অনেক রায ও নেয়াযের কথার পর আল্লাহ তায়ালা উম্মতে মোহাম্মদীর উপর দিনে রাত্রে ৫০ পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরয করলেন এবং নবী করিম (দঃ) কে বিদায় দিলেন। নবী করিম (দঃ) যখন ৬ষ্ঠ আকাশে আসলেন, তখন মুছা (আঃ)-এর সাথে সাক্ষাত হলো। সিদ্রাতুল মোস্তাহাতে জিব্রাইল (আঃ), কিংবা সপ্তম আকাশে হযরত ইব্রাহীম (আঃ), কিংবা অন্য কোন আকাশে অন্যান্য নবীগণের সাথে সাক্ষাতের উল্লেখ কোন হাদীসগ্রন্থে দেখা যায়না। শুধু মুছা (আঃ)-এর উল্লেখ রয়েছে- (বোখারী মুসলিম, মিশকাত প্রভৃতি হাদীস গ্রন্থ)। হযরত মুছা (আঃ) আরয করলেন- "কত ওয়াক্ত নামায ফরয করা হলো আপনার উম্মতের উপর"? হুযুর (দঃ) বললেন- পঞ্চাশ ওয়াক্ত। মূছা (আঃ) বললেন, আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি আপনার উম্মত তা আদায় করতে পারবে না। কেননা, আমার উম্মতের উপর আরও কম হওয়া সত্বেও তারা তা আদায় করতে পারেনি। সুতরাং আপনি আপনার রবের কাছে আবার ফিরে যান এবং হাল্কা করার প্রার্থনা করুন। হাদীসের এবারত নিম্নরূপ-
ارْجِعْ إِلَى رَبِّكَ وَاسْنَلِ التَّخْفِيفَ
অর্থ-"আপনার রবের কাছে ফিরে যান এবং হাল্কা করার দরখাস্ত পেশ করুন"।
হুযুর (দঃ) এরশাদ করেন- "অতঃপর আমি ফিরে গেলাম। আল্লাহ তায়ালা এবার পাঁচ ওয়াক্ত কমালেন। আমি পুনঃ ৬ষ্ঠ আকাশে ফিরে আসলাম। এবারও মুছা (আঃ) পুনরায় আমার রবের কাছে ফিরে যেতে আরয করলেন"। এভাবে নয় বার ৬ষ্ঠ আকাশ থেকে নবী করিম (দঃ) আল্লাহর দরবারে যাওয়া-আসা করলেন। আল্লাহ তায়ালা প্রতিবার পাঁচ ওয়াক্ত করে নামায কমাতে থাকলেন এবং পঞ্চাশের মধ্যে পঁয়তাল্লিশ ওয়াক্ত কমিয়ে মাত্র পাঁচ ওয়াক্ত বহাল রাখলেন। এবারও হযরত মুছা (আঃ) পুনরায় আল্লাহর দরবারে ফিরে যাওয়ার জন্য আরয পেশ করলেন। নবী করিম (দঃ) বললেন- "আমি পাঁচ ওয়াক্তেই রাজী হলাম। পুনরায় ফিরে যেতে লজ্জা লাগে”। আল্লাহ পাক সাথে সাথে ওহী নাযেল করলেনঃ
لا تبديل لكلمات الله
অর্থাৎ- "আল্লাহর ফায়সালার আর কোন পরিবর্তন হবে না"।
তবে আল্লাহ তায়ালা শান্তনা দিয়ে নবী করিম (দঃ) কে বললেন, "আপনার উম্মত পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করলে আমার এখানে পঞ্চাশ ওয়াক্তই লিখা হবে। সুতরাং আপনার উম্মতত্ত্বে পাঁচ ওয়াক্ত দেয়া যেমন ঠিক, তেমনিভাবে আমার পঞ্চাশ ওয়াক্তের নির্দেশও ঠিক। পার্থক্য শুধু সংখ্যায় "গুণে নয়"। সুবহানাল্লাহ! আল্লাহর কি অসীম দয়া! বান্দা পাঁচ ওয়াক্ত আদায় করবে, আর আল্লাহ তায়ালা তার দশগুন করে রেকর্ড করবেন-এমন নযির কোথাও আছে কি?।
পাঁচ ওয়াক্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার হেকমত তাফসীরে রুহুল বয়ান, ইতকান, বেদায়া নেহায়া প্রভৃতি গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। ফজর নামায হযরত আদম (আঃ) আদায় করতেন। যোহরের নামায হযরত ইব্রাহীম (আঃ), আসরের নামায হযরত ইউনুছ (আঃ), মাগরিবের নামায হযরত ঈছা (আঃ) এবং এশার নামায হযরত মুছা (আঃ) আদায় করতেন। আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করে পাঁচজন পয়গাম্বরের পাঁচ ওয়াক্ত নামায একত্রিত করে উম্মতে মোহাম্মদীকে দান করলেন। সুতরাং নামাযের ইবাদতটি নবীগণের স্মৃতি বহনকারীও বটে।
[মূলতঃ প্রত্যেক ইবাদতের মধ্যেই, এমনকি প্রত্যেক তসবিহ-এর মধ্যেও কোন। না কোন নবী, অলী অথবা ফেরেস্তার ইবাদতের স্মৃতি বিজড়িত আছে। যেমন- হজ্বের মধ্যে হযরত ইব্রাহীম, কোরবানীর মধ্যে হযরত ইসমাইল (আঃ), সাঈ- এর মধ্যে বিবি হাজেরা এবং আরাফাতে অবস্থানের মধ্যে হযরত আদম (আঃ)- এর স্মৃতি জড়িত। নামাযের মধ্যে কিয়াম, রুকু, সিজদা, তছবিহ্-ইত্যাদি ফেরেস্তাদের ইবাদতের স্মৃতি-যা নবী করিম (দঃ) মি'রাজে প্রত্যক্ষ করে এসেছেন। নবী করিম (দঃ) প্রথমে নিজে আমল করেছেন। পরে আমাদেরকে হুকুম করেছেন- হুযুর (দঃ) কে দেখে দেখে অনুসরণ করার জন্য। সুতরাং নবী করিম (দঃ)-এর অনুকরণ ও অনুসরণের নামই ইবাদত- যার মধ্যে রয়েছে অন্যদের স্মৃতি বিজড়িত। (জালালুদ্দীন সূযুতি কৃত শরহে সুদূর)।
এখানে প্রশ্ন জাগে- মি'রাজ থেকে প্রত্যাবর্তনকালে শুধু মুছা (আঃ)-এর সাথে হুযুর (দঃ)-এর সাক্ষাৎ এবং তাঁর অনুরোধে বার 'বার আল্লাহর দরবারে নবী করিম (দঃ)-এর যাতায়াত কি আল্লাহর ইচ্ছায় এবং পরিকল্পনা মোতাবেক হয়েছিল-না কি দুই নবীর ইচ্ছায় হয়েছিল? এ প্রশ্ন স্বাভাবিক। সাথে সাথে আর একটি প্রশ্নও এসে যায়। তাহলো- নবী করিম (দঃ) বার বার আল্লাহর দরবারে গেলেন কিসে করে এবং দুনিয়াতে ফেরত আসলেন কেমন করে? আরও একটি প্রশ্ন জাগে-মুছা (আঃ) কি উদ্দেশ্যে উম্মতে মোহাম্মাদীর জন্য সুপারিশ করেছিলেন? অন্য কোনও উদ্দেশ্য এর ভিতরে নিহিত ছিল কিনা? বিভিন্ন কিতাবে এসবের উত্তর দেয়া আছে। নিম্নে ক্রমান্বয়ে বর্ণনা করা হলো।
১। প্রথম প্রশ্নের উত্তর হলো: আল্লাহ তায়ালার পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেকই হযরত মুছা (আঃ) ৬ষ্ঠ আকাশে অপেক্ষমান ছিলেন। আল্লাহর ইচ্ছা ছিল- তাঁর প্রিয় হাবীব বারবার তাঁর দরবারে ফিরে যাক এবং দশবার তাঁর সাথে হাবীবের দীদার নসিব হোক। (তাফসীরে সাভী)
২। দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব হচ্ছে: ষষ্ঠ আকাশ থেকে আল্লাহর দরবারে যাতায়াতের ক্ষেত্রে বা দুনিয়াতে ফেরত আসার ক্ষেত্রে রফরফ বা বোরাক ব্যবহারের উল্লেখ হাদীসের কিতাবে সরাসরি পাওয়া যায় না। তাফসীরে রুহুল মাআনীতে বলা হয়েছে: যেভাবে বোরাকে করে নবী করিম (দঃ) মি'রাজ গমন করেছেন, সেভাবেই আবার ফেরত এসেছেন। এটাই স্বাভাবিক ধারণা। তাফসীরে রুহুল বয়ান তাফসীরে রুহুল মাআনীরও পূর্বে রচিত- তাই এর মতামত অধিক শক্তিশালী। উক্ত তাফসীরে রুহুল বয়ানের গ্রন্থকার সুরা নাজম- এর প্রথম তিনটি আয়াত-এর ব্যাখ্যায় বলেছেন:
والنجم - إِذَا هُوَى ، مَا ضَلَّ صَاحِبَكُمْ وَمَا غَوَى .
অর্থ-"নিম্নগামী তারকার শপথ। তোমাদের সাথী মোহাম্মদ (দঃ) কখনও পথ ভুলেননি বা পথভ্রষ্ট হননি এবং টেরা বাঁকাও হননি"।
তাফসীরকারক বলেন- উক্ত আয়াত মি'রাজের ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত। সাধারণ অর্থে অস্তমিত তারকা হলেও ইমাম জাফর সাদেক (রাঃ)-এর মতে 'নাজম দ্বারা উক্ত আয়াতে নবী করিম (দঃ) কেই বুঝান হয়েছে। কেননা হুযুর (দঃ)-এর এক হাজার নামের মধ্যে আন-নাজম একটি নাম"। আর هوی অর্থ নিম্নগামী। তাহলে আয়াতের অর্থ দাঁড়ায়- "আল্লাহর দরবার থেকে নিম্নগামী তারকা মুহাম্মদ মোস্তফা (দঃ)-এর শপথ"। আর 'পথ ভুলেননি বা টেরা বাঁকা হননি'- এই মন্তব্যের অর্থঃ "যে পথে তিনি এসেছিলেন, সেপথেই ফিরত গিয়েছেন"।
বোরাক বা রফরফের মাধ্যমে প্রত্যাবর্তন করলে একথার প্রয়োজন হতো না। কেননা, তখন তো বোরাক বা রফরফই তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতো। সুতরাং নবী করিম (দঃ) মি'রাজ থেকে আসাকালীন সময়ে আল্লাহর কুদরতে একা একা যাতায়াত করেছেন- এটাই সুস্পষ্ট। কেননা, তিনি তো নূর। নূর ও আলো সব কিছু ভেদ করে সোজা গতিতে ধাবিত হয়, এটাই বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত (তাফসীরে ইবনে আব্বাস রুহুল বয়ান-সুরা আন নাজম)। শুধু বাইতুল মোকাদ্দাছে এসে বোরাকে আরোহন করে তিনি মক্কায় পৌছেন। ৭০০ বৎসর পূর্বের ফারছী গ্রন্থ "রিয়াযুন নাসিহীন"-এ ইমাম জা'ফর সাদেক (রাঃ) হতে বর্ণনা করা হয়েছে- "মি'রাজ হতে ফিরে আসার পথে রফরফ, বোরাক বা ফিরিস্তা-কিছুই সাথে ছিলনা"।
৩। তৃতীয় প্রশ্নের জবাব হলো: একজন নবী ইন্তিকালের আড়াই হাজার বৎসর পরও অন্যের উপকার করতে পারেন। যেমন উপকার করেছিলেন মুছা (আঃ) উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য। এভাবেই আল্লাহর নবী এবং অলীদের উছিলায় সাধারণ মানুষের অনেক উপকার হয়। এ সম্পর্কে অসংখ্য প্রমাণ ও দলীল বিদ্যমান আছে।
বাহ্যিক দৃষ্টিতে মনে হয়- হযরত মুছা (আঃ) আমাদের উপকারের জন্য ৬ষ্ঠ আকাশে দাঁড়িয়ে থেকে নবী করিম (দঃ) কে বারবার আল্লাহর দরবারে যাতায়াত করতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর অন্য একটি উদ্দেশ্যও এর মধ্যে নিহিত ছিল। তাহলো-তাফসীরে সাভীতে উল্লেখ আছে, তিনি তূর পর্বতে আল্লাহর দীদার চেয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এমন কি- আল্লাহর যে তাজাল্লী তূর পর্বতে আপতিত হয়েছিল-মুছা (আঃ) ঐ তাজাল্লীতে বেহুঁশ হওয়ার কারণে তাও দর্শন করতে পারেননি। কিন্তু মি'রাজের রাত্রিতে নবী করিম (দঃ) আল্লাহর সান্নিধ্যে ফানা হয়ে আল্লাহর যে তাজাল্লী নিয়ে এসেছিলেন- তা দেখে হযরত মুছা আঃ)-এর তূর পর্বতের সেই সাধ পুনরায় জেগে উঠে। তাই তিনি বারবার আল্লাহর তাজাল্লী দর্শনের জন্যই উম্মতে মোহাম্মদীর বাহানা করে নবী করিম (দঃ) কে আল্লাহর দরবারে বার বার ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। আমাদের জন্য সুপারিশ করা ছিল উপলক্ষ মাত্র। সুবহানাল্লাহ! (তাফসীরে সাভী ২য় খন্ড ৪১৯ পৃঃ) একটি কাজে কয়েকটি উদ্দেশ্য থাকা খুবই স্বাভাবিক। সুতরাং উভয়বিধ উদ্দেশ্যের মধ্যে (উম্মতের কল্যাণ ও খোদা দর্শন) কোন বিরোধ নেই। আ'লা হযরত শাহ আহমদ রেযা (রাঃ) বলেন-
کس کو دیکھا یہ موسی سے پوچھے کوئی آنکه والون کی همت په لاکهون سلام ـ مصطفى
অর্থ-"মুছা (আঃ) সেদিন কাকে দেখেছিলেন এবং তাঁর মাধ্যমে কার প্রতিচ্ছবি দেখেছিলেন- তা মুছা (আঃ) কেই জিজ্ঞেস করো। দিব্যদৃষ্টি সম্পন্ন লোকদের দিব্য জ্ঞানের উপর শত সহস্র ছালাম"। (হাদায়েকে বখশিষ- আ'লা হযরত)
রাসুলে খোদা (দঃ) হলেন আল্লাহ দর্শনের আয়না স্বরূপ (মসনবী)
مصطفى آننه ظل خدا ست + منعکس دروی همه خون خداست
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০৪৪) উম্মতের জন্য মাগফিরাতের সুপারিশ | (০৪৬) আল্লাহর দীদার সম্ভব কিনা? |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |