বিবি খাদিজা (রাঃ)-এর সাথে হুযুর আকরাম (দঃ)-এর বিবাহ বন্ধন তাঁর সততা, বিশ্বস্ততা ও আমনতদারীর এক উজ্জ্বল ফসল। বিবি খাদিজা (রাঃ) আরবের ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্যতমা ছিলেন। ইয়েমেন, সিরিয়া, মদিনা ও বোছরা শহরে ছিল তাঁর বাণিজ্য কুঠি। তিনি লাভ-লোকসানের অংশীদারিত্বের (মুদারাবা) ভিত্তিতে তাঁর ব্যবসায়ে লোক নিয়োগ করতেন। নবী করিম (দঃ)- এর সত্যবাদিতা, আমানতদারী ও চরিত্র মাধুর্যের কথা শুনে তাঁর ব্যবসার দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য প্রস্তাব পেশ করলে নবী করিম (দঃ) সানন্দচিত্তে তাতে রাজী হন। বিবি খাদিজার (রাঃ) বিশ্বস্ত গোলাম মাইছারাকে সাথে করে নবী করিম (দঃ) বিবি খাদিজার বাণিজ্যপণ্য নিয়ে সিরিয়ায় গমন করেন এবং প্রচুর 'লাভ করে মক্কায় ফিরে আসেন।
পথিমধ্যে মাইছারা দেখতে পায়- দু'জন ফিরিস্তা নবী করিম (দঃ) কে সূর্যের তাপ থেকে পাখা বিছিয়ে ছায়া দিচ্ছে। মক্কায় ফিরে মাইছারা আপন মনিব বিবিকে এ সংবাদ দিলে বিবি খাদিজা (রাঃ) শুনে মুগ্ধ হয়ে যান এবং মনে মনে নবীজীর চরণে আপন জীবন সমর্পণ করার সংকল্প করেন। তিনি ছিলেন একে একে দুই স্বামীহারা বিধবা- ৪০ বছর বয়স্কা মহিলা। চরিত্রমাধুর্যে লোকে তাঁকে তাহেরা (পবিত্রা) উপাধিতে ভূষিত করেছিল। তিনি আপন গোলামের মাধ্যমে বিবাহের প্রস্তাব পাঠালেন। নবী করিম (দঃ) আপন চাচাদের মতামত নিয়ে জানাবেন বলে জবাব দিলেন। এই প্রস্তাবে আবু তালেব, হামযা ও আব্বাস সানন্দে রাজী হলেন এবং সামাজিক প্রথানুযায়ী বিবাহের কাজ সম্পন্ন হয়। তখন নবী করিম (দঃ)-এর বয়স ছিল পঁচিশ বৎসর।
এই বিবাহে খোত্ত্বা পাঠ করেন আবু তালেব। খুতবার সারমর্ম ছিল এই-"আমি ঐ আল্লাহর প্রশংসা করছি- যিনি আমাদেরকে হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর বংশে এবং হযরত ইসমাইল (আঃ) কর্তৃক আবাদকৃত মক্কা ভূমিতে স্থাপিত করেছেন এবং বংশ পরম্পরায় মাআদ ও মুদার গোত্রের মূল শাখার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি আমাদেরকে তাঁর পবিত্র হেরেমের পরিচালক ও তাঁর ঘরের সেবক নিযুক্ত করেছেন এবং মক্কায় বসবাসকারী জনপদের উপর আমাদেরকে শাসক নিযুক্ত করেছেন। আমার এই ভাতিজা মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহকে যেকোন লোকের সাথে তুলনা করা হলে তাঁর ওজনই ভারী হবে। যদিও আর্থিক স্বচ্ছলতা তাঁর নেই, অর্থসম্পদতো ঢলেপড়া ছায়ামাত্র, তবুও তাঁর আত্মীয়-স্বজন সম্পর্কে আপনারা সবাই অবগত রয়েছেন"।
খুতবা শেষে ১২ উকিয়া রৌপ্য বা ৪৮০ দিরহাম মোহরানার বিনিময়ে হযরত খাদিজা (রাঃ)-এর নিকট বিবাহের প্রস্তাব প্রেরণ করেন। হযরত খাদিজা (রাঃ)- এর পক্ষে তাঁর চাচা উকিল হয়ে এই বিবাহকার্য্য সম্পাদন করেন। "আল আমীন" (দঃ) ও "তাহেরা" (রাঃ) দম্পতির দাম্পত্য জীবন কেটেছিল ২৫ বৎসর। বিবি খাদিজা (রাঃ) আদর্শস্বামী পেয়ে জীবন ও অর্থ সম্পদ সব কিছু নবীজীর (দঃ) চরণতলে সঁপে দিলেন। তাঁদের পবিত্র সংসারে হযরত কাসেম, হযরত যয়নব, হযরত আবদুল্লাহ, হযরত রোকাইয়া, হযরত উম্মে কুলসুম ও হযরত বিবি ফাতেমা (রাঃ) জন্মগ্রহণ করেন। অন্য রেওয়ায়াত মতে ইবনে হিশাম হযরত তৈয়ব ও হযরত তাহের নামে আরও দু'জন সাহেবজাদার নাম উল্লেখ করেছেন। এ হিসাবে বিবি খাদিজার ঘরে নবী করিম (দঃ)-এর চার সাহেবজাদা ও চার সাহেবজাদী- মোট আটজন সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। চার সাহেবজাদা শৈশবেই ইনতিকাল করেন। সাহেবজাদী সকলেই নবুয়ত যুগ পেয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন ও বিবাহিতা জীবন যাপন করেন। সবচেয়ে ছোট ও প্রিয় কন্যা বেহেস্তের নারীগণের সর্দার হযরত বিবি ফাতিমা (রাঃ)-এর সন্তানগণই কিয়ামত পর্যন্ত প্রকৃত সাইয়্যেদ খান্দান নামে অভিহিত। অন্য কেউ বংশ পরিচয়ের ক্ষেত্রে আইনগত সাইয়্যেদ হতে পারবেননা। তবে সম্মানসূচক "সাইয়ি্যদ" শব্দ অন্যান্য সাহাবীদের বংশধরের নামের সাথেও যোগ করা যাবে। ইমাম হাসান-হোসাইন (রাঃ)-এর বংশ ছাড়া কেউ 'আওলাদে রাসূল' দাবী করলে তা মিথ্যা হবে। আজকাল সৈয়দ বা আওলাদে রাসুল নাম ধারণ করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়- যার কারণে প্রকৃত সাইয়্যেদ বা আওলাদে রাসূল খুঁজে বের করা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। ইমাম হাসান-হোসাইন (রাঃ) পর্যন্ত পুরুষ কুষ্ঠিনামা বা নসবনামা প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হলে তাঁকে প্রকৃত সাইয়্যেদ বা আওলাদে রাসুল বলা যাবে না। পিতা সাইয়েদ না হলে মায়ের কারণে সন্তানগণ সৈয়দ বলে গণ্য হবে না।
হযরত বিবি খাদিজা (রাঃ) হুযুরের নবুয়ত ঘোষণার পূর্বে ১৫ বৎসর এবং নবুয়ত ঘোষণার পর ১০ বৎসর হুযুর (দঃ)-এর ঘর-সংসার করেছেন। তাঁর অগাধ সম্পদ নবীজীর চরণে সঁপে দিয়েছিলেন। নবী করিম (দঃ) গরীব, মিছকিন, ইয়াতীম, কাঙ্গাল, বিধবা ও সহায় সম্বলহীন জনগণের পুনর্বাসনে সব সম্পদ দান করে দেন। মক্কার কোরেশগণ কর্তৃক তিন বৎসরকাল 'বয়কট' সময়ে বিবি খাদিজা (রাঃ) নবী করিম (দঃ)-এর সাথে নির্বাসিত জীবন যাপন করেছিলেন এবং ক্ষুধার তাড়নায় গাছের ছাল বাকল পর্যন্ত খেয়েছিলেন। একজন ধনবতী মহিলার এই স্বামীপ্রেম ও আত্মত্যাগের আদর্শ একমাত্র আউয়ুব (আঃ)-এর বিবি ও ইউসুফ (আঃ)-এর কন্যা হযরত রহিমার সাথেই তুলনীয় হতে পারে। আমাদের নারীসমাজ আজ কোন্ পথে চলছেন? (তাফসীরে সাভী সূরা ইউসুফ ১৩ পারা)
নবী করিম (দঃ)-এর দাম্পত্য জীবনের প্রথম ১৫ বৎসরের বিস্তারিত দৈনন্দিন ঘটনাবলী জানা না গেলেও মোটামুটিভাবে নিম্নরূপ ছিল। ২৭ বৎসর বয়সে হুযুর আকরাম (দঃ)-এর প্রথম সন্তান হযরত কাশেম (রাঃ) জন্মগ্রহণ করেন এবং দুই বৎসর পর ইনতিকাল করেন। ৩০ বৎসর বয়সের সময় বিবি যয়নাব (রাঃ) জন্মগ্রহণ করেন। এর পর পর অন্যান্য সাহেবজাদা ও সাহেবজাদীগণ জন্মগ্রহণ করেন ৪০ বৎসর বয়সের মধ্যেই।
যখন নবী করিম (দঃ)-এর বয়স ৩২ বৎসর, তখন আপন চাচাত ভাই হযরত আলী (রাঃ)-এর জন্ম হয়। জন্মের পর নবী করিম (দঃ) আপন চাচা আবু তালেবের নিকট থেকে হযরত আলীকে লালন-পালনের জন্য নিজের কাছে নিয়ে আসেন। বিবি খাদিজা (রাঃ) আপন সন্তানবৎ হযরত আলীকে লালন পালন করেন। এটা ছিল চাচার প্রতিপালনের বিলিশয়ে প্রতিদানস্বরূপ। হযরত আলী (রাঃ) শিশুকাল থেকেই নবী করিম (দঃ)-এর বিশেষ যত্নে ও সান্নিধ্যে গড়ে উঠেন এবং পরবর্তীকালে বিবি ফাতেমা (রাঃ)-এর যোগ্য স্বামী হবার গৌরব অর্জন করেন। আল্লাহ তায়ালার নির্দেশেই হযরত আলীর (রাঃ) সাথে বিবি ফাতেমার (রাঃ) বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল।
বিবি খাদিজার (রাঃ) ব্যবসার দায়িত্ব গ্রহণকাল থেকে বিবাহোত্তর ১৫ বৎরের ঘটনাবলী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়-
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০২৪) ফিজার যুদ্ধে যোগদান ও হিলফুল ফুযুল গঠন | (০২৬) হজরে আসওয়াদ স্থাপনে নবীজীর ভূমিকা ও প্রজ্ঞা |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |