তাকলিদ (অনুগমন) এর ধারা ব্যাপক বিস্তৃতি লাভের অনেক কারণের মধ্যে নিম্নের ৩টি উল্লেখযোগ্য।
সাধারণের মধ্যে কোন ইমাম ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের মতবাদ প্রসার লাভের 'ও প্রভাবশালী হবার শ্রেষ্ঠ ও কার্যকর মাধ্যম হলো, তাঁর কর্তৃক তীক্ষ্ণ ধী-শক্তি সম্পন্ন ও দৃঢ়চেতা বিশিষ্ট শাগরিদ এবং সহযোগী থাকা। যাঁরা ইমামের নীতি পন্থায় আকৃষ্ট ও প্রভাবিত এবং জনসাধারণের মাঝে তাঁরা বিশ্বস্ত নির্ভরযোগ্য এবং মর্যাদা ও প্রতিপত্তির আসনে সমাসীন।
নির্ভরযোগ্য ও বিশিষ্ট শাগরিদগণ তাঁদের বরেণ্য ইমামগণের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রকাশ এবং তাঁদের ফিকহী মতবাদ ও উদ্ভাবনের পক্ষে অভিমত প্রকাশ করতেন। এ বিদ্বান শাপরিদগণ জনসাধারণের কাছে অনুসরণীয় হওয়ার কারণে তাঁরাই ফিকহী মতবাদ অনুসারে আমলে অভ্যস্ত হত এবং এভাবেই মাযহাব প্রচলিত হয়ে যেত।
সংকলন যুগের শীর্ষস্থানীয় ইমামগণ এবং তাঁদের অনুগামী শাগরিদগণের জীবন কাহিনী ও কর্মধায়া আলোচনায় পাঠকগণ অবগত হয়েছেন। তাঁদের উন্নত মেধা; ইল্মী যোগ্যতা- বিশ্বস্ততা, প্রামাণ্য সিদ্ধান্ত প্রদানে প্রতিভা এবং বিশিষ্ট ও সাধারণের মাঝে তাঁদের ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্বের অবগতি ও পাঠকগণ লাভ করেছেন।
দ্বিতীয় যুগের বিদ্বানগণ তাঁদের ইমামগণের ফিরে প্রচার-প্রসারে ব্রতী হন এবং কিতাবাদি রচনা করেন। তাঁদের পরবর্তী স্তরের শাগরিদগণ আরও ব্যাপক প্রসারে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁরা প্রতিপক্ষ ও বিরুদ্ধবাদীদের মুকাবিলায় তর্ক-বিতর্ক এবং বহস-মুনাযারাহ্ করে ও কিতাবপত্র লিখে নিজেদের ইমামগণের 'মাযহাব' প্রতিষ্ঠিত করেছেন। পরিশেষে অবস্থা এমনি পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে, অন্য কথা শুনতেও আর কেউ রাযী হয় না।
ঐতিহাসিক ইব্ন খালেদুনের ভাষায় স্পেনে ইন্ন হাযম যাহিরী তাকলীদের বিরুদ্ধে কথা তুললে চারিদিকে প্রতিবাদের সোচ্চার ধ্বনি উঠে। এমন কি ইব্ন হাযমের কিতাবপত্র ক্রয়-বিক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। অনেকক্ষেত্রে তাঁর রচনাবলী বিনষ্ট করে ফেলা হয়।
সাহাবী ও তাবিঈগণের যুগে সাধারণত কাযী পদে সে সব ব্যক্তিত্বই নিয়োজিত হতেন, যাঁরা ইজতিহাদী প্রভিতায় পূর্ণাংগ উত্তীর্ণ প্রতিভা। সময়ের বিবর্তনে অবস্থায় পরিবর্তন হয়। কাযীদের সে ক্ষুরধার প্রতিভার অভাব দেখা দিতে শুরু করলো। তুলনামূলকভাবে এ পদে অযোগ্য লোক নিয়োগ পেতে থাকলো। পরিণামে সমালোচনা শুরু হলো। তাই কাযীগণ (বিচারকগণ) বাধ্য হয়ে সংকলিত ফিহের ভিত্তিতে 'রায়' প্রদান করতে লাগলেন। নিজেদের ইজতিহাদ ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে রায় দান থেকে বিরত থাকলেন। কাযীগণ ও আলিমগণ যেহেতু কোন প্রখ্যাত ইমামের অনুসারী অনুগামী হয়ে চল্ছিলেন, সে জন্যে বিচারক পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিগণ ও কোন নির্দিষ্ট ইমামমের মাযহাব অনুসারে 'রায়' দিতে শুরু করলেন। ফলে ঐ বিচারকের আওতাধীন এলাকায় তাঁর অনুসারী ইমামের মাযহাব চালু হয়ে যায়।
যে মাযহাবে অভিজ্ঞ ও নির্ভরযোগ্য সংকলক ছিলেন, সে মাযহাব খুব প্রচার-প্রসার লাভ করে। যেমন, হযরত ইমাম আবূ হানীফা (র.)-এর ফিকহ্ যুগশ্রেষ্ঠ শাগরিদগণ দ্বারা রচিত হয়েছিল। তিনি তাঁদের সহায়তায় নিজস্ব ফিকহ্ সংকলন তৈরী করেন। তাঁর শগরিদগণ মুজতাহিদ ও কাযীগণকে প্রশিক্ষণ দাতা হওয়ার প্রতিভাধারী। ফলে, তাঁর মাযহাব চালু হয়ে গেল এবং তা ব্যাপকতর বিস্তৃতি লাভ করলো।
হযরত ইমাম শাফিঈ (র.) নিজেই তাঁর ফিকহ সংকলন করেন। তাঁর সুযোগ্য বিশ্বস্ত শাগরিদগণ তাঁর মাযহাবের সমর্থনে বহু অবদান রাখেন। ফলে, হযরত ইমাম আযম আবূ হানাফী (র.)-এর পরবর্তী স্থানে তাঁর মাযহাব প্রতিষ্ঠিত হয়।
হয়রত ইমাম মালিক (র.) তাঁর মাযহাবের প্রচার-প্রসার করেন। তাঁর শ্রেষ্ঠ শাগরিদগণ তাঁর সংকলিত ফিকহ্ ছড়িয়েছেন। ফলে, শাফিঈ মাযহাবের পরে মালিকী মাযহারের বিস্তৃতি ঘটে।
হযরত ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল (র.) নিজে কোন ফিকহী সংকলন তৈরী না করলেও তাঁর কর্মবীর শাগরিদগণের মাধ্যমে তাঁর মাযহাবও বিস্তৃতি লাভ করে। অবশ্য এ বিস্তৃতি পূর্বের তিন ইমামের তুলনায় কম।
মোটকথা, চার ইমামের মাযহাব সংকলিত হবার কারণে। এবং তাঁদের শাগরিদগণের পরিশ্রমের ফলে এ মাযহবগুলোর তাকলীদ ব্যাপকতা লাভ করে। এ বিষয়ে ইমাম শাফিঈ (র.) এর মন্তব্য বিশেষভাবে প্রনিধানযোগ্য। তিনি বলেন, "লাইস (র.) মালিক (র.)-এর তুলনায় অধিক ফকীহ্ ছিলেন, কিন্তু তাঁর শাগরিদগণ তাঁর ইল্ম বিনষ্ট করে ফেলে।" অর্থাৎ অনুসরণীয় এমন শাগরিদ ছিল না, যাঁদের দ্বারা মাযহাব প্রসার লাভ হতে পারে।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০১৯) ফিকহ সংকলন ও সম্পাদনার পূর্ণাংগতা ও তাকলীদের যুগ | (০২১) ঐতিহাসিক ইব্ন খালদূনের ভাষ্য |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |