ফাতিহা সম্পর্কে বিরোধিতাকারীদের নিম্নলিখিত আপত্তিসমূহ উলেখযোগ্য।
ফকীহগণের অনেকেই মৃতব্যক্তির নামে তৃতীয় ও সপ্তম দিন খাবার তৈরী করা নিষেধ বলেছেন (ফত্ওয়ায়ে শামী ও আলমগীরী দেখুন) বরং বযাযিয়া (রাঃ) লিখেছেন وَبَعْدُ الْاَسْبُوْعِ সাতদিনের পরেও খাবার তৈরী করা নিষেধ। এতে বাৎসরিক, ষন্মাসিক, চেহলাম সবই এসে যায়।
অধিকন্তু কাজী ছানাউল্লাহ সাহেব পানিপথী ওসীয়ত করেছিলেন-
كه بعد مردن من رسوم دنياوى وهم وبستم وچهلم وششماهى وبرسينى. هيچ نه كنند كه رسول الله ﷺ زياده از سه روز ماتم كردن جائز نه داشته.
-‘‘মৃত্যুর পর দুনিয়াবী রেওয়াজ অনুযায়ী দশভী, বিশভী, চেহলাম, ষন্মাসিক ও বাৎসরিক বেহুদা কাজ করো না, কেননা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) তিনদিনের অধিক শোক প্রকাশ করাটা নাজায়েজ মনে করেছেন। অধিকন্তু হুযুর আলাইহিস সালাম ফরমান, মৃতব্যক্তির নামে উৎসর্গীয় খাবার গ্রহণে মনের মৃত্যু ঘটে ইত্যাতি ইত্যাদি।’’
ফকীহগণ মৃতব্যক্তির ঈসালে ছওয়াব করার ব্যাপারে নিষেধ করেননি বরং করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন- প্রথম অধ্যায়ে আমি উলেখ করেছি যে ফকীহগণ যেটা নিষেধ করে সেটা অন্য জিনিস। সেটা হচ্ছে মৃতব্যক্তির ওসীলায় আত্মীয়-স্বজন কর্তৃক খাবার আদায় করা অর্থাৎ সামাজিক সমালোচনা থেকে বাঁচার জন্য মৃতব্যক্তির কুলখানি, চেহলাম ইত্যাদিতে আত্মীয়-স্বজন কে দাওয়াত দেয়া হয়, সেটা নাজায়েয। কেননা এটা হচ্ছে মান সম্মান রক্ষান জন্য। অথচ এখানে সেটার প্রশ্নই আসতে পারে না। গরীবদেরকে যদি ঈসালে ছওয়াবের উদ্দেশ্যে ফাতিহা দিয়ে খাবার পরিবেশন করা হয়, তা সকলের মতে জায়েয।
ফতওয়ায়ে শামীর প্রথম খন্ড কিতাবুল জানায়েযের الدفن শীর্ষক অধ্যায়ে উলেখিত আছে-
وَيُكْرَهُ اتِّخَاذُ الضِّيَافَةِ مِنْ الطَّعَامِ مِنْ أَهْلِ الْمَيِّتِ لِأَنَّهُ شُرِعَ فِي السُّرُورِ لَا فِي الشُّرُورِ.
-‘‘মৃতব্যক্তির ওয়ারিস থেকে দাওয়াত য়ো মাকরূহ। কেননা এটা খুশীর সময় করা হয়,শোকের সময় নয়।’’
¶ ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২৪০, পরিচ্ছেদ: مطلب فِي الثَّوَاب عَلَى المصيبة
এখানে দাওয়াত নেয়া বলতে দাওয়াত দিতে বাধ্য করাকে বোঝানো হয়েছে। উক্ত অধ্যায়ে আরও উলেখিত আছে -
وَهَذِهِ الْأَفْعَالُ كُلُّهَا لِلسُّمْعَةِ وَالرِّيَاءِ فَيُحْتَرَزُ عَنْهَا لِأَنَّهُمْ لَا يُرِيدُونَ بِهَا وَجْهَ اللَّهِ تَعَالَى.
-‘‘যে সমস্ত কাজ কেবল লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে। সুতরাং এসব থেকে দূরে থাকুন। কেননা এর দ্বারা আল্লাহর রেযামন্দী কামনা করা হয় না।’’
¶ ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২৪১, পরিচ্ছেদ: مطلب فِي الثَّوَاب عَلَى المصيبة
পরিষ্কার বোঝা গেল, গর্ববোধ করে আত্মীয়-স্বজনকে দাওয়অত দেয়া নিষেধ। আরও উলেখিত আছে -
وَإِنْ اتَّخَذَ طَعَامًا لِلْفُقَرَاءِ كَانَ حَسَنًا.
-‘‘মৃতব্যক্তির ওয়ারিস যদি গরীবদের জন্য খাবার তৈরী করে, তাহলে খুবই ভাল।’’
¶ ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২৪০-২৪১, পরিচ্ছেদ: مطلب فِي الثَّوَاب عَلَى المصيبة
এতে ফাতিহার বৈধতা প্রমাণিত হলো।
কাজী ছানাউল্লাহ ছাহেব পানিপথী কর্তৃক স্বীয় কুলখানি ও দশভী না করার জন্য বলাটা একেবারে যুক্তি সংগত। তিনি বলেছেন পার্থিব প্রথা অনুযায়ী যে ধরনের কুলখানি ইত্যাতি করা হয়, তা কর না। এখন প্রশ্ন হলো, পার্থিব প্রথাটা কি? এটা হচ্ছে কুলখানি ইত্যাদিতে মহিলারা জমায়েত হয়ে কান্নাকাটি বা বিলাপ করা, যা বাস্তবিকই হারাম। এ জন্যেই তিন দিনের অধিক শোক প্রকাশ করাকে নাজায়েয বলা হয়েছে।
কিন্তু এখানেতো ঈসালে ছওয়াব ও ফাতিহার কোন উলেখ নেই। উপরোক্ত বক্তেব্যের ভাবার্থ হলো- কুলখানি ইত্যাদিতে যেন মাতম করা না হয়। আর মৃতব্যক্তির নামে প্রদত্ত খাবার গ্রহলে মন মরে যাওয়ার যে কথা বলেছেন, সে ধরনের হাদীচ আমি কোথাও দেখিনি। যদি এটা হাদীছ হয়ে থাকে, তাহলে ওসব হাদীছের যেগুলোতে মৃতব্যক্তির পক্ষে দান-খয়রাত করার প্রতি উৎসাহ দেয়া গয়েছে, কি ভাবার্থ হতে পারে? আপনারাওতো বলেন, দিন তারিখ ঠিক না করে মৃতব্যক্তির নামে দান খয়রাত জায়েজ। এ দান খয়রাত কে খাবে? মানুষ খেলেতো মন মরে যাবে। তাহলে কি ফিরিশ্তারা খাবে?
একটি মাসআলা- মৃতব্যক্তির নামে প্রদত্ত খাবার কেবল গরীবদেরকে খাওয়অনো চাই। আলা হযরত (কুঃ সিঃ) এ প্রসংগে جلى الصوت الهنى الدعوت عن الموت নামক একটি স্বতন্ত্র পুস্তিকা রচনা করেছেন। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ মতে, আলা হযরত কোন মৃতব্যক্তির পরিবার পরিজনের কাছে শোক প্রকাশ করতে গেলে, তথায় পান তামাক ইত্যাদিও গ্রহণ করতেন না। তাঁর স্বীয় ওসীয়ত নামায় উলেথি আছে ‘আমার নামে প্রদত্ত ফাতিহার খাবার যেন গরীভদেরকে খাওায়ানো হয়।’ যদি মৃতব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকে ফাতিহা দিতে হয়, তাহলে এটা খেয়াল রাখতে হবে, যেন অনুপস্থির ওয়ারিস ও নাবালেগের অংশ থেকে ফাতিহা দেয়অ না হয়। অর্থাৎ প্রথমে মৃতব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পত্তি বন্টন করতে হবে। অতঃপর কোন বালেগ ওয়ারিসের অংশ থেকে এসব কাজ সমাধা করা হবে। তা যদি না হয়, এ খাবার কারো জন্য জায়েয হবে না। কেননা মালিকের বিনা অনুমতিতে ও নাবালেগের জিনিস খাওয়া জায়েয নেই। এ মাসআলাটা যেন অবশ্যই স্বরণ থাকে।
ফাতিহর জন্য তারিখ নির্ধারণ করা নাজায়েয। এগারভী তারিখ বা তেসেরা, দশভী বিশভী চলিশা, বাৎসরিক ইত্যাদি দিন তারিখ নির্ধারণ অনর্থক মাত্র।
কুরআন করীম ইরশাদ ফরমান-
هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ.
-‘‘মুসলমানগণ বেহুদা কাজ থেকে যেন বিরত থাকেন।’’
¶ সূরা মু’মিনুন, আয়াত নং-৩
যত তাড়াতারি পারেন ঈসালে ছওয়াব করুন, তৃতীয় দিনের অপেক্ষায় থাকবেন না। আর কুলখানির জন্য ভুনা চনা নির্ধারণ করা একেবারে ফালতু কাজ। এজন্য কুলখানি ইত্যাদি করা নিষেধ।
দিন তারিখ নির্ধারণ করার উত্তর আমি ‘মীলাদে কিয়াম’ আলোচনায় দিয়েছি। কোন বৈধ কাজের জন্য দিন-তারিখ নির্ধারণ করা এজন্যই হয়ে থাকে যে নির্ধারিত দিনে সবাই একত্রিত হবেন এবং সবাই মিলে এ কাজ সমাধা করবেন। যদি কোন একটা দিন নির্ধারণ করা না হয়, তাহলে সুচারুভাবে সে কাজের আঞ্জাম দেয়া সম্ভব নয়।
وَعَن شَقِيق: كَانَ عبد الله يُذَكِّرُ النَّاسَ فِي كُلِّ خَمِيسٍ فَقَالَ لَهُ رَجُلٌ يَا أَبَا عَبْدِ الرَّحْمَنِ لَوَدِدْتُ أَنَّكَ ذكرتنا كُلِّ يَوْمٍ قَالَ أَمَا إِنَّهُ يَمْنَعُنِي مِنْ ذَلِكَ أَنِّي أَكْرَهُ أَنْ أُمِلَّكُمْ.
-‘‘হযরত শাকীক (রহঃ) বলেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) ওয়াজের জন্য প্রতি বৃহস্পতিবারকে নির্ধারণ করেছিলেন। একজন শ্রোতাগণ আরয করেছিলেন হে আব্দুর রাহমান! আমার বাসনা আপনি প্রতিদিন ওয়াজ করুণ। এর উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আপনাদেরকে কষ্ট/বিরক্ত দেয়া আমার পছন্দ নয়।’’
¶ খতিব তিবরিযি, মিশকাত শরীফ, কিতাবুল ইলম, ১/৭২ পৃঃ হা/২০৭, ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ১/২৫ পৃঃ হা/৭০
ইমাম বুখারী (রহঃ) এ প্রসংগে বুখারী শরীফে একটা স্বতন্ত্র অধ্যায় খাড়া করেছেন।
এটা কেবল সুবিধার জন্য করা হয়। আজও মাদ্রাসা সমূহের পরীক্ষা, বার্ষিক সভা ও ছুটির মাস ও তারিখ নির্দিষ্ঠ থাকে, প্রতি বছর জনগণ নির্দিষ্ট তারিখে বিনা বিজ্ঞপ্তিতে জমায়েত হয়। ওসবের বেলায়ও একই উদ্দেশ্যে তা করা হয়। তবে এখন প্রশ্ন হলো এসব তারিখই বা কেন নির্ধারণ করা হলো? তাহলে শুনুন, গিয়ারবী অর্থাৎ ১১ তারিখ নির্ধারণ করার কারণ হচ্ছে, তৎকালীন মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের প্রতিটি অফিস আদালতে চাঁদের দশ তারিখে বেতন দেয়অ হতো এবং কর্মচারীদের এটাই বাসনা থাকতো যে তাদের বেতনের প্রথম পয়সা যেন হুযুরে গাউছে পাকের ফাতিহাতে ব্যায় হয়। তাই তারা যখন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ঘরে ফিরতেন, সাথে কিছু মিস্টান্ন নিয়ে আসতেন এবং মাগরিবের পরে অর্থাৎ ১১ তারিখের রাতে ফাতিহা দিতেন। এ প্রচলনটা মুসলমানদের মধ্যে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে, যা পরবর্তীতে এ ফাতিহা গিয়াভরী শরীফ হিসেবে প্রসিদ্ধ লাভ করে। এখন যে কোন তারিখেই হুযুরে গাউফে পাকের ফাতিহা শরীফ করা হবে বা তার নামে সাদাকা করা হবে, গিয়ারভীই বলা হয়। ইউ.পি.ও কাফিয়াওয়ার্ড নামক স্থানে সারা রবিউছ ছানি মাসে হুযুরে গাউছে পাকের ফাতিহা হয়, কিন্তু বলা হয় ‘গিয়ারভী শরীফ’। অধিকন্তু বুযুর্গানে কিরামের সংগে বড় বড় ঘটনাবলী ১০ তারিখেই সংঘটিত হয়েছে এবং যার পরে আগমন ঘটেছে এগার তারিখের এই শুভ রাত্রে। হযরত আদম (আঃ) এর পৃথিবীতে পদার্পণ এবং তার তওবা কবুল হওয়া, হযরত নূহ (আঃ) এর জাহাজ কুলে আসা, হযরত ইসমাঈল (আঃ) জবেহ থেকে মুক্তি পাওয়া, হযরত ইউনুস (আঃ) মাছের পেট থেকে বের হয়ে আসা, হযরত ইয়াকুব (আঃ) স্বীয় সন্তানের সাক্ষাত লাভ, হযরত মূসা (আঃ) ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি লাভ, হযরত আইয়ুব (আঃ) এর আরোগ্যলাভ, ইমাম হুসাইণ (রাঃ) এর শাহাদাত বরণ ও শহীদদের সর্দারের মর্যাদা অর্জন সবই দশ তারিখেই সংঘঠিত হয়েছে। এরপর প্রথম যে রাতটি আসে, সেটা এগার তারিখের রাতই। সুতরাং এ রাতটি খুবই বরকতময়। এ কারণে গিয়ারভী শরীফের ফাতিহা প্রায় সময় এগার তারিখের রাতেই হয়ে থাকে। কেননা বরকতময় রাত সমূহে সাদাকা খয়রাত ইত্যাদি করাটা বাঞ্চনীয়।
এ কথাটা বাস্তব অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রমাণিত বরং এ ব্যাপারে আমার নিজেরও অভিজ্ঞতা রয়েচে যে যদি প্রতি চাঁদের এগার তারিখ কিছু নির্ধারিত পরিমাণ টাকা পয়সা খরচ করে নিয়মিতভাবে ফাতিহাখানি করা হয়, তাতে যথেষ্ট বরকত রয়েছে। খোদার শুকরিয়া যে আমি এ কাজটা একান্ত নিয়মিতভাবে পালন করি এবং অনেক বরকতও লাভ করি। يازده مجلس নামক কিতাবে লিখা আছে হুযুরে গাউছে পাক (রাঃ) হুযুর আলাইহিস সালামের বারভী অর্থাৎ বার তারিখের মীলাদ শরীফ একান্ত নিয়মিতভাবে উদ্যাপন করতেন। একবার স্বপ্নে হুযুর
(ﷺ) বললেন, হে আবদুল কাদির, তুমি আমাকে বারভেিত (বার তারিখের মীলাদ) স্বরণ করেছ; আমি তোমাকে গিয়ারভী দান করলাম অর্থাৎ জনগণ তোমাকে গিয়ারভীতে (১১ তারিখের ফাতিহা) স্বরণ করবে। এ জন্য রবিউল আউয়াল মাসে সাধারণতঃ মীলাদে মুস্তফা (ﷺ) অনুষ্টিত হয় এবং রবিউল ছানিতে হুযুরে গাউছে পাকের গিয়ারভী শরীফ উদ্যাপন করা হয়। যেহেতু এটা হুযুর আলাইহিস সালামের অবদান, সেহেতু এটা সারা দুনিয়ায় প্রসার লাভ করেছে। বিরোধীরা এটাকে শিরক ও বিদ্আত বলে বিলোপ সাধনের চেষ্টা করেছে, কিন্তু দিন দিন এর অগ্রগতি হচ্ছে।
توگهٹان سے كسى كے نه گهٹاهے گهٹے
جب برهائے تجهے الله تعالى تيرا
-‘‘আল্লাহ তাআলা যদি তোমাকে উন্নতি দান করে কেউ শত চেষ্টা করেও তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।’’
কুলখানির জন্য তৃতীয় দিন নির্ধারণ করার পেছনেও যুক্তি রয়েছে। প্রথম দিন লোকজন মৃতব্যক্তির কাফন দাফনে ব্যস্ত থাকে, দ্বিতীয় দিন বিশ্যামের জন্য ছেড়ে দেয়া হয়েছে, তৃতীয় দিন সবাই একত্রিত হয়ে ফাতিহাখানি, কুলখানি ইত্যাদি পাঠ করে। এ তৃতীয় দিন হচ্ছে, শোক প্রকাশের শেষ দিন। এরপর শোক প্রকাশ করা নিষেধ।
ফত্ওয়ায়ে আলমগীরীর কিতাবুল জানায়েযে الدَّفْنَ অধ্যায়ে উলেখিত আছে-
وَوَقْتُهَا مِنْ حِينِ يَمُوتُ إلَى ثَلَاثَةِ أَيَّامٍ وَيُكْرَهُ بَعْدَهَا إلَّا أَنْ يَكُونَ الْمُعَزِّي أَوْ الْمُعَزَّى إلَيْهِ غَائِبًا فَلَا بَأْسَ بِهَا
-‘‘শোক প্রকাশের সময় হচ্ছে মৃত্যুর তিন দিন পর্যন্ত। এরপর শোক প্রকাশ করা মাকরূহ। কিন্তু সমবেদনা জ্ঞাপনকারী বা গ্রহণকারী অনুপস্থিত হলে মাকরূহ নয়।’’
¶ নিযামুদ্দীন বলখী, ফাতওয়ায়ে আলমগীরী, ১/১৬৭ পৃঃ পরিচ্ছেদ: مَسَائِلُ فِي التَّعْزِيَةُ
তৃতীয় দিন পর্যন্ত লোক শোক প্রকাশের জন্য আসতে থাকে। এর পর যেহেতু আর আসবে না, তাই তৃতীয় দিন ঈসালে ছওয়াব করেই বিদায় নেবে। আর দূরের আত্মীয়-স্বজনও ফাতিহায় অংশ গ্রহণ করে এবং তিন দিনের মধ্যে মুসাফিরও ঘরে পৌছঁতে পারে। চেহলাম, বার্ষিকী ইত্যাদি উদ্যাপন তরার কারণ হচ্ছে; মুসলমাদের অভিপ্রায় হলো সারা বছর মৃতব্যক্তির কাছে ধারাবাহিকভাবে ছওয়াব পৌছতে থাকুক। কেননা মৃত্যুর পর প্রথম প্রথম মৃতব্যক্তির বিদেহী আত্মা স্বীয় আত্মীয়-স্বজনের স্বরণে ব্যাকুল থাকে। অতঃপর ক্রমান্বয়ে এদিক থেকে মন উঠে যায়। মেয়েকে বিবাহ দেওয়অর পর শ্বশুর বাড়ীতে পাঠানো হয়। প্রথম প্রথম আসা-যাওয়া এবং উপহার সামগ্রী প্রেরণটা ঠিকমত চালু থাকে। অতঃপর যতই সময় যেতে থাকে, এগুলোও আস্তে আস্তে কমতে থাকে। কেননা প্রথম দিকে ওখানে মন বসে না। এর উৎস হাদীছ শরীফ থেকেও পাওয়া যায়। দাফন করার পর কিছুক্ষণ কবরের পাড়ে দাঁড়িয়ে ঈসালে ছওয়াব করা ও তলকীনের মাধ্যমে মৃতব্যক্তির সাহায্য করা বাঞ্চনীয়। হযরত উমর ইবনে আস (রাঃ) ওসীয়ত করেছিলেন- দাফনের পরে কিছুক্ষণ যেন আপনারা আমার কবরের পার্শ্বে থাকেন, যাতে আপনাদের কারণে আমার মন টিকে যায় এবং মুনকার-নাকীরের প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিতে পারি। যেমন -
মিশকাত শরীফে الدَّفْنَ অধ্যায়ে তাঁর এ আবেদনটি উদ্ধৃত করা হয়েছে-
ثُمَّ أَقِيمُوا حَوْلَ قَبْرِي قَدْرَ مَا يُنْحَرُ جَزُورٌ وَيُقَسَّمُ لَحْمُهَا حَتَّى أَسْتَأْنِسَ بِكُمْ وَأَعْلَمَ مَاذَا أُرَاجِعُ بِهِ رُسُلَ رَبِّي. رَوَاهُ مُسلم
¶ ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, ১/১১২ পৃঃ হা/১২১, খতিব তিবরিযি, মিশকাত, ১/৫৩৭ পৃঃ হা/১৭১৬, পরিচ্ছেদ: بَاب دفن الْمَيِّت
এ জন্যই তাড়াহুড়া করে ঈসালে ছওয়াব করা হয়। শাহ আবদুল আজীজ ছাহেব তাফসীরে আযীযীর আমপারার وَالْقَمَرِ إِذَا اتَّسَقَ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন-
اول حالتے كه بمجرد جدا شدن روح از بدن خواهد شد فى الجمله اثر حيات سابقت والفت تعلق بدن ودگير معروفان از انباء جنس خود باقى است آں وقت گويا برزخ است كه چيزے ازاں طرف چيزے ازيں طرف معدد زندگاں بمردن دريں حالت زود ترمى رسد ومرد گاں منتظر لحوق مدد ازيں طرف مى باشد صدقات واد عيه وفاته ودريں وقت بسياربكار آدمى آيد وازيں است كه طوائف بنى آدم تايك سال وعلى الخصوص يك چله بعد موت دريں نوع امداد گوشش تمام مى نمايند .
-‘‘মৃতব্যক্তির প্রাথমিক অবস্থায় অর্থাৎ শরীর থেকে রূহ বের হওয়ার সময় রূহের মধ্যে পূববর্তী জীবনের কিছুটা প্রভাব এবং আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্কটা কিছুটা রেশ বাকী থাকে। এসময় রূহটা কিছুটা এদিকে কিছুটা ঐদিকে অর্থাৎ দোদুল্যমান অবস্থায় বিরাজ করে। এসময় জীবিতদের সাহায্য মৃতদের কাছে খুব তাড়াতাড়ি পৌছে এবং মৃতব্যক্তিও সাহায্যের অপেক্ষায় থাকে। ওই সময় সাদাকা, দুআ, ফাতিহা, মৃতব্যক্তির খুবই কাজে আসে। এ কারণে সবাই এই বছর পর্যন্ত বিশেষ করে মৃত্যুর পর চল্লিশ দিন পর্যন্ত এধরনের সাহায্য পৌছাঁনোর জন্য যথাসম্ভব চেষ্টা করেন।’’
¶ শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী, তাফসিরে ফতহুল আজিজ, (ফারসী) খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-১১২-১১৩, কাবুল, আফগানিস্তান।
একই অবস্থা জীবিতদেরও হয়ে থাকে। প্রথম প্রথম খুবই শোকাতুর অবস্থায় তাকে। অতঃপর সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে মানসিক বিষন্নতা কমতে থাকে। তাই সারা বছর ব্যাপী সাদাকা পৌছানোর অভিপ্রায় বছরের প্রতি ভগ্নাংশ সাদাকা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। যেমন বছরান্তে বার্ষিকী, এর অর্ধাংশে ষান্মিসিক, এর অর্ধাংশ ত্রৈমাসিক ফাতিহা এবং এর অর্ধাংশে অর্থাৎ পয়ঁতালিশ দিনের ফাতিহা হওয়াটা যর্থাথ ছিল। কিন্তু যেহেতু চল্লিশ সংখ্যাটি আধ্যাত্মিক ও শারীরিক উন্নতির প্রতীক, সেহেতু চল্লিশতম দিনের ফাতিহা অর্থাৎ চেহলাম করার কথা বিবেচিত হয়েছে। অতঃপর এর অর্ধাংশে বিশতম দিনের ফাতিহা এর অর্ধাংশে দশম দিনের ফাতিহা করার কথা বলা হয়েছে।
‘চল্লিশ’ সংখ্যার কি বৈশিষ্ট, তা এখন শুনুন। হযরত আদম (আঃ) এর খামির চল্লিশ বছর পর্যন্ত একই অবস্থায় ছিল। অতঃপর চল্লিশ বছরে এটা শুকিয়ে ছিল। মায়ের পেটে শিশু প্রথম চল্লিশ দিন বীর্য; অতঃপর চল্লিশ দিন জমাট বাঁধা রক্ত, এরপর চল্লিশ দিন মাংসপিন্ড হিসেবে থাকে। (মিশকাত শরীফের الايمان بالقدر অধ্যায়ে দেখুন) জন্ম হওয়ার পর চল্লিশ দিন যাবৎ মায়ের নিফাস (রক্তক্ষরণ) থাকে। চল্লিশ বছর বয়সে জ্ঞান পরিপূর্ণ হয়। এ জন্য অধিকাংশ আম্বিয়অয়ে কিরামের চল্লিশ বছর বয়সে নবুয়াত প্রদান করা হয়েছে। সুফিয়ানে কিরাম ওজীফা সমূহের ক্ষেত্রে চিল্লা অর্থাৎ চল্লিশ দিনের সাধনা করে থাকেন, এতে তাঁদের রূহানী উন্নতী হয়। হযরত মূসা (আঃ) কেও নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, ‘তুর পর্বতে গিয়ে চল্লিশ দিন ইতিকাফ করুন।’ অতঃপর তাওরাত কিতাব প্রদান করা হয়েছিল।
وَإِذْ وَاعَدْنَا مُوسَى أَرْبَعِينَ لَيْلَةً.
-‘‘যখন মূসা (আঃ) চল্লিশ রাত অবস্থান করে ওয়াদা পূর্ণ করলেন।’’
‘আনওয়ারে সাতেয়া’ কিতাবে চেহলাম শীর্ষক আলোচনায় বায়হাকী শরীফের বরাত দিয়ে হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে-
والبيهقي في حياة الأنبياء، عن أنس، أن النبي -صلى الله عليه وسلم، قال: إن الأنبياء لا يتركون في قبورهم أربعين ليلة، ولكن يصلون بين يدي الله تعالى حتى ينفخ في الصور
ইমাম যুরকানী (রাঃ) তাঁর শরহে মুওয়াহেব গ্রন্থে এ হাদিসের অর্থ এভাবে করেছেন
‘‘আম্বিয়ায়ে কিরামের রূহ মুবারকের সম্পর্ক তাদের কবরস্থ শরীরের সাথে চল্লিশ দিন পর্যন্ত খুবই বেশী থাকে। এরপর ওসব রূহ আল্লাহর সান্নিধ্যে ইবাদতে নিয়োজিত হয় এবং শরীরী আকার ধারণ করে যেখানে ইচ্ছা সেখানে ঘুরে বেড়ায়।’’
সাধারণ্যে এ বিশ্বাস রয়েছে যে চল্লিশ দিন পর্যন্ত ঘরের সাথে মৃতব্যক্তির আত্মার সম্পর্ক থাকে। এ ধারণার পিছনে সম্ভবতঃ কোন ভিত্তি রয়েছে। এর থেকে বোঝা যায়, চল্লিশ দিন পর রদবদল ও পরিবর্তন ঘটে। সুতরাং চল্লিশ দিনের দিন ফাতিহা করা বাঞ্চনীয়। এ ব্যাপারে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই।
কুলখানির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের প্রচলন রয়েছে। কাথিয়াওর্য়াড নামক স্থানে প্রায় সময় তৃতীয় দিন কেবল কুরআন খানিই হয়ে থাকে। পাঞ্জাবে সাধারণতঃ তৃতীয় দিন দুধ ও কিছু ফল ফাতিহা দেয়া হয়। ইউ, পি, তে তৃতীয় দিন কুরআন খানিও হয় এবং ভুনা চনায় কালেমা তৈয়্যবা পাঠ করে ঈসালে ছওয়াবও করা হয়। আমি প্রথম অধ্যায়ে মৌলবী কাসেম ছাহেবের উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেছি যে মৃতব্যক্তিকে এক লাখ পাঁচ হাজার বার কালেমা শরীফ পড়ে বখশিশ করলে, এতে সে ব্যক্তির মগফিরাত হয়। এ প্রসংগে বিভিন্ন রেওয়ায়েত পাওয়া যায়। তাই সাড়ে বার সের চনা বুট নির্ধারণ করা হয়েছে। কেননা হিসাব করে দেখা গেছে যে, এ পরিশানে একলাখ হয়ে যায়। এটা কেবল গণনার সুবিধার্থে করা হয়েছে। এ পরিমাণ তাসবীহ বা ফলের আটি বা পাথরের টুকরা সংগ্রহ করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তাই এ ব্যাপারে চনাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এতে কালেমা গণনার কাজও হলো এবং পরে সাদাকাও করা গেল। আর ভুনা চণা এ জন্যই বাছাই করা হলো যে কাঁচা চনা হলে ফেলে দেবে বা গাধা-ঘোড়ার খাদ্যে পরিণত হবে। এতে কালেমার অপমাননা হবে। কিন্তু ভূনা চনাবুট কেবল (লোকের) খাবার হিসেবেই ব্যবহৃত হবে।
ফাতিহা ইত্যাদি হিন্দুদের সাথে সাদৃশ্য রয়েছে। তারাও মৃতদের ত্রয়োদশী কর্ম পালন করে। হাদীস শরীফে আছে-
عَنِ ابْنِ عُمَرَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ.
-‘‘যিনি যে সম্প্রদায়ের সাথে সাদৃশ্য রাখেন তিনি সে সম্প্রদায়ের বলে গণ্য হয়।’’
¶ সুনানে আবি দাউদ, ৪/৪৪ পৃঃ হা/৪০৩১
সুতরাং এ ধরনের ফাতিহা করা নিষেধ।
কাফিরদের সাথে সব সাদৃশ্য নিষেধ নয়, কেবল দুষনীয় বিষয়ে সাদৃশ্য নিষেধ। আবার সেই সাদৃশ্যটা এ রকম হওয়া চাই, যা কাফিরদের ধর্মীয় বা সম্প্রদায়িক চিহ্নে পরিণত হয়েছে এবং যেটা দেখে লোকেরা তাকে কাফির-সম্প্রদায়ের লোক মনে করে। যেমন-ধুতি, টিকি, পৈতা, হ্যাট ইত্যাদি। তা নাহলে আমরা যেমন মক্কা শরীফ থেকে যমযম কূপের পানি আনয়ন করি, হিন্দুরাও তেমনি গংগা থেকে গংগাজল আনয়ন করে। আমরা যেমন মুখ দিয়ে খাই, পায়েল সাহায়ে চলি, কাফিরেরাও তদ্রুপ করে। হুযুর আলাইহিস সালাম আশুরার রোযা রাখার হুকুম দিয়েছিলেন। অথচ তাতে ইহুদীদের সাদৃশ্য ছিল তাই তিনি পুনরায় বললেন, ঠিক আছে, আমরা দু’রোযা রাখবো। এভাবে কিছু পার্থক্য করে দিয়েছিলেন, কিন্তু বন্ধ করে দেননি। অনুরূপ আমাদের ফাতিহায় কালেমা, কুরআন পাঠ করা হয়; মুশরিকদের সেখানেতো এগুলো পাঠ করা হয় না। তাহলে সাদৃশ্য কোথায় রইলো? এর বিস্তারিত বিবরণ ফত্ওয়অয়ে শামীর مكروهات الصلوة শীর্ষক অধ্যায়ে দেখুন। অবশ্য যে কাজটা কাফিরদের সাথে সাদৃশ্য দেখানোর উদ্দেশ্যে করা হয়, সেটা নিষেধ। ফাতিহার পূর্ণ বিবরণ সুপ্রসিদ্ধ কিতাব আনোয়ারে সাতেয়ায় দেখুন।
যদি ফাতিহায় শারীরিক, আর্থিক উভয় ইবাদত পাওয়া যায়, তাহলে কোন নাপাক জিনিস দান করার সময় ফাতিহা পড়ে নিন। যেমন-গোবর ইত্যঅদিতে ফাতিহা পাঠ করে কাউকে দিয়ে দিন। যখন মেথর ঘরের পায়খানা পরিষ্কার করে মল-মূত্র নিয়ে যায়, তখন ফাতিহা দেওয়অর পরই একে ঘর থেকে বের হতে দিবেন। (দেওবন্দী তাহজীব)
নাপাক জিনিসের উপর ও নাপাক জায়গায় তিলাওয়াত কুরআন হারাম। সুতরাং ওসবের দান দক্ষিণার সময় তিলাওয়াত করা যায় না। ঢেকুর আসলে আলহামদুলিল্লাহ বলা হয়। কিন্তু বায়ু ছাড়লে তা বলা হয় না। কেননা এটা নাপাক ও ওযু ভংগকারী। অনুরূপ হাঁচি আসলে আল-হামদুলিল্লাহ বলা হয়, কিন্তু নাক দিয়ে রক্ত বের হলে তা বলা হয় না।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০১২) ফাতিহাখানির প্রমাণাদি প্রসংগে | (০১৪) জানাযার নামাযের পর দুআ প্রসঙ্গে আলোচনা |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |