব (দঃ)।
যে মুবারক চক্ষু মিরাজের রজনীতে স্রষ্টার দীদার লাভ করেছেন, সে পবিত্র চক্ষু হতে সৃষ্ট আবার কিভাবে গুপ্ত থাকতে পারে।
কবির ভাষায়ঃ
[উর্দূ]
অর্থাৎ- "যখন স্বয়ং স্রষ্টাই তোমা হতে লুকায়িত নয়, তখন সৃষ্টির আর কী তোমার দৃষ্টির আড়ালে থাকতে পারে। তোমার উপর অসংখ্য দরুদ।"
(দীদারে ইলাহী সম্পর্কিত বিস্তারিত আলোচনা পরে আসবে ইনশাল্লাহ)।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০০৩) ভূমিকা | (০০৫) আয়াতঃ ২ |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |