কোরাইশদের অত্যাচার যখন চরমে, তখন নবী করিম (দঃ) সাহাবায়ে কেরামকে আফ্রিকার আবিসিনিয়ায় হিজরত করার অনুমতি প্রদান করেন। নবুয়তের পঞ্চম সালে ১১ জন পুরুষ ও ৪ জন মহিলা- এই পনেরজন সাহাবীর একটি কাফেলা আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। এটা ছিল ইসলামের প্রথম হিজরত। জিদ্দা থেকে মাথা পিছু তখনকার আট দিরহাম ভাড়ায় নৌকাযোগে তাঁরা আবিসিনিয়ায় পৌছেন এবং খ্রীষ্টান বাদশাহ নাজ্জাশীর (আস্হামা) দরবারে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করেন। উক্ত দলে নবী করিম (দঃ)-এর দ্বিতীয়া কন্যা বিবি রোকাইয়া ও তাঁর স্বামী হযরত ওসমানও (রাঃ) অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
কোরাইশরা নাজ্জাশীর দরবারে প্রচুর উপঢৌকন পাঠিয়ে মুসলমানদের ফেরত পাঠানোর অনুরোধ করে। কিন্তু নাজ্জাশী এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। মুসলমানদের এই হিজরত এবং বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণের মধ্য দিয়ে ইসলামের কূটনৈতিক বিজয় সুচিত হয়। পরবর্তীতে আরও ৮৩ জন পুরুষ সাহাবী ও ১৮ জন মহিলা সাহাবী- সর্বমোট ১০১ জন আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। এটা ছিল দ্বিতীয়বার হিজরত। এই হিজরতে আবু সুফিয়ানের কন্যা বিবি উম্মে হাবীবা (রাঃ) তাঁর স্বামী ওবায়দুল্লাহ ইবনে জাহাশ সহ অংশগ্রহণ করেছিলেন। বিবি উম্মে হাবীবা (রাঃ) কে পরে নবী করিম (দঃ) বিবাহ করেন। নাজ্জাশীর মাধ্যমে এই বিবাহ কার্য সম্পন্ন হয়। কিন্তু ওবায়দুল্লাহ সেখানে খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করে মৃত্যু বরণ করে।
দীর্ঘদিন (১৫ বছর) আবিসিনিয়ায় অবস্থান করার পর ৭ম হিজরী সনে সাহাবায়ে কিরাম সরাসরি মদিনা শরীফে এসে নবীজীর (দঃ) সাথে মিলিত হন। আবিসিনিয়ায় মুসলমানদের অবস্থান সেদেশে ইসলাম প্রচারে সহায়ক হয়েছিল। বর্তমানে ইরিত্রিয়া বা হাবসা শায়ত্বশাসন লাভ করেছে। মুসলমানদের আদব ও আখলাক দেখে বাদশাহ আসহামা নাজ্জাশী ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়েন।
৭ম হিজরীতে নবী করিম (দঃ) রোম, পারশ্য, মিশর, বাহরাইন ও আবিসিনিয়ার বাদশাদের নিকট ইসলামের দাওয়াত সম্বলিত পত্র প্রেরণ করেছিলেন। নবী করিম (দঃ)-এর পত্র পাঠ করে বাদশাহ্ নাজ্জাশী (আসহামা) ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। বিদেশের একজন বাদশাহ্ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় খৃষ্টান জগতে হৈ চৈ পড়ে যায়। বিনা যুদ্ধে বিনা তলোয়ারে এভাবে ইসলাম প্রসার লাভ করে। এবার ইসলাম এশিয়ার বাইরে আফ্রিকায়ও প্রবেশ করলো।
বাদশাহ নাজ্জাশী (আস্হামা) ৯ম হিজরী সনের রমযান মাসে ইন্তিকাল করেন। নবী করিম (দঃ) তাবুকের যুদ্ধ হতে মাত্র মদিনায় ফিরেছেন। তিনি সাহাবায়ে কেরামকে ডেকে বললেন- "তোমাদের ভাই নাজ্জাশী আজ আবিসিনিয়ায় ইন্তিকাল করেছেন। সুতরাং আমরা তাঁর জানাযা পড়বো"। কারণ, এখন পর্যন্ত আবিসিনিয়ার জনগণ ইসলাম গ্রহণ করেনি-তাই আসহামার জানাযা মদিনা থেকে নবীজী আদায় করেছিলেন (মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়া-৩০৪ পৃষ্ঠা)। সাহাবাগণ এই কথা শুনে নবীজীর ইলমে গায়েব দেখে হতবাক হয়ে যান। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মদিনা হতে আবিসিনিয়া পর্যন্ত মধ্যবর্তী সমস্ত পর্দা (প্রতিবন্ধকতা) সরিয়ে দেন। নবী করিম (দঃ) নাজ্জাশীর লাশ দেখে দেখে জানাযার নামাযে ইমামতি করেন। এই জন্যই হানাফী মাযহাবে গায়েবী জানাযা দুরস্ত নেই। জানাযার নামায দুরস্ত হবার জন্য ছয়টি শর্তের মধ্যে অন্যতম এবং প্রথম শর্তই হলো- লাশ ইমামের দৃষ্টির সামনে জমীনে থাকতে হবে। নাজ্জাশীর লাশও হুযুর (দঃ)-এর দৃষ্টির সামনে উপস্থিত ছিলেন। বস্তুতঃ হুযুর (দঃ) মদিনা শরীফ হতে বেহেস্ত পর্যন্ত অবলোকন করতেন। আবিসিনিয়া বা বাংলাদেশ তো অতি কাছে।
[উল্লেখ্য, ৮ম হিজরীতে মৃতার যুদ্ধে একে একে তিনজন মুসলিম সেনাপতি শহীদ হয়েছিলেন। নবী করিম (দঃ) মদিনা হতে তা দেখতে পেয়ে সাহাবীদেরকে তাঁদের শাহাদাতের সংবাদ দিয়েছিলেন। ঐ যুদ্ধে হযরত আলীর (রাঃ) ভাই হযরত জাফর (রাঃ) শহীদ হয়েছিলেন। আল্লাহর ফিরিস্তাগণ তাঁর পবিত্র রুহ মোবারক নিয়ে আকাশে ভ্রমণকালে নবী করিম (দঃ) তাঁকে আকাশে উড়ন্ত অবস্থায় দেখতে পেয়েছিলেন। হুযুর (দঃ) 'ওয়া আলাইকুম ছালাম' বলে তাঁর ছালামের জবাব দিলে উপস্থিত সাহাবীগণ তার কারণ জিজ্ঞাসা করলে নবী করিম (দঃ) বললেন- "জাফর আমাকে বিদায়কালীন ছালাম দিয়েছে আকাশ থেকে। আমি তাঁর ছালামের জবাব দিয়েছি। তোমরা যাহা জান না- আমি তাহা জানি; তোমরা যাহা দেখনা- আমি তাহা দেখি" (বোখারী)। নাজ্জাশীর জানাযা ও জাফর তাইয়ার (রাঃ)-এর এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, নবী করিম (দঃ)-এর ইলমে গায়েব আছে এবং তিনি হাযির ও নাযির। পরে যথাস্থানে বিস্তারিত বর্ণনা করা হবে। পৃথিবীর কোন বস্তুই তাঁর দৃষ্টির বাইরে নয়। (যিকরে জামিল ও জা'আল হক)
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০৩২) চন্দ্র বিদারন বা শক্কুল কামার | (০৩৪) সামাজিক বয়কট |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |