তাফসীর রূহুল বয়ানে সপ্তম পারায় সূরা আন-আমের আয়াত وَهَذَا كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ مُبَارَكٌ এর ব্যাখ্যা প্রসংগে বর্ণিত আছে -
وَعَنْ حميد بن الأعْرَجِ قَالَ مَنْ قَرَأ الْقُرْآنَ وَخَتَمَهُ ثُمَّ دَعَا أَمَنَّ عَلَى دُعَائِهِ اَرْبَعَةَ آلافِ مَلَكٍ ثُمَّ لَا يَزَالُوْنَ يَدْعَوْنَ لَهُ وَيَسْتَغْفِرُوْنَ وَيَصَلُّوْنَ عَلَيْهِ اِلَى المسَاءِ اوْ اِلَى الصُّبْاحِ
হযরত আরজ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি কুরআন খতম করেন, তাঁর মুনাজাতে চার হাজার ফিরিশ্তা আমীন বলেন এবং সন্ধ্যা বা সকাল পর্যন্ত তার জন্য দুআ ও মাগফিরাত কামনা করতে থাকেন।
¶ ইসমাঈল হাক্কী, তাফসিরে রুহুল বায়ান, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৬৬, দারু ইহ্ইয়াউত-তুরাশুল আরাবী, বয়রুত, লেবানন।
এ বক্তব্যটা ইমাম নববীর ‘কিতাবুল আযকার’ গ্রন্থে তিলওয়াতে কুরআন অধ্যায়েও উলেখিত আছে। এতে প্রতীয়মান হলো যে কুরআন খতমের সময় দুআ কবুল হয় এবং ঈসালে ছওয়াবও দুআ বিশেষ। তাই ওই সময় খতমে কুরআন পড়া উত্তম।
আশ্ আতুল লুমআত গ্রন্থের زيارت القبور অধ্যায়ে আছে-
وتصدق كرده شود از ميت بعد رفتن او از عالم تاهفت روز
‘‘মৃত্যুর পর সাত দিন পর্যণ্ত সাদ্কা করা যাবে।’’
সেই আশ্আতুল লুমআতে একই অধ্যায়ে আরও উলেখিত আছে -
وبعض روايات امد است كه روح ميت مے آيد خانه خودر اشب جمعه پس نظر مى كند كه تد قكنند ازوے يانه
-‘‘জুমআর রাতে মৃত ব্যক্তি স্বীয় ঘরে আগমন করে এবং তার প্রতি লোকেরা সদ্কা করে কিনা তা অবলোকন করে।’’
এর থেকে বোঝা গেল, কতেক জায়গায় মৃত্যুর পর সাত দিন পর্যন্ত নিয়মিত রুটি দান আর সব সময় জুমআর রাতে ফাতিহাখানি করার যে প্রচলন রয়েছে, এর মূল এটাই। আনোয়অরে সাতেয়ার ১৪৫ পৃষ্টায় এবং খজনাতুল রেওয়ায়েতের হাশিয়ায় বর্ণিত আছে যে, হুযুর আলাইহিস সালাম আমীর হামযা (রাঃ) এর তৃতীয়, সপ্তম ও চলিশতম দিনে এবং ষান্মাসিক ও বাৎসরিক সাদ্কা দিয়েছেন। এটাই কুলখানি, ষান্মাসিক ও বার্ষিক ফাতিহার উৎস।
ইমাম নববী ‘কিতাবুল ‘আযকার’ এর تلاوت القران শীর্ষক অধ্যায়ে বলেছেন যে হযরত আনাস ইবনে মালিক কুরআন খতমের সময় নিজ ঘরের সবাইকে একত্রিত করে মুনাজাত করতেন।
হযরত হাকীম ইবনে আতবা বলেন, হযরত মুজাহিদ ও তাঁর গোলাম ইবনে আবিলুবাবা একটি জনগোষ্ঠীকে আহবান করলেন এবং বললেন, আপনাদেরকে এজন্য আহবান করা হয়েছে যে, আজ আমরা কুরআন পাক খতম করতে যাচ্ছি এবং কতমে কুরআনের সময় দুআ কবুল হয়। হযরত মুজাহিদ (রাঃ) থেকে বিশুদ্ধ রেওয়ায়েত মতে বর্ণিত আছে, বুযুর্গানে দ্বীন কুরআন খতমের সময় জনসমাবেশের ব্যবস্থা করতেন এবং বলতেন, এ সময় রহমত নাযিল হয়। (কিতাবুল আযকার দ্রষ্টব্য) সুতরাং কুলখানি ও চেহলাম উপলক্ষে জমায়েত হওয়া পূর্ববর্তী মনীষীদের সুন্নাত।
দুররুল মুখতারে মৃত ব্যক্তির জন্য কুরআন তিলাওয়াত র্শীষক আলোচনার الدفن অধ্যায়ে উলেখিত আছে -
وَفِي الْحَدِيثِ مَنْ قَرَأَ الْإِخْلَاصَ أَحَدَ عَشَرَ مَرَّةً ثُمَّ وَهَبَ أَجْرَهَا لِلْأَمْوَاتِ أُعْطِيَ مِنْ الْأَجْرِ بِعَدَدِ الْأَمْوَاتِ
-হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি এগারবার সূরা ইখলাস পাঠ করে এর ছওয়াব মৃতদের প্রতি বখ্শিশ করে দেয়, এর ছওয়াব সকল মৃতব্যক্তিগণ পাবে।
¶ ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, ২/২৪২-২৪৩ পৃঃ দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।
এ জায়গায় ফত্ওয়ায়ে শামীতে আছে-
وَيَقْرَأُ مِنْ الْقُرْآنِ مَا تَيَسَّرَ لَهُ مِنْ الْفَاتِحَةِ وَأَوَّلِ الْبَقَرَةِ إلَى الْمُفْلِحُونَ وَآيَةِ الْكُرْسِيِّ - وَآمَنَ الرَّسُولُ - وَسُورَةِ يس وَتَبَارَكَ الْمُلْكُ وَسُورَةِ التَّكَاثُرِ وَالْإِخْلَاصِ اثْنَيْ عَشَرَ مَرَّةً أَوْ إحْدَى عَشَرَ أَوْ سَبْعًا أَوْ ثَلَاثًا، ثُمَّ يَقُولُ: اللَّهُمَّ أَوْصِلْ ثَوَابَ مَا قَرَأْنَاهُ إلَى فُلَانٍ أَوْ إلَيْهِمْ
-‘‘যতটুকু সম্ভব কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করবেন। সূরা ফাতিহা, সূরা বাকারার প্রথম কয়েক আয়াত, আয়াতুল কুরসী, আমানার রসূল, সূরা ইয়াসিন, তাবারাকাল মূলক, সূরা তাকাছুর ও সূরা ইখলাস বার বা এগারবার অথবা সাত বা তিনবার পাঠ করবেন। অতঃপর বলবেন-হে আল্লাহ; আমি যা কিছু তিলাওয়াত করলাম, এর ছওয়াব অমুককে বা অমুক লোকদের মাঝে পৌঁছে দিন।’’
¶ ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, ২/২৪৩ পৃঃ দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।
উপরোক্ত ইবারতে প্রচলিত ফাতিহাখানির পূর্ণ নিয়মটা বলা হয়েছে। অর্থাৎ কুরআনের বিভিন্ন অংশ থেকে পাঠ করা; অতঃপর ঈসালে ছওয়াবের উদ্দেশ্যে দুআ করা। দুআ করার সময় হাত উঠানো সুন্নাত। তাই হাত উঠাবেন। মোট কথা, প্রচলিত ফাতিহাখানি পূর্ণরূপে প্রমাণিত হলো।
ফতওয়ায়ে আযীযীয়ার ৭৫ পৃষ্টায় বর্ণিত আছে
طعاميكه ثواب آں نياز حضرت امامين نمايند براں قل وفاتحه ودرود خواندن متبرك مى شود وخوردن بسيار خوب است
-‘‘যে খাদ্যদ্রব্য হযরত হাসান-হুসাইন (রাঃ) এর নামে উৎসর্গ করার নিয়ত করা হয় তাতে সূরা ইখলাস, সূরা ফাতিহা ও দরূদ শরীফ পড়া মুবারক এবং ওটা খাওয়া খুবই ভাল।’’
একই ফাত্ওয়ার ৪১ পৃষ্ঠায় আছে -
اگر ماليده وشير برائے فاتحه بزرگے بقصد ايصال ثوب بروح ايشاں پخته بخور اند جائز است مضائقه نيست
-‘‘যদি কোন বুযুর্গের ফাতিহার জন্য ঈষাে ছওয়াবের নিয়তে দুগ্ধজাত কোন কিছু তৈরী করে পরিবেশন করা হয়, তা জায়েয এবং এতে কোন ক্ষতি নেই।’’
বিরোধিতাকারীদেরও মান্যবর হযরত শাহ ওলীউল্লাহ ছাহেবেরও কুলখানি হয়েছিল। যেমন- হযরত আবদুল আযীয ছাহেব স্বীয় মলফুজাতের ৮০ পৃষ্টায় বর্ননা এভাবে দিয়েছেন -
روز سوم كثرت هجوم مردوم آں قدر بود كه بيروں از حساب است هشتا دويك كلام الله به شمار آمده وزيادهم شده باشد وكلمه را حضر نيست
-‘‘তৃতীয় দিন জনগণের এত সমাগম হয়েছিল, যা গণনার বাইরে ছিল। একাশিবার খতমে কুরআন হিসেব করা হয়েছিল কিন্তু বাস্তবে এর থেকে আরও বেশী হতে পারে। আর কালেমা তৈয়্যবারতো কোন হিসেব নেই।’’
এ থেকে শাহ ছাহেবের কুলখানি হওয়া ও এ উপলক্ষে খতমে কুরআন করাটা প্রমাণিত হলো। দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম ছাহেব রচিত ‘তাহযিরুন নাস’ গ্রন্থের ২৪ পৃষ্ঠায় উলেখ করেছেন জুনাইদের কোন এক মুরীদের চেহারা হঠাৎ পরিবর্তন হয়েগিয়েছিল। তিনি (জুনাইদ বাগদাদী (রহঃ) এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে মুরীদ বলল, আমি কশফের সাহায্যে আমার মাকে দোযখে দেখতেছি। হযরত জুনাইদ (রহঃ) একলাখ পঞ্চাশ হাজার বার কালেমা পাঠ করেছিলেন এ আশায় যে কতেক রেওয়ায়েতে এ পরিমাণ কালেমা পড়ার ছওয়াবে মাগফিরাত লাভের কথা বর্ণিত আছে। তিনি সাথে সাথে এর ছওয়াবে ওর মাকে বখ্শিশ করে দেন কিন্তু ওকে কিছু জানাননি। বখ্শিশ করার সাথে সাথে তিনি সেই জওয়ানটাকে আনন্দ উৎফুল্ল দেখেছিলেন। এর কারণ জিজ্ঞেস করলে সে আরয করল, আমার মাকে বেহেশতে দেখছি। তিনি এর পরিপ্রেক্ষিতে বললেন, সে জওয়ানটির কশফ-শক্তির অধিকারী হওয়াটাতো হাদীস থেকে আমার জানা ছিল এবং হাদীছের সত্যতা ওর কাশফ থেকে প্রমাণিত হয়ে গেল। এ ইবারত থেকে বোঝা গেল, একলাখ পঞ্চাশ হাজার বার কালেমা পাঠ করে মৃতব্যক্তির আত্মার প্রতি বকশিশ করে দিলে, এর দ্বারা নাজাত পাবার সম্ভাবনা আছে এবং কুলখানির সময় চনাবুটের সাধ্যমে তা-ই পাঠ করা হয়।
এসব ভাষ্য থেকে ফাতিহা, কুলখানি ইত্যাদি প্রচলিত নিয়ম বৈধ প্রতিভাব হলো। উপরোক্ত ভাষ্য থেকে ফাতিহা শরীফ পাঁচ আয়াত পাঠ করা, অতঃপর ঈসালে ছওয়াবের জন্য হাত তুলে মুনাজাত করা, কুলখানির দিন কুরআন তিলওয়াত, কালেমা শরীফের খতম, খাবার তৈরি করে কাংগালী ভোজের ব্যবস্থা করা সবই বোঝা গেল। কেবল খানা সামনে রেখে হাত তুলে মুনাজাত করার প্রসংগটা বাকী রইল। এর নানাবিধ প্রচলন রয়েছে। কাথিয়াওয়ার্ড নামক স্থানে খানা তৈরী করে প্রথমে গরীবদেরকে খাওয়ানো হয়। এরপর ঈসালে ছওয়াব করা হয়। ইউ, পি, পাঞ্জাব ও আরবে খাবার সামনে রেখে প্রথমে ঈসালে ছওয়াব করা হয় এবং পরে খাবার পরিবেশন করা হয়। উভয় রকম প্রচলন বৈধ এবং হাদীছ দ্বারা প্রমাণিথ। মিশকাত শরীফেও অনেক রেওয়ায়েত মওজুদ আছে যে, হুযুর আলাইহিস সালাম খাবার গ্রহণ করার পর ছাহেবে মেজবানের চন্য দুআ করেছেন বরং নির্দেম দিয়েছেন, দাওয়াত খাওয়ার পর ছাহেবে মেজবানের চন্য দুআ করুন।
মিশকাত শরীফের كتاب الْأَطْعِمَة শীর্ষক অ্যধায়ে বর্ণিত আছে যে, হুযুর আলাইহিস সালাম খাওয়া-দাওয়া শেষে ইরশাদ ফরমাতেন -
الْحَمْدُ لِلَّهِ حَمْدًا كَثِيرًا، طَيِّبًا مُبَارَكًا، غَيْرَ مَكْفِيٍّ، وَلَا مُوَدَّعٍ، وَلَا مُسْتَغْنًى عَنْهُ رَبَّنَا
-‘‘আল্লাহর অনেক পবিত্র মুবারক শুকর, হে খোদা, এতে অফরন্ত, অসীম ও অতৃপ্ত বরকত দিন।’’
¶ ইমাম ইবনে মাযাহ, আস-সুনান, ২/১০৯২পৃঃ হা/৩২৮৪, ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, খণ্ড-৭, পৃষ্ঠা-৮২, হাদিস/৫৪৫৮, ইমাম তিরমিযি, আস-সুনান, ৫/৫০৭ পৃঃ হা/৩৪৫৬, খতিব তিবরিযি, মিশকাত, ২/১২১৫ পৃঃ হা/৪১৯৯, সুনানে আবি দাউদ, হা/৩৮৪৯
এর থেকে বোঝা গেল, খাওয়ার পর পালনীয় দু’টি সুন্নাত রয়েছে-খোদার প্রশংসা করা ও ছাহেবে মেজবানের জন্য দুআ করা। ফাতিহা শরীফে এ দুঃটি বিষয় মওজুত রয়েছে। আশা করি, বিরোধিতাকারীরাও এটা অস্বীকার করতে পারবে না। এখন বলতে হয়য় খাবার সামনে রেখে দুআ করা প্রসংগে। এ প্রসংগে অনেক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।
মিশকাত শরীফের المعجزات অ্যধায়ের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে বর্ণিত আছে হযরত আবু হুরাইরা (رضي الله عنه) ফরমান-আমি কিছু খোরমা হুযুর আলাইহিস সালাম-এর সমীপে পেশ করলাম এবং এর বরকতের জন্য দুআ করতে আরয করলাম।
فَضَمَّهُنَّ ثُمَّ دَعَا لِي فِيهِنَّ بِالبَرَكَةِ
-‘‘তখন তিনি (ﷺ) এগুলোকে একত্রিত করলেন ও বরকতের জন্য দুআ করলেন।’’
¶ ইমাম তিরমিযি, আস-সুনান, ৫/৬৮৫ পৃঃ হা/৩৮৩৯, ইমাম তিরমিযি এ হাদিসটিকে হাসান বলেছেন, খতিব তিবরিযি, মিশকাত, মু’জিজাত আধ্যায়, ৩/১৬৬৮ পৃঃ হাদিস/৫৯৩৩
সেই মিশকাত শরীফের المعجزات অ্যধায়ের প্রথম পরিচ্ছেদে বর্ণিত আছে যে, তাবুক যুদ্ধে ইসলামী সেনা বাহিনীর খাদ্য ঘাটতি দেখা দিল। হুযুর আলাইহিস সালাম সকল সৈনিককে নির্দেশ দিলেন-‘যার কাছে যা আছে, তা নিয়ে এসো’। সবাই কিছু না কিছূ আনলেন। দস্তরখানা বিছিয়ে দেওয়া হলো এবং এর উপর এগুলো রাখা হলো-
فَدَعَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَيْهِ بِالْبَرَكَةِ، ثُمَّ قَالَ: خُذُوا فِي أَوْعِيَتِكُمْ
"অতঃপর হুযুর আলাইহিস সালাম এসবের বরকতের জন্য দুআ করলেন এবং ইরশাদ ফরমালেন আপনারা এখাণ থেকে নিয়ে নিজ নিজ প্লেটে রাখুন।’’
¶ ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, ১/৫৬ পৃঃ হা/২৭, পরিচ্ছেদ: بَابُ مَنْ لَقِي اللهَ بِالْإِيمَانِ وَهُو غَيْرُ شَاكٍّ فِيهِ دَخَلَ الْجَنَّةَ وَحُرِّمَ عَلَى النَّارِ , খতিব তিবরিযি, মিশকাত, মু’জিজাত আধ্যায়, ৩/১৬৬০ পৃঃ হাদিস/৫৯১২
একই মিশকাত শরীফের একই অধ্যায়ে বর্ণিত আছে- হুযুর আলাইহিস সালাম হযরত যয়নব (রাঃ) কে বিবাহ করা উপলক্ষে হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) ওলিমা হিসেবে যৎসামান্য খাবার তৈরী করলেন। কিন্তু অনেক লোককে দাওয়াত দেয়া হয়েছিল।
فَرَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَضَعَ يَدَهُ عَلَى تِلْكَ الْحَيْسَةِ وَتَكَلَّمَ بِمَا شَاءَ اللَّهُ
-‘‘হুযুর আলাইহিস সালাম ওই খাবারের উপর হস্ত মুবারক রেখে কিছু পাঠ করলেন।’’
¶ খতিব তিবরিযি, মিশকাত, মু’জিজাত আধ্যায়, ৩/১৬৬০ পৃঃ , হা/৫৯১৩, ইমাম তিরমিযি, আস-সুনান, ৫/৩৫৭ পৃঃ হা/৩২১৮, ইমাম তিরমিযি (رحمة الله) বলেন- هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ -‘‘এই হাদিসটি হাসান, সহীহ।
একই মিশকাত শরীফের একই অধ্যায়ের আর এক জায়গায় বর্ণিত আছে, হযরত জাবির (রাঃ) খন্দকের যুদ্দের দিন যৎসামান্য খাবার তৈরী করে হুযুর আলাইহিস সালামকে দাওয়াত দিলেন। হুযুর আলাইহিস সালাম তাঁর ঘরে যখন তাশরীফ আনলেন তখন তাঁর সামনে ময়দার তৈরী খাবার পেশ করা হলো। তিনি (ﷺ) এতে পবিত্র থুথু ফেললেন এবং বরকতের জন্য দুআ করলেন। এরকম আরো অনেক রেওয়ায়েত পেশ করা যায়। কিন্তু এতটুকুই যথেষ্ট বলে মনে করি।
আল্লাহর শুকর, ফাতিহাখানির আনুষংগিক যাবতীয় বিষয় সমূহ সুষ্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়ে গেল। বিবেকও বলে যে ফাতিহাখানিতে কোন ক্ষতি নেই। কেননা, যেমন আমি ভূমিকায় আরয করেছি, ফাতিহা হচ্ছে দু’টি ইবাদতের- তিলওয়াতে কুরআন ও সদ্কার সমষ্টি। এ দুটি কাজ যদি পৃথক পৃথক ভাবে করলে জায়েয হয, তাহলে একত্রিত করলে হারাম হবে কেন? বিরিয়ানি খাওয়াটা কোথাও প্রমাণিত নেই, অথচ তা হালাল। কেননা বিরিয়ানি হচ্ছে চাউল, মাংস, ঘি ইত্যাদির সংমিশ্রণে তৈরী। তাই এর সমস্ত আইটেম যেহেতু হালাল, সেহেতু বিরিয়ানিও হালাল। অবশ্য সুনির্দিষ্ট যেসব ক্ষেত্রে কয়েকটি হালাল বিষয়কে একত্রিত করাটা হারাম বলা হয়েছে, সেটা হারাম। যেমন সহোদর দুবোনকে একসাথে বিবাহ করা বা কয়েকটি হালাল বস্তু একত্রিত করার ফলে কোন হারাম জিনিস সৃষ্টি হলে যেমন মাদকদ্রব্য তা হারাম। তাহলে বোঝা গেল যে, উলেখিত কারণে হালাল বস্তুর একত্রিকরণ হারাম হবে। কিন্তু ফাতিহা উপলক্ষে কুরআন তিলাওয়াত ও সদ্কার একত্রিকরণ শরীয়ত কর্তৃক হারাম করা হয়নি। আর এর ফলে কোন হারাম জিনিসও সৃষ্টি হলো না। তবুও কাজটা কেন হারাম হবে?
দেখুন, একটি ছাগল মারা যাচ্ছে, যদি এমনি মারা যায়, তাহলে হারাম আর যদি আল্লাহর নামে যবেহ করে দেয়া হয়, তাহলে হালাল হয়ে গেল। কুরআন করীম মুসলমানদের জন্য রহমত ও শেফা স্বরূপ। যদি এর তিলওয়াতের কারণে খাবার হারাম হয়ে যায়, তাহলে কুরআন রহমত হলো কিভাবে? এটাতো অভিশাপ (নাউযুবিল্লাহ)। তবে হ্যাঁ এটা মোমিনদের জন্য রহমত আর কাফিরদের জন্য অভিশাপ।
وَلَا يَزِيدُ الظَّالِمِينَ إِلَّا خَسَارًا
-‘‘এর থেকে জালিমগণ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তিলওয়াত করার কারণে ওরা খাবার থেকে বঞ্চিত হলো।’’
¶ সূরা বানী ইসরাঈল, আয়াত নং-৮২
যেটার জন্য দুআ করা হয়, ওটা সামনে রেখেই করা চাই। মৃত ব্যক্তিকে সামনে রেখে জানাযার নামায আদায় করা হয়। কেননা, এর জন্যই দ্আু করা হয়। অনরূপ খাবার সামনে রেখে দুআ করলে, এতে কি ক্ষতি রয়েছে? কবর যিয়ারতের সময়ও কবরকে সামনে রেখে দুআ করা হয়।
হুযুর আলাইহিস সালাম স্বীয় উম্মতের পক্ষে কুরবানী দিয়ে যবেহকৃত জানোয়ারকে সামনে রেখে বলতেন -
اللهم هَذَا منْ اُمَّة مُحَمَّد
-‘‘হে আল্লাহ, এটা আমার উম্মতের পক্ষ থেকে কুরবানী দেয়া হলো।’’
¶ ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৩০, মাকতাবায়ে এমদাদিয়া, মুলতান।
হযরত খলিলুল্লাহ (আঃ) কাবা ঘরকে সামনে রেখে দুআ رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا করেছিলেন। এখনও আকীকার পশুকে সামনে রেখে দুআ পাঠ করা হয়। সুতরাং ফাতিহাখানিতে খাবার সামনে রেখে যদি ঈসালে ছওয়াব করা হয়, তাতে ক্ষতি কি?
বিসমিল্লাহ্ বলে খাবার শুরু করা হয় এবং বিসমিল্লাহ্ হচ্ছে কুরআন শরীফের আয়াত। যদি খাবার সামনে রেখে কুরআন শরীফ পাঠ করা নিষেধ হয়, তাহলে বিসমিল্লাহ্ পড়াটাও নিষেধ হওয়া চাই।
বিরোধিতাকারী যাকে মুরুব্বী বলে স্বীকার করেন, তিনিও প্রচলিত ফাতিহাকে জায়েয মনে করেন। যেমন শাহ ওলীউল্লাহ ছাহেব الانتباه فى سلاسل اولياء الله নামক স্বীয় কিতাবে বর্ণনা করেছন-
پس ده مرتبه درود خوانند ختم تمام كنند وبر قدرے شير نى فاتحه بنام خوا جان چشت عموما بخواند وحاجت از خدا سوال نمايند
-‘‘অতঃপর দশবার দরূদ শরীফ পাঠ করবেন এবং সম্পূর্ণ কুরআন খতম করবেন। তারপর কিছু র্শিনীতে সমস্ত আওলিয়া কিরামের নামে ফাতিহা দিবেন ও খোদার কাছে দুআ করেন।’’
শাহ ওলীউল্লাহ ছাহেব زبدة النصائح নামক কিতাবের ১৩২ পৃষ্টায় একটি প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন -
طوشير بربخ بنابر فاتحه بزرگے بقصد ايصال ثواب بروح ايشاں چزند وبخور ند مضائقه نيست واگر فاتحه بنام بزركے داده شود اغنارا هم خوردن جائز است
-‘‘ঈসালে ছওয়াবের নিয়তে দুধ ও চাউলের উপর কোন নেককার বান্দার নামে ফাতিহা দিলে, রান্না করতে পারেন ও খেতে পারেন এবং যদি কোন বুযুর্গের নামে ফাতেহা দেয়া হয়, তা সচ্ছল ব্যক্তিদেরও খাওয়া জায়েয।’’
মৌলভী আশরাফ আলী ও রশীদ আহমদ ছাহেবের মুর্শিদ হাজী ইমদাদুল্লাহ ছাহেব, ফয়সালায়ে হাপ্ত মাসায়েলা নামক পুস্তিকায় লিখেছেন -
-“মৃত ব্যক্তিদের রূহের প্রতি ঈসালে ছওয়াবের বেলায় কারো আপত্তি নেই, তবে যদি এক্ষেত্রে বিশেষ কোন সময় বা কাল নির্ধারণ করাটা ছওয়াব মনে করা হয় বা ওয়াজিব বা ফরয করা হয়, তাহলে নিষেধ। কিন্তু যদি এ ধরনের কোন ধারণা না থাকে, কেবল বিশেষ কোন উদ্দেশ্যে অনুরূপ করা হয়, তাতে কোন ক্ষতি নেই। যেমন কোন যুক্তি সংগত কারণে নামাযে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অধিকাংশ মাশায়েখ এ নীতিরই অনুসারী।”
তিনি আরও বলেন, নামাযের জন্য মনে মনে নিয়ত করাটা যথেষ্ট। কিন্তু মুখ ও অন্তরের সামঞ্জস্যতার জন্য সাধারণ লোকদের ক্ষেত্রে টুখে বলাটা উত্তম। এক্ষেত্রেও যদি মুখে বলেন, হে আল্লাহ, এর ছওয়াব অমুককে পৌঁছে দিন। তাতে কল্যান রয়েছে। এর পর কারো এ ধারণা হলো যে (ফাতিহার জন্য তৈরী) খাবারটা সামনে রাখলে মনের আবেগটা বৃদ্ধি পাবে। তাই খাবারটা সামনে রাখলেন। আবার কেউ মনে করলেন, যে এটা এক প্রকারের দুআ বিশেষ। তাই এর সাথে যদি কিছু কালামে পাক পড়া হয়, তাহলে দুআ কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশী এবকং সাথে সাথে কালামে পাক পড়ার ছওয়াবও পৌঁছবে। এত দুটি ইবাদতের সংমিশ্রণ হলো। তিনি আরও বলেন, গাউছে পাকের গিয়ারভী শরীফ, দশভী, বিশভী, চেহলাম, ষান্শাসিক, বাৎসরিক ফাতিহা ইত্যাদি এবং শেখ আবদুল হক (রহঃ) এর তোশা (সদ্কা বিশেষ) হযরত শাহ বু-আলী কালন্দরের বাৎসরিক ফাতিহা, শবে বরাতের হালুয়া-রুটি এবং ঈসালে ছাহেবের অন্যান্য পদ্ধতি উপরোক্ত নিয়মনীতির ভিত্তিতে প্রচলিত আছে।”
পীর ছাহেবের এ বক্তব্যে পরিপূর্ণ সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ! আকলী ও নকলী দলীলসমূহ এবং বিরোধিতাকারীদের উক্তিসমূ থেকে ফাতিহার মাসআলাটা সুষ্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়ে গেল। আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে হক কবুল করার শক্তি দান করুন। আমিন।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০১১) ফাতিহা, কুলখানী, চেহলাম ইত্যাদির বর্ণনা | (০১৩) ফাতিহা সম্পর্কে আপত্তি এবং এর জবাবসমূহ |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |