চরমপন্থী শী'আ সম্প্রদায়ের কতিপয় লোক হযরত আলী (রা.)- কে উলুহিয়্যাতের মনযিলে পৌঁছে দেয়। কেউ কেউ তাঁকে নবীও বলে মনে করে। কেউ কেউ তাকে নবী (সা.) হতেও শ্রেষ্ঠ বলে ধারনা রাখে।
চরমপন্থী শী'আরা বাড়াবাড়ীর প্রক্ষাপটে ইসলামের সীমারেখা থেকে বের হয়ে যায়। পরে তারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। নিম্নে চরম পন্থী শি'আ সম্প্রদায়ের প্রধান প্রধান কয়েকটি দলের সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রদান করা হল।
এ সম্প্রদায় আবদুল্লাহ্ ইব্ন সাবা -এর অনুসারী। আবদুল্লাহ্ ইব্ন সাবা ছিল একজন ইয়াহুদী। হীরা প্রদেশের বাসিন্দা। সে হযরত উসমান (রা.) এবং তাঁর মাজলিসে শুরার ঘোর বিরোধী ছিল।
আবদুল্লাহ্ ইব্ন সাবা মুসলিম সমাজে হযরত আলী (রা.) সম্পর্কে বিভিন্ন প্রকারের আকীদা তথা কুমন্ত্রনা বিস্তারে তৎপর হয়ে উঠে। সে প্রচার করে বেড়াতে থাকে যে, প্রত্যেক নবীর 'ওসী' রয়েছে। তাই হযরত আলী (রা.) হলেন মুহম্মদে (সা.)-এর 'ওসী'। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) হলেন 'শ্রেষ্ঠ নবী 'আর হযরত আলী (রা.) হলেন 'শ্রেষ্ঠ ওসী'। মুহাম্মদ (সা.) পুনরায় জীবিত হয়ে দুনিয়ায় তাশরীফ আনবেন। সে বলত, আমি ভেবে হতাশ হই যে মানুষ ঈসা (আ.)-এর অবতরণে বিশ্বাসী অথচ মুহাম্মদ (সা.)-এর পুনরায় আগমন স্বীকার করছে না। এভাবে পর্যায়ক্রমে সে হযরত আলীর (রা.) উলুহিয়্যাত এর দাবী তোলে। হযরত আলী (রা.) যখন এ সম্পর্কে জ্ঞাত হন, তখন তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন আব্বাস (রা.) এ ব্যাপারে বাঁধা প্রদান করেন এবং বলেন যে, এ মুহূর্তে যদি তাকে হত্যা করা হয় তবে আলী (রা.)-এর অনুসারীদের মধ্যে মতানৈক্য তথা বিপর্যয়ের সৃষ্টি হওয়ার আশংকা রয়েছে।
এ দলের কেউ কেউ এ আকীদা পোষণ করে যে, আল্লাহ্ তা'আলা হযরত আলী (রা.) -এর দেহের মধ্যে প্রবেশ করেন। তারা অন্যান্য ইমামদের ক্ষেত্রেও এরূপ আকীদা পোষণ করে থাকে।
এ দলের কেউ কেউ এ আকীদায় বিশ্বাসী যে, আল্লাহ্ তা'আলা স্বীয় কায়ায় হযরত আলীর দেহে অবতরণ করেন। এমন কি তারা হযরত আলী (রা.)-কে উলুহিয়্যাতের মনযিলে পৌছিয়ে দেয়।
এরা শী'আ সম্প্রদায়ের একটি চরম পন্থী দল। সাবাইয়াদের ন্যায় হযরত আলী (রা.)-কে উলুহিয়্যাতের পর্যায়ে সমাসীন করে। এমন কি তারা হযরত আলী (রা.)-কে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) হতেও শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে। তাঁরা এ অবস্থার দাবীর সপক্ষে অহেতুক যুক্তি পেশ করে বলে নবী মূলত হযরত আলী ছিলেন। কিন্তু হযরত জিব্রাঈল (আ.) ভুলক্রমে মুহাম্মদের কাছে ওহী নিয়ে অবতরণ করেন।
তাদের মতে হযরত আলী (রা.) নবী করীম (সা.)-এর ন্যায় ছিলেন, বিধায় এ সম্প্রদায়ের লোকদের কে গুরাবিয়া )غرابية( বলা হয়। যেমন-কাক কাকের অনুরূপ হয়ে থাকে।
প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইব্ন হাযম (র.) স্বীয় গ্রন্থ, 'كتاب الفصل 'এ ভ্রান্ত আকীদা পোষণ কারীদের কে ইতিহাস সম্বন্ধে অজ্ঞ বলে উল্লেখ করে বর্ণনা করেন যে, নবী করীম (সা.)-এর নবুওয়্যাত প্রাপ্তির সময় হযরত আলীর বয়স ছিল মাত্র নয় বছর। এ বয়সে নবুওয়্যাত ও রিসালাতের গুরু দায়িত্ব পালন করা অসম্ভব। আর সাধারণত এ সময় কেউ শরী'আতের মোকাল্লাফও হয় না। তাই তাদের যুক্তি অমূলক তথা ভ্রান্ত।
অন্যদিকে হযরত আলী (রা.) যখন বয়ঃপ্রাপ্ত হন তখন নবী (সা.)-এর অবয়ব তথা শেকেলে সূরাতের সাথে তাঁর কোন মিল ছিল না এবং একে অপরের থেকে শারীরিকগঠনে ভিন্নরূপ ছিলেন বলে কিতাবে পাওয়া যায়।
কাইসানিয়া 'কাইসান' এর দিকে সম্পর্ক করে এ দলের নামকরণ করা হয়েছে 'কাইসানিয়া'। কেউ কেউ বলেন যে, কাইসান ছিল হযরত আলী (রা.)-এর আযাদকৃত গোলাম। কারো কারো মতে 'কাইসান' ছিল হযরত আলী (রা.)-এর ছেলে মুহাম্মদ ইবন হানফ্যিয়ার নাম।
বস্তুত রিসালাতের সাথে কাইসানিয়াদের আকীদার কোন মিল নেই। তারা আওলাদে আলী (রা.)-এর প্রশংসায় এমনিভাবে ডুবে আছে যেন নবৃওয়াতের মর্যাদা থেকেও তাদেরকে উর্ধ্বে উন্নীত করেছে। তাদের কতিপয় আকীদায় দার্শনিক চিন্তাধারার সংমিশ্রণ রয়েছে। (اسلامی مذاهب ৫৯-৬৫ পৃঃ)
শী'আদের মধ্যে যায়দিয়া সম্প্রদায় আকীদার দিক দিয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা'আতের অধিক নিকটবর্তী। এরা ইমামদেরকে নবুওয়াতের মর্যাদায় সমাসীন করে না। তাদের মতে ইমামের মর্যাদা সাধারণ লোকের ন্যায় আর রাসূলুল্লাহ্ (সা.) হলেন সর্বশ্রেষ্ট ব্যক্তিত্ব। হয়রত আলী (রা.) যাঁদের ইমামত স্বীকার করে বাইয়াত গ্রহণ করেছেন তাঁদেরকে অস্বীকার করে না। যায়দিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা হচ্ছে যায়িদ ইবন আলী ইবন হুসাইন ইবন আলী ইব্ন আবু তালিব (রা.)-এর অনুসারী। তাই এ সম্প্রদায়ের লোকদেরকে 'যায়দিয়া' বলা হয়। এরা ইমামতের গুরু দায়িত্ব আওলাদে ফাতিমার মধ্যে সীমাবদ্ধ বলে বিশ্বাস রাখে। তারা অন্য কারে পক্ষে ইমামত বৈধ বলে মনে করে না।
যায়দিয়াগণ ইমাম নিয়োগের ব্যাপারে নির্বাচন নীতি স্বীকার করে। তাদের মতে আলীর বংশধরদের মধ্য হতে যে কোন ব্যক্তিকে নির্বাচনের ক্ষমতা মুসলমানদের রয়েছে। তবে বিশেষ কারণে উক্ত বংশের লোক ব্যতীত অন্য লোক ইমাম নির্বাচিত হতে পারেন। এ নীতির আলোকে তাঁরা হযরত আবূ বাকর ও হযরত উমরের পক্ষে ইমামত বৈধ বলে মনে করে। (اسلامی مذاهب ৬৬ পৃঃ)
কালক্রমে যায়দিয়া সম্প্রদায় দুর্বল হয়ে পড়ে এবং অন্যান্য শী'আরা এদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে। এমন কি যায়দিয়ারা স্বীয় বৈশিষ্ট্য হারিয়ে রাফেযী নামে রূপান্তরিত হয়। এ পর্যাযে তারা শায়খাইন (হযরত আবূ বাক্স ও উমর (রা.)-এর ইমামত অস্বীকার করে।
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে এ কথা বুঝা যায় যে, যায়দিয়ারা দু'দলে বিভক্ত ছিল।
১. মুতাকাদ্দিমীনঃ যারা রাফেযী বলে গন্য হয় না এবং শায়খাইনের ইমামত অস্বীকার করে না।
২. মুতায়াখিরীনঃ যারা ছিল রাফেযী। এরা শায়খাইনের ইমামত, স্বীকার করে না। বর্তমানে যায়দিয়া সম্প্রদায় ইয়ামনে বসবাস করে। এরা মুতাকাদ্দিমীন যায়দিয়াদের আকীদার অনুসারী। (الموسوعة الميسرة في الأديان والمذاهب المعاصرة, দ্বিতীয় সংস্করণ, ২৯৯ পৃষ্ঠা)
এ সম্প্রদায়কে শী'আ ইমামিয়াও বলা হয়। সাধারণত শী'আদের সবদল ও সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত। ইরান, ইরাক, পাকিস্তান সহ বিভিন্ন ইসলামী দেশে এ সম্প্রদায়ে লোকদের দেখতে পাওয়া যায়। ইমামিয়া সম্প্রদায় দ্বাদশ ইমামে বিশ্বাসী বিধায় এ সম্প্রদায়েকে 'ইস্স্না-আশারিয়া' বলা হয়। নিম্নে তাদের ইমামগণের নাম উল্লেখ করা হল।
১. হযরত আলী (রা.), ২. ইমাম হাসান (রা.), ৩. ইমাম হুসাইন (রা.), ৪. আলী জয়নুল আবেদীন ইব্ন হুসাইন, (রা.), ৫. মুহম্মদ বাকির ইবন আলী জয়নুল আবেদীন (র.). ৬. জা'ফর আস্-সাদিক ইবন মুহাম্মদ বাকির, (র.) ৭. মূসা আল্-কাযিম ইব্ন জা'ফর আস্-সাদিক (র.), ৮. আলী আর-রিযা ইব্ন মূসা আল-কাযিম (র.), ৯. মুহাম্মদ আল্-জাওয়াদ ইব্ন আলী আর-রিযা (র.), ১০. আলী আল-হাদী ইব্ন মুহাম্মদ আল্-জাওয়াদ, ১১. আল-হাসানুল আসকারী ইব্ন আলী আল-হাদী, ১২. মুহাম্মদ আল- মাহদী ইব্ন আল হাসানুল-আসকারী। (اسلامی مذاهب ৬৬ পৃঃ)
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০৩১) শী'আ মতবাদের মূল উৎস | (০৩৩) শী'আ আকীদা প্রচারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গ |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |